#ঋণশোধ
#পর্ব২৪
#লেখাঃসাদিয়া_আফরিন_ইভা
অথৈয়ের কথাতে মনোয়ারা বেগম একটু অবাক হলেন তবে মনে মনে খুশিও হলেন। আবেগও অবাক হলো কিন্তু অনন্যার মন খারাপ হয়ে গেলো। মুখ গোমড়া করে ই জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি সত্যি চলে যাবে ভাবি?”
অনন্যার কথাতে অথৈ কেনো জানি একটুও নরম হলোনা। কিছু যায় আসেনা এমন ভঙ্গিতেই বললো, “হ্যাঁ”। অনন্যা আর কিছু বললো না। খাওয়া শেষ করে উঠে চলে গেল কলেজে। আর আবেগ খেতে খেতে ই অথৈয়ের দিকে তাকিয়ে কাহিনি টা বোঝার চেষ্টা করছিলো। তখন ই অথৈ আবেগকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“কাল তো শুক্রবার আপনার অফিস নেই। কাল কি একটু কষ্ট করে আমাকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসতে পারবেন?”
মনোয়ারা বেগম তার ছেলেকে ভালো করে ই চিনেন তার ছেলে “না” বলার চান্স ই বেশি তাই আবেগ মুখ খোলার আগেই মনোয়ারা বেগম বললেন,
“যাবেনা কেন অবশ্যই যাবে। দরকার হয় ও নিজেও গিয়ে থাকবে কয়েকদিন। তুমি একদম ভেবো না মা। তুমি ব্যাগ গুছিয়ে রাখো কাল সকাল সকাল রওনা হয়ে যাবে”।
আবেগ অথৈয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে এবার তার কাহিনি বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছু বুঝতে পারছিলো না। আর মায়ের এত আগ্রহ দেখে কেনো জানি আবেগের মুখ থেকে ফট করে বেড়িয়ে গেল
“সবচেয়ে বেশি ভালো হবে আজকেই অফিস থেকে ফিরেই চলে গেলে”
আবেগের কথাটা মনোয়ারা বেগম লুফে নিলেন বললেই,”সেই ভালো সেই ভালো তোরা আজই চলে যা। বউমা তুমি রেডি হয়ে থেকো ও ফিরলেই চলে যেও।”
আবেগের মনে হলো যেনো মস্ত বড় একটা ভুল করে ফেলেছে মুখ ফসকে ওই কথা টা বলে। ওর মা যে এভাবে ফাঁসিয়ে দিবেন বুঝতে পারেনি বেচারা। কি আর করার বলে ফেলছে এখন তো আর ফিরিয়ে নিতে পারবে না। নাস্তা করে অফিস চলে গেলো।
অফিস থেকে ফিরেই চলে যেতে হলো শশুরবাড়িতে। ওরা চলে যাওয়ার সময় অনন্যা মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে ছিলো। অথৈ যখন যাওয়ার কথা বললো তখন শুধু জিজ্ঞেস করলো, কবে আসবে? জবাবে যখন অথৈ বলেছে জানে না কবে ফিরবে তারপর আর কিছু ই বলে নি।তবে মনোয়ারা বেগম বেশখুশিমনে অথৈকে বিদায় দিলো।
বাসা থেকে বের হয়ে গলির সামনে দাঁড়িয়ে রিক্সা আসে কি-না তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো তখন অথৈ একটা মলিন নিঃষ্প্রাণ দৃষ্টিতে আবেগের দিকে তাকিয়ে ওকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“এবারে হাটিয়ে নিবেন না?”
