#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-১৪||
★———ছেড়ে দে ইরফান, ছেড়ে দে। মেয়েটা তোকে না ইবাদ কে ভালোবাসে। তুই ওদের পথে বাধা হোস না। যদি ভালোবাসার অযুহাত দেখাস তাহলে বলবো তুই ভালোবাসিস না। কথাটা শেষ করতেই ইরফান ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইশালের দিকে। সে আবারও বলতে শুরু করলো,
—ভালোবাসলে আঘাত করা যায় না ইরফান। ইবাদ কে দেখ কত কী করছে? দিন – রাত এক করে দিচ্ছে শুধু মাত্র মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠবে বলে। আর তুই? তুই কী করলি? নিজের জেদ বজায় রাখতে ওকে অসুস্থ করে দিলি? এটাকে তুই ভালোবাসার নাম দিবি? এটা ভালোবাসার কাতারে পড়ে? পড়ে এটা? পড়ে না। প্রিয়তমা কে যে আঘাত করতে পারে সে সব করতে পারে। তুই ওকে অসুস্থ করে দিলি। একটু দিক-বেদিক হলে মেয়েটা আজীবন এভাবেই রয়ে যাবে। ইশাল থেমে যায়। ইশালের কথা শেষ হতেই ইরফান বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে এসে বলল,
—–তুই আমায় মেডিসিন দিয়েছিলি। মনে আছে?
—হ্যাঁ মনে আছে। তুই বলেছিলি তোর লাগবে। এখানে পাচ্ছিস না। তুই এটা বলিস নি একটা সুস্থ মানুষকে তুই অসুস্থ করার জন্য মেডিসিন চাইছিস….তুই যেটা করেছিস সেটা অন্যায়। ভালোবাসা এমন হতেই পারে না। পাগলামী ছাড়।
—-ঠিক আছে। মেনে নিলাম। ইবাদের জন্য এটুকু করতেই পারি। আমি ওদের থেকে অনেক দূরে চলে যাবো। তবে হ্যাঁ ওদের বিয়ের দিন ঠিক ফিরে আসবো। ইনভাইটেশন কার্ড দিলেও আসবো না দিলেও আসবো। হাজার হোক আমার বন্ধু বলে কথা। কথাটা বলেই ইরফান ছোট একটি হাসি হাসল। বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। ইশাল অবাক হয়ে গেল। ইরফান যে এত তাড়াতাড়ি মেনে নেবে ও ভাবতেই পারে নি। কীভাবে মেনে নিল ইরফান? এত সহজেই হাল ছেড়ে দিল? গাড়ির হর্নের শব্দ কানে আসতেই জানলার কাছে গিয়ে পর্দা সরাতেই দেখলো ইরফান চলে গেছে। ইশালের চোখ মুখে খুশির ঝলক দেখা দিল। অবশেষে পেরেছে সে।
★ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাম পাশের কাধে পড়ে থাকা চুল সরাতেই লাল দাগটি দেখা গেল। আয়নায় সেই দাগের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইশরা। ওইদিন অন্ধকারে ইশালের সাথে ধাক্কায় পড়ে গিয়ে এই হাল করেছে নিজের। দুজনেই অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় পড়ে গেছিলো। না চাইতেও দুজন বার বার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছিলো। ইশালের ডান হাতের কনিষ্ঠা আঙুলের নখ বড় হওয়ায় সেই নখেরই আঁচড় ইশরার ঘাড়ে পড়ে গেল। তার হয়তো খেয়াল নেই। দাগের উপর মলম লাগিয়ে ইশরা আবারও চুল দিয়ে ঢেকে দিল। পেছনে ফিরে দু কদম সামনে এগিয়ে যেতেই ঘটে গেল এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। ইশাল দ্রুত এসে ইশরা কে জড়িয়ে ধরল। ইশরা বুঝতে পারলো না কী থেকে কী হলো। ইশালের এমন জাপটা দিয়ে জড়িয়ে ধরায় ইশরা টাল সামলাতে না পেরে একটু পিছিয়ে গেল। ড্রেসিং টেবিলের সাথে ঠেকে যেতেই পেছনে এক হাতের ভর দিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গেল। নিজের এত কাছে ইশালের উপস্থিতি যেন ইশরাকে এলোমেলো করে দিচ্ছিল। এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অনেকটা দূরে সরিয়ে রেখেছে। ইশাল আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই ইশরার শ্বাসরোধ হয়ে আসে, অস্ফুটস্বরে বলল,
——-কী করছেন?
