#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_৪
#খাদিজা_আক্তার
রাত্রি রাগী চোখে দেখছে ইব্রাহিমকে। দেখছে এক পুরুষকে যার মুখনিঃসৃত বাক্য নিজ কানে কত কুৎসিত মনে হচ্ছে। রাগে অন্তর জ্বলে গেলেও কেবল তিন শব্দে রাত্রি উত্তর করল,
—শাড়ি পরা অপছন্দ।
শব্দ করে হেসে ওঠল ইব্রাহিম। বলল,
—শুধু কি শাড়ি অপছন্দ না কি আমাকেও?
রাত্রি প্রতুত্তরে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তার সমস্ত মুখ ঘৃণায় ভরে ওঠেছে আর তা দেখে ইব্রাহিম শক্ত চোয়ালে বলল,
—এ এলাকায় না থাকলেও আমাকে অন্ধ মনে করার কোনো কারণ নেই। আদী নামক গুণ্ডার সাথে ঢলাঢলি করার খবর কিন্তু আমার কানে ঠিকই যায়। আমি সামান্য শাড়ি পরার কথা বলতেই এত ঘৃণা ভাসছে মুখে। তোমার নাগরের সাথে ঢলাঢলি করার সময় এমন ঘৃণা মুখে ভাসে না? দুই দিন বাদে বিয়ে অথচ এখনো সেই গুণ্ডার সাথে এত কীসের মহব্বত? ভেবেছিলাম তোমাকে বিয়ে করব না। আজকে সেটি বলতেই এসেছিলাম, কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি তোমাকেই বিয়ে করব। দেখব বিয়ের পর আমার প্রতি কত ঘৃণা আসে আর ওই আদী প্রতি কত মহব্বত।
এ কথা বলে ইব্রাহিম উঠে দাঁড়াল। মোশাররফ হোসেনের সাথে দেখা করার চিন্তা বাতিল করে বেরিয়ে পড়ল অজানা গন্তব্যে। মনে রাগ থাকলে মানুষ তার নিজ গন্তব্য চট করে ঠিক করতে পারে না; ইব্রাহিমের ক্ষেত্রেও তাই হলো। এদিকে রাত্রির সমস্ত দেহ রাগে কেঁপে ওঠল আর চোখ ভিজে এলো আদীর প্রতি অভিমান করে। রাত্রি বুঝতে পারছে না কেন তাকে এবং আদীকে এক করে ইব্রাহিম এমন নোংরা কথা বলে গেল। রাত্রির সাথে তো আদীর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই যেখানে অন্যের মুখে এমন কটুকথা শুনতে হবে। দিশেহারা অবস্থায় রাত্রি নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করল,
—চারদিকে এত বিতৃষ্ণা কেন ছেয়ে আছে?
*
—অসময়ে বৃষ্টি নামল। এমন চৈত্র মাসে অঝোর ধারায় বৃষ্টি যদি হয় তবে আষাঢ় শ্রাবণ কাকে নিয়ে বাঁধবে ঘর?
যেন নিজেকে প্রশ্ন করল আদী আর কেউ একজন উত্তর দিবে সেই আশায় চুপ করে গেল। ভেজা বারান্দায় এক মগ কফি নিয়ে ব্যস্ত হলো। কালকে ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যাওয়ার পর প্রচুর পানি মাথায় ঢেলেছিল সে। প্রেশার পরে নেমেছিল, কিন্তু শরীর এত দূর্বল করেছিল যে বাকি সময়টুকু প্রায় অজ্ঞান মনে হয়েছিল নিজেকে। সকালে জেগে উঠে দেখে আকাশ মুখভার করে আছে। নিজের ক্লান্ত দেহ নিয়েও রাত্রির কথা তার মনে এসেছিল। মেয়েটি তাকে আর কল করেনি। আদীও যেচে আর খোঁজ নেয়নি, কিন্তু এমন হুট করে যোগাযোগ বন্ধ করা কি যায়? একই গ্রামে বসবাস। রাত্রির বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ঠিকই দেখা হবে আর দেখা হলে মন টালমাটাল হবে খোঁজ নেওয়ার জন্য।
রাত্রি চাপা স্বভাবের হলেও আদীর সঙ্গে তার চপলতা কিঞ্চিৎ যেন দেখা দেয়। একদিন হেসে আদী জিজ্ঞাসাও করেছিল,
—সবার সাথে একদম বোবা হয়ে থাকো অথচ আমার সঙ্গে কথা বলতে বসলেই তোমার মুখে খই ফোটে। আমার বেলায় এমন কেন?
