আলো_আঁধার পর্ব ৮

#আলো_আঁধার [৮]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

দীপ্ত আলোকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। আলো দীপ্তকে বলল,

-“তোমার বাড়িতে আমি থাকতে পারব না দীপ্ত।”

-“কেন পারবে না? আমার বাড়িতে থাকতে তোমার সমস্যা কী?”

-“সমস্যা একটা না অনেক। আমি তোমার কেউ হইনা। তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। কোন পরিচয়ে আমি এখানে থাকব? আমি এখানে থাকলে লোকে নানান কথা বলবেই। কয়জনের মুখ তুমি বন্ধ করে রাখতে পারবে? আমি চাই না দীপ্ত আমার জন্য তোমাদের পরিবারের দিকে লোকে আঙুল তুলুক। আমি চলে গেলেই তোমাদের সবার জন্য এমনকি আমার জন্যও ভালো হবে।”

দীপ্ত শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,

-” কোথায় যাবে তুমি? ”

-“হ্যাঁ? ” দীপ্তর দিকে দেখল আলো।

-“যাবার একটা জায়গা বের করতে হবে।”

-“তাহলে যতদিন সেই জায়গা ঠিক না হয় ততদিন আমার বাড়িতেই থাকবে। আর কোন তর্ক না।”

আলো যেন নিজে নিজেই বলছে,

-” আমার একটা চাকরি পেলে বেশ ভাল হত। কিন্তু এই অবস্থায় আমাকে চাকরি কে দেবে? বাবুটা দুনিয়াতে আসা পর্যন্ত আমি তোমার উপর বোঝা হয়ে থাকতে পারব না।”

দীপ্তর এত রাগ লাগছে। তবুও সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে।

-“সত্যিই তুমি জব পেলে করবে?”

-“হ্যাঁ। না করে উপায় কী?”

-“তোমার প্রেগন্যান্সির এখন সাত মাস আলো। এই সময় তুমি চাকরি করার কথা ভাবছ! আর কয়টা মাস বাকি ডেলিভারির। এখন তোমার যতটা সম্ভব জার্নি কম করতে হবে। টেনশন তো একদমই করা যাবে না। আচ্ছা ধরো এখন তুমি চাকরি পেলে। সাধারণ একজন স্টাফকে নিশ্চয়ই অফিস থেকে গাড়ি দিবে না। তুমি রোজ সকাল বিকেল অফিসে যাওয়া আসা করবে কীভাবে ভেবেছ? তোমার এই ছুটাছুটির কারণে যদি বেবীর কিছু হয়ে যায়? তখন নিজেকে কী বলে সান্ত্বনা দিবে?”

আলো চুপ করে আছে। দীপ্তর বলা প্রতিটা কথা সত্যি এটা সে-ও খুব ভালো করেই জানে। এখনই হাঁটাচলায় যে কষ্ট হয়। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। দাঁড়িয়ে থাকলেও পা ফোলে যায়। এই অবস্থায় চাকরি করার কথা ভাবা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু তার কাছে যে আর কোন পথ খোলা নেই।

-“তবুও দীপ্ত। সম্পূর্ণ ভাবে তোমার উপর নির্ভর করে থাকতে আমার মন সায় দিচ্ছে না। তোমার তো কোন দায় পড়েনি অযথা ঝামেলা পোহাবার।”

-” তুমি আমাকে বন্ধু মনে করো তো আলো?”

-“হ্যাঁ, কিন্তু। বন্ধু মনে করি, তবু এভাবে…

-” কোন কিন্তু না আলো। বেবিটা আসা পর্যন্ত নাহয় আমার উপর একটু নির্ভর করো।”

-“তুমি আমাকে ঋণী করে ফেলছ। তোমার এত উপকার আমি কীভাবে শোধ করব বলো তো?”

-“শোধ করতে কে বলেছে? হিসেব করে তুলে রাখ। সময় হলে নাহয় সুদসমেত ফেরত নেব।”

-“তুমি না থাকলে আমার কী হত আল্লাহই জানেন।”

কথাটা আলো আস্তে করেই বলেছে যেন দীপ্তর কানে না যায়। কিন্তু দীপ্ত ঠিকই শুনে ফেলল। শুনে মনে মনে হাসলও।

দীপ্ত আলোকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় মেজো মা’র সামনাসামনি হয়ে গেল। আলোকে দীপ্তর সাথে দেখে মেজো মা খানিকটা হকচকিয়ে গেল। আলোকে উনি এবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন, এই কথা আলো দীপ্তকে বলে দেয়নি তো? দীপ্তর চোখে চোখ পড়লে মেজো মা সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। দীপ্ত মেজো মাকে সরাসরি কিছু না বললেও মনে মনে বলল,

-“তোমাকে আমি এত সহজে ছাড়ব না মেজো মা। তুমি যা করেছ তা আমি জানি। এর শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।
___________________________
-” ওটাতে জিনিসটা আছে তো?”

