আরোও_একবার_বসন্ত💔 পর্ব ৪

#আরোও_একবার_বসন্ত
#৪র্থ_পর্ব

বাসায় পৌছাতে পৌছাতে এগারোটা বেজে গেলো প্রিয়ন্তীর। চব্বিশ ঘন্টা টানা ডিউটি করে শরীরটা যেনো চলতেই চাচ্ছে না। কাল রাতে দু ঘন্টা ঘুম হয় নি প্রিয়ন্তীর। এখন নিজ রুমে যেয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিবে সে। কিন্তু বাসায় ঢুকেই দেখলো কিছু মানুষ ড্রয়িং রুমে জড় হয়ে বসে রয়েছেন। জাহানারা বেগম তাদের আপ্পায়নে ব্যাস্ত। শিপন হেসে হেসে কথা বলছে তাদের সাথে। প্রিয়ন্তী ঘরে ঢুকতেই জাহানারা বেগম তাকে দেখে বললেন,
– ওই তো আমার মেয়ে চলে এসেছে। প্রিয়ু এখানে আয় মা।

চব্বিশ ঘন্টা রামগাধার মতো টানা খাটার পর এখন চিড়িয়াখানার অবাককরা জন্তুর মতো মানুষের সামনে নিজেকে প্রদর্শন করতে হবে কথাটা ভাবতেই মাথার বা পাশের শিরাটা রাগে ফুলে উঠলো। মেজাজ এখন অত্যন্ত খারাপ, মোটামোটি সপ্তম আসমানে। দাঁতে দাঁত পিশছে। না জানি কি করে ফেলবে সে। কিন্তু এখানে সিন ক্রিয়েট করাটা বুদ্ধিমানের হবে না। তাই মুখে মেকি হাসি রেখেই তাদের সালাম দিলো প্রিয়ন্তী,
– আসসালামু আলাইকুম
– ওয়ালাইকুম সালাম, আসো আমার পাশে বসো।

সোফায় বসা আনুমানিক চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী একজন ভদ্রমহিলা চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রিয়ন্তীর উদ্দেশ্যে কথাটা বললো। প্রিয়ন্তী মুখে মেকি হাসিটা এখনো বজায় রাখলো। তার বুঝতে বাকি নেই ইনারা কেনো বাসায় এসেছেন। কাল যাদের কথাটা তার মা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছিলেন, ইনারা তারাই। জাহানারা বেগম পুনরায় নিজের মেয়ের বিয়ের জন্য তোড়জোড় করছেন। চার বছর আগের কথাটা যেনো তিনি ভুলেই গেছেন। প্রিয়ন্তী সেখানে বসতেই মহিলাটি বলে উঠলেন,
– তোমার কি ডিউটি ছিলো?
– জ্বী, টুয়েন্টি ফোর আওয়ার ডিউটি ছিলো কাল।
– কয় বছর হয়েছে চাকরির?
– পাঁচ বছর হতে চললো
– আমাদের আবার টাকার অভাব নেই, ভাইয়া দু হাতে টাকা টাকা কামাই করেছে। এখনো আমাদের প্রতিপত্তির অভাব নেই। সুতরাং বিয়ের পরে তোমার চাকরিটা করা লাগবে না। তুমি রিত্তর খেয়াল রাখবে, ভাইয়ার খেয়াল রাখিবে এটাই যথেষ্ট হবে৷ জানোই তো মানুষটি একা। তার এখন একজন সাথীর খুব প্রয়োজন। আর বাড়ির বউ কাজ করবে এটা তো ভালো দেখায় না। আমার ভাবীও গৃহিনী ই ছিলেন।

মহিলা স্পষ্ট কন্ঠে প্রিয়ন্তীকে জানিয়ে দিলেন তাদের বাড়ির বউ হিসেবে তারা কেমন মেয়ে পছন্দ করেন। প্রিয়ন্তীর হাসি পেলো৷ তারা একরকম ঘরে চব্বিশ ঘন্টা কামলা দিবে এমন মেয়ে চান, তাহলে একজন ডাক্তারকে কেনো বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিতে এসেছেন! ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি ফুটিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো সে,
– আমি আপনাকে কি বলে সম্বোধন করবো বুঝছি না, আপুই বলি। একটা প্রশ্ন ছিলো করতে পারি?
– হ্যা করো?
– আমি পেশায় ডাক্তার, সেটা হয়তো মা আপনাদের জানায় নি
– না না তা হবে কেনো? আমরা তো জানি তুমি ডাক্তার। এজন্যই তো আরো আগ্রহী হলাম৷ তোমার মতো শিক্ষিত মেয়ে বাড়ির বউ হবে এটা তো আমাদের সৌভাগ্য
– ওহ, তাই বুঝি? আচ্ছা তাহলে কি আপনাদের বাড়ির হাউসকিপার হতেও সি.ভি তে এম.বি.বি.এস ডিগ্রিটা থাকতে হয়?
– বুঝলাম না ঠিক!