অথৈয়ের চাওনিতে কি ছিলো কে জানে আবেগ কড়া কথা তো দূরে থাক মনটাকেও কঠিন করতে পারেনি। কেমন জানি কথা আটকে গেলো। কেনো জানি ওই চাওনি দেখে বলতে ইচ্ছে করছিলো “আর কখনও তোমাকে কষ্ট দিবোনা”। কিন্তু কিছু ই বলতে পারলো না। কয়েক মিনিটের মাথায় একটা রিক্সা পেলো সেটাতে করে বাসস্ট্যান্ড অব্দি গেলো। আড়চোখে একবার অথৈকে দেখার চেষ্টা করলো দেখলো অথৈয়ের দৃষ্টি কোনো একটা নির্দিষ্ট দিকেই রয়েছে। দিক পরিবর্তন করছে না।
বাসে উঠার পরেও একই অবস্থা। আবেগের কেনো জানি অথৈকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছিলো না। তাই জন্য জিজ্ঞেস করলো,
“হঠাৎ বাপের বাড়ি যাওয়ার শখ জাগলো কেনো আপনার পাটরানি?”।
আবেগ সব সময় যেমন করে অথৈয়ের সঙ্গে কথা বলে তেমন করেই বলেছিলো। কিন্তু অথৈ কোনো রেস্পন্স করলো না। অথৈ চুপ করে আছে দেখে আবেগ হাত ধরে ধাক্কা দিলো একটা তারপর আবারও বললো,
“তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দিচ্ছ না কেনো”।
অথৈ এবারও কিছু না বলে চুপচাপ আবেগের কাধে মাথা রাখলো। অথৈয়ের আচরণ হঠাৎ করে ওকে হতভম্ব করে দিচ্ছে। গতকাল জড়িয়ে ধরেছে আজকে আবার এভাবে কাধে মাথা রাখলো। আবেগ কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না।
বাসায় পৌঁছে অথৈ চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো কারোর সঙ্গে কথা বললো না।
অথৈয়ের বড় বোনও সেখানে উপস্থিত ছিলো সে সহ সবাই অথৈয়ের আচরণ এ অবাক হয়ে আবেগের দিকে তাকালো। তাদের ওভাবে তাকানোর অর্থ বুঝতে পেরে মনে মনে বলল, “বোধহয় ফেসে গেছি”। আবেগ সবার তাকানো দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো তখন যেনো সবার হুস এলো। আবেগ কে নিয়ে বসালো ওর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে গেল। অনু অথৈয়ের কাছে গেল কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু অথৈ কথা বললো না অনুকে বললো চলে যেতে ও একা থাকতে চাইছে। অনু বোধহয় বুঝতে পারলো তাই উঠে চলে গেলো।
রুম থেকে বের হয়ে আবেগের চোখে চোখ পড়লো। আবেগ তাকিয়ে রইলো এটা ভেবে যে ওদের মধ্যে কি কথা হয়েছে, অথৈ অনুকে কি বললো। আবার অনু ভাবতে লাগলো আবেগ এভাবে তাকিয়ে রয়েছে কি জন্য? অথৈয়ের কি হয়েছে সেটা বুঝতে না পেরে না-কি ওর কারণে অথৈয়ের কিছু হয়েছে সেজন্য। আবেগের তাকিয়ে থাকা দেখে অনু ভাবনা বাদ দিয়ে একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিলো কিন্তু সেই হাসিটা কেমন যেনো মলিন ছিলো। আবেগের খটকাগুলো যেনো বেড়ে যাচ্ছিলো। অনু ড্রয়িংরুমের পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো ওর মায়ের কাছে। আবেগ এসেছে দেখে নাস্তা বানানোর জন্য গিয়েছেন। অনুকে রান্নাঘরের দিকে আসতে দেখে ওর মা ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে অথৈয়ের। অনু ইশারায় জবাব দিয়ে বললো কাছে এসে বলবে। আর আবেগ তাকিয়ে সব দেখছিলো তাই ইশারা টা দেখে ফেললো।
অথৈয়ের বাবা আবেগের সঙ্গে কথা বলছিলেন আবেগের সেদিকে কোনো মন নেই। অনুকে রান্নাঘরে যেতে দেখে আবেগও উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলো। আর শশুরকে বললো একটু ওয়েট করতে শাশুড়ীকে একটা কথা বলার আছে বলে ই চলে আসবে। অথৈয়ের বাবা আর কিছু বললেন না। আবেগ রান্নাঘরের কাছাকাছি এসে দাড়ালো যাতে কি কথা বলে সেটা শুনতে পায়। অনু রান্নাঘরে ঢুকতেই ওর মা জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে অথৈয়ের? তার কথার জবাবে অনু বললো,
“অথৈ কিছু বলে নি মা। আমি জিজ্ঞেস করলাম পর আমাকে বললো একা থাকতে চাইছে বিরক্ত যেনো না করি”
“জামাইয়ের সাথে কি কিছু হলো না-কি?”