লোকটা বক্সের মুখ খুলতে খুলতে বলল,

-” হ সাব। আপনে যেমন কইছিলেন, বিষ দাঁত দুইডা ভাইঙা দিছি। কামড়াইলেও মরব না৷ কিন্তু ডর খাইয়া মক্কেল মইরা যাইবার পারে।”

দীপ্ত দেখল কুন্ডলী পাকিয়ে সাপটা বসে আছে। ডালার মুখ ফাঁক হওয়ার সাথে সাথে হিস করে আক্রমণ করার জন্য মাথা তুলে দীপ্ত দিকে তেড়ে আসল।

-” এ ভাই সামলা ওটাকে। আমাকে কাটতে আসছে।’

-‘কাটব না স্যার। বিষ দাঁত তো নাই।’

-“আচ্ছা আচ্ছা। রাখো ওটাকে।’

দীপ্ত রহস্যময় হাসল।

-‘ মেজো মা, তোমাকে আমি মা ডাকি, মা। তুমি আমার ভালো না-ই চাইতে পারো। কিন্তু আমি তো তোমার ক্ষতি চাইতে পারি না। শুধু তোমাকে একটু শাস্তি দিতে চাই। যাতে পরের বার আমার পথে কাঁটা না হও। তুমি তো আমার ফ্যামিলি। কিন্তু আফসোস, এই ফ্যামিলি মানে টাই তুমি জানো না। তোমাকে তো এমনি এমনি ছেড়ে দিতে পারি না আমি।’

-“সাব কিছু কইলেন?’

-” না। এটাকে রেখে তুমি এখন যাও।’

লোকটা চলে গেল। দীপ্ত পকেটে হাত ভরে দাঁড়াল। তার চেহারা কঠিন হয়ে উঠেছে।

-” আমি জানি তুমি পৃথিবীতে এই একটা জিনিসকেই ভীষণ ভাবে ভয় পাও। কিন্তু তুমি যে এর থেকেও বেশি বিষধর। এর থেকে বিপদ অনুমান করে লোকে দূরে থাকতে পারে। তোমার তো মুখে মধু অন্তরে বিষ। তোমার থেকে তো বিপদও অনুমান করা যায় না৷ ব্যাপার না। ওটার যেভাবে বিষ দাঁত ভেঙে দিয়েছি, ঠিক সেইভাবেই তোমার বিষ দাঁতও আমি ভেঙে দেব। তখন তুমি শুধু ভয়ই দেখাতে পারবে। কারো ক্ষতি করা তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না।”
_________________________
মেজ চাচী ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে চুলে চিরুনি বোলাচ্ছে। দীপ্ত দরজার সামনে থেকে দেখল। মৃদু হেসে সাবধানে ডালা টার মুখ খুলে দিয়ে সাপ টাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। বিড়বিড় করে বলল,

-“যা বাবা, তোর কাজ দেখা। পারলে মেজ মা’র পা জড়িয়ে ধরিস। গলা জড়িয়ে ধরতে পারলে আরও ভালো হতো। কিন্তু ব্যাপার না। তুই শুধু মেজ মা’র সামনে গিয়ে কয়েকটা পোজ দিয়ে আয়। তাতেই মেজ মা ফিট খাবে। হার্ট অ্যাটাকও করতে পারে বলা যায় না। সাপে মেজ মা’র ফোবিয়া আছে।’

সাপটাকে ভেতরে দিয়ে আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে নিচে নেমে এলো দীপ্ত। মা বাবা ছোট মা’কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে। দাদাও বাড়িতে নেই। কাজের লোকগুলো দীপ্তর কথা ছাড়া দরজা খুলতে যাবে না। আলোকে নিয়ে বলা যায় না। সে হয়তো মেজ মা’র চিৎকার শুনে ছুটে যাবে। দীপ্ত সোফায় শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ঠিক একটু পরেই মেজ মা’র আকাশ ফাটানো চিৎকার শোনা গেল। ভয়ার্ত আতঙ্কিত গলায় মেজ মা চিৎকার করছে,

