আমি শুধুই তোমার পর্ব -০৮

#আমি_শুধু_তোমার
#লেখনিতেঃ লামিয়া ইসলাম তন্নি
#অষ্টম_পর্ব

✘কপি করা সম্পূর্ণ নি/ষিদ্ধ✘
জানালা ভেদ করে ভোরের তীব্র আলো এসে চোখে পড়তেই ঘুম ছুটে গেল আমার। পাশ ফিরে শুতে নিতেই নিজেকে কোথাও আবদ্ধ মনে হলো। আমার ঘুমটা এবার পুরোপুরি ছুটে গেল। আমি চোখ খুলে সামনে তাকাতেই আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। আমি ওনার বাহুতে আবদ্ধ! এতগুলো দিন একসাথে ঘুমাচ্ছি কখনো তো এমন হয়নি। উনি এতটাও অসাবধান তো নন। তবে? আচমকা আমি নিজের মাঝে পরিবর্তন লক্ষ করলাম। এইযে, ওনার এত কাছে আছি আমার একটুও অস্বস্তি হচ্ছে না। এইযে উনি আমায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন, আমার রাগ হচ্ছে না। বরং, ওনাকে এতটা কাছ থেকে দেখতে বেশ ভালো লাগছে। অন্যরকম এক মা/দকতা যেন টানছে ওনার দিকে। ভীষণ ইচ্ছে করছে ওনার খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলোতে একবার হাত চালাতে। এই প্রথম ওনাকে ঘিরে কোনো ইচ্ছেকে আমি প্রাধান্যও দিলাম। আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলাম ওনার গালে। আমার ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় নড়েচড়ে উঠলেন উনি। যাতে করে ওনার গরম নিঃশ্বাস এসে পড়লো আমার মুখে, গলায়। আমি একটু কেঁপে উঠলাম। পরক্ষণেই নিজের কাজে ভীষণ ল/জ্জা পেলাম। চটজলদি ওনার বাহু থেকে মুক্ত হতে নিতেই উনি আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। আমার নিঃশ্বাস যেন এবার আটকে আসার উপক্রম। আমি শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা গলায় ওনাকে ডাকলাম,
“শু শুনছেন?”

প্রথমবার ওনার কোনো সাড়া না পেয়ে একে একে তিনবার ডাকলাম। ঘুম কুমারের কোনো সাড়াই নেই। তাই, বাধ্য হয়ে আবার সেই ঠান্ডা হাতটা তার গালে রাখলাম। ডাকলাম,
“শুনছেন?”

এবার প্রায় সাথে সাথে নড়েচড়ে উঠলেন উনি। ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই বললাম,
“আমাকে ছাড়ুন। আমি উঠব।”

আমার কথাটা শেষ হতেই উনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বসলেন। এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মাথা নিচু করে অপরাধী স্বরে বললেন,
“আ’ম সরি। আসলে, আমি ঘুমের ঘোরে খেয়াল করিনি।”

তারপর, আবার আমার দিকে তাকালেন। নিচু স্বরে বললেন,
“কিছু মনে করো না, প্লিজ।”

আমি বলার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না। কেবল মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে বললাম,
“ইট’স ওকে।”

