#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৭ম_পর্ব
এর মাঝেই কাঠের জং ধরা দরজাটি ঠেলে ঘরে আসে রুদ্র। রুদ্রের আগমনের আভাষ পেতেই ঘরে যায় উমা। ঘরে প্রবেশ করতেই যা দেখলো তাতে গা শিউরে উঠলো উমার। রুদ্র যেনো রক্তস্নান করে এসেছে, সাদা শার্টটা রক্তের ভিজে লাল রঙ্গে রঙিন হয়ে আছে। রুদ্রের চোয়াল শক্ত, মুখেও রক্তছিটা স্পষ্ট, চোখজোড়া যেনো জ্বলছে ক্রোধের অগ্নিতে। রুদ্রের এমন রুপ দেখে শরীরে হিম ধরে আসে উমার। হাত পা জমে যায় অজান্তেই। মনের এক কোনে কালো শীতল ভয় জট পাকাতে শুরু করে। ইহজীবনে কোনো মানুষের এমন রুপ সে দেখে নি; ছা পোষা নিখিলের ঘরে অভাব ছিলো বটে, তবে ত্রাশের ছিটাফোটা ছিলো না। রতী বেগম লোভী, দজ্জাল, অত্যাচারী তবে সে উমাকে কথায় আঘাত করতেন; তবে কখনো শারীরিক নির্যাতন করেন নি। রুদ্রকে দেখে উমার প্রথম যে প্রশ্নটা মস্তিষ্কে খেললো তা হলো,
“রুদ্র কি চোট পেয়েছে?”
উমার ভীত নজরকে উপেক্ষা করে আলমারির কাছে চলে গেলো রুদ্র। রক্তে ভেজা শার্টটা খুলে ছুড়ে ফেললো ঝুড়িতে। উমা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলো,
“এ..তো রক্ত? আপনি কি চো..ট পেয়েছেন?”
গামছাটা ঘাড়ে নিতে যেয়ে থেমে গেলো রুদ্র। সরু দৃষ্টিতে তাকালো উমার দিকে। উমার ভীত শুকনো মুখশ্রী দেখে কেনো যেনো তৃপ্তি লাগছে তার। এই ভীত মুখশ্রীর মোহে পড়েছিলো সে এক দিবস। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো উমার দিকে। উমা তখন ও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেই জায়গায়। রুদ্র খানিকটা ঝুকলো, উমার চোখে চোখ রেখে ফিসফিসিয়ে বললো,
“আমার জন্য চিন্তা হচ্ছে তোমার?”
রুদ্রের রহস্যপ্রবণ চোখ জোড়ায় চোখ রাখতেও ভয় হলো উমার। কেমন যেনো চোখ জোড়া, এক পৈশাচিক প্রবৃত্তি! উমা নজর সরিয়ে নিলো। কথাগুলো এলোমেলো হয়ে গেলো। গলার কাছে এসে সব কিছু যেনো হাওয়া হয়ে গেলো! উমাকে চুপ করে থাকতে দেখে শব্দ করে হাসলো রুদ্র। এক ভয়ংকর হাসি। শ্রবণেন্দ্রিয়তে হাসি ঝংকার তুলতেই গায়ে কাঁটা দিলো উমার। রুদ্র হাসি থামিয়ে উমার কানে মুখ লাগিয়ে বললো,
“এই রক্ত আমার নয়, এক জানোয়ারের। ওই শুয়োরের বাচ্চা, আমার উমাকে নিয়ে বাজে কথা বলার স্পর্ধা দেখিয়েছিলো।”
