ইস্ক সাহেবান পর্ব -০৮

#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-৮||

★ইরফান এসেছে অনেক্ষণ হলো। ইবাদ বাসায় না থাকায় বসার ঘরে সবার সাথে বসে গল্প করছে ইরফান। ইরফানের আচরণে কোনো খুঁত পেলো না জাফর আর নাহিদা বেগম। মারিয়াম সবাইকে চা এনে দিলো। সারারাত ইবাদ বাড়ি ফেরে নি। ইরফান চায়ের কাপে চুমুক দিতেই নার্স উপর থেকে চিৎকার করে ডাকলো।

—–ম্যাডাম আবারও উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। প্লিজ কেউ আসুন।

ইরফান সাথে সাথে চায়ের কাপ রেখে দাঁড়িয়ে গেল। ইরফান কে উঠে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে দিদার মাহসান ও দাঁড়িয়ে গেল,

—-কই যাচ্ছিস তুই?

—–দাদু আমি দেখছি। ইবাদ আসা পর্যন্ত আমি সামাল দিই। নাহলে তো সমস্যা হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা করো না আমি দেখছি। বলেই ইরফান দ্রুতগতিতে উপরে চলে গেল। ইফতি রুমের জিনিস পত্র ছোড়াছুড়ি করছে। ফুলের ভাস তুলে দরজার দিকে ছুড়ে মারতেই ইরফান এক হাতে তা ধরে নিলো। একহাতে ফুলের ভাস ধরে অন্য হাতে পর্দা সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। ইফতির দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি হেঁসে ভেতরে ধীর পায়ে প্রবেশ করে ইরফান। ইফতি কাদঁছে। চোখ মুখ ফুলে গেছে মেয়েটির। হাতে থাকা ফুলের ভাস ইরফান রেখে দিলো। ইফতির সামনে গিয়ে বলল,

—–কেন চেঁচামেচি করছো তুমি? ভালো মেয়েরা কি এমন চেঁচামেচি করে? চেঁচামেচি কারা করে জানো?

ইফতি বাচ্চাদের মত গাল ফুলিয়ে ডানে বামে মাথা নাড়লো। ইরফান ফিক করে হেঁসে দিলো। ধীরে ধীরে ইফতির এলোমেলো হয়ে সামনে চলে আসা চুল গুলোকে দু’হাতে ধরে পেছনের দিকে চলে গেল ইরফান। চুল বাধতে বাধতে বলল,

—চেঁচামেচি করে পঁচা মেয়েরা। তুমি কি পঁচা?

—–না না আমি পঁচা না। আমিতো ভালো। আমি ভালো মেয়ে। কথাটা বলেই ইফতি ইরফানের সামনে ঘুরে দাঁড়ালো। ইরফান ইফতির চুলে অল্প প্যাঁচ দিয়ে বেনি করে দিলো। ইফতির কপালের সামনে আসা চুলকে ইরফান এক হাতে সরিয়ে দিতে দিতে বলল,

—-তাহলে কেন চেঁচামেচি করছিলে?

—-উনি আমাকে ইনজেকশন দিচ্ছিলো। এত এত অষুধ আর ইনজেকশন আমার ভালো লাগে না। আপনি ওনাকে বলে দিন না আমি এসব নেব না।

-ইফতির কথা শুনে ইরফান নার্সের দিকে তাকালো। নার্স অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। ইরফান ইফতির দিকে তাকিয়ে বলল,

—–তুমি জানো আমি কে?

—-আপনি ডাক্তার। তাই না?

ইরফান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,

—-হ্যাঁ আমি ডাক্তার।

—জানেন আমারও একটা ডাক্তার ছিল। ইফতির কথা শুনে ইরফান ভ্রু কুঁচকে নিলো। ইফতিকে জিজ্ঞেস করলো।

—-তোমার ডাক্তার?

—–হ্যাঁ!

—-কোথায় সে?

—–জানি না। বলেই বিছানায় বসে পড়লো ইফতি। ইরফান ইফতির সামনে বসে পড়লো। নার্সের কাছ থেকে খাবারের ট্রে নিয়ে বলল,

—–আসো আমিও খাবো তুমিও খাবে। তারপর আমরা ঘুরতে যাবো।

—-সত্যি?

—-পাক্কা সত্যি। বলেই ইরফান অতি যত্নে ইফতিকে খাইয়ে দিল। খাবার শেষে ইরফান ইফতিকে অষুধ ও খাইয়ে দিলো। সব খাওয়া শেষে ইরফান পকেটে হাত দিয়ে একটা ডেইরি মিল্ক এর প্যাকেট বের করে। ইফতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

—–এটা তোমার জন্য হীরামতী!

