#এই_মনের_আঙিনায়[২]
#কুরআতুল_আয়েন
আদুরীর সাথে শাওনের বেশ ভাব জমেছে!খালাতো ভাইয়ের সম্পর্ক!আদুরীর বড় খালার ছেলে।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ নিয়ে পড়ছে।ফারিহার বিয়ে উপলক্ষে আসা।আদুরীর এখন মনে হচ্ছে মেঝোআপা ঠিকই বলেছিলো বেশিদিন থাকলে সবার সাথে সখ্যতা এমনেই গড়ে উঠবে।আর তাই হলো!আদুরী মনে মনে ভীষণ খুশি হয়।নানুবাড়িতে তার সময় গুলো দিব্যি কেটে যাচ্ছে।তার উপর বাহিরে হালকা হালকা বৃষ্টি আদুরীর মন’কে যেনো দ্বিগুণ বেগে উৎসাহিত করলো।বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।এদিকে দাঁড়ালে বাড়ির পেছনের দিকটা’য় দৃশ্যমান হয়ে উঠে।কলপাড় পেরিয়ে গাছগাছালির বিশাল স্তূপ।দানবের মতো উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ঘরের ভেতর থেকে অর্পার গলা পেতেই আদুরী আর দাঁড়ালো না।পর্দা ঢেলে ঘরে প্রবেশ করলো।আদুরী যেতেই অর্পা বললো,
‘আদুরী!বসারঘরে চল।সবাই ওখানে আছে।তোকে খুঁজছে।’
‘কেনো আপু।’
‘মুড়ি মাখা হয়েছে।সবাই খেতেও বসে গিয়েছে।এখন না গেলে আর পাবিও না।আর,একা একা এখানে বসে কি করছিস।’
‘বৃষ্টি দেখছিলাম আপু।’
‘বৃষ্টি কি দেখার জিনিস!’
আদুরীর পাল্টা জবাব,
‘দেখার জিনিস নয়!’
‘না’রে পাগলী।বৃষ্টি তো অনুভব করার জিনিস।এবার চল তাড়াতাড়ি না হলে আমাদের দু’জনের কপালে কিছুই জুটবে না।’
আদুরী অর্পার সাথে পা মিলিয়ে চললো।বসারঘরে এসে দেখলো এলাহি কাণ্ড।মাদুর বিছিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে আছে।বড় বড় স্টিলের তাগাড়ি’তে মুড়ি মাখানো হয়েছে।সাথে পাঁপড় ভাজাও রয়েছে।আদুরী’কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাওন একটু চেপে বসলো।আদুরী’র উদ্দেশ্যে বললো,
‘আদুরী এখানে বসো।আমি একটু চেপে বসেছি।তুমি এখানে আরামসে বসতে পারবে।’
আদুরীর ঠোঁটে হাসি ফুটলো।শাওন’কে তার বড্ড গোছালো লাগে।কি সুন্দর করে কথা বলে!ছোট বড় সবাইকেই তুমি বলে সম্বোধন করে।আদুরী ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই শাওনের পাশে এসে বসলো।শাওন পাঁপড় ভাজা’র তাগাড়ি’টা আদুরীর সামনে রেখে দিয়ে বললো,
‘তোমার নাকি পাঁপড় ভাজা খুব প্রিয় আদুরী!’
‘আপনি কীভাবে জানলেন ভাইয়া!’
‘ছোটআন্টির মুখেই শুনেছি।
‘আম্মা বলেছে।’
‘হ্যাঁ!তাই তো তোমাকে ডেকে নিয়ে আসলাম।তোমাকে ছাড়া পাঁপড় ভাজা খেয়ে নিলে তুমি যদি কেঁদে দাও!