কথাটা শুনতেই উমার মনে শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। এক ভয়ংকর শীতল ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে এলো। তবে কি রুদ্র কাউকে খুন করেছে! রুদ্র মাতাল, অসভ্য, নারীলোভী কথাগুলো জানাছিলো উমার। কিন্তু তার ভেতর এক হিংস্র পশু লুকিয়ে আছে সে রাতের আধারে মানু্ষকে শিকার করে; এই সত্যটা যেনো হজম হলো না উমার। রুদ্র আবারো ঝংকার তুলে পৈশাচিক হাসি হাসলো। উমার ভীত মুখশ্রীর উপরের অবাধ্য চুলগুলো রক্তাক্ত হাতে সরিয়ে দিয়ে ধীর শীতল কন্ঠে বললো,
“চিন্তা করো না, খুন করি নি। বেঁচে আছে শুয়োরটা। তবে এমন শাস্তি দিয়েছি আজীবন স্মরণে রাখবে।”
হ্যা রুদ্র কারোর খুন করে নি একথা সঠিক তবে মৃত্যু থেকেও খারাপ অবস্থায় এখন বাদল। বাদল, রুদ্রের বন্ধুমহলের একজন। সন্ধ্যের কথা, গুদামে চা খাচ্ছিলো রুদ্র। মদ খাবে না বিধায় এখন চা খাওয়ার বাতিক হয়েছে। নয়ত মাথা যন্ত্রণায় ছিড়ে যায় তার। সেই মূহুর্তে বাদল, শাবীব, রক্তিম, তূর্য, সৌমিকের আগমন ঘটে গুদামে। রুদ্রের অনুপস্থিতি তাদের বিরক্ত করছে। যে রুদ্র সন্ধ্যা হলেই বোতল খুলতো। সেই রুদ্র এখন এক দিন অন্তর অন্তর বোতল খুলে তাও খুব ই কম মদ্যপান করে। এক পেগ, আধ পেগ খেয়েই সে উঠে যায়। বন্ধুদের সাথে নিষিদ্ধ পল্লীতেও যায় না সে। গুদাম, বাড়ি, বাড়ি, গুদাম—- এই তার দৌড়। তাই বিরক্ত বন্ধুরা জড়ো হয়েছে গুদামে। যে করেই হোক আজ সারারাত তাদের সাথেই থাকবে রুদ্র। নিষিদ্ধ পল্লীতেও যাবে তারা। এটাই তাদের ইচ্ছে। গুদামে বন্ধুদের দেখেই রুদ্রের সন্দেহ হলো। অভিনব সিংহের কড়া নির্দেশ উলটা পালটা কোনো কাজ সে আসার আগ অবধি যেনো রুদ্র না করে। একটা ঝামেলা ইতিমধ্যে সে করে ফেলেছে। যার কারণে অভিনব সিংহের শহরে ছুটতে হয়েছে। শাবীব এসেই চেয়ার টেনে বসলো। হেসে আবদার করলো,
“দোস্ত, আজ বৃহস্পতিবার, আজকের রাত আমাদের। চল, ফিরু বু বলেছে কড়া মাল এসেছে। তাই চল যাই।”
“আমি যাবো না। তোরা যা”
রুদ্রের কঠোর অসম্মতিতে রক্তিম জোর করলো,
“বিয়ের পর থেকেই এই বাহানা শুনছি চল না ভাই”
“বললাম তো যাবো না, বাবা মানা করেছে। বাবা আসুক, এর পর যাবো”
বন্ধুদের হাজারো আবদার, আকুতি বাদেও যখন রুদ্রের সম্মতি হলো না তখন হিনহিনে স্বরে বাদল বললো,
“কেনো রে! বউ কি খুব ভালো সেবা করছে নাকি? একেবারে বউ লেউটা হয়ে উঠলি যে বড়। তা আমাদের একটু ভাগ তো দিতেই পারিস। গ্রামের সুন্দরী মেয়েটাকে একা একাই ভোগ করছিস।”
