আমার শহরে রংধনু উঠেনা পর্ব ৩

#আমার_শহরে_রংধনু_উঠেনা
Part–3
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

নভেম্বরের শুরু কেবল। ঢাকা শহরে হালকা শীতের আমেজ কেবল মজে উঠেছে। তবে গ্রামের দিকে নভেম্বরের আগে থেকেই রাত করে কুয়াশায় সমস্ত গ্রাম ছেয়ে যায়। ঢাকা শহরে শীত দেরিতে আসে। এদিকে এখনো ফ্যান চালানো হচ্ছে। বর্ষা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকা শহরের ব্যস্ত সড়ক দেখছে সে।ফারাজদের বাসা একদম মেইন রোডের সঙ্গে লাগানো। বাসা থেকে বের হলেই মেইন রোড। বনানীর মেইন রোড গুলোও নিরিবিলি হয়। সাইসাই করে গাড়ি ছুটে যায়। রিকশার চেয়ে দামী দামী প্রাইভেট গাড়ির পরিমাণ বেশি। প্রতিটা বাঙ্গালীরই ঢাকা শহরটা নিয়ে তুমুল আগ্রহ আর উত্তেজনা থাকে। বর্ষাও ব্যতিক্রম নয়। ঢাকা শহরে এসে ঘুরার ইচ্ছা ছিল তার। ছোটবেলায় একবার বাবার সঙ্গে তিনদিনের জন্য ঢাকায় এসেছিল। তখন চিড়িয়াখানা আর ঢাকা ভার্সিটির সামনটা ঘুরে ফিরে গিয়েছিল নিজ গ্রামে। তখন মনে হচ্ছিল তারা যদি ঢাকায় থাকত তাহলে কতো মজা হতো। কিন্তু ঠিক এই মূহুর্তে এই সমগ্র ঢাকা শহরের উপর তার বিতৃষ্ণা জেগে গেছে। বিষাক্ত লাগছে শহরটাকে। এতো সুন্দর নিরিবিলি বাসাটাকেও অসহ্য লাগছে তার। তার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। ঠিক তখনি পরপর দুইবার ডোরবেল বেজে উঠল। কলিং বেলের আওয়াজে সে চকিত দৃষ্টিতে সদর দরজার দিকে তাকালো। সকাল থেকে প্রচন্ড পেট ব্যথা ছিল। দুপুরে সে মেডিসিন নিয়ে ঘুম দিয়েছিল। কিছুক্ষন আগে জাগনা পেয়েছে। ফারাজ বাসায় না থাকলে তার সময় খুব একটা মন্দ কাটে না।

বর্ষা বড় বড় পা ফেলে দরজার দিকে এগুলো এবং দরজা খুলে দিলো। দরজার ওপাশে খুব দামী একটা সালোয়ার কামিজ পড়া মাঝ বয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে হাসি হাসি মুখ করে।তার সঙ্গে দশ-বারো বছর বয়সের একটা ফুটফুটে মেয়ে চিপস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। গেইট খোলা মাত্র পারফিউমের সুভাসে জায়গাটা ভরে উঠে। বর্ষার কাছে গন্ধটা দারুণ লাগলো। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করলো কোন ব্র‍্যান্ডের পারফিউম। খুব হার্ড স্মেলটা।

মহিলা বলে উঠে, কি ব্যাপার আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি?

বর্ষা বিপাকে পড়ে গেল। মহিলাটাকে সে চেনে না। আদৌ এ বাসায় এসেছে কিনা কে জানে?

তখনই বুনুর মা এসে বলে, ও আপামনি আপনি আসছেন! ফারাজ স্যার তো বলেনি আপনি আসবেন।

মহিলা বর্ষাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে বলে, ফারু কে তো জানাইনি আসব। ও বলবে কোথ থেকে? বিয়ে করে ব্যাটার কোন খোঁজ-খবর নাই। বৌ নিয়ে ব্যস্ত খুব বোধহয়। ফোন দিলাম ধরেনি।

কথা শেষ করে মহিলা বর্ষার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, তোমাকে দেখে কোন এঙ্গেলেই নতুন বউ মনে হচ্ছে না। ভাগ্যিস ফারু আগেই তোমার ছবি আমাকে দেখিয়েছে নাহলে তো চিনতামই না। জানো এই মূহুর্তে তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে বর্ষা?

