আমার গল্পে আমি খলনায়িকা পর্ব -১৪

#আমার_গল্পে_আমি_খলনায়িকা
পর্ব—১৪
আমি নিজেকে সংযত করতে না পেরে প্রত্যয়ের দিকে ছুটে গেলাম।

—-প্রত্যয় কি হয়েছে তোমার,তোমার এই অবস্থা কিকরে হলো,বলো।

প্রত্যয় আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না,শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।রোদেলা ম্যানেজারকে উদ্দেশ্য করে বললো-

—ইনি এখানে কতোদিন ধরে আছেন?আর এর এই অবস্থা কেনো?

—আসলে উনি একটু অসুস্থ!

—অসুস্থ তো হাসপাতালে থাকার কথা,এখানে কেনো?

হোটেল ম্যানেজার কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

—কি হলো চুপ করে আছেন কেনো,দেখুন এই যে ভদ্রমহিলাকে দেখতে পারছেন উনি প্রত্যয়ের স্ত্রী।আপনাদের তো সমস্ত এভিডেন্স দেখিয়েছি।যদি এরপরেও বিশ্বাস না হয় বাকিটা পুলিশ বলবে।

পুলিশের কথা শুনে হোটেল ম্যানেজার ঘাবড়ে যায়।

—এর ভেতরে আবার পুলিশ কেনো,আপনারা কি আমায় পুলিশের ভয় দেখাচ্ছেন?

—একটা অসুস্থ লোককে কেউ এখানে জিম্মি করে রেখেছে,আর আপনাকে তাকে কো অপারেট করছেন এর একটা শাস্তি তো প্রাপ্য।যদি একবার পুলিশকে ইনফর্ম করি আপনাদের হোটেল চালানো তো ঘুচে যাবেই,যার কথায় এসব করছেন সেও কিন্তু বাঁচাতে আসবে না আপনাদের।

—তো আমরা এখন কি করতে পারি আপনিই বলুন ম‌্যাডাম।তারপরেও প্লিজ এসব আইন আদালতের ভয় দেখাবেন না।বরবাদ হয়ে যাবো।

—আপনাদের তেমন কিছু করতে হবে না,শুধু আমাদের কাজটা করতে দিন।ব্যস,তাতেই হবে।

—কীরকম কাজ?

—আমরা প্রত্যয়কে আজকেই এই হোটেল থেকে বের করে নিয়ে যাবো।আপনারা বাঁধা দিতে পারবেন না আমায়।

—ঠিক আছে,তাই হবে।আপনারা যেরকম চাইবেন তাই হবে।

—আমার কথা এখনো শেষ হয়নি,আগে শেষ করতে দিন।আমরা তো একে নিয়ে যাবো এখান থেকে কিন্তু এর লোক ভুলেও যেনো কিছু জানতে না পারে।তাকে অন্য কিছু বুঝিয়ে দেবেন।

—এতো আরো বড়ো ঝামেলায় ফেঁসে গেলাম,আপনারা ওনাকে লিগ্যালি নিয়ে যাচ্ছেন ঠিক আছে।কিন্তু আমরা স্যারকে মিথ্যে কিকরে বলবো বলুন।উনি ছেড়ে দেবেন আমায়।না আমরা মিথ্যে বলতে পারবো না।

রোদেলা নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা টাকার বান্ডেল বের করে ম্যানেজারের হাতে দিলো।তারপর বলতে লাগলো।

—আশা করি এটা পেলে মিথ্যে বলতে অসুবিধে হবে না,টাকা পেলে মাথার বুদ্ধিটাও খুলবে অযুহাত রেডি করার জন্য।

এরপর আমি আর রোদেলা মিলে প্রত্যয়কে ঐ হোটেল থেকে বের করে আনলাম।তারপর আবার ট্যাক্সিতে উঠি।যাবার পথে আমি রোদেলাকে জিজ্ঞেস করি।

—-রোদেলা,তুমি প্রত্যযের খোঁজ পেলে কিকরে তো বললে না এখনো?