তূর্য, রক্তিম, শাবীব তাকে থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু সে থামে না। বাদলের কথাগুলো কানে যেতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রুদ্রে। রাগে গা কাঁপতে থাকে। নিজের সম্পত্তির উপর অন্য কারোর কু নজর একেবারেই সহ্য হয় না তার। উপরন্তু বাদলে বাজে কথাগুলো তার মাথায় আগুন জ্বেলে দেয়। ব্যাস, ক্রোধ সংবরণ না করে ইচ্ছেমতো আপাদমস্তক মারে বাদলকে সে। এতোটাই বাজে ভাবে যখম করে যে ছেলেটা রক্তবমি অবধি করে। কেউ ঠেকাতে পারে না রুদ্রকে। পরিশেষে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“বন্ধু বলেছিলাম তাই জানে মারলাম না। এর পরে আমার জিনিসে নজর দিলে মাটিতে পুতে ফেলবো। এই নিয়ে যা ওকে”
বাদলকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যায় শহরে। তার বুকের পাজরে এতো লাথি দিয়ে রুদ্র যে তা ভেঙ্গে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বাদলের রক্তেই তার সাদা শার্ট আজ রক্তে রঞ্জিত। রুদ্র শীতল স্বরে বলে,
“একটি কথা মনে রেখো, তুমি আমার ব্যাক্তিগত জমাপুঁজি। কেউ তোমার দিকে চোখ উঠিয়ে তাকালে সেই চোখ আমি গালিয়ে দিবো। তুমি আমার, শুধু আমার। তোমার দেহ, হৃদয়, মস্তিষ্কে শুধু আমার রাজত্ব চলবে। অন্য কোনো পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। স্বপ্নেও যদি তেমনটা হয়; তবে এই পৃথিবীতে সেদিন ই তোমার শেষ দিন। শুনেছি খুব ছাত্রী তুমি, রপ্ত করে নাও। শাশ্বতের সাথের সেই সকালের ঘটনাটাই যেনো শেষ ঘটনা হয়।”
রুদ্রের কন্ঠ শীতল, ঠান্ডা কন্ঠে আড়ষ্টতা নেই। ঠান্ডা স্বরে কোনো মানুষ কাউকে হত্যা করা কথা বলতে পারে এই প্রথম দেখলো উমা। সে চোখ তুলে তাকালো না। শব্দহীন মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। বুকের ভেতরটা ভয়ে আতঙ্কে চুপসে গিয়েছে উমার। এতোটা ঠান্ডা মস্তি তার মাথাটা চিন্তাশূন্য হয়ে যাচ্ছে, অতিরিক্ত ত্রাশে চিন্তাশক্তি যেনো লোপ পাচ্ছে উমার। রুদ্রের চোখের দিকে তাকানোর সাহসটা হলো না তার। রুদ্র উমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো না, স্নানঘরে চলে গেলো। উমা এখনো দাঁড়িয়ে রইলো সেই স্থান। কিছু সময় বাদে অনুভব করলো তার গাল ভিজে গেছে নোনাজলে। বুকের বা পাশে চিনচিনে সূক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে তার। ব্যাথাটা প্রবল হচ্ছে এটা ভেবে সেদিন বাঁচার সুযোগ ছিলো তার। শাশ্বত তাকে এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে দেবদূত হয়ে এসেছিলো, কিন্তু ভয়ে, জড়তা, কাপুরুষতার কারণে সে এই সুযোগটাও হাতছাড়া করেছে। এখন এই জমিদার বাড়ির চার দেওয়ালেই তার ইহজীবন কাটাতে হবে। একটু সাহস করলে কি হতো! কি বা হতো!
