#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব–২৪|| অন্তিম পর্ব
★নির্জন চারিপাশ। নিকষকালো আকাশ। যার বুকে ছোট ছোট তারারা চিকচিক করছে। এক পাশে বিশাল অর্ধচাঁদ।
ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে আছে ইশরা। পরনে লং থ্রি পিস। ওড়না টা গলায় ঝুলছে। ওড়নার এক প্রান্ত ডান পাশের কাধে পড়ে আছে। চুলগুলো খোপা করা। হঠাৎ কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে পেছনে ফিরলো ইশরা। ইশাল কে দেখে একটু সরে দাঁড়ালো। এই একমাসে কম চেষ্টা করেনি ইশাল। কিন্তু ইশরা? এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কী মেয়ে কী হয়ে গেল। কোথায় তার ওয়েস্টার্ন? কোথায় তার চুলের বাহার? ইশালের সামনে থেকে সরে গিয়ে ইশরা হাটা দিলো। পা সামনে চালাতেই হাতে টান পড়লো ইশরার। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো ফারিস। ফারিস কে দেখে অনেকটা অবাক হয়ে গেল। ইশরার খেয়ালই ছিল না কখন ফারিস এসে সামনে দাঁড়ালো। ইশরা পেছনে ফিরতেই ফারিস হাত ধরে টেনে ইশালের সামনে দাঁড় করালো। ইশালের দিকে একবার তাকিয়ে ইশরার দিকে তাকালো আর বলতে শুরু করলো,
——-ভালোবাসা মানুষকে বদলে দেয় ইশরা। হয় ভালো, নয় খারাপ। আপনি নিজেকেই দেখুন আজ থেকে ৭/৮মাস আগে আপনি কেমন ছিলেন, আর আজ কেমন। ইশরা এই সময়টা খুব ছোট। কিন্তু এই ছোট সময়ে বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছে আপনার মাঝে। কেন জানেন? কারণ এই মানুষটিকে আপনি মনে প্রাণে চেয়েছিলেন। এই একটি মানুষের জন্য নিজের চালচলন সব বদলে দিলেন। যার ভালোবাসা না পেয়ে নিজেকে এতটা বদলে দিলেন তার ভালোবাসা আজ পেয়েও কেন পায়ে ঠেলে দিচ্ছেন ইশরা? আমি জানি আপনি কষ্ট পেয়েছেন। অনেক পেয়েছেন! মেয়েরা সহজেই কাউকে বলেনা যে ‘ ভালোবাসি’! যখন বলে বা যেই মানুষটিকে বলে অবশ্যই সেই মানুষটি তাদের জন্য স্পেশাল! আপনার ভালোবাসা আপনার দরজায় করাঘাত করছে এভাবে দূরে সরিয়ে দেবেন না। কথা শেষ করে ফারিস ইশালের দিকে তাকালো। ইশালকে ইশারা দিতেই সে ইশরার হাত ধরলো। ইশরা ইশালের দিকে তাকালো।
—–আমি দয়া দেখাচ্ছি না। আমি চাই ভালোবাসা। আপনার ভালোবাসা ইশরা। আমি হয়তো আপনার এই পরিবর্তন বদলে দিতে পারবো না কিন্তু আমি চাই আপনার ভেতর চুপচাপ, শান্ত হয়ে থাকা ভালোবাসাটা। যা আপনি জোর করে চেপে রেখেছেন।
ইশরা কেঁদে দিলো। সব ভুলে ইশালকে ঝাপটা মেরে জড়িয়ে ধরলো। ফারিস ইশালকে জড়িয়ে ধরতে ইশারা দিল। ইশাল জড়িয়ে ধরতেই ফারিস ঘুরে দাঁড়ালো। তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে বেরিয়ে এল। ছাদ থেকে বেরিয়ে ইশাল দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। প্যান্টের পকেট এ হাত দিয়ে একটি কালো রঙের বক্স বের করলো। বক্স খুলতেই একটা রিং চকচক করে উঠলো। রিং টার দিকে তাকিয়ে ইশাল ছাদের দিকে উঁকি দিল। আবারো ঘুরে দাঁড়িয়ে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বলে উঠলো,
——-এই রিংটা আপনাকে দিতে পারলে আমি অনেক খুশি হতাম। আপনার সামনে নিজের না বলা কথা রাখতে পারলে আরো খুশি হতাম। কিন্তু? এইযে এখন! আপনি যত খুশি হয়েছেন আমার খুশি এটার কাছে খুবই তুচ্ছ। আমি আপনাকে ভালো দেখতে চাই। আমি চেয়েছিলাম আপনি হাসুন। আপনি প্রাণখুলে হাসুন। আমার সাথে নাইবা হলো মিলন আপনার প্রিয় মানুষের সাথে ঘটুক মধুর মিলন। ভালো থাকুন ইশরা। অনেক ভালো থাকুন। প্রশান্তিতে আপনার চারপাশ ছেয়ে যাক।
★হুট করেই ছাদের সমস্ত লাইট বন্ধ হয়ে গেল। হয়তো লোডশেডিং। এই রাতে আবার এটা কোন ঝামেলা। পুরো ছাদ অন্ধকারে ছেয়ে যেতেই ইফতি ইবাদ কে জড়িয়ে ধরে। ইবাদ পাথরের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইফতিকে আগলে নিল না। আকাশের দিকে তাকাতেই দেখলো চাঁদের আলোয় ছাদ আলোকিত হয়ে গেছে। ইবাদ ইফতিকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিল। ইফতি ইবাদের দিকে তাকাতেই ইবাদ বলল,
——হুটহাট জড়িয়ে ধরবেন না, সাহেবান।
—–কেন? চোখ ছোট করে কপাল কুঁচকে বলল ইফতি।
—–কারণ..