“এমন কিছু মনে হলো না আমার, যদিও হতে পারে। কিন্তু আবেগ ওকে যে পরিমাণে ভালোবাসে আমরা জানি তাতে ওর সঙ্গে কিছু হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।”
“তাহলে কি হলো মেয়েটার! সেই ঘটনার পর তো আর এমন মুখের অবস্থা আমি কোনোদিন দেখিনি”
“মা”
“কি”
“আমারও একদম এই জিনিসটা ই মনে হলো ওর মুখ দেখে। কিন্তু তুমি আমি ছাড়া কেউ-ই তো ওই ঘটনার কথা জানে না। বাবা বা অন্তুর বাবা ও না। তাহলে ওর হঠাৎ কিভাবে ওই ঘটনা মনে পড়লো।”
“আমার বড্ড ভয় করছে রে অনু! সত্যি সত্যি ই যদি মনে পড়ে যায় এবার ওকে কিভাবে সামলাবো।”
কথাটা উনি অনুর হাত ধরে বলে কেঁদে ফেললেন। অনু বিরক্ত হয়ে বললো,
“আহ মা৷ সব কিছু তেই তোমার এমন বাড়াবাড়ি টেনশন। এখনও তো জানি না কি হইছে আসলে। তার আগেই কেঁদে ভাসাই দিতেছো”
অনু এই কথা বলার পর উনি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে কাজ করতে লাগলেন। আবেগ আর দাঁড়ালো না। ওইটুকু শুনেই ওখান থেকে সরে গেলো। আর যেতে যেতে ভাবতে লাগলো অথৈয়ের সঙ্গে এমন কি ঘটেছে যাতে অথৈ এমন হয়ে গেছে। যেকোনো উপায়ে ই এটা ওর জানতে হবে। অথৈয়ের থেকে জানা সম্ভব না কিছুতেই। অনুর থেকে জানার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে এটা ভেবে ড্রয়িংরুমে ফিরে গেলো।
রাতের খাবার খেতে অথৈকে ডাকা হলো কিন্তু অথৈ এলো না। খাওয়া শেষ করে রুমে ঢুকে দেখলো অথৈ বিছানার উপর গুটিশুটি মেরে বসে আছে। আবেগের অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলো। অনু খাওয়া শেষ করে আরেকবার এসেছিলো অথৈয়ের কাছে কিন্তু কোনো সুবিধা করতে পারে নি। তাই চুপ করে বাসায় ফিরে গেলো। রাতে আবেগও ভালো করে ঘুমাতে পারলো না। যতবার চোখ খুললো ততবারই দেখলো অথৈ ওভাবেই বসে আছে। কেনো জানি ইচ্ছে করছিলো হাত ধরে টেনে বুকে জড়িয়ে নিতে কিন্তু কিসে জানি বাধা দিচ্ছিলো বলে নিতে পারছিলো না। অথৈ ওভাবেই বসে রইলো আর আবেগ শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগলো। এমন করে করে যে কখন ঘুমিয়ে গেলো নিজেই টের পেলো না।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলো অথৈ ওভাবেই বসে ঘুমিয়ে গেছে। আবেগ ওকে আস্তে করে ধরে শুইয়ে দিলো। তারপর ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে গেলো। অনুর সঙ্গে যেভাবে ই হোক কথা বলতে হবে। কিন্তু ওইদিন কথা বলার চেষ্টা করার সুযোগ ই পেলো না। হঠাৎ অনন্যার কল এলো বলে চলে যেতে হলো।
#ঋণশোধ
#পর্ব২৫ (শেষ পর্ব)
#লেখাঃসাদিয়া_আফরিন_ইভা
অথৈকে বাবার বাড়িতে রেখে আসার বয়স প্রায় দু সপ্তাহ হলো। এরমধ্যে আবেগ অথৈকে নিয়ে ভাবার সময়ও পায় নি। কাজের চাপ অনেক বেশি ছিলো আর মায়ের অসুস্থতার জন্যও কিছু টা ব্যস্ত ছিলো। সেদিন মায়ের অসুস্থ হওয়ার কথা শুনে আবেগ দ্রুত ফিরে এসেছিলো। অথৈয়ের ওইরকম অবস্থা দেখে ওকে আর জানায় নি মায়ের অসুস্থতার কথা।
আরও এক সপ্তাহ বাদে কাজের চাপ অনেক কমে গেল। তখন ভাবলো অথৈয়ের খোঁজ নেয়ার কথা। অথৈকে কল করে তেমন একটা সুবিধা করতে পারবে না তাই অনুকে কল করলো। কল রিসিভ করে ই অনু বললো,
“বাব্বা এতদিন পরে কি মনে করে কল দিলেন শুনি”
“সরি। আসলে অনেক ব্যস্ত ছিলাম তাই সুযোগ করে উঠতে পারিনি। অথৈ কেমন আছে?”
