ইট পাটকেল পর্ব -২৭+২৮

#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২৭

রাতের আকাশে অজস্র তারার মেলা বসেছে।চারিদিকের ভ্যাপসা গরমের কারনে সবার জীবন ওষ্ঠাগত। ছাদের দোলনায় বসে গরমের তীব্রতা আন্দাজ করতে পারছে নূর। সারাদিন এসির ভেতর থেকে গরমের তীব্রতা উপভোগ করার সুযোগ হয় না।পূর্বপুরুষদের অর্জনের জন্য এই বিলাসবহুল জীবন তার।কি হতো যদি এতো বিলাসিতা না থাকতো?আর পাচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো তারাও না হয় সংগ্রাম করে বেচে থাকতো।দামী গাড়িতে না চড়ে লোকাল বাসে চড়ে সবার মতো সাধারণ জীবন যাপন করতো। দিন শেষে আপন মানুষগুলো কে পাশে তো পাওয়া যেতো। কি হবে এতো অর্থ পতিপত্তি দিয়ে।আভিজাত্য যদি দিন শেষে নিঃসঙ্গতা দেয় সেই আভিজাত্য তো অভিশাপ স্বরুপ। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নূরের।পেটে হাত রেখে অনুভব করলো নিজের অস্তিত্ব কে। মা হওয়ার সংবাদ তাকে আশমিন ই দিয়েছে। চোখে মুখে তার কি নিদারুণ জোত্যি ছিল।ভাবতেই নূরের ঠোঁটে বিষাদের হাসি ফুটে উঠলো। কি হতো তাকে একটু ভালবাসলে? মিথ্যা ভালবাসি না বলে সত্যি ঘৃণা করি বলে নাহয় গু*লি ই করে দিতো।মৃ*ত্যু যন্ত্রণা হয়তো এই মিথ্যার যন্ত্রণার থেকে কম ই হতো। এই যে ক্ষনে ক্ষনে বুক ভারি হয়ে আসে।কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে থেকে মরণ যন্ত্রণা দেয়।এর চেয়ে কি মৃত্যু ভালো ছিল না?
আহা কষ্ট! এই কষ্ট তার পিছু কেন ছারছে না?আর কতটা যন্ত্রণা ভোগ করলে কষ্ট তাকে রেহাই দিবে?

— এখানে কি করছো নূর?

আমজাদ চৌধুরীর কথায় চোখ তুলে তাকালো নূর।বিষাদমাখা হাসি দিয়ে আবার আকাশ দেখায় মন দিলো। আজকাল কাউকে তার সহ্য হয় না। আসেপাশের সবাইকে প্রতারক মনে হয়। এতো মানুষের ভিড়ে তার কেন একজন আপন মানুষ নেই এই ভেবেই দিনের অর্ধেক টা সময় কেটে যায়।

আমজাদ চৌধুরী এসে নূরের পাশে বসলো। নূরের মলিন চেহারা দেখে ক্লান্ত শ্বাস ছাড়লো। কিছু না করেও এই মেয়েটাকেই সব কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। নিয়তি এতো নিষ্ঠুর কেন?

— রাত হয়ে গেছে তো মা।এই সময়ে এভাবে এখানে বসে থাকতে নেই।

— ঘরেই যদি জান নেয়ার মানুষ থাকে তাহলে বাইরে আর কিসের ভয়?

আমজাদ চৌধুরী হচকচিয়ে গেলো। হতভম্ব গলায় বলল,

— কি বলছো মা?

— একটা গল্প শুনবে আংকেল? এক অভাগী রাজকুমারীর গল্প।

আমজাদ চৌধুরী শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। নূর হালকা হেসে বলতে শুরু করলো,