ইশাল সরে আসে। ইশরা গাল নিজের দুহাতের মাঝখানে রেখে বলে,
—–আমি পেরেছি। আপনি বলেছিলেন না শুধরে নিতে আমি শুধরে নিয়েছি। আমি পেরেছি ইশরা।
—–কী শুধরে নিয়েছেন? কপাল কুঁচকে আছে ইশরার। চোখ মুখে বিস্ময়, হতাশার ছড়াছড়ি।
—-আমার দ্বারা যে ভুল হয়েছে সেটাই।
—-আমি জানতাম আপনি পারবেন। ইশরার কথা শেষ হতেই ইশাল ইশরার গাল কাছে টেনে এনে চুমু বসিয়ে দিল। ইশরা মুহুর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল। ঠোঁট দুটি একে অপরকে ছেড়ে আলাদা হয়ে গেল। চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেল। অক্ষিকোটর ছেড়ে চোখের বাদামী রঙের মণি জোড়া মনে হয় বেরিয়ে আসবে। পুরো শরীর বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে গেল। গায়ের চামড়া যেন চিড়চিড় করে উঠলো। ইশাল সরে আসতেই ইশরা তার দিকে তাকালো। ইশাল নিজেও নিজের কাজে অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। কিসের বশে এমন একটা কাজ করে বসলো ইশাল বুঝতে পারলো না। দু কদম পিছিয়ে ইশরার দিকে তাকাতেই ইশরা চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে নিল। ইশাল কে কিছু বলতে না দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায় ত্রস্তব্যস্ত হয়ে। ইশাল পেছনে ফিরে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। এটা কি করে ফেলল সে? পেছনে ফিরে আয়নায় তাকাতেই ইশাল চোখ সরিয়ে নিল।
★ইফতির রুমে এসে দরজার দাঁড়িয়ে আলতো ভাবে দরজায় টোকা দিল ইবাদ.. শব্দ শুনে ইফতি তাকালো। ইবাদকে দেখে হালকা হাসলো। আগে থেকে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে মেয়েটি। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে কয়েকদিন আগে। ইফতির চুল একটু বড় হয়েছে। ঘাড় ছাড়িয়ে নিচে নেমেছে। ইবাদ পাশে গিয়ে বসলো,
—–কেমন আছেন?
—–ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
—-আমিও ভালো আছি। এখানে একা একা বসে না থেকে চলুন বাহির থেকে হেটে আসবেন।
—-বাহিরে মানে?
—মানে বাগান বা অন্যকোথাও…
—–ওহ্! আচ্ছা চলুন। ইবাদ হালকা হাসলো। আগে রুম থেকে বের হতে বললে ইফতি চেঁচামেচি করতো, ভয় পেত। আর আজ অনায়াসে রাজি হয়ে গেল। ধীরে ধীরে ইফতি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে। সময় মত ট্রিটমেন্ট না করলে ইফতি হয়তো বাকি দশজন রোগীদের মত আজীবন এই রোগ বহন করতো। পড়ে থাকতো মানসিক রোগীদের তালিকায়। ইবাদকে বসে থাকতে দেখে ইফতি ডেকে উঠলো,
—–কী হলো ডাক্তার? বসে আছেন কেন? যাবেন না?
—-যাবো তো.. চলুন। মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো ইবাদ।
★হাসির শব্দ শুনে নিচে তাকাতেই দেখল ইবাদ আর ইফতি। ইফতি হাসতে হাসতে চারপাশের স্তব্ধ পরিবেশ জমজমাট করে রেখেছে। দুজনকে দেখে ইশরার ভালোই লাগলো।
—–দুজনের জুটি মন্দ হবে না? খালি একবার সুস্থ হয়ে নে বেহনা। বিয়ে তো তোর এই ডাক্তার এর সাথেই হবে। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি…..
ইফতির হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। ইফতিকে গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে ইবাদ সামনে এসে দাঁড়ালো।
—–কী হলো? ঠিক আছেন?