তারপর, উনি বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। উনি উঠে যেতেই আমি বিছানা গুছিয়ে ফেললাম। তারপর, কাপড় হাতে অপেক্ষা করতে লাগলাম উনি বের হওয়ার!

~~~~~~~~~~

বিছানার কোণে বসে হাত পায়ে লোশন মাখছিলাম। উনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছিলেন। আমি লোশন মাখার ফাঁকে ফাঁকে তার দিকে আঁড়চোখে তাকাচ্ছি। কালো রঙের প্যান্টের ওপর নীল রঙের শার্ট। হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। বা হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। সাদা শরীরের নীল আর কালো দু’টো রঙ-ই মারাত্মক লেভের সুন্দর লাগে। আর, এই বান্দারে তো দুনিয়ার সব পোশাকেই চকলেট বয় লাগে। বউ সুন্দর হইলে নাকি জামাইরা সারাদিন চিন্তায় থাকে। আমার ক্ষেত্রে উল্টা। আমি সুন্দর না। আমার জামাই রাজকুমারের মতো। তার থেকেও সুন্দর বলা যায়। এই ব্যাটা ঘর থেকে বের হলেই আমার চিন্তায় থাকতে হয়।৷ মাঝেমধ্যে তো মন চায় মুখে কত্ত খানি কালি মেখে দেই। এরে এত সুন্দর হইতে বলছেডা কে?

আমি ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে আয়নার দিকে তাকাতেই দেখি উনি হাতে জেল নিচ্ছে। ব্যাটা কত্ত বড় ব/জ্জাত! চুলে জেল মাখতে নিছে। এমনি কি তোরে কম সুন্দর লাগে, ভাই? তুই আবার চুলে জেল মে/রে চুল সেট করে আরও সুন্দর হইতে যাস। এমনিতেই তো মাইয়ারা তোর পিছন ছাড়ে না। এমনে চললে তো কোনদিন যেন তোরে তুলে নিয়ে যায় আমি তো সর্বদা সেই ভ/য়েই থাকি। মনে মনে বিরবির করে করতে আমি লোশনের বোতল ফেলে দৌড়ে গিয়ে ওনার হাত থেকে জেলের কৌটা কেড়ে নিলাম।

আচমকা আমার এমন আচরণে উনি অবাক হয়ে তাকালেন। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে চোখ সরু চোখে চাইলাম। দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,
“ভার্সিটিতে কি মেয়ে পটাতে যান নাকি ক্লাস করাতে?”

আমার কথা শুনে উনি যেন আকাশ থেকে টুপ করে পড়লেন, এমন ভাব করে বললেন,
“মানে? ভার্সিটিতে আমার কাজ কী? সেটা করতে যাই।”

আমি এবার জেলের কৌটাটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম,
“আচ্ছা? তো এসব জেল টেল কেন মাখছেন?”

আমাকে ওভাবে দাঁড়াতে দেখে ওনার হয়তো হাসি পেল। উনি কোনোমতে হাসি চেপে বললেন,
“আরে, বাবা! চুলগুলো সিলকি। জেল দিয়ে সেট না করলে কপালে এসে পড়ে। বিরক্ত লাগে।”

আমি কোমড় থেকে হাত নামিয়ে দাঁড়ালাম। অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
“বিরক্ত লাগলে লাগুক। বিরক্ত লাগা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। তাই, আপনার জেল দেওয়া যাবে না।”

আমার কথা শুনে উনি শব্দ করে হেসে ফেললেন। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই উনি কোনোমতে হাসি থামালেন। বললেন,
“আচ্ছা, তা নাহয় দেখা যাবে। কিন্তু, জেল দিলে সমস্যা কী?”

আমি ওনার দিকে ফিরে তাকালাম। চোখ গরম করে বললাম,
“এত কিছু জানিনা। শুধু জানি, আপনি জেল লাগাবেন না।”

উনি ঝুঁকে কৌটাটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন,
“তবে আমিও জেল লাগাবো, ম্যাম।”

ওনার কথা শুনে আমার মেজাজ খা/রাপ হলো। রাগ হলো ভীষণ। আর, এরপর রাগের বসে আমি যা করলাম, তা কল্পনার বাইরে। জীবনের সবচেয়ে বড় বলদামিটা করে ফেললাম। মুখ ফসকে বলে ফেললাম,
“আপনাকে অনেক সুন্দর লাগে। যার কারণে সব মেয়েরা আপনার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার জামাইর দিকে কোনো মেয়ে তাকাক, এটা আমার একদম পছন্দ না। আমার রাগ হয়। মন খা/রাপ হয়। তাই, আপনি জেল দিয়ে বাহিরে যেতো পারবেন না।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামতেই আমি বুঝলাম আমি ঠিক বলেছি। তারপর আর কি! তার চোখেমুখে বিস্ময়। আর, আমার চোখে-মুখে ল/জ্জা। তারপর, সবশেষে সুযোগ বুঝে এক দৌড়ে রুমের বাইরে!

~~~~~~~~~

সকলের সঙ্গে টেবিলে বসে নাস্তা করছেন আর আঁড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন উনি। আমি নিচে তাকিয়ে খেলেও তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আর, অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হচ্ছি। একটা জিনিস দেখবেন, আপনি বড় বড় অ/ন্যায় করে যখন আপনি বাঁচতে পারবেন, বা কারো সম্মুখে পড়বেন না, তখন আপনার মাঝে কোনো কিছুই যায় আসবে না। আপনার রিয়াকশন এমন হবে যে, আপনি কিছুই করেননি। কিন্তু, কখনো যদি সামান্য কোনো কাজ করার পর সেটা কারো চোখে পরে আর সে আপনাকে কিছু না বলেও শুধু আপনার তাকায়, তাহলে সেটা যে কি ল/জ্জার বা অস্বস্তির তা আপনি সেই পরিস্থিতিতে না পরলে কখনোই বুঝবেন না। আপনি সর্বদা ভ/য়ে থাকবেন, এই বুঝি সে কিছু বলল। সেই পরিস্থিতিতে এখন আমি আছি।

আমি চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে রুটির শেষ অংশটুকু মুখে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ বাদে চা হাতে ফিরে এলাম। সবার সামনে চা দিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লাম। নিজের জন্য বরাদ্দকৃত চা’তে চুমুক দিতে দিতে আঁড়চোখে একবার ওনার দিকে তাকালাম। সাথে সাথে চোখাচোখি হতেই দেখলাম উনি মুচকি হাসছেন। যা দেখে আমার অস্বস্তি কয়েকগুণ বেড়ে গেল। যার ফলে আমার কাশি উঠে গেল। উনি চায়ের কাপ রেখে পানি এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি পানিটা নিয়ে কিছুটা পানি খেতেই কাশি কমে এলো। মা বললেন,
“এত তাড়া ক্যান? আস্তে খা।”