—–কারণ?
——এত কারণ জানতে নেই। বলেই ইফতির নাক টেনে দিল ইবাদ। ইফতি ব্যাথা পেয়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো,
—আহ্!
—–লেগেছে?
—-হুম!
——আসুন খাবেন।
——খাওয়ার পর?
——ঘুমিয়ে পড়বেন। আমার তো সারাদিন অনেক ধকল গেছে ঘুমটা বড্ড দরকার। হামি দিতে দিতে বলল ইবাদ।
——আজ না আমাদের বিয়ে হয়েছে। কপাল কুঁচকে বলল ইফতি।
—–ভুলে গেলেন কী করে? আমি বলেছিলাম বিয়ের রাত নিয়ে আমার কোনো প্ল্যান নেই। মনে পড়ে? একটু এগিয়ে এসে বলে ইবাদ। ইফতি আহাম্মক এর মত তাকিয়ে রইল,
—-ওটা সত্যি ছিল?
—–ইবাদ মাহসান মিথ্যে বলেনা সাহেবান।
—-এ কেমন লোক? এই রাত বার বার আসে না। আমি কিন্তু বলে দিলাম।
——আমি তো বলিনি বার বার আসে। আসুন খাবেন। বলেই ইবাদ বেরিয়ে গেল। ইফতির রাগ হলো। অযথায় এসব শাড়ি চুড়ি পরেছে। কত কী ভাবলো আর এই লোক?
খাবার টেবিলে ইফতি ইবাদের দিকে বার বার তাকাচ্ছিলো। ইবাদ চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। ইফতি খাবারের প্লেট ঠেলে দিয়ে বলল,
——আর খাবো না। খিদে নেই।
——থাকবে কী করে? আপনি তো খাওয়ার চেয়ে বেশি আমায় গিলেছেন!
——মানে? ভ্রু কুঁচকে বলে ইফতি। ইফতির প্রশ্ন শুনে ইবাদ হালকা হাসলো। টেবিলে ভর দিয়ে ঝুকে বলল,
——এমন না যে আমি দেখিনি। আমি দেখেছি আপনি ৩লোকমা খেয়েছেন ভাত আর ১৭বার আমার দিকে তাকিয়েছেন।
ইফতি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল,
—–এটাও গুনেছেন?
—–আমার কাছে সব হিসাব পাবেন। শুধু……
—–শুধু?