“নিজের বউয়ের খবর আমার কাছে চাইছো কেনো, তার টা তাকেই জিজ্ঞেস করো না”
“না মানে আসলে ওর সঙ্গে হয়নি”
“কি বলো? তোমার এত ভালোবাসার বউয়ের সঙ্গে কথা হয়নি তোমার!”
” না মানে আসলে.. ”
“কি না মানে আসলে? এত মানে মানে করছো কেনো?”
“আসলে ওকে যখন রেখে এসেছি তখন তো আপসেট ছিলো, কথা বলার চেষ্টা করলেও উত্তর দিতো না তাই কল করা হয়ে উঠেনি এই ভেবে যে যদি না ধরে। আর ও এতদিন বাদে কেমন আছে ভালো না খারাপ এটা তোমরা যারা আশেপাশে রয়েছ তারাই বলতে পারবে। ওকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো খারাপ থেকেও বলতো ভালো আছি তাই আরকি”
“বাব্বা কি লজিক। তা এতদিন পরে কেনো, এতদিন দাও নি কেনো? এখানে কি লজিক দিবেন শুনি”
“হাহা ওই যে বললাম কাজের প্রেশার ছিলো। আর মাও একটু অসুস্থ ছিলো যার জন্য সুযোগ হয়ে উঠে নি।”
“কি হয়েছে আন্টির? আমাদেরকে কিছু জানাও কি কেনো?”
“তেমন সিরিয়াস কিছু নয়। প্রেশার হাই হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলো আরকি। এখন আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছে।”
“আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে কাজ টা একদম ভালো করোনি তুমি”
“আচ্ছা বাদ দেও এসব এটা বলো অথৈ কেমন আছে”
“বাব্বা বউয়ের খোঁজ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে জনাব।”
অনুর এই কথার জবাবে আবেগ কিছু বললো না। অনু নিজেই আবার বললো অথৈ ভালো আছে। অথৈ ভালো আছে বলার পর আবেগ জানতে চাইলো অথৈ কি বলেছে ওর মন খারাপ হওয়ার কারণ কি। অনু একটু আমতা আমতা করছিলো দেখে আবেগ ভাবলো বুঝি ওর বিষয় এ কিছু বলেছে। তাই এই ব্যাপার টা না ঘেটে ওই বিষয় এ জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা অনু অথৈয়ের কি কোনো খারাপ অতীত আছে? যেটা মনে করলে ও আপসেট হয়।”
“ক ক ই না তো”
“মিথ্যা বলো না। সেদিন তোমরা রান্নাঘরে যা বলেছো আমি শুনেছি। এতকথা অবশ্য ফোনে বলা সম্ভব না। আমি বিকেলে আসছি তোমাদের ওখানে আর অথৈ কে কিছু জানিয়ো না,এখন রাখলাম।”
এই কথা বলে আবেগ কল কেটে দিলো। আর অনু কিছু ই বললো না। আবেগ কল কেটে দিলে অনুও ফোন কান থেকে সরিয়ে ফেলে ভাবতে লাগলো কি করবে। আবেগকে সব কিছু বলে দেওয়া টা কি উচিৎ হবে? কিন্তু ওর তো জানার অধিকার আছে। অথৈ ভালো আছে বলেছে ঠিকই কিন্তু আসলে তো অথৈ ভালো নেই। সেই থেকে ই কেমন যেনো হয়ে আছে। তবে বলেছে সেই ঘটনা টা মনে পড়লো বলে ওর এমন অবস্থা। কিন্তু কি করে হঠাৎ মনে পড়লো এটা বলে নি,এই টুকুই জানিয়েছে।
আবেগ যদি জানে তাহলে হয়তো এই ট্রমা থেকে ও অথৈকে বের করে আনতে পারবে।
অথৈয়ের একার চেষ্টায় যে বেরুতে পারছে না সেটার নমুনা দেখা ই যাচ্ছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না অনু।
বিকেলে আবেগ অণুদের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। বাসায় তখন অনু আর অন্তু ছিলো।
আবেগ এসেছে দেখে অনু ওকে নাস্তা দিলো। যেহেতু আগে থেকে ই জানতো আসবে তাই আগেই রেডি করে রেখেছিলো।
আবেগ অল্প কিছু খেয়ে অনুকে আবার জিজ্ঞেস করলো। অনু একটু আমতা আমতা করছিলো দেখে আবেগ বললো,
