ইস্ক সাহেবান পর্ব -০৯

#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-৯||

★ইবাদের বলা প্রতিটি কথা ইরফানের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। নিজের উপর কিছুসময়ের জন্য বিরক্ত হয়ে পড়ে সে। প্রতিটি কথা ভাবতে ভাবতে একটা সময় নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে মুহুর্তেই। ডাইনিং টেবিলে থাকা ফলের ঝুড়ি থেকে ফল কাটার ছুরি টা তুলে নিজের হাতের তালুতে চালিয়ে দিলো ইরফান। হাতের তালু রক্তে লাল হয়ে যায়। রক্ত মাখা হাত চোখের সামনে ধরে বিড়বিড়িয়ে বলল,

——আম–আমি ইচ্ছে ক করে ত তাকে আঘাত করেছি। আমার জন্যই আজ সে একজন মানসিক রোগী! আমি তাকে অসুস্থ করে দিলাম? হ্যাঁ আমিই করে দিলাম। ইবাদ ঠিকিই বলেছে ভালোবাসার মানুষকে আঘাত করা যায় না। তবে? তবে, আমি কি ওকে ভালোবাসি না? একদমই না..! আমি ওকে ভালোবাসি। হ্যাঁ আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু..? আমি এটা কি করলাম? নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে এভাবে…? ইরফান নিজেই নিজের ভুল ক্ষনিকের জন্য হলেও বুঝতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই দিদার মাহসানের বলা কথাটি মনে পড়ে যায়। মন আবারো বদলে যায় তার। রক্তবর্ণে চোখে পানি টলমল করছে। মুখে হাসির রেখা টেনে বলল,

——না না আমি ভুল কিছু করি নি। আমি ভুল করি নি। ও খুব শীগ্রই আমার হয়ে যাবে। আমি ওকে বিয়ে করে এনে সুস্থ করে তুলবো নিজের আদর যত্নে। ও অসুস্থ থাকলে কিছুতেই ইবাদের সাথে ওর বিয়ে দেবে না দিদার মাহসান। কারণ অসুস্থ মানুষের সাথে আর যাই হোক সুস্থ মানুষের বিয়ে অসম্ভব…… বলেই রক্ত মাখা হাত কপালে ঠেকিয়ে ইরফান হাসতে থাকে।

★ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট হাতে নিয়ে ইবাদ বেদনপূর্ণ দৃষ্টিতে নার্সের দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে থাকা লোকটির দৃষ্টির ভাষা নার্স বুঝতে পেরেছে। এতবছর যার সাথে কাজ করছে তার দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পারার’ই কথা। কিন্তু ব্যাপারটা জটিল মনে হচ্ছে। তাই নার্স চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ইবাদ ঘুমন্ত ইফতির দিকে তাকিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিল। চোখ বন্ধ করতেই তার মনে পড়লো ইফতির হাতে ইনজেকশনের দাগ। সাথে সাথে সে চোখ খুলে ফেলে। এগিয়ে গিয়ে ইফতির হাত তুলে ধরে। এখনো কালো হয়ে আছে। একটা ইনজেকশনের এত শক্তি ভাবতেই ইবাদের রুহ কেঁপে উঠলো। শুধু একবার নয়? ৪৮ঘন্টায় ৩বার এই ইনজেকশন পুশ করেছে যার কারণে ইফতি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। রক্তচলাচল বেড়ে গিয়ে ইফতির মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। এবার ইবাদ বুঝতে পারছে, হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যাওয়া, উঠে আসার সময় ইফতির মাথা ঘুরে যাওয়া, সামান্য কথায় তার রেগে যাওয়া সবটাই এক সূত্রে বাধা। বিছানার পাশে থাকা চেয়ারটাতে ইবাদ ধপ করে বসে পড়ে।

——অনেক কষ্ট হয়েছে আপনার তাই না? আমি বুঝতেই পারি নি। তবে আর না। ৬মাসের মধ্যেই আমি আপনাকে সুস্থ করে তুলবো আই প্রমিস…. আপনি আবার সুস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াবেন। শুধু আমার সাথে একটু তাল মিলিয়ে চলুন সাহেবান। আপনার সাপোর্ট না পেলে আমি কিছুতেই পারবো না। কথাটা বলেই ইবাদ নার্সের দিকে তাকালো।