— এক দেশে এক রাজকুমারী ছিল।রাজা রানীর চোখের মনি। হেসে খেলে তাদের জীবন পার হচ্ছিল। একদিন হুট করেই তাদের জীবনে অতীত হানা দিল।রাজার বোন প্রেমে পড়েছিল এক ভীনদেশী যুবকের।রাজার অগোচরে রেজিষ্ট্রি করে বিয়েও করেছিল তারা।
একমাত্র বোনের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি রাজা।ক্ষুব্ধ হয়ে বোনের কাছে গেলো জবাব চাইতে। বোন নিজের ভালোবাসার কথা জানালে রাজা তাদের মানতে অস্বীকৃতি জানান। বোন ও জেদ ধরে রাজার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়।রানী দুজন কে থামাতে ব্যর্থ হলে রাজার বোন কে বোঝায় আপাতত রাজার কথা মেনে নিতে। বোন তাকে অপমান করতে পিছ পা হয় না। বড় বোনের মতো ভাবির গায়ে হাত তুলতে ও পিছ পা হয় না। প্রেয়সীর গায়ে আঘাত সহ্য করতে পারে না রাজা।সকল রাগ গিয়ে জমা হয় ভীনদেশী যুবকের উপর। আঘাত করে বসে বোনের স্বামী কে।দুর্ঘটনা বশত মৃত্যু হয় তার। স্বামীর মৃত্যুর শোকে নিস্তব্ধ হয়ে যায় বোন। মৃত্যুর কারণ ধামাচাপা দিলেও বোনের নজরে থেকে যায় আজীবন দোষী। দুই মাসের অন্তসত্তা বোন কে নিয়ে বারবার আফসোস করতে থাকে রাজা।বোনের নীরবতা তাকে বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে নিজের অপরাধ দেখিয়ে দিচ্ছিলো। হাতে পায়ে ধরেও ক্ষমা পায় নি সে। নয় মাস পরে এক ফুটফুটে ছেলের জন্ম দেয় সে। ছেলে জন্ম দেয়ার তিন মাস পর বিয়ে করে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড কে। যাকে ভালোবাসলেও আজ পর্যন্ত স্বামীর অধিকার দিতে পারে নি। নিজের প্রথম ভালবাসাকে ভুলে এগিয়ে যেতে পারে নি সে। ছেলে কে সব সময় নিজের থেকে দূরে রেখেছে সে।ছেলের মুখের আদল বারবার তাকে তার ভালবাসার মানুষ টির কথা মনে করিয়ে দিতো। যাকে তার ভাই খু*ন করেছে। প্রতিশোধের আগুনে বারবার নিজের স্বত্তা কে জ্বালিয়ে ভাইকে ধ্বংসের খেলার নেমেছে সে। ক্ষমা করার ভান করে তাকে বারবার আঘাত করেছে।ঠান্ডা মাথায় তার প্রিয়তমা স্ত্রী কে খু*ন করে এক্সিডেন্ট বলে চালিয়ে দিয়েছে। দেখাশোনার নাম করে রাজার আদরের রাজকুমারী কে চাকরানীর মতো ট্রিট করেছে। প্রথম স্বামীর বোন কে দিয়ে রাজা কে সিডিউস করেছে। সেই সন্তানদের কেই তাকে ধ্বংস করার কাজে লাগিয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিজের ছেলেকে দিয়ে,,,,(তাচ্ছিল্যের হেসে)

আচ্ছা আংকেল, এক ভুলের কতো শাস্তি হয় বলো তো? অনুশোচনার চেয়ে বড় শাস্তি কি এই পৃথিবীতে আর কিছু আছে? এখন রাজকুমারী যদি প্রতিশোধ নিতে চায়! তার মাকে খু*ন করার প্রতিশোধ, তার শৈশব, কৈশোর নষ্ট করার প্রতিশোধ, মিথ্যা সম্পর্কে বেধে দেয়ার প্রতিশোধ, ভালবাসার নামে ঠকানোর প্রতিশোধ, তাকে এই পৃথিবীতে পুরোপুরি এতিম করে দেয়ার প্রতিশোধ, তাকে প্রতারণার মতো মরণ যন্ত্রণা দেয়ার প্রতিশোধ। তখন রাজকুমারী অপরাধী হবে না তো? কিছু না করেও সেই তো সবচেয়ে বেশি শাস্তি পেলো।তার প্রতিশোধ নেয়া অন্যায় হবে না তাই না?

