উমা পর্ব -০৩

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩য়_পর্ব

রকিবুল মাষ্টার এসে দাঁড়ালো শাশ্বতের পাশে। করুন স্বরে বললো,
“তোমার মামার সাথে কেউ পারে না শাশ্বত। হেরে গেলে তো। নিখিল ভয় পেয়েছে। দারোগার কাছে তার কথাই শেষ কথা। উমার জন্য কষ্টই হচ্ছে৷ মেয়েটা বড্ড সরল। কিন্তু আমাদের হাতে কিছুই নেই। তোমার মামার প্রসার বাড়ছে, টাকা বাড়ছে। সব কালো টাকা।”

কালো টাকা শুনতেই শাশ্বতের দৃষ্টি যায় রকিবুল মাষ্টারের দিকে। রকিবুল মাষ্টার ধীর স্বরে বলে,
“তোমার মামা ততটা সাধু নন যা সবাই দেখে, এই ভালো মানুষী মুখোশের আড়ালে সে কুৎসিত চেহারাটা লুকিয়ে আছে তা কেউ দেখে না। দেখলেও চেপে যায়”

শাশ্বতের ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো আরোও বেশি। মামা মশাই ক্ষমতার অহমিকা করেন এটা তার জানা, কিন্তু তিনি অসৎ কাজ করবেন ব্যাপারটা হজম হলো না শাশ্বতের। যতই হোক মামামশাইকে বেশ সম্মান করে সে! পিতৃতুল্য ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে এমন আকর্ষিক কথা যেনো তাকে অনেকটা নাড়িয়ে দিয়েছে। শাশ্বতের অবিশ্বাসের চাহনী দেখে স্মিত হাসে রকিবুল মাষ্টার। তারপর গলার স্বর নামিয়ে বলেন,
“প্রমাণ ব্যাতীত কথা বলার মানুষ আমি নই, বাবা চুল তো রোদে শুকিয়ে পাকাই নি। অনেক কালো অতীত এবং বর্তমান আছে গ্রামের। তুমি চাইলে জানাবো। না জানতে চাইলে থাক।”
“কি জানেন আপনি?”
“তুমি যে দুমুখো সাপ নও তার প্রমাণ কই! এতদিন মুখ খুলি নি ভয়ে, আমারো পরিবার আছে। মেয়ে, বউ; তাদের ক্ষতি হলে সেই ক্ষতিপূরণ কে দেবে!”

রকিবুল মাষ্টারের ঘোলাটে কথাগুলো খুব ধাধা উৎপন্ন করলো মনে, সাথে একটা সূক্ষ্ণ ডেউ সন্দেহের। শাশ্বতের চোখ গেলো অভিনব সিংহের দিকে। প্রসন্ন মুখখানা দেখে বোঝার জো নেই তিনি কোনো ভয়ানক কাজ করতে পারেন। রকিবুল মাষ্টার বাঁকা হাসি হাসলেন। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সম্মুখে। শাশ্বত এখনো তাকিয়ে আছে। মাথা ভন ভন করছে, রহস্যের ভনক যখন পেয়েছে সুতরাং এই রহস্য খুঁড়ে তার শেষ সীমানায় যাবে শাশ্বত; যেতে হবেই। রকিবুল মাষ্টার কি সত্যি সত্যবাদী! যদি হন মামা মশাইকে শাস্তি পেতে হবে, আর যদি রকিবুল মাষ্টার মিথ্যুক হন তবে শাশ্বত গ্রামের সবাইকে সেটা জানাবে। তবে এই রহস্যের সমাধান সে করবেই।

৩.
পুত্রবধু সমেত অভিনব সিংহ রায় নিজের বাড়িতে ফিরলেন। বাড়ি বললে কম ই হবে, এ পুরো মহল। এই বাড়িটা ব্রিটিশের আমলের। অভিনব সিংহের পূর্বপুরুষেরা খুব যত্নে রেখেছেন এ বাড়ি। তাই তো এতো বছর বাদেও টিকে আছে এ বাড়ি নিজের যোগ্যতায়। দোতালা জমিদার বাড়ি, চারিদিকে বারান্দা ঘেরা। মাঝে বেশ বড় বসার ঘর। চিকন সিড়ি উঠে গেছে সেখান থেকে। ছোট বড় ১৪ খানা কামরা। পেছনে বিশাল পুকুর, তার পাশে ফলের বাগান। বাড়ির আঙ্গিনায় তুলসি গাছ। তুলসি গাছে প্রদীপ জ্বলছে। তাই ছোট বেলায় উমা প্রায় ই লুকিয়ে আসতো বান্ধবীদের সাথে। পেছনের পুকুরের পাশের বাগানের ফল চুরি করতো তারা। ভয় করতো, কারণ কর্তামা খুব দাপটে মহিলা। একবার ধরা খেলে নিস্তার নেই। আজ সেই বাড়ির পুত্রবধু রুপে পা রাখলো উমা। ব্যাপারটাকে কাকতালীয় বলবে নাকি নিজের ভীতু মনের ফল জানা নেই উমার। লক্ষী দেবী বেজার মুখে বরণ করলেন উমাকে। তার বেজার মুখের কারণটি জানা নেই উমার। জানার ইচ্ছেবোধও নেই। কারণ ইহজীবনে কারোর খুশির কারণ সে হতে পারে নি। না নিজের জন্য, না নিজের পরিবারের জন্য।