—–এত জেনে কী করবেন? অল্প জ্ঞান থাকা ভালো। বলেই ইবাদ চলে গেল।
—-এ কাকে বিয়ে করলাম আমি? এই লোক এমন কেন? আমার বিবাহিত জীবন..! বলেই ইফতি গাল বাকিয়ে কান্নার মত আওয়াজ করলো।
★ভোর হতেই নাহিদা বেগম এসে ইশরার দরজায় টোকা দিল। কিছুক্ষণ পর ইশরা দরজা খুলতেই নাহিদা বেগম ভেতরে প্রবেশ করেন।
—-হ্যাঁ রে ফারিস হঠাৎ চলে গেল কেন? নাহিদা বেগমের কথা শুনে ইশরার ঘুম এক মুহুর্তেই উধাও হয়ে গেল।
——চলে গেল মানে? ইশরা আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না ওড়না গায়ে নিয়ে, ফোন হাতে নিয়ে ফারিসের রুমের দিকে দৌঁড় দিল। রুমে প্রবেশ করার আগেই ইশরার ফোনের ম্যাসেজ রিংটোন বেজে উঠলো। ইশরা দাঁড়িয়ে গেল। ফোনের দিকে তাকাতেই দেখলো ফারিসের ম্যাসেজ। ইশরা ম্যাসেজ ওপেন করলো।
‘মাই ডিয়ার ডল’
আমি ইতালি ব্যাক করেছি। অনেক অনেক কাজের প্রেসার ছিল তাই হুট করেই চলে এলাম। আপনি কিন্তু ইতালি তে পা রাখবেন না খবরদার! হ্যাঁ মি. ফায়াজ কে নিয়ে অবশ্যই হানিমুনে আসতে পারেন চাইলে? তবে এই পুরনো জায়গায় এসে লাভ হবে না কোনো। বিয়েতে আমাকে অবশ্যই ইনভাইট করবেন। আমি আর একবার বাংলাদেশ আসা ইচ্ছে পোষণ করি। আর সেটা হলো আপনার বিয়েতে। কী ইনভাইট করবেন তো? ইশরা! খুব অল্পদিনে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। মাতৃসম একজনের আদর, বাবার মত সাপোর্ট, একটা পরিবার। সবশেষে যেটা পেয়েছি সেটা হলো বন্ধু। ইবাদ আর ইশাল। আমি নিজের জীবনে যা আশা করিনি তা আমি পেয়েছি। আর এসব ধরে রাখার জন্য বড় বড় জিনিস আমি হাতছাড়া করতে রাজি৷ অ্যানিওয়ে, আর মাত্র কয়েকমিনিট আছে। সবশেষে এটাই বলতে চাই ভালো থাকবেন।
ফারিসের ম্যাসেজ দেখে ইশরা চোখ বন্ধ করে ছোট্ট শ্বাস ছাড়লো। ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
——সরি! আপনার জন্য কিছুই আমি করতে পারিনি। দোয়া করি আপনি অনেক সুখে থাকুন। বলেই মৃদু হাসল ইশরা। কী করে থাকবে ফারিস সুখে? তার সুখ যে বাংলাদেশের বুকে রেখে সে চলল অজানা পথে। ভালোবাসা বোধহয় এমনই হয়। হয় দাও! নয় নাও। ফারিস দিয়েই গেল। ইশরার সুখের কাছে নিজের ভালোবাসার বলিদান দিয়ে চলে গেল আজীবনের জন্য।
★গাড়ি থামার সাথে সাথেই ইফতির চোখ ইবাদ বেধে দিল। ইফতি কিছু বলার আগেই ইফতির মুখে আঙুল ঠেকিয়ে বলল,
——বেশি কথা বললে ভালো হবেনা।
ইবাদের এমন হুমকিস্বরুপ কথা শুনে ইফতি চুপ করে গেল। গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। গাড়ি থেকে বের হয়ে ইবাদ ইফতির পাশের দরজা খুলে ইফতিকে হাত ধরে নামালো। অতি যত্নে ইফতিকে একহাতে পেছনে জড়িয়ে ধরে অন্যহাত দিয়ে ইফতির হাত ধরে কয়েক কদম সামনে এগিয়ে গেল। তারপর ইবাদ ইফতির হাত ছেড়ে দিল। একটু দূরে সরে গিয়ে পেছনে চলে গেল। পেছনে গিয়ে দুহাত সামনে নিয়ে এসে ইফতির চোখের বাধন খুলে দিল।চোখ খুলতেই ইফতি ত্রস্তব্যস্ত হয়ে খুলে ফেলল। বিস্ময়ে ইফতির মুখ হা হয়ে গেল। ইফতি ঢোক গিলে নিঃশ্বাস ছাড়লো। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বাড়ি। যার রং সাদা। বাড়ির নেমপ্লেটে লেখা আছে ‘ ইস্ক সাহেবান’! ইবাদ বাঁকা হেসে ইফতির কাধে থুতনি রেখে বলল,
—–আমার সাহেবানের জন্য একটি ছোট্ট উপহার, ইস্ক সাহেবান। ইফতি চটজলদি ইবাদের দিকে তাকালো, ইবাদ হালকা হেসে বলল,
——আমি জানি ফার্স্ট নাইট বার বার আসে না। তবে আমি সেই রাতটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চাই। ইবাদ হেটে সামনে চলে গেল। ইফতির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দুহাত মেলে বলল,
—‘ এই ইস্ক সাহেবানে শুধু আমার সাহেবানের রাজত্ব চলবে’!
_____________________সমাপ্ত__________________