উমা পর্ব -০৮

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৮ম_পর্ব

উমা এবার চোখ তুলে তাকালো রুদ্রের দিকে। রুদ্রের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সে। রুদ্রের চাহনীতে নেই কোনো ক্রোধ, নেই কোনো পৈশাচিকতা। খুব কোমল, শান্ত একটা চাহনী। এই রুদ্র যেনো অচেনা এক রুদ্র। উমার এক আগে এই রুদ্রকে দেখে নি। কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে উমা,
“অভয় দিলে একটা প্রশ্ন করবো?”
“করো”
“বিয়ের রাতে কোথায় ছিলেন আপনি? লোকেরা কানাগোসা করছিলো যে আপনি নাকি নিখোঁজ। কোথায় ছিলেন সে রাতে?”

উমা ভীত স্বরে প্রশ্নটি ছুড়লো। স্বর এখনো কাঁপছে, কন্ঠে জড়তার তীব্র ছোয়া। কাঁচুমাচু হয়ে বসে রয়েছে সে। রুদ্রের ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া হবে জানা নেই উমার। রুদ্র মানুষটির আচারণ অনুমান করা বেশ দুষ্কর কার্য্য। মানুষটির চিত্তপটের তল পাওয়া ভার। অবশ্য উমা চেষ্টাও করে নি। মানুষ তার মনের গভীরত্ব মাপে যাদের প্রতি সুপ্ত নীল ভালোলাগা কাজ করে। যে মানুষটাকে সে ঘৃণা করে, ভয় পায় তার অন্তরে উঁকি দিয়ে কি বা হবে! ষোড়শী উমার মনের কৌতুহল গুলো রুদ্রের কাছে আসলেই বিলীন হয়ে যায়। হ্যা, তার বর চমৎকার পুরুষ। উঁচু, লম্বা, সুদর্শন, ধনবান; কিন্তু সৌন্দর্য কি সবকিছু? যার অন্তরে সামান্য দয়াটুকু নেই; অহমিকা, দাম্ভিকতায় পরিপূর্ণ মানুষটিকে ভাবনার গহীণে ঠায় দেওয়া যায়? প্রশ্নের উত্তর গুলো জানা নেই ষোড়শীর। জানার ইচ্ছেও নেই, সরীসৃপের মতো তো বেশ বাঁচছে সে। আজ হুট করেই মনের কৌতুহলের ডানা মেলে ধরলো সে রুদ্রের সামনে। রুদ্র উত্তর না দিয়ে উমার সাথে নিজের দূরত্ব কমিয়ে দিলো। এগিয়ে এসে স্পর্শের প্রগাঢ়তা বাড়ালো। কাঁধ বেয়ে নেমে আসা গহীন কালো ডেউ খেলানো চুল সরিয়ে নাক ঠেকে ষোড়শীর কাঁধে। এক অসম্ভব মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এলো রুদ্রের। ঘ্রাণটি রুদ্রের চেনা। উমার নিজস্ব মিষ্টি ঘ্রাণ। এই সুগন্ধে যেনো এক মাদকতা রয়েছে, প্রতিটা সময় যখন উমার সন্নিকটে আসে এই ঘ্রান তাকে তাকে মাতাল করে তোলে। কোনো মদে এই মাদকতা নেই। মেয়েটিকে তার ভালো লাগে, বড্ড ভালো লাগে। এই ভালোলাগার মাত্রাটা বাড়ছে। পাগলামীর নেশার মতো মত্ত করে তুলছে তাকে। রুদ্র কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে মাদকতাপ্রবণ কন্ঠে বললো,
“যদি বলি সে হাতে আমি খুব নিকৃষ্ট কাজ করেছি সইতে পারবে?”

কথাটা বলে মুখ তুললো রুদ্র। স্মিত হাসির প্রলেপ ঠোঁটে লেগে রয়েছে। রুদ্রের কথার উত্তর দিলো না উমা। শুধু রুদ্রের গাঢ় নয়নের পানে চেয়ে রইলো। মানুষের চোখ কখনো মিথ্যে কথা বলে না। যে মানুষ চোখের ভাষা গোপন করতে পারে সে মানুষ নয়, মানুষ রুপে শয়তান। উমার আজ বেশ অবাক হলো, কারণ সে রুদ্রের চোখ পড়তে পারছে। রুদ্র মিথ্যে বলছে না, ভয় ও দেখাচ্ছে না। তবে কি সত্যি প্রচন্ড নিকৃষ্ট কোনো কাজ করেছে সে! এবার নিজচিত্তকে প্রশ্ন করলো,
“সত্য শোনার সাহস কি আছে তোর?”