বরণ শেষে কঠোর স্বরে বললেন,
“ফুলির মা, ওরে ঘরে নিয়ে যাও”

ফুলির মা আজ্ঞাকারী দাসির ন্যায় উমাকে ঘরে নিয়ে যায়। আজ উমা ফুলির মার সাথে থাকবে। রীতি অনুযায়ী আজ তাদের কালরাত্রি। উমা প্রস্থান পর ই রুদ্র টোপরটা ফেলে বাহিরের দিকে পা বাড়ালো। তখন ই অভিনব সিংহ রুঢ় স্বরে বলেন,
“কোথায় যাচ্ছো রুদ্র?”
“একটু বাহিরে যাচ্ছি”
“তোমার এই গাছাড়া স্বভাব ই তোমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে কথাটা ভুলো না। তোমার এক ভুলের কারণে নিখিলের মেয়েকে ঘরে তুলতে হলো, উপরন্তু আজ শাশ্বত যা কান্ড করেছে। নিখিল বুদ্ধিমান বলে আমার অপমান করে নি। এমন কোনো কাজ করো না যেনো আমাদের এতো বছরের সাম্রাজ্যে আগুন ধরে।”

রুদ্র কথা শোনার বান্দা নয়। শাশ্বতের কথা শুনেই মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো তার। চেঁতে উঠে বললো,
“দুধ কলা দিয়ে তো কালশাপ পুষেছো বাবা, এখন আমাকে ওর জন্য কথা শোনাচ্ছো। খুব তো বলেছিলে শাশ্বত হবে তোমার ঢাল। কি করলো! তোমার মুখ রাগলো ভাগনে তোমার?”
“রুদ্র বাবা, শান্ত হ। উত্তেজনা মোটেই ভালো নয় তোর জন্য। মালিনী শুনতে পাবে। ও দোতালার ঘরেই আছে।”

লক্ষী দেবী রুদ্রকে থামাতে চাইলেন। কিন্তু রুদ্র থেমে যাবার পাত্র নয়। উলটো চেঁচিয়ে বললো,
“শুনুক। যতসব আজাইরা জঞ্জাল বাবা পুষে রেখেছে। লাভ কি হলো! সেই করলো বাবার বিরোধ”
“রুদ্র চেঁচিও না”

অভিনব সিংহের কড়া কন্ঠ কানে যেতেই দমলো রুদ্র। রুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,
“তোমার নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ দিয়েছো অনেক। এবার থেমে যাও। ছেলে হয়েছো বলে মাথা কিনে নাও নি। দাম্ভিক হও, কিন্তু তার যোগ্যতাও রাখো। তোমার জন্য আজ আমার এতো বছরের পরিকল্পনা জলে যেতে নিয়েছিলো। শাশ্বত কেমন তা তুমি জানো। আমি চাই না সিংহের ঘুম ভাঙ্গাতে। মালিনী আছে তাই শাশ্বত আমার হাতের পুতুল। আমি তোমার মতো নই, প্রতিটা কদম মেপে চলি আমি। সুতরাং এই স্পর্ধা আমাকে দেখাবে না।”

রুদ্র মুখ বাঁকিয়ে এক রাশ ক্ষোভ এবং বিরক্ত নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। ছেলে ভক্ত লক্ষী দেবী শাঁশালেন অভিনব সিংহ কে,
“আমার ছেলেকে বকছো কেনো তুমি? ওর জীবনটা এভাবে নষ্ট করে শান্তি মিললো না? কি দরকার ছিলো ছোটলোকের মেয়েটাকে ঘরে তোলার?”
“তুমি বুঝলে তুমি অভিনব সিংহ রায় হতে। বেশি বকো না। জানো বেশি বকা আমার পছন্দ নয়।”

বলেই নিজের কক্ষে চলে গেলেন অভিনব সিংহ। দোতালার সর্বকনিষ্ঠ রুম থেকে এই সকল দৃশ্য চোখে পড়লো উমার। কিশোরী উমার কাছে চেয়ারম্যান বাড়ির কুৎসিত চিত্র ভেসে উঠলো। তার সাথে ভেসে উঠলো একটি নাম “শাশ্বত”। এই নামটি আঙ্গিনাতেও শুনেছিলো সে। লোকটিকে ধন্যবাদ জানানো হয় নি। যেখানে বাবা-মা হাল ছাড়লো সেখানে অপরিচিত মানুষ তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো। পৃথিবীটা সত্যি ই আজব কারখানা। কে আপন, কে পর; সংজ্ঞাই বদলে যায়। ফুলির মা বিছানা গুছাতে গুছাতে বললো,
“রঙ্গ তো কেবল শুরু রে উমা। এই বাড়ির দেওয়ালে অনেক রহস্য আছে। এক এক করে সব জানবি।”

