আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্ব ৬+৭

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_৬
#খাদিজা_আক্তার

কথা শেষ করেই রাত্রির চিবুকে আলতো করে হাত রাখল ময়না বেগম। তার গলায় আদুরে ভাব, কিন্তু রাত্রি গম্ভীর আর স্থির দৃষ্টিতে আম্মাকে দেখল। মিনিট দুই সময় নিয়ে আম্মার হাত সরিয়ে আবারও বলল,

—আমি ঘরে যাচ্ছি, আম্মা।

রাত্রি আর দাঁড়াল না। মেয়ের চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে ময়না বেগম দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। নিজের গর্ভের সন্তানকেও সর্বদা চেনা যায় না ও জানা যায় না— এ সত্য তার মনের দরজায় টোকা দিতেই সে কেমন বির্মষ হয়ে পড়ল।

*

সব কিছু ঠিকঠাক। গোসল শেষে লা”শের জানাযা এবং কবর দেওয়া হবে। কিন্তু এর মাঝেই হঠাৎ এক অজানা তথ্য সম্মুখে এলো। স্বর্ণালির লা”শকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া রহস্যের মারপেঁচ নিয়ে এখন থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মিজান তালুকদারের বাড়িতে জল্পনা কল্পনা চলছে।

মিজান তালুকদার হলেন আদীর বাবা। স্বর্ণালির লা”শ নিয়ে গ্রামে ফিরতে গিয়ে প্রায় মধ্য রাত হয়ে গেছে। তাই মিজান তালুকদার সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাইকে জানিয়েছিলেন,

—রাত অনেক হয়েছে। তাছাড়া সবাইকে খবর দেওয়া হয়নি। মাঝ রাতে তো আর এসব… কালকে সকাল দশটায় জানাযা হবে।

বড়ো কষ্ট নিয়ে এ কথা বলেছেন মিজানুর তালুকদার। একমাত্র বোনের একমাত্র মেয়ের এমন পরিণতি তাকে বেশ শোকাহত করেছে। তবে পুরুষ মানুষের মন খারাপ করা বড়োই লজ্জার ব্যাপার বলে তিনি মনে করেন। তাই শক্ত গলায় ক্রন্দনরত বোনকে কান্না করতে বারণ করে আদীকে বলেছিলেন,

—আদী, ইমাম সাহেবকে খবর দিয়ে রাখো। কালকে সকাল দশটায় জানাযা হবে।

আদী কেবল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল। মিজানুর তালুকদারের কথা মতো সকালে সমস্ত ব্যবস্থা হয়েছে। স্বর্ণানলির লা”শ যথারীতি মেয়েরা গোসল করিয়েছিল, কিন্তু গোসলের এক পর্যায়ে বিভিন্ন কানাঘুষা শুরু হয়। বাড়িময় চলতে থাকা কানাঘুষা যখন রাত্রির কানে পৌঁছায়, তখন সে বিচলিত হয়ে আদীর সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। রাত্রিকে দেখে আদী নিজের মনে একটুখানি স্বস্তি পেয়েছিল, কিন্তু গম্ভীরমুখের দিকে তাকিয়ে ব্যথিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,

—কল রিসিভ করা হয়নি কেন?

সারাদিন স্বর্ণালির লা””শ নিয়ে অনেক ভুগতে হয়েছিল আদীকে। এত সব করেও রাত্রির জন্য তার মন কেমন করছিল। লা”শবাহী গাড়িতে বসেই সে রাত্রিকে বারংবার কল করেছিল, কিন্তু রাত্রি তার কথামতো আদীর সাথে যোগাযোগ করেনি; কলও রিসিভ করেনি। রাত্রির এমন আচরণে আদীর তখন প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল, কিন্তু এখন তার অন্তরে কোনো রাগ নেই। এ নিষ্পাপ মেয়েটির মুখ দেখলে আদী রাগ করতে ভুলে যায়।

—আমার কথা তোমার কান পর্যন্ত যাচ্ছে না?

রাত্রি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে আদীর ঘরে এসেছে কথা বলতে; চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে নয়। কিন্তু আদীর ঘরে পা দিয়েই রাত্রি সিগারেটের গন্ধ পেয়েছে যা তার মাঝে চাপা রাগের সৃষ্টি করছে। আদীর সিগারেটের নেশা জোড়ালো ভাবে নেই। তবে প্রায়শই নিকোটিনে বুক ভরাতে হয়— এ বিষয়ে রাত্রি অবগত। কিন্তু অপছন্দ হলেও বলার সাহস কই?