বর্ষা ভারী ইতস্ততবোধ করতে লাগে। মহিলাটি তার নামও জানে? সে জবাবে চুপ করে থাকে। মহিলা নিজ থেকে বলে উঠে, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কালকেই তোমার বাবু হইছে। ডেলিভারির পর কাহিল দশা। এই অবস্থা কেন তোমার?

বর্ষা কিছু না বলে সামান্য ভদ্রতাসূচক হাসলো। উনি বলে উঠে, আমি ফারুর খালাত বোন। ওর বড় বোনের মতোই আমি৷ আমাকে তুমি শিলা আপু বলে ডাকবে। ঠিক আছে?

— আচ্ছা।

এরপর সঙ্গে থাকা বাচ্চাটাকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, আর ও হচ্ছে তোমার ভাগ্নি। তারপর ছোট মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে, মামীকে সালাম দাও।

বাচ্চাটা মায়ের আদেশ পালন করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সালাম দিল। বর্ষাও সালামের জবাব দিলো।

শিলা নামক মহিলাটা ড্রয়িংরুমে বসে বলে, বিয়ের প্রথম কিছুদিন সেজেগুজে থাকতে হয়। তোমাদের বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারিনি। ইনায়ার আব্বুর জরুরি মিটিং পড়ে গিয়েছিল। নাহলে নিশ্চয়ই এটেন্ট করতাম।

বর্ষা নিরব রইল। সে জানে এতো বড়লোক ঘরের মহিলা কোনদিন গ্রামে যেত না বিয়ে এটেন্ট করতে। এসব সান্ত্বনামূলক কথা-বার্তা৷ এবং অযুহাতটাও খুবই কমন। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। বর্ষার খুব কান্না পাচ্ছে। এই নম্র ভাষী মহিলার পাশে নিজেকে বেমানান লাগছে। ওনার কথা বলার স্টাইলটাও চমৎকার। স্পষ্ট বাংলা৷ কোথাও শব্দ বাধা পায় না৷ শুনতে ভালো লাগে।

শিলা বেশ ব্যতিব্যস্ততা দেখিয়ে নিজের সঙ্গে আনা প্যাকেট খুলতে লাগে। এবং নিজ থেকেই গল্প জুড়ে দেওয়ার উসিলায় বলে, তোমার বাসার সবাই ভালো আছেন?

— জি।

— তুমি কি আনইজি ফিল করছো?

বর্ষা এই প্রশ্নের উত্তরে নিরব থাকে৷ শিলা একটা নীল রঙের শাড়ি বের করে বলে, দেখো তো শাড়িটা কেমন?

কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হয় বিধায় সে বললো, সুন্দর।

— যাও শাড়িটা পড়ে আসো৷

সে শিলার কথায় বেশ বিষ্মিত হলো। শিলা আপা বলে উঠে, কি হলো শাড়ি পড়তে জানো না? না পারলে ব্লাউজ পড়ে থাকো।বাকিটা ফারু এসে পড়িয়ে দিবে–বলে হোহো করে হেসে উঠলো।

শিলা আপুর মুখ থেকে অশ্লীল কথা শুনে গা রিরি করে উঠে। সে দৃঢ়তার সঙ্গে বলে — আমি শাড়ি পড়তে জানি।

— গুড। তাহলে পড়ে ফেলো।

— এখন শাড়ি পড়তে ইচ্ছা করছে না।

–আচ্ছা ঠিক আছে। ইচ্ছা না থাকলে পড়বে না।চল আমরা রান্না-বান্না করি। রান্না করতে ইচ্ছা করছে?

