#আমি_শুধু_তোমার
#লেখনিতেঃ লামিয়া ইসলাম তন্নি
#নবম_পর্ব
✘কপি করা সম্পূর্ণ নি/ষিদ্ধ✘
মানুষ বিষাদের রঙকে নীল বলে। কারণ, বিষাদ নাকি নীল রঙের মতোই গাড় তিক্ত হয়! কিন্তু, বিচ্ছেদের রঙের নাম কেউ জানে না। হয়তো, কেউ কখনো খোঁজার চেষ্টা করেনি। আমিও করিনি। কারণ, আমার জীবনে ‘বিচ্ছেদ’ নামক শব্দটা কখনোই আসেনি। খুব সাধারণ পরিবারের সন্তান হলেও ছোট থেকো সকল চাহিদাই পূর্ণতা পেয়েছে আমার। কোনো স্বপ্ন, ইচ্ছে বা খুশি! কিছুর সাথেই আমার বিচ্ছেদ কখনোই হয়নি। তাই, বিচ্ছেদের রঙও খোঁজা হয়নি। তবে, আজ হঠাৎ করে বিচ্ছেদ বিচ্ছেদ গন্ধ পাচ্ছি। বিচ্ছেদের রঙ খুঁজতে ইচ্ছে হচ্ছে। জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। জীবনের মতো গায়েও সেই রঙ-টা জড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে!
আমি তপ্ত শ্বাস আলমারির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শরীরটা ঠিক নেই। সকাল থেকেই হালকা জ্বর ছিল। সময়ের সাথে সাথে তা বেড়ে চলছে। মাথার বা পাশটায় টনটনে ব্যথা। একটু শান্তির প্রয়োজন। কিন্তু, মন জুড়ে ভীষণ অশান্তি! ছোট থেকেই আমার এমন হয়। শরীর আর মনের কানেকশনটা গভীর। মনের কিছু হলেই শরীরটা নেতিয়ে যায়। তারপর, হুট করেই ভ/য়ানক জ্বর নিয়ে জ্ব/লে ওঠে।
আমি তপ্তশ্বাস ফেললাম। দূর্বল হাতে আলমারিটা খুলে ভাজ করে রাখা শাড়িগুলোতে চোখ বোলালাম। সেখান থেকে আমার চোখ গেল ধূসর রঙ-টার দিকে। কেন যেন বিচ্ছেদের রঙ-টা ধূসর বলেই বোধ হলো আমার! আমি শাড়িটা বের করলাম। অতঃপর, আরমারি লাগিয়ে শাড়িপা চেঞ্জ করে নিলাম।
শাড়ি পরা শেষে আয়নার সামনে বসে চুলে চিরুনী করছিলাম। আচমকা আয়নায় চোখ আটকালো। আমার হাতও থেমে গেল। আমি মাথা থেকে হাত নামিয়ে চোখের সামনে ধরলাম। অনামিকাতে জ্বলজ্বল করছে ছোট্ট পাথরের সেই গোল্ডের আংটি-টা। যেটা উনি আমাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। আজ থেকে এই আংটি-টা আর আমার নয়। এটা পরে থাকার অধিকারও আমার নেই। ‘অধিকার’ শব্দটা মাথায় আসতেই কেমন যেন অনুভূতি হলো। বুকটা ফাঁকা লাগলো। তবুও নিজেকে সামলে নিলাম। দূর্বল হাতে আংটিটা খুলে নিয়ে তার বক্সে রেখে ড্রয়ারে রেখে দিলাম। ড্রয়ারটা লাগিয়ে হাতটা নিজের সামনে ধরলাম। এবার হাতটা কেমন যেন খালি লাগলো। হাতের সৌন্দর্যেও ঘাটতি দেখলাম। সাথে দেখলাম, অনামিকায় আংটির ছাঁপ! আজকের পর থেকে আংটি-টা হয়তো আর এখানটায় থাকবে না। তবে, তার ছাঁপটা থেকে যাবে।