রাত্রি মুচকি হেসে বলেছিল,
—বন্ধুর সাথে চুপচাপ থাকা যায় না। তোমার মতো ভালো বন্ধু পেলে বাকপ্রতিবন্ধীও কথা বলতে শুরু করে দিবে।
আদী পলকহীন চোখে রাত্রিকে দেখেছিল আর কেমন গলায় যেন প্রশ্ন করেছিল,
—রাত্রি, আমি কি কেবলই তোমার বন্ধু?
—না, তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির মধ্যে একজন। যার সঙ্গে কথা বললে আমার সময়-জ্ঞান থাকে না।
এ উত্তর পেয়ে আদী আর কথা বাড়ায়নি। মেয়েটি বড়ো সরল। সব কথার সোজা অর্থ বুঝে নেয় সে। এমন সরল বলেই আদীর বড়ো চিন্তা হয়। কারণ বর্তমান যুগ অতি সরল হলে টিকে থাকা মুশকিল।
সকালের নাস্তা সেরে প্রেশারের ওষুধ নেওয়া হয়েছে। বৃষ্টিও হচ্ছে ফলে আদীর কেমন শীত শীত করছে। পরনের টিশার্ট আর লুঙ্গি দিয়ে ঠাণ্ডার তীক্ষ্ণতা দূর করা যাচ্ছে না। কিন্তু এটি বড়ো উপভোগ্য মনে হচ্ছে আদীর কাছে।
উষ্ণ কফিতে ঠোঁট ছোঁয়াতে গিয়ে আদীর চোখ জোড়া হঠাৎ স্থির হলো পাশের বাসার উঠোনে। অচেনা এক তরুণী পা টিপে টিপে হাঁটছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে। প্রথম দর্শনে অচেনা হলেও এখন একটু একটু করে আদী চিনতে পারছে। এ মেয়েটি হলো মেঘলা। দুই দিন আগেই ওর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সমস্ত আয়োজনে চারপাশ চঞ্চল ছিল। কিন্তু হঠাৎ ঝড়োমেঘ এসে বৃষ্টি নামিয়ে দিলো।
আজ সকালেই আদী তার আম্মার মুখে শুনেছিল,
—মেয়েটার কপাল এত খারাপ হবে ভাবি নাই। বাপ ভাইয়ের কীর্তির জন্য বিয়ে হলো না। লোকের তো দোষ দেওয়ার উপায় নাই। বাপ ভাই যদি জেল খাটে বছরে দুই তিনবার। তবে কোন মা বাপে তার ছেলেকে এমন পরিবারে বিয়ে করতে দেবে?
আদী চুপচাপ শুনেছিল বিনা মন্তব্যে। তবে আজ তরুণীকে দেখতে পেয়ে তার বড়ো মায়া হচ্ছে। দূর থেকে যেই মুখাবয়ব আদীর চোখের সীমানায় ধরা পড়ছে, সে মুখে কোনো হিংস্রতা নেই; নেই কোনো অপরাধের রেশ। শুধুই স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে, ব্যথিত হৃদয় নিগড়ে বেরিয়ে আসা বৃষ্টিস্নাত চোখের জল।
আদীর মন বড়ো খারাপ হয়ে গেল। একই সাথে রাত্রির এবং মেঘলার কথা মনে এসে তাকে কেমন বিমর্ষ করে তুলল। হঠাৎ ঘরের ভেতর ফোন বেজে ওঠল। আদীর মনে হলো রাত্রির ফোন। তাই দ্রুত পায়ে ঘরে এসে ফোন হাতে নিলো, কিন্তু রাত্রি কল করেনি। আদীর মন আরও খারাপ হয়ে গেল। ফোন বিছানায় ছুঁড়ে দিতে গিয়েও রিসিভ করল,
—হ্যালো স্বর্ণালি?
ফোনের ওপাশ থেকে কান্না ভেসে এলো; বয়স্ক মহিলার কান্না। এতে আদীর কপালে ভাঁজ পড়ল,
—হ্যালো? কে বলছেন?
আদী আরেক দফা প্রশ্ন করতেই কান্না জড়ানো কণ্ঠে কেউ একজন বলল,
—বাবা আদী, আমার মেয়ে তো সুই””সাইড করেছে।
—ফুপু, তুমি এসব কী বলছ?
—আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তুমি শীগগির এসো। আমি আমার মেয়ের লা””শও খুঁজে পাচ্ছি না।
—তুমি কোথায় আছ? লা””শ না পাওয়ার কারণ কী? আর স্বর্ণালি সুই””সাইড করতে গেল কেন? পরশু দিনই ওর সাথে আমার কথা হয়েছে। এমন কিছু করতে পারে বলে তো আমার মনে হয়নি।
ফুপু কেঁদেই চলেছেন আর বহুকষ্টে কান্না থামিয়ে থামিয়ে বলছেন,
—আমিও কিছু জানি না। পরশু দুপুরে ওর সাথে আমার কথা হয়। ওর বিকালে স্কয়ার হসপিটালে কোন এক ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। আমাকে বলেছিল রাত হবে ফিরতে আর ফিরে এসে আমাকে জানাবে। কিন্তু কালকে দুপুর হওয়ার পরও আমি ওকে ফোনে পাচ্ছি না। এরপর ওর বোডিঙে চলে এসে জানতে পারলাম ও না কি পরশু রাতে সুই””সাইড করেছে। ওর লা””শ পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ আমাকে বলতে পারছে না কোন মর্গে ওকে পাঠানো হয়েছে। বাবা, আমি চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। তুমি চলে এসো ঢাকায়। আমার মেয়ের লা””শ না পেলে আমি…
পুরো কাহিনি শুনে আদীর মাথা ধপধপ করছে। এতক্ষণ যে শীতলতা তাকে কাবু করছিল। এখন ক্রমশ তা সরে গিয়ে উষ্ণতা অনুভব হচ্ছে। আদীর মনে হচ্ছে তার ব্লাডপ্রেশার বাড়তে পারে, কিন্তু এটি হলে এখন সে ফুপুকে কোনো সহযোগিতা করতে পারবে না। তাই যথাসম্ভব নিজেকে সংযত করে ফুপুকে নিশ্চিত করল নিজের যাওয়ার ব্যাপারে।
পুরো প্রস্তুতি নিয়ে আদী বেরিয়ে পড়ল ঢাকার উদ্দেশ্যে। আপন ফুপাতো বোন সুই””সাইড করেছে— এ বিষয়টি আদীকে পীড়িত করলেও দূরসম্পর্কের ফুপাতো বোনের জন্য আদীর সবচেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে। সে ভেবেছিল বৃষ্টি থামলে ছুটে গিয়ে একবার দেখে আসবে রাত্রিকে। কিন্তু বৃষ্টি মাথায় করে ঢাকা যেতে হবে তা সে কল্পনা করেনি। আসলে প্রকৃতির নিয়ম বড়ো অদ্ভুত। প্রকৃতি যখন যা চাইবে, আমাদের তখন তাই করতে হবে।
(চলবে)#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_৫
#খাদিজা_আক্তার
বোডিঙে গিয়ে আদী জানতে পারল লা”শ পোস্ট””মর্টেম করার জন্য ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে। বড়ো আশ্চর্যের বিষয় এ কথাটি প্রথমে কেউ বলতে রাজি হয়নি। আদী যখন শাসিয়ে বলল,
—নিজেদের ভালো চাইলে বলে দিন স্বর্ণালিকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নয়তো আমি সাজ্জাদকে খবর দিবো। সাজ্জাদ কে তা নিশ্চয়ই জানেন না। পুলিশ ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ, আমার বন্ধু। একবার যদি খবর দিই আর ও এখানে আসে। তবে আসল খবর বের করতে বেশি সময় লাগবে না।
এসব বলেও কাজ হয়নি। কিন্তু একবারে বিফলেও যায়নি। আমতা আমতা করে বোডিঙ সুপার বলল,
—আসলে তাড়াহুড়ো ছিলাম। তাছাড়া আমাদের বোডিঙে এ ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। তাই আমরা সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
এত বিশদ বক্তব্যে আদী বিরক্ত হয়ে বলল,
—আঃ! এত লম্বা পেচাল শুনতে চাই না। আসল কথা বলুন; জাস্ট কুসুমটুকু।
বোডিঙ সুপার মধ্য বয়স্ক মহিলা। উত্তেজিত আদীকে দেখে বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডার দিনেও প্রচুর ঘামছেন। চোখেমুখে তার অস্বস্তি ভাসছে; চোখের দৃষ্টিতে কেমন চোর চোর ভাব। কপালের ঘাম হাতের উলটো পিঠে মুছে জবাব দিলেন,
—মনে হয় ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে গেছে।
—মনে হয়! এত কিছুর পর আপনি কেবল বলছেন মন হয়? এত বড়ো একটা বোডিঙের সুপার হয়ে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলতে আপনার অবাক লাগছে না?
