#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৫. (অন্তিম পর্ব-শেষ)
–’ডিউক! আপনাকে ভিষণ হ্যান্ডসাম লাগছে। কিন্তু এই রাতের বেলা সানগ্লাস পড়ার থিওরিটা ঠিক বুঝলাম না। একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?’
বর্তমানে ইচ্ছের সাথে ডিউকের বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ডিউক যদিও সম্পর্কটাকে বন্ধুত্ব থেকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু ইচ্ছের এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ না দেখানোতে সে আর কিছু বলার সাহস পায়না। তবুও সে সর্বদা ইচ্ছের সামনে নিজেকে পরিপাটি হিসেবে তুলে ধরতে পছন্দ করে। চেষ্টা করে ইচ্ছের একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করার। কিন্তু আবেগের বশে এমন বোকামি করে ফেলবে সেটা বুঝতে পারেনি। ইচ্ছের কথায় সে ভিষণ লজ্জা পেল। কিন্তু তাও পরিবেশ স্বাভাবিক করতে সে হেসে বলল,
–’আরে না না আমি এটা নতুন কিনেছি তাই তোমাকে দেখাচ্ছিলাম। কেমন মানিয়েছে আমায়?’
–’নতুন?’
–’হ্যাঁ। আজ-ই কিনলাম।’
–’কিন্তু আমিতো এর আগে বহুবার এই গ্লাসটা আপনায় পড়তে দেখেছি।’
–’না দেখোনি। মানে দেখেছো বাট এটানা। আসলে এই মডেলটা আমার অনেক পছন্দতো তাই বারবার এই মডেলটাই কিনি।’
–’ওহহ আচ্ছা! তাহলেতো দোকানদার আপনায় ঠকিয়েছে। চলুন ঐ দোকানে। বেটাকে ধরে আচ্ছা ধোলাই দিতে হবে।’
–’আরে! এই! কেন কেন?’
–’কারণ সে আপনায় ঠকিয়ে একটা পুরোনো গ্লাস দিয়েছে। ইসস কত ইনোসেন্ট আপনি!’
ডিউক বুঝতে পারছেনা এখন তার কি করা উচিত। এভাবে ফাসাবে ইচ্ছে তাকে সেটা সে বুঝতে পারেনি। এই মেয়ে যদি সত্যিই শপে যায় তাহলে সম্মানের কানা কড়িও টিকে থাকবে না। সব ধুয়ে মুছে সমুদ্রে ভেসে যাবে। ডিউক কিছু ভেবে না পেয়ে কল আসার বিহানা দেখিয়ে দ্রুত বেকারি থেকে বের হয়ে যায়। ডিউক চলে যেতেই ইচ্ছে দম ফাটানো হাসিতে মেতে ওঠে। সে ইচ্ছে করেই ডিউককে এমন অস্বস্তিতে ফেলেছে যাতে সে দ্রুত চলে যায়। খুব বেশিই বাচাল লোকটা। কিন্তু সহজ-সরল মাইন্ডের। ইচ্ছে জানে ডিউক তার উপর দুর্বল। হয়তো ভালোওবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসার উপর যে তির আস্থা নেই। সে আনমনেই বলে,
–’এক সমুদ্র সমান ভালোবাসা পেয়েছি আমি। উপোভোগ করেছি কাছ থেকে। পরিমাপ করেছি তার গভীরতা। বিলিন করেছি নিজেকে। আবার নিজ চোখেই সেই ভালোবাসার বিনাশ হতে দেখেছি। সবকিছু হারিয়ে গেল। রেখে গেলো কেবল কিছু তিক্ত স্মৃতি। যা আমাকে রোজ কাঁদায়। এমন ভালোবাসা আমি আর পেতে চাইনা। আমি মুক্ত পাখির ন্যায় বাঁচতে চাই। কোনো মায়ার বাহুডোরে আর আটকাবো না নিজেকে।’