—–কেন জানি না খারাপ লাগছে আমার। মাথাটা ঘুরছে, শরীর ও কাঁপছে।
ইফতির এমন কথা শুনে ইবাদ বেচয়েন হয়ে পড়লো।
—হঠাৎ করে কী হলো? আচ্ছা চলুন বার থাকতে হবে না। সামনে পা বাড়াতেই ইফতি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ইবাদ দ্রুত এগিয়ে এসে ধরে নিলো। ইফতি কে কোলে তুলে হাটা দিলো বাড়ির দিকে।
★সারাদিন ইশরার সাথে কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল ইশাল। যে কাজ ও করেছে ইশরা ওকে খারাপ ভাবলো? নাহলে কেন নিজেকে সরিয়ে রেখেছে দূরে। পুরো দিনে কী এমন ব্যস্ততায় মিশে ছিল সে? নিজের কাজের উপর নিজেরই রাগ হলো। কেন যে জোশের বশে এমন এক কাজ করে বসলো। এই কয় দিনে যতটা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ইশরা করেছে আর বোধহয় সেটা করবে না। নিজেকেই নিজে দোষারোপ করতে থাকে ইশাল।
রাতে খাবার টেবিলে ইশরা কে দেখতে পেল না ইশাল। ইশরা নাকি তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছে আজ। ইশাল কোনো মতে খাওয়া শেষ করে উঠে গেল।
—-দাদু আন্টি কেমন আছে? খেতে বসে দিদার মাহসান কে প্রশ্ন করলো ইবাদ।
—–ভালো আছে। ইশরা আর ইফতির কথা জিজ্ঞেস করছিল।
—-ওহ্, এসে ঘুরে যেতে বলো। অনেকদিন তো হলো…
—-আমি বলেছি। জাফর এর অফিসে কাজের চাপ তাই আসতে পারছে না।
—-ওহ্ আচ্ছা।
খাওয়া শেষ করে ইবাদ উঠে গেল। যাওয়ার সময় থেমে দিদার মাহসানকে বলল,
—–দাদু?
—-হুম?
—–ইফতি সুস্থ হওয়ার তিনদিনের মধ্যেই আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করবে। আন্টিকে জানিয়ে দিও। মনে রেখো শুধু তিনদিন….কথাটা শেষ করেই ইবাদ চলে গেল। দিদার মাহসান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাসলেন। নাতীর মতি গতি তিনি আজও বুঝে উঠতে পারলেন না। ইফতি কে যে ইবাদ অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে তা দিদার মাহসানের জানতে বাকি নেই। তার শান্ত শিষ্ট নাতী যে তলে তলে এসব করবে কল্পনার বাহিরে ছিল। অচেনা এক মেয়ের প্রেমে যে নিজেকে বিলীন করে দেবে সত্যিই অকল্পনীয়……
★বারান্দায় বসে আছে ইশরা। গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে রেখেছে। নিকষকালো আসমানের দিকে তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। চারপাশের নিস্তব্ধ পরিবেশের সাথে যেন নিজেকে মিশিয়ে রেখেছে। পরিবেশের নিস্তব্ধতা চাপা দিয়ে ইশরা বলে উঠল,
— ভালোবাসা এক অন্তহীন খেলা..
কে, কখন, কীভাবে এই খেলায় নিজেকে বিলীন করে বোঝা বড় দায়। আমি এই পুরো জীবনে কিছু চাই নি। আমার বোনের সঙ্গ চেয়েছিলাম। আর পেয়েছিও! কিন্তু এখন আমি আমার বোনের সাথে সাথে আরো একজনের সঙ্গ আজীবনের জন্য চাই। যে শুধু আমার হবে, যে শুধু আমায় ভালোবাসবে, যাকে আমি আমার সমস্ত ভালোবাসা উপহার দিবো। ইশাল ফায়াজ….! আই লাভ ইউ.. আমি আপনাকে ভালোবাসি… আমার মনের সূক্ষ্ম অনুভুতি গুলোকে জাগিয়ে তোলার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। থ্যাংক ইউ সো মাচ মি. ফায়াজ….
মুচকি হেসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল ইশরা।
চলবে…?