আদুরী পুনরায় হেসে উঠলো।শাওনের মধ্যে রসিকতাও রয়েছে বটে!তবে সেই হাসি ঠোঁটে বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।ফারাজের দিকে চোখ পড়তেই আদুরীর হাসি গায়েব হয়ে গেলো।ফারাজের এই ভারভার চোখের দৃষ্টির দিকে আদুরী আর তাকানোর সাহস পায় নি।মাথা নিচু করে নিলো।আদুরী ভেবে পায় না!সবার সাথে সহজ হতে পারলেও ফারাজের সাথে কথা বলা’টাও যেনো তার কাছে দুষ্কর হয়ে উঠে।এই যে,শাওনের সাথে কি সুন্দর ভাব জমে উঠেছে!কথা বলতেও যেনো ভালো লাগে।আদুরী’কে চুপ থাকতে দেখে শাওন আবারও বললো,
‘কি হলো খাচ্ছো না কেনো আদুরী।’
আদুরী জোরপূর্বক হাসলো।শাওনের কথায় কোনো প্রত্যুত্তর করলো না।ফারাজ আর বসলো না।সবাইকে উপেক্ষা করেই চললো ঘরের দিকে।আদুরী মাথা নিচু করে রাখলেও অনুভব করলো ফারাজের এখান থেকে চলে যাওয়ার মুহূর্ত’টা।
বাহিরে জুম জুম বৃষ্টি পড়ছে!সবাই ছুটলো উঠোনের দিকে।উদ্দেশ্য বৃষ্টিতে ভিজতে যাওয়া!আদুরী প্রথমে নাকচ করলেও সীমা তা মোটেও শুনে নি।সীমা আদুরীর মেঝোখালার মেয়ে।ছোটবেলায় আদুরী সীমার কোলেই বেশি থাকতো।সীমাও যেনো আদুরীকে কাছে পেয়ে বোনের অভাব মেটাতো।সীমার দুই ভাই।সীমান্ত আর সজীব।সীমান্ত সীমার একবছরের বড় আর সজীব দু’বছরের ছোট।বয়সের ব্যবধান তেমন একটা নেই বললেই চলে।
ভিজে একদম জুবুথুবু অবস্থা!যেনো বৃষ্টি থেকে তার নিষ্পত্তি নেই।বড় একটা ওড়না দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলো আদুরী।বৃষ্টির পরাক্রম যেনো একটু একটু করে বাড়ছে।সেই সাথে শীতল হিমযুক্ত বাতাস।আদুরী কেঁপে উঠলো।পাশে তাকিয়ে দেখলো বাকিরা সবাই আমবাগানের দিকে ছুটেছে।আদুরী শক্তি পেলো না।শীতল বাতাস’টা তাকে পরাস্ত করে নিয়েছে।আদুরী ধীরে ধীরে ঘরের দিকে এগোতে লাগলো।উঠোন’টা পিচ্ছিল হয়ে আছে।যেকোনো সময় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।তবে পেছন থেকে ভেসে আসা শাওনের ডাকে আদুরী থেমে গেলো।মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে এগোতে নিলেই বড়সড় একটা অঘটন ঘটেই গেলো।পিচ্ছিল জায়গায় পা ফসকে আদুরী পড়ে গেলো।আদুরী ব্যথায় চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।শাওন দৌড়ে এলো।আদুরী’কে ধরতে নিলে অসাবধানতাবশত নিজেও পিচ্ছিল খেয়ে পড়লো।তবে নিজেকে সামলিয়ে শাওন আদুরীকে ধরে উঠে দাঁড়ালো।আদুরী ব্যথায় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।কান্না আঁটকিয়ে রাখলেও ক্ষণে ক্ষণে স্পন্দন দিয়ে উঠছে।
—
রাহেলা খাতুন একদফা বকেও প্রশমিত হন নি।আদুরী ভয়ে গুটিসুটি মেরে বিছানার এককোণায় আধশোয়া হয়ে আছে।পা’য়ের ব্যথা’টা বেশিই বেড়েছে।ব্যথায় যেনো টনটন করছে।রাহেলা খাতুন আবারও আদুরী’কে বকতে নিলে শাওন সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ছোটআন্টি!আদুরী’কে আর বকবেন না।আমার জন্যই আদুরী পড়ে গিয়েছিলো।আমি যদি আদুরী’কে না ডাক দিতাম তাহলে আদুরী পড়ে যেতো না।’
রাহেলা খাতুন দম নিলেন।শাওনের কথার পিঠে বললেন,
‘আদুরীর দোষ তুই একদম নিবি না শাওন।সে-তো দেখেশুনেও চলতে পারতো।’
আদুরী কিছু বলতে নিলেই রাহেলা খাতুন থামিয়ে দিয়ে বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন,
‘আদুরী তোর আব্বাকে আমি কি জবাব দিবো!তোর আব্বা শুনলে আমাকে দু’একটা কথা শুনিয়ে ছাড়বে।’
সীমা তপ্ত এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘ছোটআন্টি তুমি চিন্তা করো না।ওষুধ পড়লেই ঠিক হয়ে যাবে।তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।’