আমি আঁড়চোখে ওনার দিকে তাকালাম। ব/জ্জাত লোকটা এখনও হাসছেন। রাগে আমার গা জ্ব/লে উঠলো। দাঁত কিড়মিড় করে তাকাতেই উনি চোখে ফেরালেন। দু’ঠোঁট এক সাথে চেপে হাসি থামালেন। আমি চোখ ফেরালাম। মা, বাবা, তাইয়্যেবাহ্ সকলে একে একে নাস্তা সেরে উঠে গেলেন। তাইয়্যেবাহ্ রুমে গিয়ে রেডি হবে। ওর ক্লাস ১০ টায়। বাবা ঘরে গিয়ে উপন্যাসের বই খুলে বসবেন। মা ঘরে গিয়ে বাবাকে পান বানিয়ে দেবেন। এতগুলো দিন মানুষগুলোর সাথে থাকতে থাকতে তাদের দৈনন্দিনের রুটিন আমার মুখস্থ প্রায়! এখান থেকে চলে গেলে দীর্ঘদিন এই অভ্যাস থেকে বের হতে পারব না। এইযে, একটুপরই মায়ের সাথে গল্পে বসে যাব। ঘন্টাখানেক পর উঠে দু’জনে রান্নাঘরে যাব। গল্প করতে করতে রান্না শেষ করব। তারপর, বাকী কাজ শেষে দু’জনে একত্রেই নামাজ পড়ব। সময়গুলো ভীষণ সুন্দর। খুব মিষ্টি!

আমার মনটা আবার খা/রাপ হয়ে এলো। সুন্দর স্মৃতি মনে পড়লে মন খা/রাপ হয়, বুঝি? কি জানি! জানা নেই। আমি আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টেবিল গুছালাম। উনি রুমে গিয়ে ওয়ালেট আর ফোন নিয়ে বেড়িয়ে এলেন। জুতার আলনা থেকে জুতা নিয়ে পরলেন। বের হওয়ার সময় আমার দিকে এক পলক তাকালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
“তা কী করবে, ভেবেছো?”

ওনার কথার মর্মার্থ না বুঝতে পেরে আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। উনি হয়তো আমার চাহনির অর্থ বুঝলেন। বললেন,
“ডি/ভোর্সের ব্যাপারে।”

ওনার কথা শুনে মুহূর্তেই আমার মন খা/রাপেরা ভীষণভাবে চেপে ধরলো। আমি হালকা হেসে শুধালাম,
“ভাবার কী আছে?”

উনি বললেন,
“সেদিন পেপার্সে সাইন হয়নি। উকিল সাহেব বলেছেন, যেহেতু তুমি সাইনটা করার আগ মুহূর্তেই বাঁধা পরেছে। হয়তো, আল্লাহ্ চান না, আমাদের বি/চ্ছেদটা হোক। তাই, সেদিন বাঁধা পড়েছে। আমাদের ভাবা উচিৎ আরও। তাই, ওনার মনে আমাদের দু’জনের কিছুদিন আলাদা থাকা উচিৎ। তুমি কী বলো?”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন উনি। ওনার কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে না, আমাকে হা/রানোর কোনো আফসোস ওনার আছে। বরং, আমাকে তাড়ানোর জন্য ব্যস্ত উনি। হবেনা কেন? হওয়ার’ই কথা। কোথায় উনি। আর, কোথায় আমি! কোথায আকাশের চাঁদ। আর, কোথায় জমিনের বামুন! আমার মন খা/রাপ, রাগ সবকিছু ধীরে ধীরে উড়ে গেল। এক ঝাঁক অভিমান এসে বসলো মনের দরজায়। ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো মনের ছোট্ট কুটিরে! আমি বাহির থেকে নিজেকে একদম স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপনা করলাম। বললাম,
“আমি কী বলব? আপনার যা ভালো মনে হয়, তাই করুন। আমার আপত্তি নেই।”

কথাটা বলে চলে আসতে নিতেই পেছন থেকে ডাকলেন উনি। বললেন,
“বিকেলে রেডি থেকো তবে।”

আমি উল্টোদিক মুখ করেই মাথা নাড়লাম। তারপর, বড় বড় পা ফেলে ঘরে এসে দরজা দিলাম। হুট করেই অনুভব করলাম, আমার বুকটা হাহাকার করছে। কেমন যেন কান্না পাচ্ছে! অদ্ভুত য/ন্ত্রণা হচ্ছে। আচ্ছা, আমিই তো এটা চাচ্ছিলাম। তবে, এখন যখন আমার চাওয়াটা পূর্ণ হচ্ছে, আমি সেটা নিয়ে খুশি থাকতে পারছি না কেন? কেন এমন লাগছে আমার? কেন এতটা য/ন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে! কেন, কেন, কেন!

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here