আমি কাউকে বলিনি সে নাম পর্ব ১৭+১৮

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১৭
__________________________

বসার ঘরটা বেশ বড় ৷ রূপা এত বড় বাড়ি আগে দেখেনি ৷ নিজেকে সংযত করে রাখার চেষ্টা করতে করতেও সে বাড়ির চারপাশটা অবাক হয়ে দেখছে ৷ বসার ঘরে সোফায় বসে আছে রূপা আর নয়ন ৷ বেশ অনেকক্ষন হলোই বসে আছে , এখনও নিপার সাথে দেখা হয়নি ৷ এর মধ্যে একজন চাকরগোছের মানুষ এসে নাস্তা দিয়ে গেছে ৷ নয়নের অস্থির লাগছে ৷ অপেক্ষার প্রতিটি সেকেন্ড যেন মনে হচ্ছে শত শত বছর ! আচ্ছা কেউ কী নিপাকে খবর দেয়নি যে তারা আসছে !

নিপা খবর পেয়ে গেছিল সাথে সাথেই ৷ কিন্তু তার শাশুড়ি তাকে আটকে রেখেছে ৷ বাপের বাড়ি থেকে মানুষ আসলেই সাথে সাথে তাদের সামনে ঝাপায়ে পড়া কোন কাজের কথা না ৷ তাছাড়া বড়মিয়া সাহেবও বাড়ি নেই ৷ উনার অনুপস্থিতিতে এমন কিছুই করতে চান না রাহেলা বেগম যাতে তিনি অসন্তুষ্ট হন !

সুমাইয়া শাশুড়ির ঘরে ঢুকেই নিপার দিকে তাঁকিয়ে বললো —

—তোমার বাপের বাড়িত থেইকা লোকজন আসছে , তুমি এখনও যাও নাই যে !

নিপা মাথা নিচু করে থাকে , কোন জবাব দেয় না ৷ জবাব দেয় তার শাশুড়ি ৷

—তোমার শ্বশুর তো নাই বাড়িত ! হ্যার অনুমতি ছাড়া বউরে কারো সামনে কেমনে পাঠাই ?

—আজব কথা বার্তা আপনার মা ! বাপের বাড়ির মানুষের সাথে দেখা করার জন্য অন্য কারো অনুমতি লাগবে ? বাচ্চা বাচ্চা দুইটা পোলাপান আসছে , মুখ দেইখাই বোঝা যাইতেছে কোন খারাপ খবরই আনছে ! আর আপনে মাইয়্যাটারে আটকায়া রাখছেন ? ক্যান মা ! নিপা , অক্ষন ওঠো তুমি , যাও গিয়া মেমানের লগে দেখা করো ৷ দেখি তোমারে কেডায় আটকায় !

নিপা এক পলকে শ্বাশুড়ির দিকে তাঁকায় ৷ রাহেলা বেগম কিছুই শোনেননি এমন একটা ভঙ্গিতে পান সাজাচ্ছেন ৷ মুখ দেখে মনে হচ্ছে আহ্লাদী শান্ত একটা মেয়ে ৷ অথচ খানিক আগেই তার চোখ দুটো থেকে আগুন ঝরছিল ৷ এই মানুষটা গিরগিটির চেয়েও দ্রুত রঙ পাল্টায় … সে আর অপেক্ষা করে না , ছুটে গিয়ে দাঁড়ায় ভাই বোনের সামনে ৷

রূপা আর নয়নকে জূড়িয়ে ধরে খানিকক্ষন কাঁদে সে ৷ কেন কাঁদছে কে জানে ! অনেকদিন পর বাপের বাড়ির মানুষকে দেখলে বুকের মধ্যে অযথাই মোচর দিয়ে উঠে , চোখে জল জমে ! হয়তো এক লহমায় মনে পড়ে যায় ফেলে আসা শৈশব , হয়তো মুহূর্তের ব্যবধানে মনে পড়ে যায় শিকড় উপরে ফেলার যন্ত্রনা … নিপাকে শান্ত করে তাকে পাশে বসায় নয়ন ৷ তারপর মাথা নিচু করে বলে “বড় চাচী খুব অসুস্থ আপা … তোমারে নিতে আসছি ৷ হাতে বেশি সময় নাই , তাড়াতাড়ি রওনা না দিলে শেষ দেখা দেখতে পারবা না ৷ ”