আমজাদ চৌধুরীর চোখ দিয়ে অঝর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পরছে।নূরের দিকে তাকানোর সাহস নেই তার।এই তিক্ত সত্যি গুলো নূর কিভাবে জানলো তা নিয়েও মাথা ব্যথা নেই। আশমিন তার ছেলে না হলেও সে তাকে জীবনের চেয়ে ও বেশি ভালোবাসে। নিজের বুকে রেখে মানুষ করেছে তাকে।কখনো বুঝতে দেয় নি সে তার নিজের ছেলে না। একটা সময় এসে আশমিন ও সত্যি টা জেনে যায়। সত্য হচ্ছে সূর্যের আলোর মতো। হাজার মেঘের আড়ালে ঢাকা পরলেও তা একসময় প্রকাশ পাবেই। আশমিন সত্যি টা জানলে ও সবসময় না জানার ভান করে থেকেছে। আগের চেয়ে বেশি তার সাথে শুরু করে। বন্ধুর মতো মিশেছে তার সাথে। এক সিগারেট দুই জন ভাগ করে খেয়েছে কতো। তার বাবা হয়ে সে এখনো ভার্জিন সেই আফসোসে কতো কতো হতাশার শ্বাস ফেলেছে। শুধু মাত্র কামিনীর প্রতিশোধের নেশা সব কিছু শেষ করে দিল। নূরের অসমাপ্ত কথার রেশ প্রমান করছে সে আরো অনেক কিছু জানে।আর চুপ থাকার মেয়েও সে না।ছেলের জন্য বুকের ভিতর আনচান করতে লাগলো আমজাদ চৌধুরীর। সে জানে তার ছেলে কতটা হিংস্র। ঠান্ডা মাথায় বাঘ শিকার করার মতো ছেলে তার।

আমজাদ চৌধুরীর ভয়ে চুপসে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো নূর। তাকে আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে বললো,

— চিন্তা করো না আংকেল।আমি প্রতিশোধ নিবো না।প্রতিশোধ শুধু ধ্বংস করে। আমি চাইনা আমার সন্তান আমার মতো জীবন পাক। মন্ত্রী সাহেব কে কিছু জানিয়ো না। সম্পর্কে আর কোন দূরত্ব চাই না আমি। স্বামী সন্তান নিয়ে শান্তিতে সংসার করতে চাই।

আমজাদ চৌধুরী স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। নূরের দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ভরাট গলায় বললো,,

— কষ্ট পেয়ো না মা। সব কিছু বাদ দিলেও এ কথা সত্যি, আশমিন তোমাকে পাগলের মতো ভালবাসে।ওর ধ্যান ধারণা একমাত্র তুমি। তোমার শূন্যতা ওকে কতটা উন্মাদ করে দেয় তা সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই। ওকে কষ্ট দিয়ো না।তারাতাড়ি নিচে চলে এসো।আশমিন এসে তোমাকে এখানে দেখলে রাগ করবে।

নূর মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।আমজাদ চৌধুরী ধীর পায়ে নেমে গেলো ছাদ থেকে। নূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,,

— যে ভালবাসা আমাকে বারবার আঘাত করছে সে ভালবাসা দিয়ে আমি কি করবো আংকেল?আমি তাকে কষ্ট দিবো না। সে নিজেই তার কষ্টের কারণ হবে।সব থেকেও সে থাকবে নিঃস্বঙ্গ।যে বিষাদের সাগরে সে আমাকে ফেলে দিয়েছে সেই বিষাদের স্বাদ সে পাবে না তা কি করে হতে পারে? আশমিন জায়িন চৌধুরী যদি তার মায়ের ছেলে হয় তাহলে তেহজিব নূর শিকদার ও তার বাবার মেয়ে।ধোকার পাল্টা জবাব দেয়া তার রক্তের বৈশিষ্ট্য।

— বউ,,,

আশমিনের ক্লান্ত গলা শুনে চোখ তুলে তাকালো নূর।সাদা পাঞ্জাবি তে রাজপুত্রের মতো লাগছে আশমিন কে। মুচকি হেসে হাত বারিয়ে দিল নূর।আশমিন নূরের হাত ধরে ধপ করে এসে বসে পরলো নূরের পাশে। নূরের হাতে চুমু খেয়ে এক হাতে জরিয়ে ধরলো তাকে।নূর ও বিড়াল ছানার মতো গুটিশুটি মেরে আশমিনের বুকে গা এলিয়ে দিলো।

— ছাদে আসতে নিষেধ করেছি না? এতো গুলো সিরি বেয়ে উঠতে কষ্ট হবে তো তোমার। আমি যখন বাসায় থাকবো তখন আমাকে বলবে।আমি কোলে করে নিয়ে আসবো তোমাকে।

আশমিনের কুচকানো মুখ দেখে হেসে ফেললো নূর।কাধে থুতনি ঠেকিয়ে নির্মিশেষে তাকিয়ে রইলো আশমিনের ক্লান্ত চেহারার দিকে।

— এভাবে তাকিয়ে থেকো না তো।আমার লজ্জা লাগে।

— আপনার লজ্জা ও লাগে(অবাক হয়ে)?

