এই মনের আঙিনায় পর্ব -০৬

#এই_মনের_আঙিনায়[৬]
#কুরআতুল_আয়েন

আদুরীর ঘুম ভাঙলো তীব্র আওয়াজে!ঘরময় অন্ধকারাচ্ছন্ন!পর্দার অন্তরালে মৃদু মৃদু আলো ঘরে এসে প্রবেশ করছে।চোখ পিটপিট করে আদুরী দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ মেললো।সময় সাড়ে পাঁচ’টা!আওয়াজ’টা আরো প্রখর হলো।আদুরী ঘাটলো না!আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই দরজার কড়া আঘাত শুনতে পেলো।বাহির থেকে ঈশিতা ডাকছে!আদুরী জোর গলায় বললো,

‘কি হয়েছে মেঝোআপা!’

ঈশিতা বিরক্তি প্রকাশ করলো।এমতাবস্থায় বললো,

‘আম্মা ডাকছে!না খেয়ে আসলি কেনো।’

আদুরীর সহজ জবাব,

‘ভালো লাগছিলো না আমার।’

‘আদু!দরজা খোল তুই।বড় মামা মামী’কে দেখেই ছুটে পালালি।ভালো মন্দ জিজ্ঞেসও করলি না।আদু!আম্মা কিন্তু তোর এই আচরণে খুবই বিরক্ত!’

আদুরী মুখ খিঁচালো!আদুরী কি আর ইচ্ছে করেই বড়মামা মামী’কে দেখে ছুটে পালিয়েছে নাকি!ফারাজের বিয়ের কোনো খবর নিজের কানে শুনতে পারবে না বলেই তো পালিয়ে এসেছে।আগের বারের কথা আদুরীর ঠিকই মনে আছে!ঈশিতা ডেকে হয়রান!পুনরায় গলায় কাঠিন্য ভাব রেখে বললো,

‘বাচালতা বন্ধ করে দরজা খোল আদু!’
আদুরী ভেতর থেকে জবাবে বললো,
‘তুমি যাও মেঝোআপা আমার কিছুটা সময় লাগবে আসতে।’
ঈশিতা তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে চলে গেলো।আদুরীর উপর বেশখানিকটা’ই রেগে আছে।

বিছানার এককোণায় আদুরী আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে।বুকের ভেতর’টা এখনো ঢিপঢিপ শব্দ করছে।বাহির থেকে জাকির সাহেবের রাগান্বিত গলা শুনতে পাচ্ছে।আব্বার সামনে যাওয়ার সাহস’টাও পাচ্ছে না।স্তূপীকৃত লজ্জা এসে হানা দিচ্ছে।ফারাজ যে এমন একটা কাণ্ড ঘটাবে তা আদুরীর ভাবনার বাহিরেই ছিলো।ঈশিতার মুখে আবছা শুনেছিলো ফারাজ নাকি বড় মামা মামী’কে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে!তাও আবার তার জন্য!যার কারণে তাঁদের এখানে আসা!আদুরী প্রথমে শুনে নিশ্চল,জড়ীভূত হয়েছিলো।পরক্ষণে!ঈশিতার দিকে তাকাতে লজ্জাও পাচ্ছিলো।যতই হোক ঈশিতা তো তার বড় বোন।আদুরী জবাবে কিছু বলতে পারলো না।কুণ্ঠা হয়েই বসে রইলো।

রাত তখন দশ’টা!বাহিরের পরিবেশ সম্পর্কে আদুরীর জানা নেই।মন’টাও ভীষণ উশখুশ করছে কি হয়েছে তা জানার জন্য!তবে আন্দাজ করে নিয়েছে আব্বা রাজি হয় নি।বাকিদের কথা ঠাহর করতে না পারলেও আব্বার কথা ঠিকই ঠাহর করতে পেরেছে।এভাবেই কাটলো সম্পূর্ণ রাত’টা।নির্ঘুম এক রাত!