—না মানে… ঢাকা মেডিক্যালেই নিয়ে গেছে।
—তো সেটা এত কাণ্ডের পর বলছেন কেন? সত্যি করে বলুন তো আসল ঘটনা কী? স্বর্ণালির সুই””সাইডের পিছনে আপনার কোনো হাত নেই তো?
আদীর প্রশ্ন শুনে বোডিং সুপার যেন আঁতকে ওঠল। ক্রমাগত হাত নেড়ে বলল,
—এসব কী বলছেন? না না, এসবের মধ্যে আমি নেই। তাছাড়া স্বর্ণালি খুব ভালো ছিল। আমি তাকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করতাম। তাহলে কোন কারণে… না না, আপনি অন্যায় অভিযোগ করছেন। আমার বয়স হচ্ছে। আজ পাঁচ বছর ধরে ডায়াবেটিস হয়ে বসে আছে। ভুল গিয়েছিলাম হসপিটালের নাম। এখন ভালো করে মনে পড়েছে।
বয়সে বড়ো হওয়া সত্ত্বেও আদীকে আপনি সম্বোধন করা সুপারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আদী কঠিন গলায় বলল,
—ঠিক জায়গায় ঠিক জিনিস পড়লে আরও অনেক কিছুই মনে পড়বে। যদি ভুলেও ওর সুই””সাইডের সাথে কারো সম্পর্ক পাই। তবে সব শালাকে জ্যান্ত পুঁতে দিবো।
বোডিং সুপার ভয়ের চোটে আর কিছু বলার সাহস পায়নি। আদীও কথা না বাড়িয়ে ক্রন্দনরত ফুপুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঢাকা মেডিক্যালের উদ্দেশ্য। কিন্তু এখানে এসে আদী জানতে পারল লা””শ পুনরায় বোডিঙে পাঠানো হয়েছে। পোস্ট””মর্টেমের পর লা””শ সাধারণত পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু স্বর্ণালির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ আদীর মাথায় ঢুকছে না।
আদীর ঢাকা পৌঁছাতে দেরি হয়েছে— এ কারণে এমন হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে ফুপুর বলল,
—আমি মাথায় কিছুই ঢুকছে না। পুরো একটা দিন শেষ হতে চলল অথচ আমার মেয়ের মরা মুখটাও এখনো দেখতে পেলাম না। আমি কোন পাপের জন্য এমন শাস্তি পাচ্ছি বলতে পারো? আমার মেয়েই বা কী অপরাধ করল যার জন্য মন বদলে তাকে…
আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে ফুপু কেঁদে ওঠল। কিন্তু আদীর সব কিছুতে কেমন গোলমাল লাগছে। তবে এসব নিয়ে এখন ভাবার সময় নেই। আগে স্বর্ণালির লা””শ পেতে হবে। এরপর গ্রামে নিয়ে যেতে হবে। তারপর মাটির ঘরে পরম যত্নে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে; এ ঘুম ভাঙবে না হাজার বছর পরেও।
*
—রাত্রি আপু, ছাদে কী করছ গো? এমন বৃষ্টির মধ্যে অকারণে নিজেকে ভিজিয়ে দিচ্ছ কেন?
কারো কণ্ঠ শুনে চমকে মুখ ফেরালো রাত্রি। উদাস দুপুরের ন্যায় রাত্রি মুখের আকাশে এক ফালি জ্যোৎস্নার মতো হাসি ফুটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেও থেমে গেল সে। সোজা হয়ে মাথা নামিয়ে কী যেন ভাবল, কিন্তু চুপচাপ থেকে গেল। রাত্রির এমন মুখ ভার দেখে অভি আবার জিজ্ঞাসা করল,
—এই আপু, কী হয়েছে? তোমার কি মন খারাপ?
রাত্রি তাকাল ১৮ বছর বয়সী তার চাচাতো ভাইয়ের দিকে; নামটি হলো অভি। কোমল চেহারার মাঝে ভাসা দুটি চোখ ছেলেটির৷ দেখলেই কেমন মায়া মায়া লাগে; মন ভরে যায় স্নিগ্ধতায়।
—না রে। মন কেন খারাপ হবে?
—এই, তুমি আমাকে মিথ্যা কেন বলছ? আমাকে বোকা মনে হয় তোমার? আমি কিন্তু ঠিক বুঝতে পেরেছি তোমার মন খারাপ।
এবার রাত্রি ম্লান হেসে ওঠল। কিন্তু তর্ক না করে পুনরায় চুপ করে গেল। চারতলার ছাদে দাঁড়িয়ে ভেজা আকাশ দেখতে ব্যস্ত হলো। সবার সাথে যেমন কথা বলা যায় না, তেমন সবার সাথে চুপ থাকাও যায় না। অভির সাথে রাত্রি চুপ থাকতে পারে না বরং মাঝেমধ্যে মনে হয়, এ ভাইটি আছে বলেই তার সাদাকালো জীবন কালেভদ্রে রঙিন হয়ে ওঠে।
—এই আপু, বলো না কী হয়েছে? আদী ভাইয়া কি বকেছে?