——সত্যিইইইই! ইফতি চকলেট ইরফানের হাত থেকে নিয়ে ইরফান কে জাপটে ঝড়িয়ে ধরলো। ইরফান একহাতে ইফতির মাথায় হাত বুলাতে থাকে অপরহাতে ইফতি কে জড়িয়ে রাখে বক্ষোমাঝে।

★দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ইবাদ ইফতিকে ইরফানের বুকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। যে ইফতিকে ইবাদ সহ্যই করতে পারতো না। সেই ইফতিকে অন্য একজনের বুকে দেখে ইবাদের ভেতরটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। যাকে কয়েকদিন আগেও নিজের বন্ধুর সাথে জোড়া লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো তাদের কে আজ একসাথে দেখে সহ্য করতে পারছে না ইবাদ। কারণ ইফতি শুধুই ইবাদের সাহেবান। নিজেকে সামলে কঠিন কন্ঠে বলে উঠলো,

—–কখন এসেছিস তুই?

ইবাদের কথা শুনে চমকে তাকালো ইরফান। ইফতি কে ছেড়ে উঠে ইবাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।

—–এসেছি তো সকালে তুই ছিলি না। তুই…… বলতেই থমকে গেল ইরফান। ইবাদের সারা গায়ে কাদা মাটিতে ভরপুর। সাদা শার্টটা ধুলোয় মাখানো।

—তোর এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে ঠিক আছিস তুই?

—-একটা ঝড় বয়ে গেছিলো। সামলে উঠতে খানিকটা সময় লেগেছে। আর কিছুই না। ইফতির দিকে তাকিয়ে বলল ইবাদ।

—-আমি তোর কথা কিছু বুঝতে পারছি না। কি বলছিস তুই? ভ্রু কুঁচকে বলে ইরফান।

—-কিছুই না। তুই আমার রুমে আয়।

——তুই যা আমি আসছি। ইবাদ নিজের রুমে চলে গেল। ইরফান পেছনে ফিরে একবার ইফতির দিকে তাকালো। যে মেয়েটি কিছুদিন আগে তার প্রপোজাল রিজেক্ট করেছিলো, সেই মেয়েটিই আজ ইরফানের বুকে মাথা রেখেছে। হালকা হেসে ইরফান বেরিয়ে গেল।

★——কতটা ভালোবাসিস ইরফান? রকিং চেয়ারে বসে দুলতে থাকা ইবাদের এমন প্রশ্নে ইরফান চমকে তাকালো।
ভ্রু কুঁচকে ইবাদ কে বলল,

—–মানে?

—–ইফতি কে কতটা ভালোবাসিস? ইরফানের দিকে মাথা ফিরিয়ে বলল ইবাদ।

ইরফান উঠে দাঁড়িয়ে গেল। একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।

—-নিজের চেয়েও বেশি।

—–তুই তো নিজেকে আঘাত করিস। জানিস আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে আঘাত করা যায় না। উঠে গিয়ে ইরফানের পাশে দাঁড়িয়ে বলল ইবাদ। ইরফান ইবাদের দিকে দ্রুত ফিরলো। ইবাদের কথা শুনে ইরফানের ভেতর কাঁপছে। সত্যিই তো যাকে ভালোবাসা যায় তাকে আঘাত করা যায় না। অথচ ইরফান ইফতির এত বড় ক্ষতি করে দিলো। ইরফান কে চুপ করে থাকতে দেখে ইবাদ আবারো জিজ্ঞেস করলো,

——ইরফান? মেয়েটা হুট করেই নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল! তোর একটুও খটকা লাগছে না? তোর একটুও কষ্ট হচ্ছে না? ভাবাচ্ছে না তোকে বিষয় টা? ইবাদের কথার উত্তর ইরফানের কাছে নেই। কি করে থাকবে ইরফানের কারণেই তো ইফতির এই অবস্থা। ইরফান কে চুপ থাকতে দেখে ইবাদ মৃদুস্বরে বলল,

—–কি হলো?

—–আমি চিন্তা করি না। তুই আছিস তো! তুই ঠিক ওকে সুস্থ করে দিবি। আমার কাছে সুস্থ করে ফিরিয়ে দিবি। তোর উপর আমি নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি। যতটা অবিশ্বাস আমি নিজেকে করি ততটাই বিশ্বাস আমি তোকে করি। তাই আমার চিন্তা নেই। খেয়াল রাখিস আসছি। বলেই ইরফান বেরিয়ে গেল। ইরফান চলে যেতেই ইবাদ ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো…..

