#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি
৬.
দু ঘন্টা যাবত মেহেদী হাতে বসে থেকে হাত যেন অসার হয়ে এসেছে। পড়নে কলাপাতা রঙের শাড়িটা বেশ আঁটসাট । শাড়িটা বেশ সুন্দর হলেও ইচ্ছের মোটেই পছন্দ হচ্ছেনা। ইহান নিজে পছন্দ করে কিনেছে শাড়িটা জানার পর থেকেই তার অস্বস্তি শুরু হয়েছে। ইহানকে যে তার পছন্দ না তেমন না। আসলে সে তো ইহানের ব্যক্তিত্বটাকে ভয় পায়। কেমন গম্ভীর! অমন সুদর্শন মানুষটার এমন পেঁচা মুখ কখনো মানায়?
ইচ্ছের সামনে মেকআপ এর সরঞ্জাম এর ছড়াছড়ি। গোটা একটা দোকান তুলে আনা হয়েছে যেন। তমা আর তিশা ব্যস্ত হাতে ইচ্ছেকে রেডি করছে। নিচ থেকে ততক্ষণে ডাক এসেগেছে। নদী একপাশে বসে মাংসের হাড় চিবুচ্ছে আর বোনের সাজ দেখছে। বোনের সাজ শেষ হলেই সে সাজবে আবার।
ড্রয়িংরুমটা গোলাপ আর রজনীগন্ধা ফুলের কম্বিনেশনে সাজানো হয়েছে। ফুলের সুবাসে মৌ মৌ করছে চারপাশ। ইচ্ছেকে সোফায় বসানো হলো। ইহান এখোনো ফেরেনি মসজিদ থেকে। চারপাশ থেকে চাপা হাসির শব্দ ভেসে আসছে। সবাই এটা ওটা বলে মজা লুটছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই শোরগোল শোনা গেল। বর এসেছে! বুক কেঁপে উঠলো। অশান্ত হলো মোন। এতক্ষণ জমিয়ে রাখার সাহসে যেন ভাটা পড়ল। মস্তিষ্ক তীব্র সংকেত দিল একজন গম্ভীর পেঁচা মুখো লোক তার জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে। সে চাইলেও আর কখনো এ জাল থেকে মুক্তি পাবেনা। এ পরিবার, বাবা বোন মা সকলকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই ছুটে পালাতে মোন চাইলো।
ইহান এসে ইচ্ছের বরাবর সোফায় বসলো। ইহান তাকালো বধূ বেশে বসে থাকা ইচ্ছের পানে। ঘোমটার আড়ালে থাকা ইচ্ছের মুখটা দৃষ্টিগোচর হলো না। তমা ব্যাপারটা লক্ষ্য করে হাত বাড়ালো ইচ্ছের দিকে। ঘোমটা তুলে দিল। দৃশ্যমান হলো গোলাপের পাপড়ির ন্যায় সুন্দর মুখশ্রী। চোখাচোখি হলো দুজনের। ইচ্ছে থমকে তাকালো যেন। এই প্রথম সে নিখুঁত ভাবে ইহানের মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করলো। সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত ইহানকে তার দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ হিসেবে মনে হলো। পাঞ্জাবির বুকের দিকের দুটো বাটন খোলা। হাতা দুটো ফোল্ড করে কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা। বাহাতে সিলভার রঙের হাত ঘড়ি। সব মিলিয়ে অতি সুদর্শন এক যুবক সে। মুগ্ধতা খেলা করলো ইচ্ছের চোখেমুখে। ইহান যেন বুঝতে পারলো প্রেয়শীর মনোভাব। ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা দিল তার অধর যুগলে। ইচ্ছের মুগ্ধতার রেশ বাড়লো। লজ্জা ভুলে একভাবে চেয়ে রইল হৃদয়কাড়া হাসির অধিকারীর দিকে।
কবুল বলার সময়ও ইচ্ছের ধ্যান ধারণা সবটা ইহানের দিকেই ছিল। খুব অকপটেই তিনবার উচ্চারণ করে নিয়েছিল কবুল। তার এমন কাজে পাশ থেকে হাসির বন্যা বয়ে গেল। চকিত হয়ে নজর সরালো ইহানের থেকে। একরাশ লজ্জা এসে জায়গা করে নিল তার চোখ মুখে। কি ভয়ানক লজ্জার সম্মুখীনই না তাকে হতে হলো!