গত দুই দিনের মনোমালিন্যের বিষয়টি এখন মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তাই সিগারেটের গন্ধ পাওয়ার মতো বিষয় রাত্রির মাঝে রাগ অভিমান আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আগুনে ঘি ঢালা যাকে বলে।

বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে থাকা আদী এবার উঠে এসে রাত্রির সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল,

—কথা বলছ না কেন?

রাত্রির চোখ মেঝেতে ছিল, কিন্তু এখন আদীর কথা শুনে আচম্বিতে আদীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল,

—এমন শরীর খারাপ হওয়া সত্ত্বেও আপনি সিগারেট খান কেন?

প্রশ্ন করতে গিয়ে রাত্রির গলা ধরে এলো। চোখে একটু একটু করে জল এসে জমছে। রাত্রির ইচ্ছা করছে এ মুহূর্তে ছুটে পালিয়ে যেতে আর কোনো এক নির্জন নদীর তীরে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে। কিন্তু রাত্রি কিছুই করল না। স্থির দৃষ্টিতে আদীর দিকে তাকিয়ে রইল। রাত্রির এমন প্রশ্নে আদী অবাক হলো। অন্য সময় হলে দু’টি কড়া কথা শোনাত৷ কিন্তু এখন সে হেসে ওঠল; বিষাদের হাসি।

—কল করলে রিসিভ করো না। তাহলে আমার শরীরের ভালো মন্দ নিয়ে কেন ভাবছ? আমি মরে গেলে তো তোমার খুশি হওয়ার কথা।

—চিন্তা আমি করছি না। এসব নিয়ে চিন্তা করার মতো লোক আপনার আছে। একটা মেয়ের মরণ হয়েছে। লা””শ এখনো মাটি পায়নি। বাড়ি ভর্তি মানুষ রেখে সিগারেট খেতে আপনার বিবেকে বাঁধেনি?

—এত কাণ্ড করে বেড়ানো লোকের মাঝে তুমি বিবেক খুঁজে বেড়াচ্ছ? তা তোমার তো বিবেক আছে, তাই না? তাহলে সেই বিবেক কি একবারও বলেনি আমার কল তোমার রিসিভ করা উচিত?

—সম্পর্কে সমাপ্তি চেয়েছে কেউ। কারো চাওয়া আমি অপূর্ণ রাখি না।

—তাই না কি রাত্রি? এত মহান তুমি কবে হলে রাত্রি? তোমার মহত্ত্ব অন্ত নেই যখন, সেটা সবার ক্ষেত্রেই দেখালে পারো। সবাইকে খুব মহত্ত্ব দেখিয়ে বেড়ালে। তবে আমার বেলায় তোমার মহত্ত্ব গেল কোথায়? এত করে চাইছি যে জিনিস তা তুমি দিচ্ছ না কেন?

শেষ বাক্যে আদীর গলা ওপরে ওঠল। ক্রমশ সে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে; না, রাগ নয়। রাত্রির প্রতি অভিমানে তার অন্তরে ক্রমাগত ছুরি মারা হচ্ছে। রাত্রি আজ বড়ো স্থির হয়ে আছে। মেয়েটি বোধহয় শিখে গেছে, কীভাবে মনের মধ্যে রাগ অভিমান চেপে পাথর হয়ে কথা বলতে হয়।

—তোমার চাওয়া আমি অপূর্ণ রাখিনি। তুমি সম্পর্কের সমাপ্তি চেয়েছিলে। আমি দিয়েছি। এখন আর কিছু বাকি নেই দেওয়ার মতো।

রাত্রি কথাগুলো বলে মেঝেতে চোখ সরিয়ে নিলো। তার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি দেখতে পাচ্ছে আদী। এক গাল হেসে তাচ্ছিল্যের সুরে আদী বলল,

—এটি আমার চাওয়া ছিল! Grand! কিন্তু এতগুলো বছরে রোজ যে একটা জিনিস চাইতাম, সেটা কি পূরণ করবে না কোনোদিন? না কি সেই যোগ্যতা তোমার নেই?

চট করে আদীর দিকে তাকিয়ে রাত্রি বলল,

—এমন একটি দিনে এসব প্রসঙ্গ টানা খুব দরকার ছিল?