____________
ইচ্ছে ইহানের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে আজ দুবছর হয়ে গেলো। দুবছর পরও তাদের রুমটা সেই আগের মতোই আছে যেমনটা ইচ্ছে রেখে গিয়েছিলো। এ রুমটাতে কারো ঢোকার পারমিশন নেই। এখানে মাঝে মাঝে ইহান এসে সময় কাটায়। ইচ্ছের রেখে যাওয়া স্মৃতি গুলোতে বিচরণ করে। কোথাও একটা শান্তি খুঁজে পায় সে। এই জনমানব পূর্ণ শহরে সে রোবটের মতো ছুটে চলে। যখন এ সকল থেকে দূরে এসে এই রুমটিতে ঢোকে তখন সকল ক্লান্তি নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। দেয়ালে টাঙ্গানো ইচ্ছের ছবিটাতে সে কখনো ধুলা জমতে দেয়না। খুব যতনে সে ছবিটাকে আগলে রাখে। ছোট্ট ইরফান যখন খুব কাদে তখন ইচ্ছের এই ছবিটা দিয়েই তার কান্না থামাতে হয়। ইচ্ছের ছবিটা দেখলেই বাচ্চাটা আদো আদো কন্ঠে মা বলে ডাকে। ভারী সুন্দর লাগে তখন। ইচ্ছেও কি খুশি হতো এটা দেখলে?
ইহান একজন সিঙ্গেল ফাদার। রুশা মারা গেছে মাস বারো আগে। শেষ মুহূর্তে এসে মেয়েটা খুব অনুতপ্ত হয়েছিল। মৃত্যুর সময় এলে বোধহয় সবাই সবার ভুল বুঝতে পারে। রুশা মারা যাওয়ার পর থেকে ইরফানকে ইহান একা হাতে সামলাচ্ছে। ইচ্ছে চলে যাওয়ার পরথেকে ইহান নিজেকে ঘরবন্ধী করে নিয়েছিলো। পাগল পাগল বিহেব করতে শুরু করেছিলো। কোনো ভাবেই যখন তাকে বোঝানো যাচ্ছিলো না তখন ইরফানের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন করেন নাজমুল সাহেব। এটাও জানতে চান সে এই ছোট বাচ্চাটার জীবনটাও নষ্ট করতে চায় কিনা। এ কথাটা ওষুধের মতো কাজ করেছিল। এতগুলো জীবন তোস সে নষ্ট করলো। এবার নাহয় একটা জীবন গড়ে দিলো! এরপর আবার আগের গতিতে কাজ শুরু করে। একজন বেষ্ট বাবা হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায়।
বর্তমানে ইহান ইচ্ছের হাস্যজ্জল মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ছবিটা যেন একদম জীবন্ত। তার দিকেই হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। কি মায়াবী সে মুখ, সে মুখের হাসি। ইচ্ছের ছবিটা দেখতে দেখতেই ইহান বলল,
–’তুমি আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো ইচ্ছে। যাকে উজ্জ্বলতায় মানায়। যাকে খোলা আকাশে জ্বলতে দেখতে সবাই পছন্দ করে। তোমার এই উজ্জ্বলতা মলিন না হোক কখনো। ইমার আকাশের মেঘ তোমায় গ্রাস করে নিয়েছিলো। অন্ধকারে টেনে নিয়েছিলো তোমায়। তুমি সে মেঘের বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছো। আমি তাতে কষ্ট পেলেও অভিমান করিনি। আর না কোনো অভিযোগ। তোমার সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস আমার নেই। তাই আমি তোমায় খুজবোনা। শুধু বলবো যেখানেই থাকো ভালো থেকো। আর আমায় কখনো ক্ষমা করোনা। যেটার যোগ্য আমি নই সেটা আমায় কখনোই দিয়ো না।’
ইহান কাঁদে নিঃশব্দে। তার এই কান্নার শব্দ কারো কানে পৌছায় না। কেবল এই চার দেয়াল তার কান্নার সাক্ষী হয়। হঠাৎ ছবির পেছনে গুজে রাখা পেপারটা নিচে পড়ে যায়। ইহান আলগোছে হাতে তুলে নেয় পেপারটি। পেপারটি খুলতেই উপরের লেখা দেখে বোঝা যায় এটা তাদের ডিভোর্সের পেপার। পেপারটির এক কোনে ইচ্ছের নাম জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু ইহানের সাইন নেই সেখানে। এই পেপারে সাইন করার মতো এতটা সাহস তার নেই যে!