মহিলার মুখের রংটা খানিকটা বদলে গেলো। তার চোখজোড়া সরু হয়ে এলো, ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে এক বিন্দুতে মিললো। চোয়ালজোড়া শক্ত। কন্ঠে কৌতুহলতার সাথে খানিকটা ক্ষোভ। এসব কিছু অগ্রাহ্য করে প্রিয়ন্তী বলতে লাগলো,
– আপু, আমি একজন ডাক্তার। প্রফেশনটাকে প্রচন্ড সম্মান করি আমি। কাগজে সীমাবদ্ধ করে রাখবার জন্য আমি আমার এম.বি.বি.এস ডিগ্রিটি নেই নি। সুতরাং আপনারা চান বা না চান আমি আমার চাকরি ছাড়বো না। আর একটা কথা, আমার এই বিয়েটা প্রথম নয়। এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে। তাই আমার বিয়ে জনিত আগ্রহটি নেই বললেই চলে। তাই প্রথমবারের মতো এই বিয়েতে কোনো রকম ছাড় দিতে রাজী নই। না আমি নিজেকে বদলাবো, না সেটার চেষ্টা করবো। আমি যেমন তেমন ই আমাকে গ্রহণ করতে হবে। আমি আর বসে থাকতে পারছি। অত্যন্ত ক্লান্ত। আমি এখন ঘুমাতে যাবো। তাই আমি উঠছি। সিঙ্গারা ঠান্ডা হচ্ছে। মায়ের হাতের সিঙ্গারা অনেক মজা। খাবেন কিন্তু

বলেই উঠে দাঁড়ালো প্রিয়ন্তী। গটগট করে নিজের রুমের দিকে হাটা দিলো। এক মিনিট ও পিছনে ঘুরে দেখলো না। তাহলে হয়তো ভদ্রমহিলার কালো মেঘে ডাকা মুখটি তার নজরে পড়লো। মহিলা কোনো কথা বললেন না। তার ইগোতে বড়সড় একটা ধাক্কা লেগেছে। তাই সে এই বাড়িতে এক মূহুর্তের জন্য থাকবে না। এখনই বেড়িয়ে যাবেন। শিপন এবং স্নেহার মুখটা পাংশু হয়ে গেছে। জাহানারা বেগম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়ের কথায় প্রতিবাদ করার ফাঁক পাচ্ছেন না। মেয়ে তার দিক থেকে কোনো ভুল কথা বলে নি। প্রথমবার বাবা-মার সম্মান রক্ষার্থে যতটা ঝড় ঝাপটা সহ্য করেছে সেটা মুখে বলার মতো নয়। কিন্তু মেয়েটার বিয়েটা তো দিতে হবে। আর ছেলের সাথে তার আমরণ থাকতে হবে। যাতাকলের মাঝে একরকম পিশছেন তিনি। কেউ যদি এমন হতো যে প্রিয়ুকে ঠিক তার মতো করে ভালোবাসতো, তাহলে হয়তো মেয়েটার জীবনটা এমন ফ্যাকাশে থাকতো না__________

ব্যাগটা টেবিলে রেখে বিছানায় বসলো প্রিয়ন্তী। আবহাওয়া ঠান্ডা, এটা ঝড়ের পূর্বাভাস। ড্রয়িং রুমে যা করে এসেছে তারপর একটা শান্তির ঘুম সে দিতে পারবে সে গুড়েবালি। দরজায় কড়া নাড়লেই তার বুঝতে বাকি রইলো না কে এসেছে। ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– ভেতরে আয়
– ওখানে ওটা কি হলো?