বর্ষা মাথা ঝাকালো যার অর্থ হ্যাঁ।

★★★

ফারাজ যখন ঘরে ঢুকে তখন আটটা বাজে। আজকে এক কারণবশত আগেই বাসায় ফিরেছে। বাসার ডোরবেল বাজাতেই গেইট খোলা অবস্থায় পেল। অথচ সে বুনুর মাকে বলে গেছে যেন কেউ আসলে গেইট না খুলে। অথচ বুনুর মা গেইট খুলে রেখে বসে আছে। কেউ আসলে ভেতরে আসতে না দেওয়ার কারণ হলো বর্ষা। ব্যাংক কিংবা আব্বা যেইখান থেকে উইলটা তৈরি করেছে সেখান থেকে লোক যদি বর্ষার খোঁজে আসে এইজন্য কাউকে বাসার ভেতরে আসতে মানা করে দিয়েছিল। বাসায় ঢুকতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। শিলা আপু ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে আছে।বাসায় ঢোকামাত্র তার নাকে সুস্বাদু খাবারের গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। খাবারের গন্ধ নাকে এসে বাজতেই পেট জানান দিল সে ক্ষুধার্ত। দুপুরে ফুফুর বাসায় খায় নি সে। ফলে ক্ষুধা লাগাটা নরমাল। সেই সাথে এতো চমৎকার খাবারের গন্ধে হিউম্যান সাইকোলজি অনুযায়ী যে কারো ক্ষুধা লেগে যাবে৷

শিলা আপু তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠে, কিরে? তোর তো খবরই নাই? কই গিয়েছিলি?

— ফুফুর সঙ্গে কাজ ছিল। সেখানেই ছিলাম। কখন আসলে?

— আসছি অনেক আগে। হাত ধুয়ে খেতে বসে যা। বিরিয়ানি গরমই আছে।খেয়ে আরাম পাবি। ইনায়ার সঙ্গে খেয়ে নে।

ফারাজ বড় বোনের কথামতো হাত ধুয়ে খেতে বসে গেল। শিলা আপু যত্ন নিয়ে খাবার প্লেটে বেড়ে দিল। ফারাজ খেতে খেতে ইনায়ার সঙ্গে হালকা কথা-বার্তা চালালো এবং বেশ সর্তকতার সঙ্গে চোখ বুলিয়ে বর্ষাকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু চোখজোড়া কাংখিত ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে অক্ষম৷ মনে হাজারো চিন্তা উঁকি দিতে লাগলো। কোথায় মেয়েটা? আপুর সঙ্গে কি দেখা হয়েছে তার? তাদের মধ্যে কথোপকথন কেমন ছিল? আপুকে কি মেয়েটা সব বলে দিয়েছে?

তার সমস্ত চিন্তায় পানি ঢেলে শিলা বলে উঠে, রান্না কেমন হয়েছে?

ফারাজ খেতে খেতে বলে, অনেক মজা হয়েছে। অনেকদিন পর এতো সুস্বাদু খাবার খেলাম। আমেজিং ফুড। এই টেস্ট ফাইভ স্টার হোটেলেও পাওয়া যায় না।

— আরেকটু নিবি?

— দাও।

প্রায় পনেরো মিনিট পর ফারাজ তৃপ্তি সহকারে খেয়ে বলে উঠে, আপু এই বিরিয়ানির শেফ কে? শেফকে যদি পাই তাহলে তার হাতে একটা চুমা দিতে হবে এতো মজার বিরিয়ানির জন্য।

শিলা আপু হেসে কিছুটা জোড়ে বলে উঠে, এই বর্ষা শুনে যাও তো একটু৷

বর্ষার নামটা কানে যাওয়া মাত্র ফারাজের মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেলো। হাসি ভাব নিমিষেই মুছে যায় মুখ থেকে৷

বর্ষা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসলো। তাকে দেখা মাত্র ফারাজ ভীষণ বড় একটা ধাক্কা খেল। বেশ সুক্ষ্মভাবে মাথার ডান পাশে চিনচিন ব্যথা অনুভব করে সে। বর্ষার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। মেয়েটা ম্যাজেন্টা রঙের শাড়ি পড়ে আছে। গলায় সোনার মোটা চেইন। অপূর্ব সুন্দর লাগছে তাকে। মেয়েটার এই রুপ আগে চোখে ধরা পড়েনি। “অবশ্য পৃথিবীর প্রতিটা মেয়েই রূপবতী ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণে৷”

বর্ষা তার সামনে এসে দাঁড়ালো একেবারে মুখোমুখি। তার ছায়া এসে ফারাজের গায়ে পড়লো। দুজনের মধ্যে আবারো চোখাচোখি হলো। বর্ষার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

শিলা আপু দুষ্টুমি করে বলে, ফারু তোমার হাতে চুমু খেতে চাচ্ছে। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে দাও।

বর্ষা-ফারাজ উভয়ই পরস্পরের দিকে তাকালো এক সেকেন্ডের জন্য। দুজনের মধ্যে ই অস্বস্তি কাজ করছে।

ফারাজ বলে উঠে, ইট ওয়াস এ জোক।

শিলা আপু বললো, আচ্ছা যা চুমু খেতে হবে না। তোরা লজ্জা পাচ্ছিস। এট লিস্ট প্রশংসা তো কর।

— কিসের?