সবকথা শুনে সুহানা সকালে এসেই হাজির।রাতে ঈশিতার সাথে কথা হয়েছিলো।তখন সব শুনেছে।তাই আর বিলম্ব করলো না।সকালে হতে না হতেই ছুটে আসলো বা’পের বাড়ি।জাকির সাহেব তখন সোফায় বসে পেপারে মুখ গুঁজে রেখেছিলেন।বড়মেয়ে’কে দেখে খুশি হলেন।সুহানা হাত ব্যাগ’টা পাশে রেখে সোফায় বসলো।রাহেলা খাতুন মুখ’টা থমথমে করে রেখেছেন।ফারাজের সাথে আদুরীর বিয়ের প্রস্তাবে খুশি হয়েছিলেন।কিন্তু জাকির সাহেবের তিক্ত কথায় তা যেনো হাওয়ার মতো ফুঁস হয়ে গেলো।মুখ ফুটে যেনো কিছু বলতে পারলেন না!থমথমে মুখ নিয়েই সুহানা’কে বললেন,

‘সুহানা!সুবহান’কে নিয়ে আসলি না!’

‘না আম্মা!সুবহান’কে তার দাদির কাছে রেখে এসেছি।আর,আমি এখান থেকে একদম সরাসরি স্কুলে যাবো।’

‘তাহলে বস!চা করে নিয়ে আসি।’

রাহেলা খাতুন যেতেই জাকির সাহেব একটু নড়েচড়ে বসলেন।সুহানা’কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘বড়আম্মা শুনেছো কিছু।’

সুহানার সহজ জবাব,
‘হ্যাঁ!আব্বা শুনেছি সব ঈশুর থেকে।তবে,ফারাজ কিন্তু ভালো ছেলে আব্বা।আর,এই জগতে ভালো ছেলে কিন্তু সচরাচর পাওয়া যায় না।’

জাকির সাহেব ভ্রুকুটি কুঁচকে বললেন,
‘যাই হোক!ছোটআম্মা’কে আমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিবো না।মেঝোআম্মা’রও তো এখনো বিয়ে হয় নি।তার আগেই ছোটআম্মার বিয়ে দিয়ে দিবো ব্যপার’টা খুবই দৃষ্টিকটু লাগবে।’

‘দেখো আব্বা ভালো মন্দ আমাদের থেকে তুমি খুব ভালো বুঝবে।আমরা এখনো ভালো মন্দের সঠিক বিচার’টাও করতে পারি না।হিমশিম খেতে হয়।তোমার কথা একদম ঠিক আছে।তবে,আব্বা এখনের সময়’টায় কেউ এইসব দেখে না।মেঝো মেয়ের আগে কেনো ছোট মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলো!’

জাকির সাহেব গম্ভীর হলেন!বড়মেয়ের কথাগুলো বেশ কঠিন লাগলো।আপাতত কিছু বললেন না।নিশ্চুপ হয়ে রইলেন!

স্বাভাবিক ভাবেই কয়েকটা দিন কাটলো!ওইদিনের পর থেকে আদুরী সবার থেকে নিজেকে একটু লুকিয়ে রেখেছে।আব্বা,আম্মা,আপাদের সামনে যেতে যেনো অস্বস্তি বোধ হয়।সাথে লাজও!তবে,এই কয়েকদিনে আদুরী ফারাজের কোনো খবর পেলো না।কথাবার্তা তো দূর!জিনিস’টা আদুরী’কে বড্ড পোড়ায়!বিছানার উপর আদুরী নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে।রাহেলা খাতুন আদুরীর সামনে এসে বসলেন।পেছন পেছন সুহানা আর ঈশিতাও ঘরে প্রবেশ করলো।রাহেলা খাতুন খাণিক’টা দম নিয়ে বললেন,