______________
সে রাতে ক্লান্ত ইচ্ছে ইহানের অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়লো। ইহান যখন রুমে আসলো তখন তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নিষ্পলক চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ তার ঘুমন্ত পরীর দিকে। পড়নে তার বিয়ের ভারী শাড়ি। ইহান চোখ মুখ কুঁচকালো। মেয়েটা ফ্রেশ হয়নি কেন? অগত্যা সে ইচ্ছেকে ডেকে তুললো। বারকয়েক ডাকার পর চোখ মেলে তাকালো ইচ্ছে। মুখের সামনে ইহানকে ঝুঁকে থাকতে দেখে তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো। ইহান সরে দাঁড়ালো। হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল,” ঝটপট ফ্রেশ হয়ে আসো।”
ইচ্ছের ঘুমের রেশ তখনো পুরোপুরি ভাবে কাটেনি। সময় নিয়ে ইহানের কথা বুঝলো। বেড থেকে নেমে ঢুলতে ঢুলতে ওয়াসরুমে ঢুকলো। মিনিট দশেক সময় নিয়ে বের হয়ে এলো। ঢোলাঢালা প্লাজো গেঞ্জি পরিহিত ইচ্ছেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকালো ইহান। রুমে যে সে বাদে ইহান ও উপস্থিত এ কথাটা বেমালুম ভুলে বসেছে ইচ্ছে। ততক্ষণে ইচ্ছে আবারও ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে।
ইহান অকপটে চেয়ে থাকে এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে থাকা ইচ্ছেকে। অধর কোণে হাসি ঝুলিয়ে ভাবে মেয়েটা যদি জেগে থাকতো তবে কি লজ্জাটাই না পেত! এইযে তার গেঞ্জিটা উপরে উঠে যাওয়ায় মেদহীন সাদা কোমর দৃশ্যমান হয়ে আছে আর সেদিকেই খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার অর্ধাঙ্গ। ইচ্ছে এই মুহূর্তে জেগে উঠলে কি খুব বেশি লজ্জা পাবে? তার সুন্দর মুখশ্রীতে লাল আভা ছড়াবে? ইহান আর কিছু ভাবতে পারে না। তার পূর্বেই কর্ণকুহরে তরাঙ্গিত হয় মোবাইলের বিকট শব্দ। ফোনটা পাশেই ছিল। স্ক্রিনে মাহিন নামটা জ্বল জ্বল করছে। সময় নিয়ে রিসিভ করলো সে। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে উচ্ছাসিত মাহিনের কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
“দোস্ত! সব কিছু রঙিন লাগছে না? হাডুডু, ক্রিকেট সবকিছু ডান?”
ইহান নিঃশব্দে হাসলো। ও এমন কিছুই প্রত্যাশা করেছিল। ফোনের ওপাশ থেকে মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সবগুলো তবে একসাথে জোট পাকিয়েছে। ইহান হাসতে হাসতেই বলল,” সে সুযোগ আর পেলাম কই? খেলায় নামার আগেই তো লাল কার্ড ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ শোনা গেল। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখলো সে। ধীর পিয়ে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। একপলক তাকালো ইচ্ছের দিকে। ডিম লাইটের আলোয় ঘুমন্ত প্রেয়সীর মুখ জুড়ে আদুরে আভা ছড়িয়েছে। ইহান আলতো হাতে ছুঁয়ে দিল লালাভ গাল। সামান্য নড়ে উঠে আবারো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল মানবী। এদিকে এক প্রেমিক পুরুষ তার এই ঘুমন্ত মুখ দেখে নিদ্রিহীন রাত যাপন করছে সে খেয়াল কি তার আছে?
_____________
চোখের পলকে কেটে গেল কিছু সুন্দর মুহূর্ত। ইচ্ছের কেমন জানি আজকাল ইহানের পাশে থাকতে বেশ লাগে। তার প্রথম দেখা ইহান যেন মুহূর্তেই বদলে গেছে। এই ইহান খুব যত্নবান। কি কোমল তার ব্যাবহার। তার করা প্রত্যেকটা কাজ মুদ্ধতায় ঘেরা। মানুষটা পুরোটাই কেমন অদ্ভূত মুগ্ধতায় ঘেরা।
বিয়ের দুদিনের মাথায় ইচ্ছে বাবার বাড়ি ছেড়ে নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। চিরচেনা মানুষ বাড়ি রাস্তা গ্রাম ছেড়ে এক অচেনা শহরের পথে পা বাড়ালো। চিরচেনা বাড়িটি যেন চিৎকার করে তাকে ডেকে উঠলো। মানা করলো তাকে ছেড়ে যেতে। মোশতাক মোড়ল মেয়েকে বুকে নিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন।
নিস্তব্ধ রাত্রি। রাতের নিস্তব্ধতা পেরিয়ে শা শা শব্দে হাইওয়ের পথ ধরে ছুটে চলছে গাড়ি। এ গাড়িতে ইহান আর ইচ্ছে বাদে অন্য কেউ নেই। নাজমুল সাহেব, শারমিন বেগম আর ইরা অন্য গাড়িতে করে যাচ্ছেন। তাদের গাড়িটা কিছুটা এগিয়ে গেছে। ইহান রাস্তা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বিমর্ষচিত্তে ইচ্ছের দিকে তাকালো। বাইরে থেকে আশা সোডিয়াম বাতির আলোয় জ্বল জ্বল করে উঠলো ঘুমন্ত ইচ্ছের মুখশ্রী। ইহান গাড়ি স্লো করলো। একহাতে ইচ্ছের মাথাটা ঘুরিয়ে নিজের কাঁধে রাখলো। ব্যাক সিট থেকে পাতলা কম্বল নিয়ে জড়িয়ে দিল প্রেয়সীর গায়ে। ওম পেয়ে ইচ্ছে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে আঁকড়ে ধরলো ইহানের বাহু। একটা সুনিশ্চিত জায়গা পেয়ে আরো গভীর হলো তার ঘুম।
কিঞ্চিৎ প্রহর পরেই আঁধার কাটিয়ে আলোর দেখা মিলল। অগ্নিপিন্ডের ন্যায় পূব আকাশে সূর্যের আগমন ঘটলো। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে প্রকৃতি হলো চঞ্চল। পাখিদের কলকলানিতে গুঞ্জিত হলো চারদিক। গাড়ি এসে থামলো দোতলা বিশিষ্ট একটি ডুপ্লেক্স ভবনের সামনে। ইচ্ছে ততক্ষণে উঠে গেছে। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে বেশ অবাক হলো বৈকি। এ বাড়িতে সে হারিয়ে গেলে খুঁজে পেতে পাক্কা একটা ঘন্টা সময় ব্যায় করতে হবে শিওর।
চলবে………