—এমন কঠিন গলায় তোমায় কখনো কথা বলতে দেখিনি। সেজন্যে প্রসঙ্গ নিজে থেকে সামনে এসে যাচ্ছে। এত দিন আমি তোমায় কড়া কথা বলতাম, কিন্তু সময়ের স্রোতে তুমিও…

—আমার অন্য কিছু বলার ছিল। আমি মোটেও আমাকে দেখতে ছুটে আসিনি।

কথাগুলো বলতে গিয়ে রাত্রির গলা একটু কাঁপলো না। আদী এমন রাত্রিকে দেখে ভেতরে বড়ো বেশি দূর্বল হয়ে পড়ছে। তাই বিছানায় আবারও হেলান দিয়ে বসে পড়ল। কিছু সময় ঘরে পিনপতন নীরবতা চলল। এরপর আদী বলল,

—বেশ। তাহলে বলো কী বলতে ছুটে এলে।

—স্বর্ণালির সাথে কিছু হয়েছে।

অবাক চোখে তাকিয়ে আদী শুধালো,

—কিছু হয়েছে বলতে?

—আপনাদের বাড়িতে আসার আগেই শুনেছি, স্বর্ণালির লা””শ পেতে অনেক ঝামেলা হয়েছে। পোস্টমর্টেম করার জন্য ওকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা নিয়েও অনেক রহস্য হয়েছে। অবশেষে না কি ঢাকা মেডিক্যালে ওর লা””শ পেয়েছেন। কিন্তু একটু আগে যারা ওকে গোসল করিয়েছে, তারা অন্য কিছু বলছে।

—অন্য কিছু! অন্য কিছু বলছে; কী বলছে তারা?

—স্বর্ণালির শরীরে পোস্টমর্টেমের সামান্য পরিমাণ চিহ্নও নেই।

—What!

আদী বড়ো বেশি অবাক হলো এবং বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এরপর বলল,

—তুমি কি আন্দাজে কথা বলছ? পোস্টমর্টেম করলে শরীরে চিহ্ন থাকবে না কেন? আর এ পোস্টমর্টেমে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিই তো এত যন্ত্রণা দিয়েছিল। এখন বলছ চিহ্ন নেই। কে বলেছে? কার কাছে তুমি এমন কথা শুনেছে?

—আপনি উত্তেজিত হবেন না। আগে ঠাণ্ডা মাথায় আমার কথা শুনুন। সবাই এটি নিয়ে আলোচনা করছে। কারো মাথায় এ বিষয় ঢুকছে না। তাই আমাকে পাঠিয়েছে আপনাকে জানাতে। তাছাড়া আরও একটি বিষয় আছে।

—কী বিষয়?#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_৭
#খাদিজা_আক্তার

রাত্রি ইতস্ততভাবে জবাব দিলো,

—স্বর্ণালির শরীরে অন্য দাগ আছে।

—অন্য দাগ মানে? কী যা-তা বকছো তুমি?

—আপনি… আপনি বাইরে গিয়ে দেখুন। সবাই কীসব বলাবলি করছে।

—সে না হয় দেখব। কিন্তু আমায় এত পর করে দিলে?

অবাক চোখে তাকিয়ে রাত্রি শুধালো,

—মানে?

—সারাজীবন তুমি করে ডাকতে। আর আজকে সম্পর্কে সমাপ্তি টেনে আমাকে আপনি করে ডাকছ? এত পর করে দিলে আমায়? আমি তোমাকে রাগে ওসব কথা বলি তারমানে কি আমি তোমায় কিছু ভাবতাম না, রাত্রি? আমাদের সম্পর্ক এত তুচ্ছ কবে ছিল?

রাত্রি নিজেও জানে না সে কখনো সম্বোধন পরিবর্তন করেছে। তবে একবার কিছুর পরিবর্তন হলে তা ঠিক করা বড়ো কঠিন বিষয়। এরপরও রাত্রি নিজেকে স্থির রেখে আদীকে পূর্বের সম্বোধনে বলল,

—তোমার সাথে আমার তো দুইটি সম্পর্ক ছিল। প্রথম সম্পর্কে তুমি আমার ফুপাতো ভাই আর দ্বিতীয় সম্পর্কে আমার খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু এসব সম্পর্ক তো তুমি রাখতে চাও না। তাহলে আমি কী করব?

আদী মুখোমুখি হলো রাত্রি। খুব কাছ থেকে চোখে চোখ রেখে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,

—শুধু কি এ দু’টি সম্পর্ক ছিল আমাদের মাঝে? গত এক বছর ধরে দু’টি মানুষ যে একে অপরকে খুব কাছ থেকে জেনেছে তাকে তুমি কী বলবে?