“দেখো অনু ফোনেই বলেছিলাম আমি তোমাদের কথা শুনে ফেলেছি। তাই প্লিজ আমাকে ঘটনাটা বিস্তারিত বলো। হয়তো আমার এটা জানা জরুরি! কি এমন ঘটেছে যে জন্য অথৈ এমন হয়ে গেছে। আমি ওই কথাটা বলার পর.. ”
অনু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কোন কথাটা? কি বলেছিলে ওকে? আমিও তো ভাবি হঠাৎ করে মনে পড়ার তো কথা নয় ওর! কি বলেছিলে তুমি আবেগ? ”
অনুর এভাবে হাইপার হয়ে যাওয়াতে আবেগ একটু দমে গেল গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তেমন কিছু না। আমি জাস্ট জিজ্ঞেস করলাম যে ও এত শক্ত কি করে হয়ে গেছে আগে তো বোকাসোকা শান্ত মেয়ে ছিলো। এই কথা বলার আগ অব্দি আমার সব কথার জবাব দিচ্ছিলো কিন্তু বলার পর থেকে যে চুপ করে গেছে এখনও তাই।”
অনু আবারও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি ওকে আগে থেকে চিনতে?”
“হ্যাঁ। আমি ইন্টারে যে কলেজে ছিলাম ও সেখানে ই স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়তো।”
“ওহ মাই গড! তুমি কি তখন থেকে ই অথৈকে পছন্দ করতে!”
“এগুলো বাদ দাও। মেইন টপিক ঘুরে যাচ্ছে”।
অনু নিজেকে অনেক বুঝিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো আবেগ কে সবটা বলবে তাই বলতে শুরু করলো,
“ঘটনা টা ঘটে অথৈ যখন এস,এস,সি দিলো তখন। শেষ পরীক্ষার দিন ওকে ওর ক্লাসের একটা ছেলে ডেকে নিয়ে বলে ওর সঙ্গে নাকি ওই ছেলের কথা আছে। ছেলেটা ওর ক্লাসমেট ই ছিলো বলে আগে পিছে না ভেবে
ও ওই ছেলের সঙ্গে কথা বলতে যায়। কথা বলার এক পর্যায়ে না-কি পিছন থেকে কেউ এসে ওর মুখ বেঁধে ফেলে। দেন গাড়িতে করে ওকে একটা বাড়িতে নিয়ে যায় আর সেখানে..! ”
এইটুকু বলে অনু থেমে গেল। আবেগের যেনো উত্তেজনায় কান গরম হয়ে গেলো।
অনুকে তাগদা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তারপর? তারপর কি অনু?”
এক অজানা আতংক যেনো আবেগ কে ঘিরে ধরেছে। অনু একটু থেমে আবারও বলতে লাগলো,
“ওকে তুলে নিয়ে কি করার চেষ্টা করলো বুঝতে নিশ্চয়ই পারছো? ও যে সহজ সরল বোকা আর ভিতু মেয়ে ছিলো এটা তো তুমি জানতে। ওই ঘটনার পর থেকে অথৈ অস্বাভাবিক হয়ে যায়। ঘুমের ঘোরেও বারবার লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতো। ঘরের বাইরে বেরুতো না। অন্ধকারকে ও তো ছোটো থেকে ভয় পেতোই এই ঘটনার পর থেকে ভয় আরও বেশি বাড়লো। ১ টা বছর নষ্ট হয়েছে এই ঘটনাটা কাটিয়ে উঠে গিয়ে নিজেকে সামলে নিতে। এখানে চলে এলাম ওই ঘটনাটার ছয়মাস পরে, এরপর আমার বিয়ে হলো আমি অন্তুর বাবাকে বললাম আমি আমার বোনের আশেপাশে থাকতে চাই, সেও রাজি হয়ে কাছেই বাসা ভাড়া নিলো আরকি৷ তখনও স্বাভাবিক ছিলো না, এরপর কলেজ ভর্তি করলো তারপর থেকে স্বাভাবিক হতে শুরু করলো”।
অনুর কথা শুনে আবেগ কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলো। মনে মনে ভাবলো অথৈ তো সব ছেলের সঙ্গে প্রেম করে বেড়াতো এজন্যই বুঝি কেউ কিন্তু ঘটনাটার কথা ভেবে একটু ঘৃণাও হচ্ছিলো। একটু কনফিউজড হয়ে গেছে তাই ক্লিয়ার করতে জিজ্ঞেস করলো,
” কিছু মনে করো না অনু একটা প্রশ্ন ছিলো”
“হ্যাঁ বলো”
“ওই ছেলে কেনো নিয়েছিলো কিছু কি জানো বা কিছু কি করতে পেরেছে.?আই মিন…!”