— আমি খুব লাজুক ছেলে বুঝলে? প্রথম যেদিন তোমাকে গভীর ভাবে ছুয়েছিলাম সেদিন আমি দুই সেকেন্ড লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ছিলাম। ভাবা যায়! ইসসস,,এতো লজ্জার জন্যই তো সুখবর পেতে বারো দিন দেড়ি হলো। এতো লজ্জা নিয়ে তো বছর বছর বাবা হতে পারবো না।কেমন বউ তুমি?বরের লজ্জা ভাঙ্গাতে পারো না।

নূর হতভম্ব হয়ে রাগ করতেও ভুলে গেলো। দুই মিনিট আশমিনের গলা চেপে ধরার অদম্য ইচ্ছা টাকে ঘুম পারিয়ে হতাশার শ্বাস ফেললো।
#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২৮

চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির বিলাসবহুল কেবিনে বসে আছে আশমিন। শান্ত মুখে পরাজয়ের ছাপ স্পষ্ট। তার সামনেই আমজাদ চৌধুরী বসে ছেলের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে।

— সব কিছু জেনেও এভাবে হাতে হাত রেখে বসে আছো কেন? ও তোমাকে আঘাত করবে আশমিন।বাবা হতে চলেছো তুমি।নিজেদের মধ্যে সবকিছু মিটিয়ে নাও।

আশমিন চোখ তুলে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। শান্ত গলায় বললো,

— ও আমাকে ঘৃণা করে আব্বু।যতটা ঘৃণা করলে একটা মানুষের হৃদয় ছিন্নভিন্ন করে দেয়া যায় ও আমাকে ঠিক ততটা ঘৃণা করে। আমি প্রতিটি মুহুর্ত তা অনুভব করতে পারি।

— তাহলে কি তুমি এভাবেই সব কিছু চলতে দিবে? রাগের বসে ও যদি নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলে?বাচ্চার সাথে ও তো কিছু করে ফেলতে পারে।যে তোমাকে ঘৃণা করে সে তোমার বাচ্চাকে ও তো ঘৃণা করবে।বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?(অস্থির হয়ে)

আমজাদ চৌধুরীর অস্থিরতা দেখে মুচকি হাসলো আশমিন। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে শান্ত চোখে তাকালো তার বাবার দিকে।

— ভুল ভাবছো তুমি আব্বু।ও কখনো আমাদের সন্তানের কোন ক্ষতি করবে না। ও আমার একার সন্তান না।ও নূরের ও সন্তান।আমি হয়তো এখনো ওকে অনুভব করতে পারি নি।কিন্তু নূর প্রতি মুহুর্তে ওকে অনুভব করছে। একজন মা কখনো তার সন্তানের ক্ষতি চাইতে পারে না।আমার প্রতি যতই ঘৃণা থাকুক না কেন,নিজের সন্তান কে অবহেলা করবে না ও। আর আমার প্রতি ঘৃণা টা কি অযোক্তিক আব্বু?

আমজাদ চৌধুরী চুপ হয়ে গেলেন। নিজেকে তার খুব অসহায় মনে হচ্ছে। রাফসান শিকদার ভুল ছিল।সে ইচ্ছে করে কামিনীর স্বামী কে মারে নি। ওটা একটা দূর্ঘটনা ছিল। এক প্রতিশোধের জন্য কামিনী নূরের মা কেও মেরে ফেলেছে। এর পরেও সে থেমে থাকে নি।রাফসান চৌধুরী কে ও ছাড়েনি সে। নূরের মায়ের এখানে কোন দোষ ছিল না। সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চেয়েছিল।কামিনী কে রাফসান শিকদারের কথা মেনে নিতে বলেছিল যাতে পরবর্তীতে রাফসান শিকদার কে বোঝানোর কিছুটা সময় পায়।কিন্তু বরাবর উগ্র মেজাজের কামিনী তাকেই আঘাত করে বসলো।পরিস্থিতি খারাপের দিকে একমাত্র কামিনী চৌধুরীর ঔদ্ধত্যের কারনে গিয়েছে। সে কামিনী কে বিয়ে করেছে তাকে আগলে রাখার জন্য। তার প্রখর ভালবাসা কামিনী বারবার উপেক্ষা করে গিয়েছে। কামিনী চৌধুরী যে তাকে ভালবাসে না তা কিন্তু না। কিন্তু তাদের মাঝে সারাজীবন দেয়াল হয়ে রয়ে গেলো তার প্রাক্তন। কামিনী চৌধুরীর প্রত্যেক টা অন্যায় জানার পর বারবার মুষড়ে পরেছেন।বাধা দিতে গিয়ে তার রোষানলে পড়তে হয়েছে।প্রচন্ড ভালবাসার কারণে আইনের হাতে তুলে দিতে পারেনি।আজ তার প্রখর ভালবাসা ই কাল হয়ে দাড়ালো। তার আবেগে ভেসে যাওয়ার কারনেই এতো গুলো জীবন নষ্ট হয়ে গেলো।