অভির এরূপ প্রশ্ন শুনে রাত্রি চমকে গেল। গোল গোল চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
—তোর আদী ভাইয়া আমাকে কেন বকতে যাবে রে? আমি কি তার গরম ভাতে পানি দিয়েছি?
—তা দাও নাই। তবে তোমার বেশিরভাগ মন খারাপের কারণ যে আদী ভাইয়া তা কিন্তু আমি জানি।
একটু যেন পরিহাসের সুর ভেসে ওঠল অভির কণ্ঠে। সেটি টের পেয়ে রাত্রি এবার হালকা রাগ প্রকাশ করে অভির কান টেনে বলল,
—দুষ্টু ছেলে, বোনের ওপর নজরদারি বসিয়েছিস? পড়াশোনার নাম নেই। টেনেটুনে পাশ করিস আবার এখানে পাকা পাকা কথা বলা হচ্ছে আমাকে?
—উহ্! আপু লাগছে গো। কান ছাড়ো।
—কেন ছাড়ব? দুই ভাইতে মিলে আমার জীবনকে করলা ভাজি করছিস। আমি ছাড়ব কেন রে?
অভি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে আর বলছে,
—প্লিজ আপু। ছেড়ে দাও না গো। আর এমন করব না।”
রাত্রি ছেড়ে দিলো। তার এ মুহূর্তে কিছুই ভালো লাগছে না। তাই বড়ো বড়ো পা ফেলে নিচে নেমে এলো। আনমনে রাত্রি ভাবছে আদীর কথা আর তখনই আদীর কণ্ঠ শুনতে পেল। আদী তাকে ডাকছে ভেবে সে খুশি হলো। কিন্তু চারধারে আদীর অস্তিত্ব না পেয়ে বুঝতে পারল এটি তার মনের ভুল। রাত্রি নিজের ঘরে পা বাড়াল, কিন্তু পুনরায় ডাক শুনতে পেল,
—রাত্রি?
সত্যিই কেউ তাকে ডাকছে। তবে সেটি ময়না বেগম। মলিন মুখে ছুটে এসে বললেন,
—স্বর্ণালি না কি সুই””সাইড করেছে।
রাত্রি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
—কোন স্বর্ণালি?
—আরে আমাদের স্বর্ণালি। তোমার রেশমি ফুপুর মেয়ে।
—কিন্তু তুমি জানলে কী করে?
—জানার জন্য আটকে থাকে না কি? মেয়েটা ঢাকায় বোডিঙে থেকে পড়ত। তোর বাবা কত নিষেধ করেছিল মেয়ে মানুষকে ঢাকায় না দিতে। সুই”””সাইড করে এখন বসে আছে। একটা মাত্র মেয়ে। একবার চিন্তা করো তোর ফুপু এবার কীভাবে থাকবে?
ময়না বেগমে বলে চলেছেন, কিন্তু রাত্রির মাথা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নিজেকে সামলে সে কোনোমতে বলল,
—এসব না বললে কি নয়?
—তো বলব না? মেয়েটার লা”শের পর্যন্ত খবর নেই। আদী তার দুইটা বন্ধু নিয়ে খোঁজ করতে গেছে। এমন মেঘলা দিনে ছেলেটার কত কষ্ট হচ্ছে ভাবো।
আদীর নাম শুনেই রাত্রির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। হঠাৎ আসা রাগের অর্থ রাত্রি বুঝতে পারছে না। তবে এ বুঝতে তার অসুবিধা হচ্ছে না, রাত্রি এখন আদী সম্পর্কিত কোনো কথা শুনতে চাইছে না। ফলস্বরূপ সে তার আম্মাকে বলল,
—আমি ঘরে যাচ্ছি, আম্মা।
অবাক চোখে মেয়েকে দেখে ময়না বেগম জিজ্ঞাসা করলেন,
—কী হয়েছে তোমার? দুই দিন ধরে কেমন যেন দেখছি অবশ্য তুমি আজকাল এমনই হয়ে থাকো। পেটে ধরলেও আমি আজকাল তোমায় কেন জানি বুঝতে পারি না।
(চলবে)