‘আদু!আমি তোর আম্মা!আমি আমার তিন মেয়ের সবসময়ই ভালো চাই।মেয়েরা বড় হলে তো মা’য়েদের চিন্তার শেষ থাকে না।সুহানার পর ঈশিতা আর ঈশিতার পর তুই।মেয়েদের আসল ঠিকানা কিন্তু স্বামীর ঘর।আমি কি বলতে চাইছি তা তুই বুঝতে পারছিস তাও জানি।ঈশিতা তো তোকে আগেই বলে দিয়েছে।ফারাজ কিন্তু অনেক ভালো ছেলে।ছেলেটা বড়ভাই ভাবী’কে রাজি করিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলো কিন্তু তোর আব্বা না করাতেও ফারাজ থেমে নেই।কয়েকদিন আগে তোর আব্বার সাথে কথা বলে তোর আব্বা’কেও রাজি করিয়েছে।আল্লাহর ইশারা ছিলো বলেই তোর আব্বাও রাজি হয়েছে।’

আদুরী মাথা’টা নুয়ে নিলো।কুণ্ঠা হয়ে বসে রইলো।মাথা তোলার শক্তি নেই।তবে ভেতরে ভেতরে ঠিকই কথা গুলো আওড়ে যাচ্ছে।শেষমেশ কিনা ফারাজ রাজি করিয়েছে।আদুরী খুশি হলেও বাহিরে প্রকাশ করলো না।যতই অভিমান থাকুক না কেনো ফারাজের প্রতি তার অনুভূতি রয়েছে।যা ভালোলাগার,এমনকি তার চেয়েও বেশি!যে অনুভূতি গুলো ঘিরে আদুরী শুধু সুখ পেতে চায়!মনের অনুভূতি আদুরী মনেই রাখলো।সুহানা আদুরীর শরীর ঘেঁষে বসলো।আদুরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

‘আমি তোর অস্থিরতা’টা বুঝতে পারছি আদু।আমিও তো এই সময়’টা পেরিয়ে এসেছি।তুই আমাদের সবার ছোট!আমাদের সবার আদরের।এখনি এমন কিছু হোক আমরা চায় নি।তবে একটা কথা মাথায় রাখবি,ভালো জিনিস কিন্তু খুব কমই ধরা দেয়।এই জগতে কে ভালো কে খারাপ বা কার ভেতর কেমন তা জাজমেন্ট করার ক্ষমতা কারোর নেই।ফারাজ’কে আমরা সবাই পার্সোনালভাবেই চিনি,জানি।কি সুন্দর গুছিয়ে,সাজিয়ে আব্বার সামনে তোকে ভালো লাগার কথা বলেছে।আমি মোটামুটি সবই জানি।ফারাজ যেদিন এইসব বলে আব্বা সেদিনই আমাকে সব জানিয়েছিলো।আব্বাও হয়তো ফারাজের বিনয়ী,নিরহঙ্কার আচরণ দেখে পছন্দ করেছে।তুই একদম সুখী হবি আদু।আমার আর ঈশুর সেই ছোট্ট আদু বলতে গেলে বড় হয়ে গিয়েছে!’

আদুরী ঝাপসা চোখে তাকালো।এবার যেনো চোখ প্লাবিত হয়ে কান্না আসছে!অনুভূতি’রা এমন কেনো!কখনো আনন্দ দেয় আবার কখনো কষ্ট দেয়!

ফারাজের মতে শুক্রবারেই বিয়ে সম্পন্ন হলো।তাও ঘরোয়া ভাবেই!বসারঘরে মানুষের সমাগম!আদুরী সবার সামনে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে।খয়েরী রঙের বেনারসি শাড়িতে আদুরী’কে স্নিগ্ধ লাগছে।এককথায় কোমল,মধুর!ফারাজ চোরাচাহনি নিক্ষেপ করলো আদুরীর উপর।আদুরী’কে দেখেই যেনো মন শীতল হয়ে উঠলো।সেই সাথে মনের অন্তস্থলেও সুখের সংবেদন সৃষ্টি হলো!

চলবে..
[এটা শেষ হলে ‘আলোয়_রাঙা_অনুভূতি’ কন্টিনিউ করবো।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here