তীব্র গতিতে ঘরের ভেতরে এসেই শিপন ক্ষিপ্র কন্ঠে কথাটা বলে উঠলো। তার ক্ষিপ্রতা কে অগাহ্য করে বললো,
– কি করেছি?
– ওখানে বেয়াদবি না করলে হতো না
– আমি কোনো বেয়াদবি করি নি। আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে আমি সেটা করেছি।
– তুই রীতিমতো বেয়াদবি করেছিস। তুই আসলে বিয়েটা কিভাবে ভেস্তে দিবি সেটাই তোর মাথায় ছিলো। এই বিয়েটা যতই ভালো হোক না কেনো তুই করবি না। এটাই হলো সত্যি। আসলে এর মাধ্যমে আমার একটু প্রমোশন হতো। এটা তোর সহ্য হলো না। তোর সমস্যাটা কি আপু?
– তোদের সমস্যাটা কি?

একরকম চিৎকার করে উঠলো প্রিয়ন্তী৷ এতোক্ষণ সব চুপ করে সহ্য করছিলো। কিন্তু আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
– আমাকে একদন্ড শান্তি দিতে তোদের কি লাগে? কি লাগে? চার বছর আগে তুই কি বাচ্চা ছিলি? জানতিস না কিছু? আমি কতোটা ভঙ্গুর অবস্থায় এখানে এসেছিলাম তোর জানা ছিলো না। আমি একটু নিশ্চিন্তের শ্বাস নিতে চাই শিপন। তোদেরটা খাই না পড়ি না। নিজের শরীরের উপর দিয়ে কি যায় আমি জানি। তার মাঝে আমি ডিউটি করি। নিজেরটাও সাথে মানুষের টাও। যাতে কটা টাকা বেশি পাই। তাতেও তোদের কাছে আমি বোঝা হয়ে গেছি তাই না? কোথায় ছিলি তুই যখন দিনের পর দিন আমাকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলে যেতো। কোথায় ছিলি তুই যখন টায়ফয়েডের মধ্যে আমাকে একটা ঘরে একা একা পড়ে থাকতে হতো? স্বামী থাকতেও না থাকার মতোই ছিলো। কোথায় ছিলি তুই যখন সব কিছু সহ্য করার পরও তাকে অন্য কারোর সাথে আমার দেখতে হয়েছে? কোথায় ছিলি তুই যখন আমি দিনের পর দিন এন্টিডিপ্রেশনের ঔষধ খেয়ে পড়ে থাকতাম। কোথায় ছিলি তুই? তুই না আমার ভাই? এখনই বেড়িয়ে যা আমার ঘর থেকে। যা বের হো

এক রকম ধাক্কা দিয়েই রুম থেকে বের করে দিলো প্রিয়ন্তী তাকে। চার বছরের ক্ষতগুলো যেনো জীবন্ত হয়ে উঠছে। ক্ষত থেকে টুপটুপ করে রক্ত পড়ছে। এই রক্ত কেউ দেখতে পারবে না। এটা শুধু অনুভব করার ব্যাপার। ইরফান নামক কালো অধ্যায়টা এখনো এমন একটা অধ্যায় যার ধার ঘেষতে ও ভয় লাগে এখনো প্রিয়ন্তীর। চোখটা বুঝতেই চার বছরের পুরোনো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

সেদিন ছিলো এপ্রিলের ১৫ তারিখ। দিনটি প্রিয়ন্তী এবং ইরফানের পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী। হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছিলো প্রিয়ন্তী। পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী বলে কথা। ইরফান বলেছিলো আজ সারাটাদিন হবে শুধু তার এবং ইরফানের। কিন্তু অফিসের কাজের জন্য সকালেই বেড়িয়ে পড়েছিলো সে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো কিন্তু ইরফানের ফেরার নাম নেই। তাই প্রিয়ন্তী ভেবেছিলো ইরফানকে একটা সারপ্রাইজ দিলে হয়তো মন্দ হয় না। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তৈরি হয়ে রওনা দিলো ইরফানের অফিসে। সে তো জানতো না সেখানে তার সম্মুখীন হতে হবে বাস্তবতার সাথে। ইরফানের অফিস রুমের সামনে যেতেই………………..…

চলবে

[গতকাল গল্পটি দিতে পারি নি, আব্বুর শরীরটা হুট করেই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ এখন অনেকটাই সুস্থ। পরবর্তী পর্ব আজ রাতে ইনশাল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here