——-আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি। ফিরে আসতে আসতে খেয়াল রাখবেন। আমি মেডিসিন দিয়ে দিচ্ছি, কয়েক ঘন্টা উনি ঘুমেই থাকবেন। আমি আসার আগেই যদি ঘুম ভেঙে যায় তাহলে প্লিজ কোনো জোর করবেন না। এমন কিছুই করবেন না যাতে তার ব্রেইনে ইফেক্ট পড়ে। উচ্চস্বরে কথা বলা, লাফালাফি এসব যেন না হয়। বি কেয়ারফুল। ইফতিকে ইনজেকশন দিতে দিতে কথা গুলো নার্স কে বলে ইবাদ।

——-স্যার আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এদিকটা সামলে নেব। আপনি নিশ্চিন্তে যান।

—-কোনো প্রবলেম হলে আমায় ইনফর্ম করবেন।

—-ওকে স্যার….

★——আমার জন্য আমার ফুলের মত মেয়েটার এই অবস্থা। আমি কেন আমার মেয়েকে জোর করলাম। মামা আমার মেয়ে কি কোনোদিন সুস্থ হয়ে উঠবে না?

নাহিদা বেগম কান্না মিশ্রিত কন্ঠে কথা গুলো বলেন। দিদার মাহসান তাকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

—–আমার নাতনী খুব শীগ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে। তুই চিন্তা করিস না। আমার দাদুভাইয়ের উপর আমার সম্পুর্ণ আস্থা আছে। ও ইফতিকে সুস্থ করে তুলবেই। তুই কান্নাকাটি থামা।

—–কি করে থামাবো বলো? আমার মেয়েটা আজ কয়দিন কেমন হয়ে আছে! একটি বার আম্মু বলে ডাকলো না মামা। আমার মেয়ে কবে সুস্থ হয়ে উঠবে? কবে আম্মু বলে ডাকবে? নাহিদা বেগমের কান্না দেখে জাফর নিজেও ভেঙে পড়েন। দিদার মাহসান মনে মনে নিজেকেই দোষী সাব্যস্ত করতে থাকেন। কেন তিনি বিয়ের কথা তুললেন? প্রাণোচ্ছল মেয়েটির বেহাল দশা মেনে নেওয়া অসম্ভব।

জাফর ধীর পায়ে ইফতির রুমে প্রবেশ করেন। ইফতি ঘুমাচ্ছে। মেয়েটির মুখ ফুলে গেছে। চোখের নিচে পড়ে গেছে কালি। ঠোঁট শুকিয়ে আছে। জাফর এহতেশাম এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে থাকা চেয়ারটিতে বসে পড়েন। ইফতির হাত ধরে নিজের হাতের মাঝখানে রাখেন। একহাতে মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। ইফতির মুখের দিকে তাকাতেই মনে পড়ছে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর দৃশ্য।

——-আম্মা? কবে সুস্থ হয়ে উঠবি তুই? দেখ তো আম্মু গত কয়েকদিন ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করছে না। তোর এসব অপছন্দ জেনেও সে এমন করছে। তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যা। তারপর ইচ্ছেমত বকে দে। তুই সুস্থ হয়ে যা আমি আর তোর অনিচ্ছায় তোকে বিয়ে দিতে চাইবো না আম্মা। আমি কেন তোর মা, নানুভাই কেউই চাইবে না তুই শুধু সুস্থ হয়ে যা। ঘুমন্ত ইফতির জানা নেই তার সুস্থতার জন্য কয়েকটি মানুষের আত্মা ছটফট করছে।

★নার্সের ফোন বাজতে থাকে। নার্স ইফতির দিকে তাকাতেই সে হেঁসে দিল। নার্স ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই ইবাদ বলে উঠল,

—–আমার ঘরে যান একটু কষ্ট করে। ওখানে একটা ফোন আছে ওই ফোনটা এনে ইফতির হাতে দিন।

—–কিন্তু স্যার…?

—-যা বলছি তা করুন।

—আচ্ছা। নার্স ইবাদের রুম থেকে ইফতির ফোন এনে তার দিকে এগিয়ে দিলো। ফোন দেখেই ইফতি খুশি হয়ে ফোনটা নিয়ে নিল। ফোন হাতে নিতেই বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভাসছে ‘মি. ডাক্তার’ দিয়ে সেভ করা নাম্বারটি। ইফতি ভ্রু কুঁচকে নার্সের দিকে তাকাতেই নার্স হালকা হেঁসে ইশারায় ফোন রিসিভ করতে বলল। ফোন রিসিভ করার পদ্ধতি যখন ইফতি খুঁজে পাচ্ছে না নার্স নিজেই এসে ফোন রিসিভ করে দিলো। ফোন কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো,

★বলো তুমি কি আমার হবে?
বলো রাখবে কি অনুভবে?