উত্তরে ক্ষীণ সঙ্কার পরিচয় মিললেও বেশ দৃঢ় প্রকল্প করলো রুদ্রের উত্তরে ভয় পাবে না সে। উমার ভীতু মুখশ্রীর সুদৃঢ় চাহনী দেখে হেসে উঠলো রুদ্র। হাসির ঝংকার চার দেয়াল গমগম করে তুললো। তারপর বললো,
“ছোট মানুষের এতো কৌতুহল ঠিক না।”

উমা চোখ নামিয়ে নিলো। অজানা কারণে বেশ আশাহত হলো সে। বুকের ভেতর কেনো যেনো এক চিলতে আশা জটলা বেঁধেছিলো, হয়তো রুদ্র হয়তো তার প্রশ্নের উত্তর দিবে। রুদ্র সুনিপুন ভাবে উমার চিন্তার মোড় বদলে দিলো। নির্লিপ্তকন্ঠে বললো,
“কাল ও বাড়ি যাবে?”

কথাটা শুনতে বিষন্ন চিত্ত উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠলো উমার। অবাক কন্ঠে বললো,
“আপনি আমায় ও বাড়ি নিয়ে যাবেন?”
“হ্যা, বিকেলে যাবো সন্ধ্যায় চলে আসবো। যাবে?”
“হ্যা”

ষোড়শীর চোখ চকচক করছে। পিপাসু ব্যাক্তি হাজারো মাইল চলার পর যখন কুয়োর সন্ধান পায় তখন যেমনটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে তার চোখ, উমার চোখ ও তেমন ই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রুদ্র স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
“বেশ, ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকালেই যাবো নাহয়।”

উমার ঠোঁট চিরে এক চিলতে হাসি উঁকি দিলো। রুদ্র খেয়াল করলো তার বুকের বা পাশটায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে, মেয়েটির এক টুকরো হাসি বুকচিরে গিয়েছে যেনো।

রুদ্র আর বসে থাকতে পারলো না সেখানে। উঠে দাঁড়ালো, নতুন সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে ঘরসংলগ্ন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো সে। মনের কোঠরে উৎপন্ন অচেনা, অজানা অনুভূতিগুলোকে ঠাহর করতে পারছে না রুদ্র। খুব বিচিত্র এই অনুভূতি, যার মাঝে এক রাশ সুখ, দুঃখ, ভয়ের অদ্ভুত সংমিশ্রণ লুকায়িত। এর পূর্বে এমন অনুভূতি পরিচয় পায় নি সে। সুখ উমার নিবিড় হাসির লুকোচুরিতে, বেদনা তার চোখে নিজের জন্য ঘৃণার ছাপে; ভয় তার ঘৃণার ছাপ প্রবল হবার। হুট করেই এক অদ্ভুত কালো সঙ্কা উঁকি দিলো মনের আঙ্গিনায়, নিজের চারপাশের দূর্ভেদ্য প্রাচীরে ফাটল ধরার সঙ্কা। এই সঙ্কা যে বড্ড ভয়ানক। এতোকালের রচিত খেলার মোড় পালটে দেবার জন্য যথেষ্ট। না না, ভুল করছে রুদ্র। নিজেকে সামান্য নারীর প্রতি দূর্বল করে তুলছে সে। ভুলে গেলে চলবে না, সে অভিনব সিংহ রায়ের পুত্র, এই গোপিনাথপুর গ্রামের ভবিষ্যৎ শাসক রুদ্র সিংহ রায়। সে সামান্য নারীর জন্য নিজেকে দূর্বল করতে পারে না। কদাপি না। রুদ্র গহীন আধারে চেয়ে রইলো। হাতে থাকা সিগারেট জ্বলছে। রাতের সাথে সাথে নিকোটিনের ধোয়া নিবিড় হচ্ছে, সে সাথে বুকের এক কোনায় জ্বলন্ত ছাই ছাপা লেলিহান শিখাটাও_____________

৬.
নিখিল বাড়ি ধুম পড়েছে। রতীরানী আপ্যায়নের ঘটা লাগিয়েছেন। মায়ের উৎসাহের কারণ খুঁজে পাচ্ছে না রাজশ্বী। যে দিদি মায়ের চক্ষুশুল ছিলো; তার দ্বিরাগমনে আসার সংবাদে মাকে এতোটা উৎসাহিত দেখে অবাক হওয়াটা অহেতুক নয়। রাজশ্বী মুখড়া কিশোরী, মুখে লাগাম নেই। উমা যতটা শান্ত, রাজশ্বী ততটা চঞ্চল। তার পক্ষে কথা মাটিতে ফেলা অসম্ভব। তাই তো হেসেলে মায়ের উৎসাহ দেখে প্রশ্ন ই করে বসে সে,
“মা, এতো আড়ম্বরতার রহস্য কি? বিয়ের পর বুঝি দিদির প্রতি আদর বেড়ে গেলো!”