-“সা-সাপ। সাপ। ব-বাবা, ও বাবা। কেউ আছো? বাঁচাও। বাঁচাও। ভাবী, বাবা… দীপ্ত কেউ আছো? এটাকে সরাও। এটাকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও।’

দীপ্ত হাসছে। মেজ মা’র চিৎকার শুনতে মজাই লাগছে তার।

-” ব্যাটা অপদার্থ সাপ, মেজ মা’র পা জড়িয়ে ধর না। একেবারে পেঁচিয়ে ধর।’

কারো চিৎকার শুনে আলো ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। সে গিয়ে যখন দরজা খুলে দিল তখন মেজ চাচী জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। সাপটার উপর চোখ পড়তে আলোও চিৎকার করে উঠল। দীপ্ত সাথে সাথে ছুটে এলো। আলো দীপ্তর হাত খামচে ধরেছে।

-“সাপ! রুমে সাপ! তোমার চাচীকে সাপে কেটেছে দীপ্ত কিছু করো। ডাক্তার ডাকো।’

সাপটা ওদের দিকে আসছিল। দীপ্ত ওকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

-” তুমি চলো। নয়তো আমাদেরও কাটবে। আমি কিছু করছি। ভয় পেয়ো না। আমি আছি।”

-“চা-চাচী, উনাকে… এই ঘরে সাপ কোত্থেকে এলো?”

-“তুমি ভয় পেয়ো না। আমি দেখছি। বললাম তো দেখছি আমি৷ তুমি রুমে যাও। মেজ মা’কে আমি দেখছি।”
_________________________
আলোর স্বামী নাসির অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল। তার হাতে ব্যাগ। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে পায়ে হাঁটা ধরল সে। দু’পাশ দেখেই রাস্তা পেরুচ্ছিল লোকটা। হঠাৎ তার পেছনে দাঁড়ানো একটা গাড়ি সোজা এসে তাকে ধাক্কা মারল। নাসির ধাক্কা খেয়ে দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ল। ব্যথা যে গুরুতর পেয়েছে তা তার কাঁকানো শুনেই বোঝা যাচ্ছে। হাত পায়ের হাড়ও হয়তো ভেঙেছে দু-একটা। গাড়ির লোকটা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। মুহূর্তে মানুষ জড়ো হয়ে এখানে।

-“ভাই আপনার লাগেনি তো? আপনি ঠিক আছেন?’

নাসির কথা বলতে পারছে না। কপাল ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে।

-“দোষ আমারই। আমিই আপনাকে দেখিনি। ভাই উনাকে একটু ধরে আমার গাড়িতে তুলে দিন। আমি উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।’

লোকেরা সবাই মিলে ধরে নাসিরকে আগন্তুক লোকটার গাড়িতে তুলে দিল। নাসির ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে গাড়িতে জ্ঞান হারালো। লোকটা তাকে হাসপাতালের রোডে না নিয়ে গিয়ে অন্য রোড ধরল। পেছনে মাথা ঘুরিয়ে নাসিরকে দেখে হাসল। এই ছোটখাটো অ্যাক্সিডেন্ট তো কিছুই না। সবটা তো প্ল্যান করা ছিল। লোকের সামনে থেকে ওকে তুলে আনার জন্য একটা নাটক। তাই জানে বেঁচে গেছে। কিন্তু সে এখন যেখানে যাচ্ছে সেখানে যা ঘটবে তা সবই সত্যি। কিছুই নাটক না। লোকটার কপালে কী আছে ভেবে গাড়ি চালক লোকটা আঁতকে উঠল।

-” বস হুকুম দিলে চোখ মুখ বেধে লোকটাকে এমনিতেই তুলে নিতে পারতাম। অ্যাক্সিডেন্টের নাটক করার দরকার ছিল না। কিন্তু বস সহজে লোকটাকে ছেড়ে দিবে না ভেবে নিয়েছে। তাই তো শুরুটাই এতটা কষ্টদায়ক করল। না জানি পরে কী হবে!”

চলবে____

গল্পটা কি আপনাদের ভালো লাগছে না? আপনাদের তেমন সাড়া পাচ্ছি না। যারা গল্প পড়েন কমেন্ট করবেন প্লিজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here