“না কিছু করতে পারেনি, এজন্য আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করি। ওকে নিয়ে যেতে দেখেছিলো দুইটা ছেলে।
আর অথৈ চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে হলেও সবাই ওকে চিনতো, সাথে আমাদেরও। ওদের একজন ওই ছেলের গাড়ির পেছনে গিয়েছে ঠিকানা দেখতে আর অন্যজন আমাদের বাসায়। ছোট ছেলেদের হাতে ফোন দেয়াটা যেমন অপকারের তেমনি হয়তো উপকারেও। আর সেটার নমুনা ওরাই দিলো। একজন অন্যজনকে ইনফরমেশন দিলো আর এজন্যই আমরা সবাই খুব দ্রুত সেখানে পৌঁছে যাই। কিন্তু পৌঁছাতে পৌঁছাতে অথৈয়ের যা ভয় পাওয়ার পেয়ে গেলো। ওকে রক্ষা করতে পারলেও ভয় থেকে ওকে রক্ষা করতে পারলাম না। ”
“কেনো নিয়েছে জানো কিছু?”
অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“সেও একটা মস্ত বড়ো ইতিহাস। ওর ক্লাসফ্রেন্ড মানে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ই ওর নাম নিয়ে ছবি নিয়ে ছেলেদের সঙ্গে রিলেশন করতো। দুজনেই যেহেতু বেস্ট ফ্রেন্ড তাই যখন ই ছবি তুলতে চাইতো অথৈ কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যেতো। তখন তো আর জানেনা ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে। আমাদের বাসায় তখন একমাত্র ফোন আব্বুর ছিলো। আমাদের দু’বোন এর কাউকে তখনও দেয়নি। ওই মেয়ের কোনো এক বয়ফ্রেন্ড ছিলো ওই ছেলেটা। সেই অথৈকে অনেক কিছু জানানোর কারণে বাকিটা আমরা খোজাখুজি করে জানতে পারি। ছেলেটা পরে মাফ চেয়েছে কিন্তু মাফ চেয়ে হবে কি? ক্ষতি যা হওয়ার সেটা তো হয়ে গেছে।”
আবেগের মাথায় যেনো বড়সড় একটা বাজ পড়লো। এসব সে কি শুনছে! অথৈ তাকে ধোকা দেয় নি? অথৈ কোনো ছেলের সঙ্গে রিলেশন করে নি! সে শুধু শুধু অথৈকে ভুল বুঝছিলো! কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? ওর ফ্রেন্ড রা তো দেখিয়েছে এক দুইজন কে কথাও বলতে দেখেছে অথৈয়ের সঙ্গে। মাথা কাজ করা অফ করে দিলো আবেগের। এতকাল পরে এসব সে কি শুনছে!
আবেগকে চুপ করে থাকতে দেখে অনু জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে ওর। আবেগ তখন ডাবল শিওর হতে জিজ্ঞেস করলো
“অনু তুমি যা যা বললে সব কি সত্যি? কোথাও কোনো ভুল নেই তো”।
“মানে!”
“মানে অনেককিছু। আমার মাথা একদম উলট পালট হয়ে যাচ্ছে।”
অনু আবেগের কথা কিছু বুঝতে পারছিলো না। তখন আবেগ অনুকে সব টা বুঝিয়ে বলে এবং এটাও বলে যে কি কারণে ও অথৈকে বিয়ে করেছিলো। অনু অবাক হয়ে গেলো, বললো,
“তাহলে অথৈ সত্যি কথাই বলেছিলো।”
“কি সত্যি কথা?”