রাত্রি তীক্ষ্ণ চোখে আদীকে দেখে বলল,

—এ দু’টি সম্পর্কের বাইরে আর কী থাকতে পারে? থাকার মতো আমি তো দেখছি না। আর তুমি হয়তো ভুলে গেছ, তোমার ইচ্ছে নেই আমার সাথে সম্পর্ক রাখার। সে সম্পর্ক বন্ধুত্বের হোক বা অন্য কিছুর। তারপর তোমার প্রেমিকা…

—রাত্রি…

আদী ধমকে ওঠল। এতে রাত্রি কিঞ্চিৎ ভয় পেলেও আহামরি কিছু প্রকাশ করল না। আদী সামনে থেকে সরে গিয়ে বলল,

—বুশরা আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসি কিনা জিজ্ঞাসা করেছ আমায়?

—এসব জেনে কী করব আমি? তারচেয়ে স্বর্ণালির বিষয়টি নাড়াচাড়া করে দেখো। তোমার সম্মুখীন হতেও এখন আর আমার ইচ্ছে করে না। অথচ একসময় আমি কত…

সুদীর্ঘ সময় ধরে চেপে রাখা কান্না এবার বাঁধ ভেঙেছে। সেটি লুকানোর জন্য ব্যাকুল রাত্রি নিমিষেই আদীর চোখের আড়াল হলো। কিন্তু এতেও আদীর চোখ এড়ালো না। আদী স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে রাত্রির চোখের নোনা জল। এতে কি তার কষ্ট হচ্ছে? হলেই বা কী। আদী তো আজ পর্যন্ত রাত্রিকে বোঝাতে পারেনি তার অন্তরের চাওয়াটি। তবে একেবারেই চেষ্টা করেনি বললে ভুল বলা হবে। কারণ আদী প্রায়শই রাত্রিকে বলেছে,

—হয়তো তোমার মতো একটি মেয়ে পারে আমার জীবন বদলে দিতে।

*

পুলিশ ইন্সপেক্টর সাজ্জাদকে খবর দেওয়া হয়েছে কারণ সকলে অনুমান করছে স্বর্ণালির সাথে খারাপ কিছু হয়েছে। পোস্টমর্টেম করার কথা উল্লেখ করলেও ঢাকা মেডিক্যালে স্বর্ণালির পোস্টমর্টেম হয়নি আর এ বিষয়টি সবাইকে অনেক বেশি অবাক করেছে। সাজ্জাদ তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে আসল তথ্য খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করবে। কিন্তু তার আগে স্বর্ণালির শরীরের দাগগুলোর রহস্য উন্মোচন করতে হবে। সেটি করার জন্য স্বর্ণালির লা””শ সাজ্জাদ পোস্টমর্টেম করতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন বসার ঘরে বসে সাজ্জাদ সমস্ত বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করছে।

—আদী, আমাকে শুরু থেকে আবার বল। জানিস তো একটি কথা দুইবার না শুনলে সেটি আমি ধরতে পারি না।

স্বর্ণালির সুই””সাইড, লা”শের হদিস পাওয়া নিয়ে ঝামেলা, রাত্রির সাথে মনোমালিন্য, স্বর্ণালির মৃত্যু নিয়ে নতুন রহস্য— এসব বিষয় একের পর এক ঘটে গেছে বলে আদী এখন বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার দেহে প্রাণ আছে, কিন্তু মন নেই।

—আদী? ওই শালা, ঝিম মেরে আছিস কেন?

আদী নড়েচড়ে বসে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

—ভাবছি।

—ভাবিস না। আমি দেখছি কী করা যায়।

—কী আর করবি? কতদিন খুব ইনভেস্টিগেশন হবে। এরপর সব শেষ। ফুপু কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মেয়ে মৃত্যুর চেয়ে এ সংবাদ তাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। এত পরিমাণ দূর্বল হয়েছে যে এখন স্যালাইন দিয়ে বিছানায় ফেলে রাখতে হচ্ছে।

আদীর কথা শুনে সাজ্জাদের মুখ লজ্জায় রক্তিম হলো। চোখ জোড়া আপনাআপনি নেমে গেল। পুলিশ সম্পর্কে এ ধরনের চিন্তা অধিকাংশ মানুষের আছে। তাই সাজ্জাদ বিতর্কে না গিয়ে বলল,

—আমাদের ডিপার্টমেন্টের বদনাম আছে— এ আমি জানি। কিন্তু আমি চেষ্টার কমতি রাখব না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলিস না। দয়া করে আমাকে সবটুকু বল।