রাজশ্বীর ঠেস মারা কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে রতী। রাজশ্বীর এই স্বভাব অতি অপছন্দের তার। হিনহিনে স্বরে বলে,
“মুখপুড়ি, ভুলে যাস না আমি তোর মা। মুখে যা আসছে তা বলছিস। হতচ্ছাড়ি, যা এখান থেকে”
“বাহ রে, সত্য কথা বললাম বুঝি রাগ করলে?”

রতীরানীর রাগ বাড়লো। অকথ্য ভাষা মুখ থেকে বের হবার আগেই নিখিল বাবুর কন্ঠ কানে এলো তার,
“কই গো, রুদ্রবাবা জীবন এসেছে। কই গো উমার মা”

নিখিলের স্বর শ্রবণ হতেই মুখের কথাটা গিলে ফেললো রতী। হাতটা ধুয়ে ছুটলো আঙ্গিনায় সে। মেকি হাসি মুখে একে স্নেহময়ী স্বরে বললো,
“উমা কেমন আছিস মা? এই কদিন কতো স্মরণ করেছি তোকে”

রতীর এমন ধারা কথা শুনে অবাক হয় উমা, মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে উমা। যে উমাকে ঘাড় থেকে নামাতে পারলে তিনি বাঁচে সেই উমাকে দেখে তার আদিক্ষেতার অন্ত নেই। মানুষ কতোটা রঙ বদলায়। গিরগিটির চেয়েও নিপুন ভাবে রঙ্গ পালটায় তারা। উদ্দেশ্য তাদের নিজস্ব বিষাক্ত স্বার্থ।

বাড়ির পেছনের পুরোনো বেল গাছের নিচে বসে রয়েছে উমা, রাজশ্বী এবং উমার ছেলেবেলার সখীরা। গল্পের আসর জমজমাট। কত প্রশ্ন তাদের, বিয়ের পর উমার জীবন কেমন? বর কেমন? জমিদার বাড়ির দিনগুলো কেমন? উমা শুধু হাসে, আর নিপুন হস্তে পায়ে আলতা দেয়। আলতা দিতে বড্ড ভালো লাগে তার। পাজোড়া লাল করে সারা বাড়িময় হাটতে এক অদ্ভুত আনন্দ রয়েছে। এর মাঝে সখী আখলিমা প্রশ্ন করে,
“হ্যা রে, দুলাভাই কি বদলেছে নাকি এখনো মাতাল হয়ে এদিক সেদিক পড়ে থাকে?”

আখলিমার প্রশ্নে কর্ণকুহরে যেতেই মাথা তুলে উমা। প্রশ্নটার সম্মুখীন যে হতে হতো জানা ছিলো, তবুও বেশ বিচিত্র লাগছে। রাজশ্বী কেনো দেয় আখলিমাকে, চোখ রাঙ্গায়। আখলিমা জিব কাটে। উমা নিজেকে সামলায়, স্মিত হাসি হেসে বলে,
“মানুষটা আজকাল নেশা করে না।”
“কি বলিস? জামাইবাবু মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে?”

অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে রাজশ্বী। উমা হাসির প্রস্থ বাড়ায়, মৃদু স্বরে বলে,
“জানি না, তবে মাতলামি করে না। বড্ড স্বাভাবিক থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে।”
“তোর বর অথচ তুই জানিস না?”

প্রশ্নটার উত্তর দেয় না উমা। শুধু হাসে। সত্যি ই তো, তার বর অথচ সেই জানে না। জানতে চায় না। পিছে পুনরায় রুদ্রের রুদ্রমূর্তির সম্মুখীন হতে হয়। ওই বাড়িতে সব কিছুই কেমন রহস্য, আর রুদ্র সবচেয়ে বড় রহস্য। এরই মাঝে রুদ্রের তীব্র হুংকার শুনলো উমা। ঈষৎ কেঁপে উঠলো তার শরীর। আলতার রেখা বেকে গেলো। আলতার বাটি উলটে পড়লো তার পায়ে। সেই আলতা রাঙা পায়েই ছুটলো অন্দরমহলে। অন্দর মহলে যেতেই নিখিলের ভীত মুখটা নজরে পড়লো। রুদ্রের দিকে চাইতেই হিম ধরে আসলো তার। চোখ জোড়া লাল হয়ে রয়েছে, চোয়াল শক্ত। অবাক উমা কারণ বুঝলো না। এতোক্ষণ তো ভালোই ছিলো। হুট করে কি এমন হলো!রুদ্রের নজর উমার দিকে পড়তেই বললো,
“বাড়ি চলো….”

চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here