_______________
ওয়াশিংটন এর রিফলেকটিং পুলের সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে তার নিজের প্রতিবিম্বকে দেখছে। সেখানে সে নিজেকে নয় বরং নিজের অতীতকে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। মানুষ সুন্দর সময়, সুন্দর মুহূর্ত গুলোকে ভুলতে পারলেও জীবনের কালো অধ্যায়গুলো থেকে কখনোই চিরতরে মুক্ত হতে পারেনা। এগুলো আজীবন তাড়া করে বেড়ায়। ইচ্ছে এসব ভাবছিলো ঠিক তখনি পাশ থেকে ডিউক বলে উঠলো,
–’তোমার কি মনে হয় তুমি সারাটা জীবন একা কাটিয়ে দিতে পারবে?’
ইচ্ছে আলতো হাসে। হাসি মুখেই বলে,’ নিজেকে নিয়ে এতটুকু গ্যারান্টি আপনাকে দিতেই পারি। ভরসা করি আমি নিজেকে।’
ইচ্ছের কথায় ডিউক তাচ্ছিল্য হাসলো। আজ তার হৃদয় ভেঙেছে। অনেক আলা নিয়ে সে ইচ্ছেকে মনের কথা জানিয়েছিল। ভরসা ছিল ইচ্ছে তাকে নিরাশ করবে না। কিন্তু তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল করে দিয়ে ইচ্ছে তাকে না করে দিল।
–’একটা মেয়ের জীবনে একা চলা কতটা কষ্টের তুমি জানো? আজ বলছো একা থাকবে কিন্তু দুদিন বাদেই তোমার একজন পার্টনার এর প্রয়োজন ফিল হবে। তবে সে পার্টনার আমি কেন নই?’
–’একজন মেয়েকে আপনি যতটা দুর্বল ভাবছেন ততটা দুর্বল ও কিন্তু নই। আমরা মেয়েরা মায়ের জাত। আর মায়ের থেকে সমর্থবান এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আমি ঠিক নিজেকে গুছিয়ে নিবো।’
_______________
লাল রঙের একটা শাড়ি তমার হাতে তুলে দিয়ে তার মা রেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে বারবার বলে গেছেন দশ মিনিটের মাঝেই যেন তমা শাড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নেয়। তমা মায়ের যাওয়ার দিকে হতিশ চোখে তাকিয়ে থাকে। এতটা কঠোর তার মা কিভাবে হতে পারে? তার মা কেন বুঝতে পারছে না এই বিয়েটা সে করতে চায়না। যেই মানুষটিকে সে পাগলের মতো ভালোবাসে তার ছোট ভাইয়ের সাথেই কিনা তার বিয়ে! সে কিভাবে এ বিয়ে করতে পারে? তমা দ্রুত তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। একটা কাগজে তার মাকে উদ্দেশ্য করে ছোট একটা চিঠি লিখে বেডের উপর রাখা লাল শাড়ির ভাঁজে রেখে দেয়। ফেলে রাখা পুরোনো জামাকাপর খুঁজে তার মায়ের একটা বোরকা পেলে সেটা গায়ে জড়িয়ে চুপিসারে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে তমা। হাতে তার জমানো অল্প কিছু টাকাও নিয়ে নেয়। জীবনে এটার প্রয়োজন ভিষণ। বাড়িতে অনেক মানুষ থাকায় তাকে কেউ সেভাবে খেয়াল করলো না। মেইন রোডে পৌঁছাতেই এতক্ষণ চেপে রখখখ শ্বাস ছাড়লো সে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে সে একটা বাসে উঠে বসলো। এতবড় প্রথিবীতে তার থাকার মতো একটা কোণ ঠিক পেয়ে যাবে সে।