উমা অবাক দৃষ্টিতে তাকায় ফুলির মার দিকে। রুমে মোমবাতি জ্বলছে। তাই আলো আধারে তার মুখটা দেখতে পেলো না উমা। দেখলে হয়তো কথাটার মর্মার্থ বুঝতে পারতো সে_______

শাশ্বত ফিরতেই মালিনী দেবীর সাথে তার দেখা হলো। মায়ের রুদ্রমূর্তি দেখেই বুঝতে বাকি নেই মা জেনে গেছে সকল কথা। হয়তো মামী তাকে শুনিয়ে গেছে কথা। শাশ্বত স্বাভাবিক আচারণ ই করলো। মার পাশ কাটিয়ে নিজ কক্ষে প্রবেশ করলো সে। মালিনী দেবীও পিছু নিলেন তার। শাশ্বত হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“কিছু বলবে মা?”
“তুই নাকি দাদাকে অপমান করেছিস?”
“কে বললো সে কথা?”
“বৌদি”

শাশ্বত ঠিক আন্দাজটাই করেছে। মামী মাই মাকে কথা শুনেছেন। শাশ্বত নির্বিকার, শান্ত স্বরে বললো,
“অন্যায় আটকানো যদি অপমান হয় তাহলে আমার কিছুই বলার নেই। কারণ চোখের সামনে অন্যায় হবে, আর আমি মুখ বুজে বসে থাকবো এটা আমার স্বত্তা মানতে নারাজ।”
“কিসের অন্যায়? আমার বিয়ে তো চৌদ্দ বছরেই হয়ে গিয়েছিলো। উমা তো তাও বলেন বড়। আর ভুল কোথায়! দাদা বরং নিজের ছেলের ভুল শুধরে নিলেন”
“মূর্খ্যতা বড় অভিশাপ মা, আমার মা হয়ে এমন ধারা কথা কি তোমায় মানায়? এখন ২০০৪ সাল, সময় আগাচ্ছে। তোমরাও আগাও!”

শাশ্বতের ঠান্ডা কন্ঠের কথা গুলো শুনে মালিনী থেমে গেলো। সে আরোও কিছু বলতো কিন্তু নিজেকে থামিয়ে নিলো। এরপর ছেলের পাশে বসে কাতর স্বরে বললো,
“ভুলে যাস নে খোকা, এই মামা ছিলেন বলেই আজ তুই শাশ্বত চ্যাটার্জি। নয়তো চিল শকুনেরা আমাদের ছাড়তো না। তাই দাদার বিপরীতে যাস নে খোকা। দাদা মুখ সরিয়ে নিলে মাথার ছাঁদটাও হারাবো”

মায়ের কথার উত্তর দিলো না শাশ্বত। সত্যি তো তার চাকরি বড় পত্রিকায় ঠিক ই কিন্তু যা বেতন তাতে ঢাকায় নিজের ই চলে না। অন্যদের মতো ঘুষ নিয়ে খবর লুকিয়ে যাবার মতো কাজটি যে করতে পারে না। কিছু টাকা পায় বিজ্ঞাপনের। উপরন্তু এখন যদি ঢাকা থেকে সাতক্ষীরাতে চলে আসতে হয় তবে আরোও কমে যাবে বেতন। বিজ্ঞাপনের টাকাটি ও পাবে না। মাকে নিয়ে এখনই সরে পরাটা সম্ভব নয় তার জন্য। তবে শাশ্বত দমে যাবে না। সন্দেহ যখন হয়েছে তার শেষ দেখবে। মালিনী দেবীকে শান্ত করতে ধীর স্বরে বলে,
“মা চিন্তা করো না। এরকম আর হবে না”

শাশ্বতের কথা শুনেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারলেন না মালিনী দেবী। ছেলে তো তার পেটেই জন্মেছে। তাই ছেলের শিরা উপশিরাও তার জানা। না জানি কোন ঝড় অপেক্ষা করছে শাশ্বতের জন্য। এক অজানা ভয়ে বুক জমে আসছে মালিনীর। ছেলে ছাড়া দুনিয়ায় কেউ নেই তার। তাই ছেলেকে হারাতে নারাজ। যেভাবেই হোক ছেলেকে এসব থেকে দূরে রাখলেই বাঁচে সে। আগামীকাল শাশ্বত ঢাকা চলে গেলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন তিনি।

উমার ঘুম ভাঙ্গলো গোলের আওয়াজে। সকালের কিরণের সাথে সাথেই চেয়ারম্যান বাড়িতে লোকের ঝটলা লেগেছে। উমার পরণে এখনো গতরাতের বেনারসি, খোপা বাধতে বাধতে কক্ষের দরজা ধরে দাঁড়ালো সে। ঝটের কারণ বুঝছে না। তবে কম হলেও ছ থেকে সাত জন মানুষ এসেছে। উপরের রেলিং ধরে দাঁড়ায় উমা। তখন কানে আসে,
“রুদ্র নিখোঁজ……….”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here