আমি চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুল আঁচড়াতে মনোযোগী হলাম। চুলগুলো খোঁপায় বেঁধে ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে ক্রিমের কৌটা হাতে তুলে নিলাম। সেখান থেকে কিছুটা ক্রিম নিয়ে কৌটা-টা আবার আগের জায়গায় রেখে দিলাম। তারপর, হাতে থাকা ক্রিমটা দু’হাতে মাখিয়ে মুখে লাগাতে গিয়ে চোখ পড়লো নাকে জ্বলজ্বল করা সাদা পাথরের বড় নাকফুলটায়। আগের দিনে চুড়ি, নাকফুল,গলার চেইন, কানের দুলসহ মহিলাদের অলংকারকে বিবাহিত নারীদের চিহ্ন ভাবা হতো। আগের দিনের মহিলারা ভাবতেন, এ-সকল জিনিসের সাথে তাদের স্বামীর নাম জুড়ে আছে। এগুলো না পরলে স্বামীর অমঙ্গল হবে। তাই, তারা খুব সম্মান আর যত্নের সাথে নাকফুল, চুড়ি, দুলসহ নানারকম অলংকার পরতো। তবে, বেশি প্রাধান্য দিতো নাকফুল আর চুড়িতে। যদিও এ-সম্পর্কে কুরআন বা হাদীসে তেমন কোনো বর্ণনা বা কথাই নেই। তবুও, তারা এমনটাই ভেবে আসতেন। এমনকি, বিংশ শতাব্দীতে এসেও অনেকে সেই ধারণাকে পুঁজি করে আসছে। আমি অবশ্য কখনোই এসবে বিশ্বাস করতাম না। তবে, আজ কেন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে, তাকে ঘিরে থাকা প্রতিটা জিনিসকে নিজের কাছে রেখে দেই। একদম চিরতরে! তাকে বলি, ‘এগুলো আমার জিনিস। এর সাথে জুড়ে থাকা মানুষটাও আমারই। এর কোনোটাই আমি ছাড়ব না! কক্ষনো না!’ কিন্তু, বলা হলো না। একি তীব্র আত্মসম্মানবোধ? নাকি, অন্যকিছু?
শত শত ভাবনার মাঝেই পরিচিত সেই অস্তিত্ব অনুভব করলাম আমি। তৎক্ষনাৎ পেছন ফিরে তাকাতেই ওনাকে দেখলাম। উনি আলমারিতে কিছু একটা খুঁজছেন। আমি ওনাকে উদ্দেশ্য করে শুধালাম,
“কী খুঁজছেন?”
উনি নিজের কাজ করতে করতেই বললেন,
“নীল রঙের পাঞ্জাবিটা। দেখেছো কোথাও?”
ওনার প্রশ্নের জবাবে আমি কোনো উত্তর দিলাম না। কেবল জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। নীরবে এগিয়ে গিয়ে পাশের কাভার্ড থেকে পাঞ্জাবিটা বের করে ওনার হাতে দিলাম। তারপর, ওনার চোখের দিকে তাকালাম৷ কি শান্ত ওনার দৃষ্টি! আর, আমার? সে ভীষণ অশান্ত। অস্থির! চোখে চোখে বলে দিতে চাইছে কত-শত কথা! জানাতে চাইছে বিষাক্ত যন্ত্রণার কথা! দেখাতে চাইছে নীল সব ব্যথা! কিন্তু, সামনের মানুষটা বড্ড অবুঝ। তার বোঝার সাধ্য নেই! সে নীরবতার ভাষা বোঝে না। তাই, চোখ জোড়া অভিমানী হলো। নিজের কথা লুকিয়ে নিলো। আমি একটু গম্ভীর স্বরেই বললাম,
“আর মাত্র কিছুক্ষণ! এরপর তো নিজের কাজ নিজেরই করতে হবে। সময় থাকতে নিজের সব জিনিস বুঝে নিন। সময় হারিয়ে আফসোস করে লাভ নেই!”
আমার কথার অর্থ উনি বুঝলেন কিনা আমার জানা নেই! তবে, আমার আর কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না। আমি চুপচাপ অভিমানী মন নিয়ে সেখান থেকে সরে আসতে নিতেই উনি ডেকে বললেন,
“তোমার আংটি কোথায়?”