_______________
কেটেছে সময় পেরিয়েছে বছর। ইচ্ছে বাংলাদেশে ফিরেছে ছমাস হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ফিরেই সে সকলের খোঁজ নিয়েছে। দূর থেকে ইহানকেও দেখে এসেছে সে। ইহান তাকে ছাড়া বেশ আছে। এতে ইচ্ছের খারাপ লাগেনা। এটা সে অনেক আগেই মেনে নিয়েছিল। কেবল নিজ চোখে দেখার বাকি ছিল মানুষটা কেমন আছে। ইরার বিয়ে হয়ে গেছে। সে বেশ সুখেই আছে। নাজমুল সাহেব বয়সের ভারে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ইচ্ছের খুব মন চায় তার সাথে একবার দেখা করতে কিন্তু অতীতকে সে আর সামনে আনতে চায়না। তির থেকে যেভাবে চলছে সেভাবেই নাহয় চলতে থাকুক।
ইচ্ছে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চপদে চাকরি করছে। পাশাপাশি সে ছোট একটা গার্মেন্টস ওপেন করেছে অসহায় মেয়েদের কাজের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। বর্তমানে তার এই গার্মেন্টসে পয়ত্রিশ জন মেয়ে কাজ করে। তার বিশ্বাস একসময় তার এই সংখ্যা বেড়ে পাঁচশততে দাড়াবে।
______________
–’এবার ছুটিতে কোথায় যাওয়ার প্লান আছে?’
এই প্রশ্নে ইচ্ছে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,’ স্কাই ডাইভিং করলে কেমন হয়? পাখির মতো আকাশে উড়বো। ইশশ ভাবতেই নিজেকে পাখির মতো মনে হচ্ছে।’
তমা হাসে। ইচ্ছের এতো আগ্রহ দেখে সে মানা করতে পারেনা। যদিও সে উচ্চতায় অনেক ভয় পায়। তবুও সে ইচ্ছেকে বলে সে ব্যবস্থা করে ফেলবে। তমা আবারো ভাবে ইচ্ছে তার জন্য ঠিক কতটা লাকি। ইচ্ছে না থাকলে আজ হয়তো তাকে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হতো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেদিন সে ঢাকায় চলে এসেছিলো। ভেবেছিলো এতবড় শহরে একটা কাজের ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ভাবনার মতো বাস্তবতা সহজ ছিলোনা। অবশেষে এক বাড়িতে ঝি এর কাজ নেয়। মাস খানেক পর একদিন বাজারে এক দোকানদারের সাথে তার ভিষণ তর্কাতর্কি লেগে যায়। সেদিন ইচ্ছেও বাজারে গিয়েছিলো সবজি কিনতে। তর্কাতর্কির মাঝেই ইচ্ছের সাথে তার দেখা হয়। ইচ্ছে তাকে দেখে অনেকটাই অবাক হয়েছিলো। কারণ তার পোশাক চলাফেরা পুরোটাই অন্যরকম ছিলো। সেদিন থেকেই সে ইচ্ছের সাথেই আছে। বর্তমানে সেই ইচ্ছের গার্মেন্টস দেখাশোনা করে। তাদের দুজনের জীবনের গতি একই। তারা দুজন-ই আছে দুজনের জন্য। বেশ আছে তারা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করা। মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যহীন ভাবে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে খোলা আকাশের নিচে হাতে হাত রেখে ঠান্ডা বাতাস উপোভোগ করা। কখনোবা ছোট্ট চায়ের দোকান থেকে মাটির কাপে চা খেতে খেতে আকাশের তারা গোনার প্রতিযোগিতা করা। ছুটি পেলেই সমুদ্র, বন কিংবা পাহাড়ে চড়ে বেরানো। এইতো বেশ আছে তারা তাদের জীবনে। কে বলেছে পুরুষ ছাড়া নারী জীবন বৃথা?
সমাপ্ত