“তুমি বিয়ের পর বাসর ঘর থেকে শুরু করে আমাদের বাড়িতে আসা অব্দি যা যা করেছ সেগুলো।”
অনুর কথা শুনে আবেগের অনুশোচনা হতে লাগলো। মুখ কালো করে ই হ্যাঁ সুচক মাথা নেড়ে সায় দিলো। অনু ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। অনু কিছু বলে উঠার আগেই আবেগ মাফ চাইলো। আর বললো,
“বিশ্বাস করো অনু আমি যদি একটা বারের জন্যও জানতাম সে ঘটনা এমন তাহলে কখনও এমন করতাম না। আমি ওকে সেই থেকে ভালোবাসতাম.. যখন জানতে পারি বহু ছেলেদের সঙ্গে ওর রিলেশন তখন এত ভেঙে পড়ে যাই। ওর মতো আমারও একটা বছর নষ্ট হয়েছে। তাই অনেক বছর পর যখন দেখলাম তখন আমি প্রতিশোধ নেয়ার কথা ভাবলাম৷ আমি খুব সরি, কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি অনু আজকের পর আমি আর ওকে কোনো কষ্ট পেতে দিবো না। বিশ্বাস করো”
“তুমি তো আমাদের থেকে ওর বিষয় এ অনেক কিছু জানতে চেয়েছো তাহলে এগুলোর কথা কেনো জানতে চাইলে না?”
“কারণ আমি ভেবেছিলাম আমি সব কিছু জানি ই। নতুন করে এজন্য জিজ্ঞেস করিনি। আর সব সময় তো সব কিছু ফ্যামিলির মানুষ জানে না, তাদের জানার বাহিরেও কতকিছু ঘটে। আমি ভেবেছি অথৈয়ের এসব কথা তোমরা হয়তো জানো না আর জানলেও হয়তো বলবে না।”
অনু মনে মনে ভাবলো হয়তো আবেগ ওর যায়গায় ঠিক। অথৈ ওমন মেয়ে হলে সেটা ওরা আবেগকে জানাতো না। কিন্তু অন্যকোনোভাবে তো যাচাই করে দেখতে পারতো। তাই বললো,
” হ্যাঁ হয়তো আমরা জানাতাম না। কিন্তু তুমিও তো ভালো করে খোঁজ নিয়ে জানতে পারতে, যা দেখেছো, শুনেছো সেটা সত্যি কি-না।”
“হ্যাঁ হয়তো। কিন্তু ওই বয়সের আবেগটাই এমন যে লজিক কাজ করে না। একটা বারও আমার মাথায় আসেনি যে ভুল না ঠিক এটা একটাবার যাচাই করি।যাচাই না করে নিজেই নিজেকে কষ্ট দিলাম। এখন যা হয়ে গেছে সেটা তো আর ফেরাতে পারবো না বলো”
অনু আর কিছু বললো না কারণ আবেগের কথাগুলো ঠিক। আর ভুল বুঝে শুধু অথৈকে নয় নিজেকেও তো কষ্ট দিয়েছে।
তাই আর কিছু বললো না চুপ করে রইলো।
আবেগ অনুকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো,
“তুমি কি আমার উপর রাগ করলে অনু?”
” না। প্রথম একটু লেগেছে বাট বুঝতে পারছি যা ঘটেছে সেটাতে তোমারও ক্ষতি হয়েছে তাই রাগ না রেখে ফেলে দিলাম। কিন্তু আমার বোন যদি এরপর কেঁদেছে শুনি তাহলে কিন্তু.. ”
অনুর কথা শুনে আবেগ হাল্কা হেসে বললো,
“কথা দিচ্ছি। আর কখনও কষ্ট পেতে দিবোনা।”
“হ্যাঁ দিও না আর৷ বেস্টফ্রেন্ড এর থেকে ধোকা খেয়ে আমার বোনটা এমন হয়েছে।
ওকে একটু সামলে নিও”
“ইনশাআল্লাহ! দোয়া করো। আমি তাহলে যাই? অথৈকে বাসায় নিয়ে যাব”।
অনু হাসিমুখে আবেগকে বিদায় দিলো। তবে মনে কোনো সংশয় রইলো না আবেগকে নিয়ে কারণ অথৈয়ের প্রতি ভালোবাসাটা ও আবগের চোখে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে। আবেগের ভালোবাসাই ওর বোন কে ভালো করে বাঁচতে শেখাবে।
আর আবেগ নিজের সব ভুল বুঝতে পেরে যাচ্ছে অথৈয়ের কাছে। এবার সব ঋনশোধ হয়ে শুধু ভালোবাসাটা বাকি থাকবে। মনে মনে বলল, “আমি আসছি অথৈ আবেগে ভাসাতে তোমায়।”
সমাপ্ত।।
(