— বাসায় যাও আব্বু। সব কিছুর উর্ধ্বে আমি নূর কে ভালবাসি।ও আমাকে ঘৃণা করুক বা ভালবাসুক। আমার সাথেই ওকে থাকতে হবে। এই জীবনে ওর আমি থেকে মুক্তি নেই।

আমজাদ চৌধুরী মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন।কামিনী চৌধুরী ফিরে এসেছে কানাডা থেকে।আমজাদ চৌধুরী আমতা আমতা করে বললো,

— তোমার আম্মু যদি,,

আশমিন ঠান্ডা চোখে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। হিমশীতল গলায় বলল,

— নিজের বউ সামলে রেখো আব্বু।আমি মানুষ টা মোটেও সুবিধার নয়। প্রচন্ড স্বার্থপর মানুষ আমি।আমার স্বার্থে আঘাত লাগলে কেউ ছাড় পাবে না।

আমজাদ চৌধুরী ভয়ার্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। ছেলে কতটা সিরিয়াস তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমজাদ চৌধুরী ঘাড় নেড়ে চলে গেলেন।

আশমিন উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দেয়ালের দিকে। সে কোন ভুল করে নি।সেদিক থেকে বিবেচনা করতে গেলে নূর ও কোন ভুল করছে না।তাহলে ভুলটা কার?বুকের ভিতর অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলো আশমিনের।নিজের অস্থিরতা কমাতে তার বউ দরকার। অস্থির পায়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল আশমিন। না জানি বউ তার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র করছে।তাই বলে সে তো আর তাকে একা ছেড়ে দিতে পারেনা।

সাত মাসের পেট নিয়ে অফিসে এসেছে নূর। এই কয়েকমাসে তার বিশ্বস্ত কয়েকজন খু*ন হয়েছে।দুটো পোশাক কারখানায় আগুন লেগেছে।রাতের আধারে কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবেই যে সব করেছে তা সে জানে। মেশিন সব পুড়ে গেলেও মাল সব অক্ষত ছিল। প্রতিদিনের মালামাল সবার অগোচরে নূর কারখানা থেকে সরিয়ে ফেলতো। কয়েক কোটি টাকার মাল বেচে গেলেও মেশিন গুলো আর বাচাতে পারে নি।ক্ষতির পরিমান টা তাই একটু কম হয়েছে। তাই প্রতিটি কারখানায় কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করেছে নূর।নিজেই সব মনিটরিং করছে। আশমিন বাধা দিলেও আমলে নেয়নি। বাড়িতে থাকা এখন তার জন্য আরো বেশি অনিরাপদ। কামিনী চৌধুরী কখন কিভাবে তার ক্ষতি করে ফেলবে তার নিশ্চয়তা নেই।

— আসবো ম্যাম,,

নূর ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তাকালো। অমি ক্লান্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

— না। আসবে না। কতো বার ম্যাম বলতে নিষেধ করেছি?

অমি বোনের অভিমান দেখে মুচকি হাসলো। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বললো,

— আপনি সব সময় আমার ম্যাম হয়েই থাকবেন। আমি এতেই কমফোর্ট ফিল করি।

নূর মুখ ফুলিয়ে নিশ্বাস ছাড়লো।

— আচ্ছা সেসব বাদ দাও।কাজ হয়ে গেছে?

— হুম।আশিয়ান এসেছিল। সব স্বিকার করেছে সে।

নূর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো। শরীর টা ইদানীং খুব খারাপ যাচ্ছে। পা গুলো অসম্ভব ফুলে উঠেছে।রাতে ঘুম হয় না ভালো করে। আশমিন ও তার সাথে জেগে থাকে।তার মন ভালো করার চেষ্টা করে। নূর কিছু নিয়ে আবদার করে না আশমিনের কাছে। যা দরকার হয় নিজেই করে নেয়। এর জন্য আশমিনের অভিযোগের শেষ নেই।

— শরীর খারাপ লাগছে ম্যাম?