আদী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে রাজি হলো,

—ঠিক আছে। আমি গোড়া থেকে বলছি। তুই মনোযোগ দিয়ে শুনিস।

—হুঁ।

—স্বর্ণালির সাথে ফুপুর কথা হয়েছিল দুই দিন আগে। ও জানিয়েছিল ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা; স্কয়ার হসপিটালে। বলেছিল বোডিঙে ফিরে এসে ফুপুকে জানাবে, কিন্তু ওর কোনো খবর নেই। এরপর যেমন করেই হোক ফুপু জানতে পারে ও সুই””সাইড করেছে। ফুপু বোডিঙে ছুটে যায়, কিন্তু ওর লা””শ না পেয়ে আমাকে খবর দেয়। আমি গিয়ে সবাইকে জিজ্ঞাসা করি, কিন্তু কেউ ওর হদিস দিতে রাজি হয়নি। এরপর নানা ভয় দেখানোর পর বোডিং সুপার মুখ খোলে। জানতে পারি ওকে ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়েও একই সমস্যা। কেউ ওর সম্পর্কে কিছুই জানে না। এরপর সেখানেও অনেক হাঙ্গামা করার পর লা””শ পাই। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় তাই বাবা বলেছিল আজকে দাফন করতে। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু হঠাৎ জানতে পারি ওর শরীরে কাটাছেঁড়ার পরিবর্তে অন্য দাগ রয়েছে। আমার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। আচমকা তোর কথা মনে পড়ল আর কল করলাম।

এ বলে আদী থামতেই সাজ্জাদ বাহবা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠল,

—পারফেক্ট কাজ করেছিস। দেখ, আমি ওর ডেড””বডি দেখেছি। গলায় মারাত্মক একটি লালচে দাগ আছে। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ও গলায় দড়ি দিয়েছে। তবে শরীরের দাগ নিয়ে যা আশংকা করা হচ্ছে। এতে কেস দুই দিকে যেতে পারে। এক, হয় ওকে কেউ পাশবিক নির্যাতন করার পর ছেড়ে দিয়েছে আর ও বোডিঙে ফিরে গলায় দড়ি দিয়েছে। দুই, কেউ ওকে নির্যাতন করেও স্বস্তি পায়নি তাই শেষ শান্তি খুঁজে পেতে গলায় দড়ি পরিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে।

—এমন জঘন্য বিষয় আমি ভাবতেই পারছি না। ও বড়ো মেধাবী ছাত্রী ছিল। অনেক শখ করে ফুপু ওকে ঢাকায় পড়তে পাঠিয়েছিল। কিন্তু শেষে এমন হবে তা কি তিনি জানতেন?

সাজ্জাদ উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলো আদীর কাছে। একটু ঝুঁকে কাঁধে হাত রেখে বলল,

—আমাদের ভাবনা সবসময় আমাদের মতো করে চলে না রে। Life is so difficult. চিন্তা করিস না পোস্টমর্টেমে কিছু জানতে পারলে আমি তোকে জানিয়ে দিবো। বন্ধুর বোন তো আমারও বোন।

সাজ্জাদের শেষ বাক্যে দরদ ভেসে এলো আর সেটি শুনে আদী অবাক চোখে তাকাল। সাজ্জাদ আদীর চেয়ে দুই মাসের বড়ো। আদীর কৈশোর কেটেছিল সাজ্জাদের সাথে। এরপর সাজ্জাদ তার নানার বাড়ি চলে যায় লেখাপড়া করতে। যোগাযোগ ছিল, কিন্তু বড়োই অল্প। কথা হতো প্রায়শই আর কথা বলতে গিয়ে আদীর মনে হতো সাজ্জাদের মন মাটির তৈরি নয়, পাথরের তৈরি। এত বছর ধরে আদী মেনে এসেছে সাজ্জাদ এক পাথুরে মানবের নাম। কিন্তু আজকে এ পাথুরে মানবের মাঝে নরম একটি মন দেখে আদী বড়ো বেশি অবাক হলো। তবে স্বস্তিতে তার মন ভরে গেল। মনে মনে আদী ভাবল,

—তাহলে তোর মন পাথুরে নয়, মাটির তৈরি। কিন্তু সাজ্জাদ, আমি কীসের তৈরি রে? রাত্রির প্রতি আমার মন কীরূপে প্রকাশ পায়? পাথর না কি মাটি?
(চলবে)
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here