ওনার এই ছোট্ট প্রশ্নটায় আমার বুক কেঁপে উঠলো। উনি খেয়াল করেছেন যে আমান অনামিকা খালি? আমার মনে কিছুটা ভালোলাগা অনুভব হলো। তবে, প্রশ্নের জবাব তো দিতেই হবে। তাই, সেই ভালো লাগার অনুভূতিটা বেশিক্ষণ টিকলো না। আমি মৃদু স্বরে বললাম,
“আংটি খুলে রেখেছি। আজ থেকে তো ওটা আমার নয়। আমার পরার অধিকার নেই। তাই, আংটি তার জায়গায় রেখে দিয়েছি।”
আমার এই কথাটুকুর জবাবে উনি যেই জবাবটা দিলেন, তা কিছুক্ষণ আগের সেই ভালো লাগার অনুভূতিটা মুহূর্তেই উবে গেল। আমার রাগ হলো। অভিমান বাড়লো! কান্না পেল। উনি বললেন,
“ওটা তোমারই। আমি তোমায় গিফট করেছি। ধরে নাও, আমাদের বিয়ে উপলক্ষে নয়। তোমার আর অভ্র’র বিয়ে উপলক্ষে।”
ওনার কথা শুনে আমার মনটা ভেঙে গেল। আচ্ছা, খুব কি ক্ষ/তি হতো যদি উনি বলতেন, ‘ওটা তোমারই। ওটা পরার অধিকারও তোমার। যাও, এক্ষুনি ওটা পরে নাও।’ কিন্তু, উনি তা বললেন না! আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
“ধন্যবাদ, আপনাকে। এমনিতেই অনেক দয়া করেছেন। আর কিছু না করলেও চলবে। ক্ষমা করবেন, গিফটা আমি নিতে পারব না। আপনার সাথে জুড়ে থাকা কিছুই আমার চাই না।”
কথাটা বলে সেখান থেকে চলে এলাম। ড্রেসিং টেবিরের সামনে গিয়ে নুড কালারের লিপস্টিকটা নিলাম। হালকা করে ঠোঁটে লাগিয়ে আবার আগের জায়গায় রেখে দিলাম। তারপর, আয়নায় তাকাতেই দেখলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। দু’জনের চোখাচোখি হলো। আমি চোখ ফেরালাম। উনি বললেন,
“তোমার মুখটা মলিন লাগছে। চোখগুলো লাল। কথাও স্বাভাবিক না। কোনো সমস্যা?”
আমি আবার ফিরে তাকালাম। তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম,
“সবাই সব বোঝে না। সেই ক্ষমতা আল্লাহ্ সবাইকে দেননি।”
তারপর, মৃদু হেসে বললাম,
“এনিওয়ে, কোনো সমস্যা নয়। আপনি রেডি হয়ে নিন। আমরা বের হই।”
উনি জবাব দিলেন না! আমি রুম থেকে বেরিয়ে তাইয়্যেবাহ্’র রুমে গেলাম। মেয়েটা পড়ছিল। আমাকে দেখেই বই বন্ধ করে আমার পাশে এসে বসলো। বলল,
“ভাবী, তোমাকে কেমন যেন লাগছে।”
তাইয়্যেবাহ্’র কথায় আমি ভ্রু কুঁচকালাম। শুধালাম,
“কেমন লাগছে?”
তাইয়্যেবাহ্ চিন্তিত চোখ চেয়ে বলল,
“কেমন যেন মলিন। দুঃখ দুঃখ!”
তাইয়্যেবাহ্’র মুখে দুঃখ সবটা শুনে আমার কপালের ভাজ স্বাভাবিক হলো। মনটা মলিন হলো। তবুও নিজেকে সামলে বললাম,
“আরে, না। শরীর ভালো লাগছে না তেমন।”
কথা শেষ হতেই তাইয়্যেবাহ্ হাত বাড়িয়ে আমার কপাল ছুঁলো। বলল,
“জ্বর নাকি?”
তারপর, হাত নামিয়ে নিয়ে বলল,
“তোমার তো অনেক জ্বর, ভাবী। এত জ্বর নিয়ে বসে আছো কীভাবে? আমি হলে তো সেই কখন বিছানা নিতাম! একদম এক সপ্তাহেও উঠতাম না।”
তাইয়্যেবাহ্’র কথায় আমি হেসে ফেললাম। মেয়েটাে চমৎকার একটা গুন আছে। কথা দিয়ে মানুষকে হাসাতে পারে বেশ। আমাকে হাসতে দেখে বলল,
“আবার হাসছো? চলো, এক্ষুনি রেস্ট করবে তুমি। ভাইয়াকে ডক্টর ডাকতে বলছি আমি।”
তাইয়্যেবাহ্’র কথায় আপত্তি করলাম আমি। বাঁধা দিয়ে বললাম,
“এতটুকু কিছু না। তোর ভাইয়াকে বলতে হবে না। বললে ও বাড়িতে নিবে না। বলবে, রেস্ট করতে। কতগুলো দিন বাবা, আম্মু, ভাই কাউকে দেখি না। ভালো লাগে না। আম্মু আর বাবাকে দেখলে আমি একদম সুস্থ হয়ে যাব।”
আমার কথা শুনে তাইয়্যেবাহ্ থেমে গেল। এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“আপন মানুষদের ছেড়ে থাকা অনেক কষ্টের, তাই না ভাবী?”