—কাল রাতে প্রত্যুষ(ফেইক প্রত্যয়ের আসল নাম প্রত্যুষ,হোটেল ম্যানেজারের থেকে জেনেছি আমরা)আমার রুম থেকে বেরিয়ে আসার পরে বিছানার ওপরে একটা ভাঁজ করা কাগজ দেখতে পাই।কাগজটা খুলে দেখলাম ওটা শুধু কাগজ নয় একটা ওষুধের প্রেসক্রিপশন।যেখানে প্রত্যয়ের নাম লেখা ছিলো সাথে ইঞ্জুরির অনেকগুলো ওষুধ।প্রত্যুষ যেহেতু সুস্থ স্বাভাবিক ওর ওষুধ বা প্রেসক্রিপশনের দরকার পড়বে না,তার মানে এটা অন্য কারোর জন্য আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম।প্রত্যয়ের নামটা দেখে কোথাও মনে হয়েছিলো ওর অস্তিত্ব বোধহয় এখনো আছে পৃথিবীতে।যদিও তখন আমি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না।

—আচ্ছা,সেসব না হয় বুঝলাম।কিন্তু তুমি এই জায়গাটার কথা জানলে কীকরে?

—প্রতুষ্যের মোবাইল ফোনে আগেই এই অ্যাড্রেসটা দেখেছিলাম,কিন্তু তখন কিছুই বুঝতে পারিনি আমি।ওকে জিজ্ঞেস করাতে আমায় এড়িয়ে যায়।কালকের ঘটনার পরে কোথায় এই দুটো ব্যপারের ভেতরের কানেক্ট করতে পারছিলাম।আর দেখো তাই হলো।

প্রত্যয় প্রথমবারের মতো ওর মুখ খুললো।এখনো বেশ ভয় পেয়ে আছে ও।

—-আমি কোথায় যাচ্ছি,তোমরা আমাকে এটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?

—প্রত্যয় দেখো আমি,আমি দোয়েল….তুমি চিনতে পারছো না আমায়?আর এটা রোদেলা,তোমার বন্ধু।তুমি কি কাউকেই চিনতে পারছো না?

—ছেড়ে দিন দোয়েল আপু,বেচারাকে টর্চার করে শেষ করে দিয়েছে।সেই কারণে কিছুই মনে করতে পারছে না ও।

—আমার মনে হয় একটু চেষ্টা করলেই সম্ভব হবে।ও আর কাউকে না হোক আমাকে না চিনে থাকতে পারে না।

—প্রত্যয় দেখো এই যে আমি রোদেলা,কতোটা সময় একসাথে কাটিয়েছি আমরা।আর ইনি তোমার ভাবী,কল্লোল ভাইয়ার বৌ।

রোদেলা যাই বলুক না কেনো আমি নিজেকে কিছুতেই প্রত্যয়ের ভাবী হিসেবে মানতে রাজি নই।এই কথাটা শুনতেও অস্বস্তি ফিল হয় আমার।কিন্তু রোদেলার সামনে সহ্য করে যেতে হচ্ছে।প্রত্যয়ের সাথে আমার কোনোদিন বিয়েই হয়নি এটা তো ঠিক,সেইদিক থেকে ওর ওপর আমার কোনো অধিকার নেই।কিন্তু আমি যে বরাবর ওকেই চেয়েছি,ওর প্রতি আমার দূর্বলতা কিছুতেই রোদেলার সামনে প্রকাশ করতে পারবো না।তাই বাধ্য হয়ে সবটা সহ্য করে যাচ্ছি।

প্রত্যয় আমাদের দুজনের সাথে আরো কিছুক্ষণ থাকার কারণে অনেকটাই ইজি হতে শুরু করে।আসলে ও নিজে এতোদিন একদিন ঘোরের ভেতরে ছিলো,বহুদিন পরে হঠাৎ নিজের পরিচিতদের দেখে বুঝে উঠতে একটু সময় লাগছে।কাঁপা কাঁপা গলায় প্রত্যয় রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।

—রোদেলা…..রোদেলা তুমি….এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি?

প্রত্যয়ের মুখে রোদেলা নিজের নাম শুনে আনন্দে আটখানা।গদগদ কন্ঠে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

—হোয়াট এ মীরাক্কেল!দোয়েল আপু দেখুন,প্রত্যয় আমাকে চিনতে পেরেছে।আমি জানতাম ও আমাকে চিনতে পারবেই,কারণ শুধু বন্ধু ছিলো না ও আমার,আমার ভালোবাসা ছিলো প্রত্যয়।ভালোবাসা নিজের ভালোবাসাকে ভুলে থাকতে পারে না আমি জানতাম।

রোদেলার মুখে ভালোবাসার কথা শুনে মনে হলো আমার কানে কেউ গরম সিসা ঠেলে দিচ্ছে।ওর কথাগুলো কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না আমি।ইচ্ছে করছে ওর গালে সপাটে একটা চড় মেরে বলি।

—চুপ থাকো।প্রত্যয় শুধু আমার।আমি তোমার মুখে ওর নাম সহ্য করতে পারছি না।

কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে ফেঁসে আছি কিছুতেই নিজের মনের কথা মুখ পর্যন্ত আনতে পারছি না।রোদেলাকে আমি একটু বিদ্রুপ করেই বললাম।

—কি যে বলো না।ও শুধু তোমায় কেনো চিনবে,আমি কি দোষ করেছি।যখন মনে করতে পেরেছে আমাদের দুজনকেই পেরেছে।প্রত্যয় দেখো,আমার দিকে তাকাও।আমি দোয়েল,

—দোয়েল,দোয়েল কে?হ্যাঁ,আগে কোথাও একটা দেখেছি আপনাকে মনে হয়,কোথায় দেখেছি বলতে পারেন?