হঠাৎ যেন কখন সুমাইয়া এসে পাশে দাঁড়িয়েছে কেউ খেয়াল করেনি ৷ ওর বিরবির শুনে তার দিকে তাঁকায় ওরা …

“শুণ্য হতেই শুরু আবার শূণ্যে গিয়ে শেষ
মধ্যেখানে মস্ত সময় , জীবন নিরুদ্দেশ ”

সুমাইয়া মাঝে মাঝেই এমন লাইন বিরবির করে বলে ৷ উদভ্রান্তের মত এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থেকে কবিতা আওড়ায় ৷ মুহূর্তেই দীর্ঘশ্বাসের সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে সুমাইয়া নিপাকে বলে

— তাড়াতাড়ি রওনা দেও , ব্যাগের মধ্যে দুইখান কাপড় নিয়া যাও , দেরী কইরো না !

—বাবা বাড়ি নাই , মা যদি অনুমতি না দেয়

—এই এত ম্যা ম্যা নেকামি করো না তো ! এই মায়ের চিন্তা ছেড়ে যে মা মৃত্যুসজ্জায় তার কাছে যাও ৷

—উনিও বাড়ি নাই

—নিপা , আর একটা কথাও তুমি কইবা না ! শুয়োরের পালের মধ্যে থাইকা অহন কী তুমি মানবরূপ বিসর্জন দিতাছো …

নিপা মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদে ৷ সুমাইয়া বোঝে সে বেশিই উত্তেজিত হয়ে গেছে ৷ নিজেকে সামলে নিপার মাথায় হাত দিয়ে বলে “তুমি তোমারু ভাই বইনের লগে যাও বইন , এদিকে আমি তো আছি … আমারে বিশ্বাস পাও না ?”

এ বাড়িতে নিপার একমাত্র বিশ্বাসের জায়গাই হলো সুমাইয়া ৷ সে আর কথা বাড়ায় না ৷ দ্রুত প্রয়োজনীয় জিনিস সাথে নিয়ে ভাই বোনের সাথে চলে যায় নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে …. না , নিজের বাড়ি নয় , কথাটা হবে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে ! কবুল বলার পরপরই নিজের বাড়িটা বাপের বাড়ি হয়ে গিয়েছিল এক লহমায় ৷ পর তো পর , নিজের জন্মদাতা পিতাও সত্য গোপন করে তাকে বিয়ে দিয়েছিল ৷ সব কিছু জানার পরও তাকে বাধ্য করেছে শ্বশুরবাড়ি ফিরে যেতে , বলেছে “লাল কাপড় পইরা ঐ বাড়িত ঢুকছোস , সাদা কাফন পইরা ঐ বিড়িত থেইকা বাইর হবি ” নিপার কান্না , অনুনয় বিনয় কিচ্ছু ছুঁতে পারেনি তাকে ৷ সেই বাড়িতে নিপা আবার যাচ্ছে ! ওর পা থেমে যায় ! না ঐ বাড়িতে আর যাবে না সে , যারা ওকে সম্মানের ভয়ে মদ্যপ স্বামীর সাথে ঘর করতে পাঠিয়েছে জোর করে তাদের সাথে কোন সম্পর্কই নেই তার ….

—আপা থামলা যে ? চলো ভ্যানে উঠো !

—আমি যামু না নয়ন , তোরা ফিরত যা !

—যাবা না মানে ! বড় চাচীরে শেষ দেখা দেখবা না !

—না , আমি তাগোর কেউ না ৷ তারাও আমার কেউ না ৷ রোজদিন তো শত শত মানুষ মরতাছে , আমার তো তাতে কিছু যায় আসে না ৷ কারণ তারা আমার কেউ না ৷ তোর বড় চাচীও তেমনি , আমার কেউ না ! কেউ না ! কেউ না ! আমি নিজেই নিজের আপনজন , আমার আর কেউ নাই ৷ তোরাও আর আসিস না এই বাড়িত ৷ মনে করিস তোরার আপা মইরা গেছে ৷

নয়ন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিপাকে ৷ নিপা শব্দ করে কেঁদে উঠে ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে ৷

—আপা , আমি জানি তারা তোমার লগে ক্ষমার অযোগ্য অন্যায় করছে ৷ কিন্তু বড় চাচী শিশুর মত নিষ্পাপ মানুষ ৷ তার মত পরিষ্কির মনের মানুষ আমি দেখি নাই … তুমিও দেখো নাই …. সেই সেই পবিত্র মানুষটারে দেখতে যাইতেছো আপা ! কারও বাড়ি যাইতেছো না ! তুমি চলো , তোমারে যাইতেই হইবো ….