বলো তুমি কি আমার হবে?
বলো রাখবে কি অনুভবে?

বইয়ের পাতায় ডুবছে না যে মন,
চোখের ভাষায় কাটছে সারাক্ষণ

সামনে এলে মন বলছে এখন
তোমায় পাওয়া বড় প্রয়োজন…..

বলো তুমি কি আমার হবে?
বলো রাখবে কি অনুভবে?

এতক্ষণ ইফতি চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে উঠল,

—–আপনি কে?

ইবাদ ইফতির প্রশ্ন শুনে চোখ বন্ধ করে নিল। নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

—-আমি ডাক্তার… মি. ডাক্তার।

—ডাক্তার..?

—–হ্যাঁ চিনতে পেরেছেন?

ইফতি কান থেকে ফোন সরিয়ে একবার তাকাল। স্ক্রিনে নামটি দেখে নার্সের দিকে তাকাতেই নার্স হাসলো,

—-আপনি সত্যিই আমার ডাক্তার..?

—-আমি মিথ্যে কেন বলবো সাহেবান!

—-আপনি কি করে জানেন আমার নাম সাহেবান? উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ইফতি।

—-আমি কেন জানবো না। আমি’ইতো নামটা দিয়েছি আপনাকে।

—-ওহ্!

—-কেমন আছেন?

—–ভালো আছি।

—-আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করলেন না?

—-কেমন আছেন আপনি?

—–ভালো নেই আমি। ভেতরবাড়ি পুড়ছে সাহেবান। দাউ দাউ করে জ্বলছে। কারো অসুস্থতা আমার ভেতরবাড়ির শান্তি নষ্ট করে দিয়েছে।

ইবাদের বেদনপূর্ণ কণ্ঠ শুনে ইফতি বলল,

—–কে অসুস্থ?

—-আমার খুব কাছের একজন মানুষ। আমার প্রিয়’র চেয়ে প্রিয়জন।

—-আমি দোয়া করে দিলাম সে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।

—-আপনি বলেছেন? তাহলে কবুল হবেই।

—-আমিন।

—-আচ্ছা আজ রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।

—-শুনছেন, আপনি মানুষ’টা ভালো।

ইফতির কথায় ইবাদের মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠলো,

—–কে বলল?

—-আমি বলছি! আমাকে গান শোনালেন না? আপনি ভালো..!

—–রাখছি। ইবাদ ফোন রেখে দিলো।

★বাড়ি ফিরতেই ইবাদের কানে গেল চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ। উপর থেকে ভাঙচুর এর শব্দ কানে আসতেই ইবাদ দ্রুত উপরে গেল। রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখল নাহিদা বেগমের কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। ইবাদ ইফতির দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। হাতে থাকা কাঁচি দিয়ে ইফতি নিজের কোমর অবধি লম্বা চুলকে কেটে কাধে এনে ঠেকিয়েছে। ইবাদ দ্রুত গিয়ে ইফতির হাত থেকে কাঁচি নিয়ে নিলো। ইফতি ইবাদকে ধাক্কা দেওয়ার আগেই ইবাদ ইফতিকে জড়িয়ে ধরে ইনজেকশন দিয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইফতি শান্ত হয়ে গেল। ইবাদের বুকেই ঘুমিয়ে পড়লো। ইফতিকে কোলে তুলে আসতে করে শুইয়ে দিলো বিছানায়। মেয়েটির ফর্সা গালে আঁচড়ের লাল দাগ ভেসে উঠেছে। ইবাদ ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নার্সের দিকে তাকাতেই নার্স আমতা-আমতা করে বলল,

—-কাঁচি নিতে গিয়েই একটু……..

ইবাদের রক্তবর্ণ চক্ষু দেখে নার্স মাথা নত করে নিলো।

চলবে…..?

|| একটা বিশেষ কারণে দেরী হয়ে গেল। ভুল-ক্রুটি আম্ফ করবেন। অবশ্যই ভুল চোখে পড়লে ধরিয়ে দেবেন আমি শুধরে নেব। আসসালামু আলাইকুম ||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here