—প্রত্যয় উনি তোমার ভাবী,কল্লোল ভাইয়ার কথা মনে আছে তো।তোমার ভাই,উনি তার স্ত্রী।তোমার ভাবী….

—এই তুমি বারবার ভাবী বলে বলে কী প্রমাণ করতে চাইছো,খবরদার এই ডাকটা আমি শুনতে চাই না।শুনতে চাই না,মানে শুনতে চাই না‌।কক্ষনো বলবে না প্রত্যয়ের সামনে।

কেনো জানি আমি একটু এগ্রেসিভ হয়ে উঠলাম রোদেলার ওপর।ও নিজেও অবাক হয়ে গেলো আমার অদ্ভুত ব্যবহার দেখে।

—দোয়েল আপু,কি হলো আপনার,আপনি ঠিক আছেন তো?

—না আসলে প্রত্যয় আমার নাম ধরেই ডাকতো,ও ভাবী ডাকটা ঠিক পছন্দ করতো না।তাই আমি চাই না ওর কোনো অপছন্দের বিষয় নিয়ে আলোচনা হোক।

—ও আচ্ছা,আগে বলবেন তো।ওকে ও কিন্তু এখনো পুরোপুরি চিনতে পারছে না আপনাকে।আমার মনে হয় খুব শীঘ্রই সবটা মনে পড়বে ওর।

–হ্যাঁ,তাই যেনো হয়।কিন্তু এখন আমরা ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছি,সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

—আমাদের প্রত্যয়কে একটা নিরাপদ জায়গায় রাখতে হবে,যাতে প্রত্যুষ কিছুতেই ওর নাগাল না পায়।এমন পরিস্থিতি আপনি চাইলেও ওকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারছেন না।ভাবুন একবার যদি প্রত্যুষ জানতে পারে তাহলে কী হবে?

—সেটা আমিও ভেবেছি।তাহলে কি তোমার কাছে রাখবে?

—না,সেটা কিকরে হতে পারে।প্রত্যুষ যেকেনো সময় চলে আসতে পারে আমার বাসায়,তখন সবটা ভেস্তে যাবে।আমরা বরং চলুন ওকে অন্য একটা জায়গায় নিয়ে যাই।যেখানে ও সেফ থাকবে।

অবশেষে প্রত্যয়কে একটা নিরাপদ জায়গায় রাখা হলো,প্রত্যুষের বদনজর থেকে অনেক দূরে।রোদেলা প্রত্যুষের কাছে থেকে গেলেও আমাকে চলে আসতে হলো।প্রত্যুষ যদি জানতে পারে আজকেও বাইরে বেরিয়েছিলাম আর অনেকটা সময় কাটিয়ে এসেছি তাহলে সন্দেহ করবে।তাই যতোদ্রুত সম্ভব আমি বাড়িতে চলে আসলাম।প্রত্যয়ের কাছে কিছুতেই রোদেলাকে একা ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিলো না আমার,প্রত্যয় এমনিতেই পুরোপুরি সুস্থ হয়নি।না জানি রোদেলা একান্তে কি কি করে বেড়াবে ওর সাথে।যদি কোনো অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন হয় দুজনের ভেতর বা এমন কিছু যা ওদেরকে আরো কাছাকাছি আনতে সাহায‌্য করে কীকরে সহ্য করবো আমি!এই দুঃশ্চিন্তাই শেষ করে দিচ্ছে আমায়।

যাই হোক বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে অনেকটা সময় কেটে গেলো।প্রত্যুষকে ফাঁকি দিয়ে সবটা সম্ভব হয়েছে এই অনেক।ড্রয়িংরুম পেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকেই চমকে উঠলাম আমি।দেখতে পাই প্রত্যুষ বিছানার ওপর হেলান দিয়ে বসে আছে।ওর হাতে একটা নিউজপেপার,সেটাই মনোযোগ দিয়ে পড়ছে!

চলবে……

কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here