শক্ত করে নিপার হাত ধরে নিয়ে নয়ন তাকে ভ্যানে বসায় ৷ পুরোটা পথ রূপার কাঁধে মাথা রেখে নিপা কাঁদে , কিন্তু কেউ কোন কথা বলে না ৷

আজ একদিনেই রূপা অনেক বড় হয়ে গেছে ৷ নিপা আপার সমস্যাগুলোর কাছে তার নিজের সমস্যা তুচ্ছ মনে হচ্ছে ৷ বিয়ে এত জটিল জিনিস ! রূপা মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে ” হে আল্লাহ তুমি আমারে কোনদিনও বিয়া দিও না ৷ আমি আলেয়া চাচী , চাচা , কাউরেই ছাড়তে পারমু না ৷ আর যদি বিয়ি দেওই মাবুদ তাইলে আমার বিয়া তুমি নয়ন ভাইয়ের সাথেই দিও ৷ তাইলে আর আমার বাড়ি ছাড়া লাগবো না …”

***********
নিপার মা তখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন ৷ হয়তো মেয়েটাকে শেষবার দেখার জন্য আজরাইলের সাথে সমঝোতা চুক্তি করেছিলেন ৷ শিওরে আজরাইল এসে বসে আছে , আরেক পাশে এসে বসলো নিপা ৷ মায়ের হাতটা নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিতেই মানুষটা যেন একটু খানি হাসলো ৷ অপর হাতটা খুব কষ্ট করে তুলে নিপার মাথায় দিলো , আর হাতটা সাথে সাথেই পড়ে গেলো ….. নিঃশব্দে একজন মানুষের অর্থহীন শব্দযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে গেলো !

চলবেআমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১৮
__________________________
সন্ধে নেমে গেছে , চারদিকে গাঢ় অন্ধকার জমতে শুরু করেছে ৷ নয়ন এসে দাঁড়িয়ে আছে তার বড় চাচীর কবরের পাশে ৷ কবরটা বাঁধাই করা হয়েছিল গত বছর ৷ সেই বাঁধানো কবরের পাশে লাগানো শিউলি গাছ ভর্তি হয়ে গেছে ফুলে ৷ মিষ্টি গন্ধে মাথাটা ঝিমঝিম করছে ৷ বাড়ি আসলেই আগে এখানে এসে বসে নয়ন ৷ মানুষটা চলে গেছে তিন বছর হয়ে গেলো ৷ তবুও এখানে এসে বসলে মনে হয় মানুষটাকে অনুভব করা যায় ৷

ঢাকা ইউনিভার্সাটিতে ভর্তি হবার পর প্রথম প্রথম ঘন ঘন বাড়িতে আসতো নয়ন ৷ সময়ের সাথে বাড়ির সাথে আরও দুরত্ব বেড়েছে ৷ দুটো কোচিং এ ক্লাস নেয় নয়ন , সাথে আরও দুটা টিউশনি … নিজের ছুটি হলেও স্টুডেন্টদের কারও না কারও পরীক্ষা থাকে ৷ আর আসা হয় না ৷ সে আসে না জন্য মা মন খারাপ করে , রূপা অভিমান করে ৷ কিন্তু বাস্তবতার কাছে সব তুচ্ছ হয়ে যায় ৷

—ভাইজান , বাড়িত চলেন , চাচী ডাকে

—কী রে তুই এখানে ! কিভাবে জানলি আমি এখানে ?

—আমি সবই জানি ৷

রহস্যময় হাসি হাসে রূপা ৷ এই মেয়েটা দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে ! এ বছর এস এস সি পরীক্ষা দিলো ৷ রেজাল্টের অপেক্ষায় আছে ৷ নয়ন জানে রূপার রেজাল্ট খুব ভালো হবে না ৷ ওর পরীক্ষার আগে যখন বাড়ি এসেছিল , অংক করতে দিয়েছিল সে ৷ একটা অংকও পারেনি ৷ ইংলিশেরও ভয়াবহ অবস্থা ৷ অবশ্য এর জন্যে ওর বাবা মাও দায়ী ৷ কোন প্রাইভেটই দেয়নি ৷ নিজে নিজে যতটা পারে তাই পড়ছে মেয়েটা ৷