—- আমি এবার তোর বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে পারবো না। এবার আমি তোর চাওয়া জিনিসটা তোকে দিতে পারবো না ইরফান। কারণ যাকে তুই চাস তার সাথেই জড়িয়ে আছে আমার সব। আমার শ্বাস- প্রশ্বাস সব তার সাথে মিশে আছে। আমার ভালো থাকার কারণ, আমার মুখে হাসি ফোটানোর কারণ, সব যে ওই একজন। তাকে আমি নিজের কাছ ছাড়া করতে পারবো না। আমার কাছে আমার সাহেবান এর আগে কিছু না। আমি ওনাকে সুস্থ করে তুলবোই তবে, তোর জন্য না। আমার জন্য! ও বাঁচবে শুধু আমার জন্য। ও হাসবে শুধু আমার চক্ষু শীতল করার জন্য। ও সাজবে শুধু আমার জন্য। ইবাদ মাহসানের জন্য আর কারো জন্য না।

★ইফতি কে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে ইবাদ। এখনো পর্যন্ত ইফতির ট্রিটমেন্ট শুরু হয় নি। যতক্ষণ না পর্যন্ত এটা জানতে পারছে যে, কি কারণে ইফতি হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়লো ততক্ষণ পর্যন্ত কিছুতেই ট্রিটমেন্ট করা যাবে না। ইফতির ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট আসলেই হয়ে যাবে। টেস্টের রিপোর্ট আসবে সকাল বেলা। মাথার চুল টানতে টানতে ইবাদ চেয়ারে হেলান দিলো। মাথা বাম পাশে কাত করে ঘুমন্ত ইফতির মুখের দিকে তাকালো। ইফতি ঘুম! বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। ইবাদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ইবাদ আস্তে আস্তে উঠে ইফতির রুমে চলে গেল। ইফতির গিটার টা খুঁজে হাতে তুলে নিলো। গিটারটার দিকে তাকাতেই ইবাদের ইফতি গান গাওয়ার দৃশ্যটি মনে পড়ে গেল। কি সুন্দর করে গাইছিলো ইফতি। ইফতি তার মি. ডাক্তারকে কতটা ভালোবাসে তা গানের প্রতিটি অক্ষরে, লাইনে প্রকাশ পাচ্ছিলো। সেই দৃশ্য মনে পড়তেই ইবাদ আনমনে হেঁসে দিলো। ইবাদ ইফতির বিছানায় বসল।অসুস্থ হওয়ায় ইফতিকে অন্যরুমে রাখা হয়েছে। ইবাদ চোখ বন্ধ করে নেয়। মৃদুস্বরে গেয়ে ওঠে,

★আজকে দুজনে,চল বলতে শিখে নিই
চোখে চোখে চলা আসা কি করে হয়…

আজকে জেনে নে, এই স্বপ্ন মেনে নে
তুই যদি না চাস তো এসব আমারও নয়…

এই আশিকি……আশিকি
করলো কি জাদু হায়…..

ইবাদ উঠে ইফতির রুমে চলে যায়। ঘুমন্ত ইফতির পাশে বসে পড়ে।

——আমার সামনে থেকেও আমি আপনাকে চিনতে পারি নি। আপনি বার বার জিজ্ঞেস করার পরও আমি কোনোদিন বলি নি আমি আপনার কে? আজ যখন আপনাকে পেলাম এমন এক অবস্থায় আছে আপনি আমি চাইলেও নিজের মনের কথা আপনাকে বলতে পারবো না। আপনাকে আমি বলতে পারবো না যে আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসি। আমি বললেও আপনি বুঝবেন না। আমার বলা কথাগুলো বুঝবেন না আপনি! আপনি খুব শীগ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন সাহেবান। নাহলে কে আমাকে বকবে? কে আমাকে অনিয়ম করে খাওয়ার জন্য বকা দেবে? কে আমার বেখেয়ালি স্বভাবের জন্য আমার উপর রাগ করবে? আপনাকে সুস্থ হতেই হবে। আমি সুস্থ করবোই। শুধু রিপোর্ট আসার পালা। আপনার ডাক্তার আপনাকে সুস্থ করে তুলবেই!…..কথাটা বলেই ইফতির হাত নিজের হাতের মুঠোই নিয়ে চুমু দিলো ইবাদ।

চলবে……..?

||ইবাদ কি পারবে নিজের সাহেবান কে সুস্থ করে তুলতে? ইবাদের জার্নি টা কেমন হবে? দেখা যাক…..! ||

[কারেন্ট নেই আমাদের এখানে তাই পোস্ট করতে পারি নি। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here