রাহেলা খাতুন কিছু বললেন না।আদুরীর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন।আদুরী বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।ব্যথার তাড়নায় চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে।সাথে মাথাব্যথাও এসে যুক্ত হয়েছে।আদুরী অনুতপ্ত চোখ নিয়ে একবার শাওনের দিকে তাকালো।একটু দেখেশুনে পা রাখলেই হতো।তাহলে অত্যন্ত শাওন দোষ’টা নিজের ঘাড়ে নিতো না।এখানে তো শাওনের কোনো দোষ নেই।অসাবধানতার জন্য একটা দূর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।আদুরীর ভীষণ খারাপ লাগলো।শাওনের মুখ’টা যেনো শুকিয়ে গিয়েছে।মুখে নেই হাসির কোনো ছোঁয়া।
_______
আদুরীর ঘুম একটু আগেই ভেঙেছে।আড়মোড়া কাটিয়ে উঠতে খুব বেগ পেতে হচ্ছে।পা’য়ের ব্যথা’টা আগের তুলনায় যেনো তীব্র হয়েছে।ঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে।জানালা দিয়ে শুধু বাহিরের আলোটুকু আসছে।বাহিরে বৃষ্টি নেই তবুও প্রকৃতি একদম শীতল।পেট অবধি নকশিকাঁথা জড়িয়ে আছে।দরজার শব্দ পেয়ে আদুরী মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকালো।দরজার সামনে ফারাজ’কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদুরী অবাক হলো।সেই সাথে ব্যাকুল!ফারাজ এগিয়ে আসছে।আদুরী উঠতে গিয়েও উঠতে পারলো না।তবে ফারাজ’কে দেখে বুকের ভেতর’টা ঢিপঢিপ করে আওয়াজ করছে।ফারাজ ছোট শপিং ব্যাগ’টা টেবিলের উপর রাখলো।আদুরীর দিকে দৃষ্টি মেললো।পলকহীন দৃষ্টি!আদুরীকে পরখ করে বিচক্ষণ কণ্ঠে বললো,
‘ব্যথা পেয়েছো তুমি কিন্তু ছুটতে হচ্ছে আমাকে!’
আদুরী স্তব্ধ হলো।মুখ দিয়ে কথার বুলি ফুটলো না।ফারাজের কথা’টা মন গহীনে কোথাও গিয়ে ধাক্কা খেলো।সেই সাথে হৃদপিণ্ড যেনো ক্রমশ গতিতে ছুটে চলেছে।ফারাজ নির্বিকার ভঙ্গিমা করে আদুরীর পাশে গিয়ে বসলো।এতে যেনো আদুরী আরো জমে গিয়েছে।কণ্ঠস্বর ঠিক রেখেই বললো,
‘টেবিলের উপর ওষুধ রাখা আছে।’
আদুরী এবারও চুপ।একপলক ফারাজের দিকে তাকিয়ে পুনরায় চোখ নামিয়ে নিলো।এভাবে কিছুটা সময় অতিবাহিত হলো।দু’জনের অবস্থানের কোনো পরির্বতন নেই।আদুরী নিজের পাশে ফারাজ’কে এখনো বসে থাকতে দেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
‘শাওন ভাইয়ার কোনো দোষ নেই।’
‘কৈফিয়ত তো চাই নি।’
আদুরী মাথা ঘুরিয়ে নিলো।হৃদপিণ্ড’টা এখনো উঠানামা করছে।ফারাজ আদুরী’কে পর্যবেক্ষণ করে শান্ত গলায় বললো,
‘কাঁথা’টা গলা অবধি টেনে নাও!’
আদুরী ভীষণ লজ্জা পেলো।চোখ পড়লো বিছানার পাশে অবলীলায় পড়ে থাকা সবুজ রঙের ওড়না’টার দিকে।এতোক্ষণ ফারাজের সামনে এরূপ অপ্রীতিকর অবস্থায় ছিলো তা ভেবেই আদুরী নিজেকে গুটিয়ে নিলো।ভেতরে সংকোচ বোধ কাজ করছে।ফারাজ বাঁকা ঠোঁটে হাসলো।কাঁথা’টা আদুরীর গলা অবধি স্বযত্নে টেনে দিয়ে বললো,
‘আমি প্রচুর বেহায়া,নির্লজ্জ!তবে,ধৈর্যশীলও!
সেইদিন’টার অপেক্ষায় আছি,যেইদিন’টা হবে আমার একমাত্র সুখের দিন!’
ফারাজ বসলো না।গটগট করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।আদুরী চোখ দুটো এখনো খিঁচিয়ে বন্ধ করে রেখেছে।গলা শুকিয়ে যেনো কাঠ হয়ে গিয়েছে।অজানা এক অনুভূতি যেনো আদুরী’কে বশীভূত করে নিচ্ছে।যার মধ্যে রয়েছে সুখ সুখ এক অনুভূতি!যা দেহ এবং মনে সংবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম।
চলবে..