সেবার রতনের ঘটনার পর আলেয়া বেগম রূপাকে কোন পুরুষ মানুষের কাছে পাঠানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না ৷ সেদিন আলেয়া বেগম সময় মত না পৌছালে রূপার একটা ক্ষতিই হয়ে যেতো ৷ রতন হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল রূপাকে , ওর মুখে হাত দিয়ে চেপে রেখেছিল ৷ একবার সে হাত ছুটিয়ে শুধু একটা চিৎকারই দিতে পেরেছিল রূপা “ও চাচী গো, আমারে বাঁচান ! ” আলেয়া বেগমের কানে পৌছেছিল সে চিৎকার ! তারপর দৌড়ে এসে রতনকে দেখে হাতের কাছে থাকা আধখানা ইট তুলে ছুড়ে মেরেছিল তার দিকে ! তারপর ওকে মাটিতে ফেলে এলোপাথারি মেরেই চলেছিল পাগলের মত !

বিচার হয়েছিল রতনের ৷ আলেয়া বেগম ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে বিচার বসিয়েছিলেন ৷ বাড়ির কোন পুরুষই চায়নি বিচার হোক ৷ গাজী মিয়া বলেছিলেন “ওরে বিদায় কইরা দিতাছি , বিচারের দরকার নাই ৷ মাইয়্যারই মান যাইবো ” …. আলেয়া বেগম কারও কথা না শুনে দৃঢ় গলায় বলেছিল “বিচার হইবো , হইবোই ….” জেল খেটেছিল রতন , তারপর জেল থেকে বের হয়ে আর গ্রামে আসেনি ৷ তারপর থেকেই রূপাকে আরও চোখে চোখে রাখেন তিনি ৷

—ভাইজান , চলেন ৷ বইসা রইলেন যে !

—তোর রেজাল্ট দিবে আগামী সপ্তাহে জানিস ?

—হ জানি

—ফেলটেল করবি না তো ! যে অবস্থা দেখে গেছিলাম , পাশ করার তো কথা না

—ফেল হইলে ফেল হইবো ! আমার চেহারা ছবি সুন্দর আছে , ফেল হইলেও আমার বিয়া হইবো ৷

—বিয়া করতে চাস ?

—হ , বিয়া তো করা লাগবোই ৷ বাড়িত সকাল বিকাল ঘটক আসে ৷

—আচ্ছা ঘটক আটকাবার ব্যবস্থা করে যাবো ৷

—ক্যান ! ঘটক না আইলে বিয়া হইবো ক্যামনে ?

—বিয়া করা লাগবো না ! যা বাড়িত যা , আইতাছি …

রূপা হাসে ৷ তার বিয়ের কথা শুনলেই নয়ন রেগে যায় ৷ রেগে গেলে ওর কপালের দুপাশের রগ ফুলে উঠে , দেখতে মজা লাগে রূপার ৷ রূপাকে সে নিশ্চয় পছন্দ করে , তা না হলে এভাবে রেগে যাবে কেন ! এই মানুষটাকে রাগাতে খুব ভালো লাগে …

নয়নের সামনে অংক কষতে বসে ইচ্ছা করেই ভুল করতো সে ৷ যাতে আরও বেশি সময় একসাথে থাকা যায় ৷ নয়ন জানে না যে রূপা কী পরিমান মেধাবী ! কোন সাহায্য ছাড়াই সে খুব ভালোভাবে নিজের প্রস্তুতি নিয়েছে , পরীক্ষাও খুব ভালো হয়েছে ৷ রেজাল্ট নিয়ে তার কোন চিন্তা নাই সেজন্যই , যে পরীক্ষা দিয়েছে তার মন ঠিক জানে রেজাল্ট কী হবে ….