— নূর মাথা নেড়ে সায় জানালো। অমি অস্থির হয়ে নূরের কাছে গেলো। পাশের কেবিন থেকে লুবানাও ছুটে এসেছে।নূরের কেবিন আর লুবানার কেবিনের মাঝে গ্লাসের দেয়াল থাকায় লুবানা স্পষ্ট সব দেখতে পায়।

নূর অস্বাভাবিক ভাবে ঘামছে। লুবানা পানি এগিয়ে দিলো নূরের দিকে। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলেও নূরের অস্থিরতা কমছে না। অমি চিৎকার করে নূর কে বুকের সাথে চেপে ধরলো। অস্থির গলায় লুবানা কে বললো,,

— তারাতাড়ি ডাক্তার ডাকো লুবানা।

নূর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। অমি পাগলের মতো ডেকে চলেছে তাকে।

— নূর,,কি হয়েছে বোন।চোখ খোল।কোথায় খারাপ লাগছে আমাকে বল। আল্লহ! নূর চোখ খুলছেনা কেন? (অস্থির হয়ে)

— ডাক্তার চলে আসবে স্যার।আমি কল করে দিয়েছি।

লুবানা ভয়ে ঘেমে গিয়েছে।নূরের অবস্থা দেখে তার আত্মা কাপছে। আশমিন জানতে পারলে তাকে আর আস্তো রাখবে না।

— নূর!!

আশমিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে নিস্তেজ নূরের দিকে। অমির কান্নারত চেহারা দেখে তার বুক কেপে উঠলো। দ্রুত পায়ে এসে নিজের বুকে আগলে নিলো নূরকে।

— কি হয়েছে নূরের? ও কথা বলছে না কেন?

আশমিনের রক্তিম চোখ দেখে দুজনেই কেপে উঠলো। আশমিন দেড়ি না করে নূর কে কোলে তুলে পাশের রুমে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে ও যখন নূরের জ্ঞান ফিরলো না তখন শুরু হলো তার পাগলামি। ভয়ে তার বুক কাপছে। আশমিন জায়িন চৌধুরীর বুক কাপছে!

দুই মিনিটের মধ্যে ই ডাক্তার চলে এসেছে।আশমিন নূর কে এক মুহুর্তের জন্য ও ছাড়েনি। নূরের মাথা টা নিজের বুকের সাতগেই চেপে ধরে ছিল।ডাক্তার নূর কে চেকআপ করে বললো,

— অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারনে জ্ঞান হারিয়েছে। ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া ও করে না হয়তো। শরীর খুব দুর্বল। রক্ত শূন্যতা ও থাকতে পারে। এই সময় এগুলো ভালো লক্ষণ নয়। বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খাওয়াবেন। টেনশন ফ্রী রাখার চেষ্টা করবেন সব সময়। এমন চলতে থাকলে দুজনের জন্যই খুব রিস্ক হয়ে যাবে।

ডাক্তার কিছু ঔষধ প্রেসক্রাইব করে দিলেন। অমি দ্রুত পায়ে চলে গেলো ঔষধ আনতে।আশমিন চুপ করে বসে আছে। রাগে তার মাথা ফেটে যাওয়ার অবস্থা। লুবানার দিকে অগ্নি চোখে তাকাতেই লুবানা কান্না করে দিলো।

— আমি খুব চেষ্টা করেছি স্যার।ম্যাম আমার কোন কথা ই শুনে না।আপনাকেও কিছু বলতে দেয় না।আমি কি করবো বলুন?

আশমিন কিছু বললো না। তার এখন কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ডাক্তার সেলাইন দিবে নূর কে।ডাক্তার কে নূর মঞ্জিলে আসতে বলে আশমিন নূর কে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। লুবানা আর ডাক্তার ও তার পিছনে ছুটলো।

— ভাইয়া আপনি ঔষধ নিয়ে বাসায় চলে আসুন।আমরা ম্যাম কে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি।

অমি আচ্ছা বলে কল কেটে দিলো। টেনশন হচ্ছে তার।তারাতাড়ি বাসায় পৌছাতে হবে।

চলবে,,
(কেউ ছোট বলে লজ্জা দিবেন না।কাল দিতে পারি নি।প্রচন্ড চোখ ব্যথা ছিল।আজ রাতে আরেক পর্ব পাবেন।)
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here