রাতে খাবারের পর শরীর এলিয়ে দিলো রুদ্র। বিদ্যুৎ নেই, মোমের হলুদ কিরণে ঘরটি কিঞ্চিত আলোকিত হলেও সম্পূর্ণ অন্ধকারকে গ্রাস করতে পারে নি। উমা ফুলির মার সাথে হেসেলের সকল কাজ শেষ করে ঘরে এসেছে। রুদ্র সরু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে উমার দিকে। মেয়েটিকে দেখতে ভালো লাগে রুদ্রের। মেয়েটি যেনো তার চোখের খোড়াক। মোমের স্বল্প মৃদু আলোতে উমাকে কোনো অপ্সরা থেকে কম লাগছে না। লাল পাড়ের সুতি শাড়ি, আটপৌড়ে করে পড়া; সাপের ন্যায় চুল গুলো খোঁপা করে ঘাড়ের উপরে তুলে রাখা। ফর্সা ঘাড় বেধে ঘামের শতবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। সূচালো নাকের নিচেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঈষৎ গোলাপী ঠোঁটজোড়ায় যখন হাসির এক চিলতে প্রলেপ আটে বুকের কোনায় উথাল-পাতাল ঢেউ উঠে রুদ্রের। টানা টানা সুগাঢ় নয়নে যেনো কত অভিমান, বিষাদ, সঙ্কা জড়ো হয়ে থাকে। মেয়েটি হাসলে এই চোখ জোড়াও যেনো হাসে। কিন্তু আফসোস বিয়ের পর থেকে একদফাও তাকে হাসতে দেখে নি রুদ্র। চিরটা সময় এক রাশ ভয় নিয়ে তাকায় সে রুদ্রের দিকে। রুদ্র ছুলেই গুটিয়ে যায়। চোখ থেকে নোনাজলের জোয়ার উঠে। রুদ্রকে ছেলেবেলা থেকে শেখানো হয়েছে দূর্বলের উপর জোর খাটাতে হয়, ভয় ই একমাত্র অস্ত্র মানুষকে নিজের আয়ত্ত করার। উমাও ব্যাতিক্রম নয়। সে ভয় পায় তাই তার আয়ত্তে আছে, এবং থাকবে। ভালোবাসার মতো অবাস্তক কাব্যিক অনুভূতিতে বিশ্বাস করে না রুদ্র। সে বিশ্বাস করে, ভয় ই জয়ের একমাত্র উপায়। আজ ও তাই করবে, উমাকে হুকুমের স্বরে বললো,
“মোমটা নিভিয়ে আমার কাছে এসো।”
রুদ্রের কন্ঠ শুনতে ঈষৎ কেঁপে উঠলো উমা। কিছুক্ষণ পূর্বের স্মৃতি মাথা থেকে মুছে নি। ভয়ের কালো ছাপ এখনো বুকের ভেতরে বিচরণ করছে। উমার কোনো হেলদোল না দেখে অস্থির রুদ্র নিজেই এগিয়ে এলো, উমাকে টেনে নিজের কাছে বসালো। উমা তখন নতমস্তকে বসে রয়েছে। চোখ তোলার সাহস হচ্ছে না। রুদ্রের হাতের বেষ্টনী আরোও শক্ত হলো। এতো শক্ত যে শ্বাস নেওয়াও কষ্টকর হয়ে গেলো উমার জন্য। উমার চাপা আর্তনাদ করে উঠলো,
“লাগছে”
রুদ্রের ভ্রু ক্ষেপ হলো না। সে উল্টো আরোও শক্ত করে উমাকে জড়িয়ে ধরলো। উমার নতমস্তক দেখে ধীর স্বরে বললো,
“ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি কি এখন তোমাকে মেরে ফেলবো নাকি! তুমি ভালো হয়ে থাকলে আমিও ভালোই থাকবো। তুমি খারাপ হলে, আমিও খারাপ হবো।”
“লাগছে আমার”
“আমার কাছে থাকতে এতো আপত্তি কেনো তোমার বলতো?”
“…….”
“তোমার কৌতুহল হয় না আমায় নিয়ে? জানতে ইচ্ছে হয় না আমাকে?”
উমা এবার চোখ তুলে তাকালো রুদ্রের দিকে। রুদ্রের দিলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সে। রুদ্রের চাহনীতে নেই কোনো ক্রোধ, নেই কোনো পৈশাচিকতা। খুব কোমল, শান্ত একটা চাহনী। এই রুদ্র যেনো অচেনা এক রুদ্র। উমার এক আগে এই রুদ্রকে দেখে নি। কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে উমা,
“অভয় দিলে একটা প্রশ্ন করবো?”
“করো”
“বিয়ের রাতে কোথায় ছিলেন আপনি?……….
চলবে
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে দিবো।]