আজকাল নয়নের সাথে একদমই কম যোগাযোগ হয় তার ৷ বাড়ি না আসলে তো আর দেখা সাক্ষাতের সুযোগ মেলে না ৷ নয়ন অবশ্য আগের মতই আছে , উদাসীন ৷ তবে রূপার ব্যাপারে সে সবসময়ই মনোযোগ দেয় ৷ ছোট ছোট বিষয়গুলোর খেয়াল রাখে ৷ একবার শহর থেকে ফেরার সময় সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর নিয়ে আসলো , এই জিনিস তাদের গ্রামে পাওয়া যায় না ৷ রূপা তখন প্রায় মাসখানেক সেই ক্যালকুলেটর মাথার কাছে নিয়ে ঘুমিয়েছে ৷ একদিন স্কুলে রূপার এই অমূল্য সম্পদ চুরি হয়ে গেলো ৷ সে এমন কান্না করেছিল যে আলেয়া বেগম নিজে স্বামীকে শহরে পাঠিয়ে আরেকটা ক্যালকুলেটর এনে দিয়েছিল ৷ রূপা কাউকে বলতে পারেনি তার যে জিনিস হারিয়েছে সেটা আর কখনও পূরণ হবার নয় …সেটা ছিল অমূল্য … সেটা ছিল ভালোবাসার উপহার ! সব কথা কী বলা যায় ! সব নাম কী বলা যায় ! কিছু কথা কিছু নাম শুধু মনের গহীনে বদ্ধ করে রাখার জন্যই , বাইরে আনার জন্য নয় ৷

নয়ন এখনও কবরের কাছেই বসে আছে ৷ এখান থেকে তার উঠতে ইচ্ছা করছে না ৷ রূপার জন্য চিন্তা হচ্ছে ৷ এই মেয়েটা হাতে পায়ে বড় হচ্ছে ঠিকই কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি হচ্ছে না ৷ এত কম বয়সে বিয়ে করলে কী কী পরিনতি হতে পারে সেসব একবারও ভাবছে না ৷ কী সুন্দর কথা ” ফেল করে বিয়ে করবে” ৷ অথচ লেখাপড়া শেখাটা কত বেশি জরুরি সেই জ্ঞানটাও ওর মধ্যে নাই ৷ নাহ , একবার মেয়েটাকে বোঝাতে হবে ৷

নাদের মিয়া মসজিদ থেকে এশার নামাজ পড়ে ফিরছে ৷ এশার নামাজের পর মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকক্ষন দোয়া খায়ের করে সে ৷ আজকে অন্ধকারে সে দেখলো কবরের পাশে কিছু একটা বসে আছে ! ভীষণ ভয় পেয়ে “ইয়া আল্লাহ বাঁচাও” বলে এক দৌড়ে সোজা বাড়ির ভেতর চলে যায় সে ৷ ঘরে বসে হাফাতে হাফাতে বলে

—বউ , বউ ! পানি দেও , পিয়াস লাগছে

লাকী ঘরে ঢুকে দেখে নাদের মিয়া দরদর করে ঘামছে ৷ তার হাতে পানির গ্লাস দিয়ে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বলে

—কী হইছে আপনের ? ডড়াইছেন ?

—মায়ের কবরের কাছে কেডা জানি বইসা আছে বউ ?

—কবরের কাছে কেডা বইসা থাকবো ? আপনে ভুল দেখছেন ৷ চলেন আমার সাথে , বাতি নিয়া গিয়া দেইখা আসি ৷

—না , অত সাহসের দরকার নাই ৷ ভুল দেখলে ভুল দেখছি ৷ এইটা পরীক্ষা করতে যাবার দরকার নাই ৷

—দরকার আছে ৷ বাড়ির পাশেই কবর ৷ এমন কথা উঠলে বাড়িত টেকা মুশকিল হইয়া যাইবো ৷ আর পরীক্ষা না হলে আপনের মনে খচখচানি থাকবো ৷ আপনে রাত বিরাতে ফেরেন , মনের সাহস কইমা যাইবো ৷

—কিছু থাকলে সে কী আমগো লাইগা বইসা আছে ?

—না থাকলে নাই ৷ চলেন ৷

লাকীকে থামানো গেলো না ৷ একটা টর্চ লাইট হাতে সে একাই এগুতে থাকলো ৷ অগত্যা নাদের মিয়াকে পিছু পিছু যেতেই হলো ৷

টর্চের আলোয় একটু দূর থেকেই তারা দেখলো “সেই কিছু একটা” মানুষটা নয়ন …. লাকীকে থামিয়ে দিলো নাদের ৷ তারপর বললো “বউ আর যাইয়া কাম নাই…” খানিকক্ষন পর আবার বললো “নয়নের মত কইরা মায়েরে আমরা কেউ ভালোবাসতে পারি নাই … আমাদের ভালোবাসার মধ্যে দায় আছে , ওরটা খাঁটি ৷ সোনার চাইতেও খাঁটি …”

লাকী কথা বাড়ায় না ৷ তার নীরবতা বলে দেয় নাদের মিয়া ভুল বলেনি ৷

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here