— তোর বউয়ের রুপের। দেখ কি সুন্দর লাগছে ওকে। ঠিকমতো তো দেখলিও না। তোর জন্যই তো ও সেজেছে। দেখ ভালো করে। নাকি দেখার জন্যও রুমে যাওয়ার লাগবে।

ফারাজ বিরক্ত হলো। তার এসব ভালো লাগে না। আসলে তার মধ্যে আবেগ বলে কিছু নেই। মেয়েদের প্রতিও তার আকর্ষণ কাজ করেনা। তবে সত্য বলতে লজ্জা নেই যে বর্ষাকে দেখা মাত্র তার মনের মধ্যে কেমন যেনো করে উঠেছিল। কিন্তু এইসব ফিলিংস সাময়িক। দিনশেষে নেশা করতে পারলেই সে সুখী। আজকাল পৃথিবীটা মূল্যহীন লাগে। পড়াশোনায় একেবারেই মন নেই তার। চলতি সেমিস্টারে মাত্র পাঁচ দিন ক্লাস করেছে। কোন কুইজ দেয়নি সে। রাতের পর রাত, এমনকি দিনেও ড্রা-গ-স নিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে সে।বউ, সংসার, ভালোবাসা এইসব কিছুর মূল্য তার কাছে নেই। তার শুধু পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা চাই নে-শা করার জন্য।

রাত আরেকটু বাড়তেই শিলা আপু চলে গেলো। ফারাজ তখনো টেবিলেই বসে ছিল। বুনুর মাও বাড়ি চলে গেছে। রাতে ফারাজদের বাসায় কোন সার্ভেন্ট থাকে না৷

বর্ষা তখন রান্নাঘরে কাজ করছিল মনোযোগ দিয়ে। ফারাজ তার দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে গমগমে সুরে বলে, বর্ষা আমার রুমে আসো।আজকে থেকে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।

ফারাজের কথা শোনামাত্র তার হাত কেঁপে উঠে সামান্য। সে বাজখাঁই গলায় বলে, আমি আপনার সঙ্গে থাকব না৷ আলাদা থাকব৷ আপনার মতো লম্পট লোকের সঙ্গে থাকতে আমার রুচিতে বাঁধে।

ফারাজ রান্নাঘরে প্রবেশ করে বর্ষার ডান হাতটা খপ করে ধরে ফেলে বলে, সাজলা তো আমার জন্যই। তাহলে আমার সঙ্গে থাকতে কি অসুবিধা?

এ কথা উল্টোপিঠে বর্ষা জবাব না দিলেও রক্তিম চোখে তার দিকে তাকায়। ফারাজ আস্তে আস্তে তার দিকে এগুতে লাগলে, বর্ষা চোখ খিঁচে বন্ধ করে বলে, প্লিজ আমার সঙ্গে কিছু করবেন না।

ওই মুহূর্তে বর্ষা তার গলায় বিপুল পরিমাণ জ্বালা অনুভব করে। মনে হচ্ছিল গলায় চামড়া ছুলে যাচ্ছে। সে চোখ খুলতেই দেখে ফারাজের হাতে শিলা আপুর বিয়ে উপলক্ষে উপহার দেওয়া সোনার মোটা চেইনটা। সে হতবিহ্বল হয়ে যায়।

ফারাজ সোনার চেইনটা পকেটে ঢুকিয়ে বলে, তোমার হীরা দিয়ে বাঁধাই করা শরীর ধরার ইচ্ছাও আমার নাই।

বর্ষা সেখানেই মূর্তির মতো বিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। স্তব্ধ সে। মাথা কাজ করছে না।

চলবে।

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here