তাইয়্যেবাহ্’র কথার জবাবে আমি মাথা নাড়লাম। অস্পষ্ট স্বরে বললাম,
“ভ/য়ানক য/ন্ত্রণার!
তাইয়্যেবাহ্ আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল,
“আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারব না। তাই, আমি বিয়ে করব না।”
তাইয়্যেবাহ্’র কথায় হেসে ফেললাম আমি। বললাম,
“আচ্ছা, করিস না।”
কথাটা বলতেই দরজায় টোকা পড়লো। পেছনে তাকাতেই নীল পাঞ্জাবিতে সেই শুভ্র মানবকে দেখতে পেলাম। কিছু সময়ের জন্য চোখ আটকে গেল তার মাঝে। বলতে গেলে, ছোটখাটো একটা ধাক্কা লাগলো আমার দূর্বল হার্টে! তাইয়্যেবাহ্’র ধাক্কায় ঘোর কা/টলো। ওকে হাসতে দেখে বেশ লজ্জা পেলাম। লজ্জা রাঙা মুখ নিয়ে চোখ ফেরালাম। উনি ভেতরে এলেন। বললেন,
“চলো।”
আমি এক পলক ওনার দিকে তাকালাম। কি স্বাভাবিক তার মুখশ্রী! তবে কি, সত্যি উনি আমায় ভালোবাসেননি? আমি চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। নিজের মনকে বুঝিয়ে তাইয়্যেবাহ্’কে আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম। লাস্ট বারের মতো মেয়েটার মাথায় হাত রাখলাম। ছোট্ট করে চুমু একে দিলাম তার মাথায়। বললাম,
“ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া আর পড়াশোনা করিস, বাচ্চা। সাথে মায়ের খেয়াল রাখিস। ভাবী যাচ্ছি।”
আমার কথা শেষ হতেই তাইয়্যেবাহ্ আমাকে ছেড়ে বসলো। বলল,
“এমনভাবে বলছো যেন চিরকালের জন্য চলে যাচ্ছো। আর কখনো আসবে না! আর, যাচ্ছি কী হ্যাঁ? আসছি বলো।”
ওর আদুরে ধমকে মৃদু হাসলাম আমি। এক পলক তাকালাম ওর ভাইয়ের দিকে। একই মায়ের পেটের ভাই-বোন। দেখতেও প্রায় এক। কতটা মিল দু’জনের। তবে, ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ আলাদা। দু’জন দু’মেরুর। আমি চোখ ফেরালাম। বললাম,
“আসছি।”
কথা শেষে উঠতে গিয়ে বুঝতে পারলাম শরীরটা নির্বোধ লাগছে। তৎক্ষণাৎ মাথাটাও ঘুরে উঠলো। চোখের সামনে ঘোলা হয়ে ঝাপসা হয়ে এলো। আমি টাল সামলাতে না পেরে পরতে নিতেই একজোড়া শক্ত হাত আমায় আঁকড়ে ধরলো। আমার বুঝতে বাকী রইলো না, হাতজোড়া কার! আমার আজন্মের চেনা ছোঁয়া যে! গা জ্বা/লা করা জ্বরের মাঝেও আমার শীতল অনুভূতি হলো। ওনার কন্ঠে উত্তেজনা দেখে অভিমানী মনটা শান্ত হলো। আধো আটকে আসা ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকে পরোখ করলো। সে উত্তেজিত হয়ে বলল,
“এত জ্বর! এত জ্বর কখন থেকে? আমায় বলোনি কেন? আশ্চর্য! জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। অথচ, তোমার কোনো হেলদোল নেই? এত বেখেয়ালি কেন তুমি?”
কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে আমায় কোলে তুলে নিলেন উনি। বক বক করতে করতে এগিয়ে গেলেন আমাদের রুমের দিকে। আমি চোখ জোড়া আর খুলে রাখতে পারলাম না। শক্তি পেলাম না যে! শেষমেশ, বন্ধ করে নিলাম। সে অবস্থাতেও সবটা আবছা শুনতে পেলাম! অনুভব করলাম ওনার উত্তজনা। তার এই উত্তেজনা, এই চিন্তা দেখে আমার অভিমানী মন যে সে কি পৈচাশিক আনন্দ পেল বোঝানো দায়! সে যে কি শান্তি! সে কি আনন্দ! আহ্!
~চলবে…?
(