এই_শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ১০

#এই_শহরের_পাখিগুলো_ডানা_মেলে_উড়তে_জানেনা
#লেখিকাঃতামান্না
#দশমঃপর্ব

শাফায়েত-” আপনারই মেয়ে আপনি যেমন খুশি তেমন সাজিয়ে তুলন, আমার কোন নিষেধ নেই।”
মেহরিন কিছু বলল না, শিমুকে বুকে জড়িয়ে রেখে লেকের পাড় ঘেষেঁ দুজনে মিলে হাটতে লাগল। লেকের স্বচ্ছ পানির দিকে একবার নজর দিয়ে
মেহরিন আপন মনে শিমুর হাত ধরে আদর করে বলতে লাগল –

“অনেক মালা গেঁথেছি মোর
কুঞ্জতলে,
সকালবেলার অতিথিরা
পরল গলে।
সন্ধেবেলা কে এল আজ
নিয়ে ডালা।
গাঁথব কি হায় ঝরা পাতায়
শুকনো মালা।”

– রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর

দুজন মিলে হাটতে হাটতে সন্ধ‍্যা গড়িয়ে পরলো। মেহরিন ঘুমন্ত শিমুকে কোলে নিয়ে শাফায়েতের সঙ্গে গাড়িতে উঠে পরল। বাড়িতে এসে মেহরিন শিমুকে খাটে শুইয়ে দিল। হাতের মুঠোয় ধরে রাখা আচল টা খুলে দিল। দুচোখ ভরে আসল তার আজ যদি প্রথম সন্তানটা থাকতো সে ও শিমুর মত তার গায়ের গন্ধ মাখতো।তার শরীরে মিশে থাকতো। তার আদর আর স্নেহমমতা পাওয়ার জন‍্য মরিয়া হয়ে থাকতো। শিমুকে প্রাণ ভরে দেখে তাকে আদর করে মেহরিনের বুকটা জুড়িয়ে যায়। পেটের সন্তান না হোক এই সন্তানই তার কাছে অমূল্য রত্ন! শাফায়েত পাশের রুম থেকে ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে এসে দেখল, মেহরিন শিমুকে খাটে শুইয়ে দিয়ে কেদে যাচ্ছে। শাফায়েত মেহরিনের পাশে বসে পরল আবার।

শাফায়েত -” আবার কাদছেন! এই তো বাইরে থেকে হাসিখুশি ভাবে এলেন। মেয়েকে নিয়ে কত খুশি ছিলেন এখন বাসায় এসে আবার কেদে দিচ্ছেন। এটা কি ঠিক?”

মেহরিন-” তেমন কিছু না, এমনি চোখে পানি চলে এসেছে। কাদছি না তো!”

শাফায়েত-” আমি বুঝি আপনার কষ্ট টা, একটা সন্তান নিয়ে মেয়েদের মনে যে আলাদা অনুভূতি থাকে তা অন‍্যরা বুঝবে না। সন্তান হারানোর কষ্টটা একমাত্র মাই বুঝতে পারে।” মেহরিন পিছনে ফিরে আরও ডুকরে কেদে উঠলো। কান্না চাপিয়ে লাভ হলো না এবার আরও বেশিই বেড়ে গেল। শাফায়েত পাশে থাকা টিস‍্যু বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল

-” আর কাদবেন না, শিমু কিন্তু উঠে যাবে।”
শাফায়েত বলতে দেরী শিমু নড়েচড়ে উঠতে দেরী করলো না। শাফায়েত মেহরিনের দিকে তাকাতেই মেহরিন অসহায় চোখে তাকালো। শাফায়েত তার অবস্থা দেখে হেসেদিল। বলল

-” এবার মেয়েকে সামলান, আমি গেলাম!”মেহরিন শিমুকে কোলে নিয়ে বেলকনিতে চলেগেল।এই কয়েকদিনে সে বুঝেগেছে মেয়েতার ঘরে নয় বাইরের দৃশ‍্য দেখতে পছন্দ করে। তাকে নিয়ে হাটলে সে শান্ত থাকে, বসতে পছন্দ করে না।
______________________________________

মেহেদী টিভি চালিয়েছে, টিভির হেডলাইনে চলছে।
হোটেল স্কাই ব্লুতে চলছে দেহ ব‍্যবসা! নামি -দামি সব লোকেরা সেখানে মদের আড্ডা আর বিভিন্ন ধরনের আসর জমাতো। সেই সব শ্রেনিতে বাদ পরেনি কোনকিছুই। স্কাই ব্লু অনেকদিনই পুলিশের নজরে ছিল। শুধু সময়ের জন‍্য বের করা হচ্ছিল না। হোটেলের সবচেয়ে আলোচিত ফুটেজটিতে ছিল শীলা আর আকাশ। শীলাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর আকাশের হাতে হ‍্যান্ডক্রাফট দিয়ে রেখে নিয়ে যাওয়ার দৃশ‍্যটা বেশিই চলছে।

মেহরিনের বাবা, মা, ঘৃণায় সেখান থেকে উঠেগেলেন দেখামাত্র। ছিহ! ছিহ! এমন অযোগ্য আর অপাত্রের কাছে মেয়েকে তুলে দিয়েছিলেন। মঈন সাহেবের মনে হচ্ছে সেদিন ডিবোর্সটা না করালে মেয়েটার জীবন যা ছিল তার থেকেও ধ্বংস হয়ে যেত। তার সাথে মানসম্মান যা ছিল তা রসাতলে চলেযেত।

মাহিনের স্ত্রী অবাক হয়ে বলল- “মেহেদী ভাই ও আকাশ না?”

মেহেদী – “হুম, আর সঙ্গে তার গোপন প্রেমিকা শীলা।”

মাহিনের স্ত্রী-“ছি! ছি! আকাশ এত নিচ!”

মেহেদী-” দাড়াও না আরও সময় পাই ওর সবকিছু আমি মানুষের সামনে টেনে হিচড়ে বের করবো!”

মাহিনের স্ত্রী-” এসব তুমি করেছো?” মেহেদী মাথা নাড়ালো।

মাহিনের স্ত্রী-” মেহেদী ভাই সবই তো বুঝলাম, তবে আমার মনে হয় তোমার এগুলো নিয়ে আর না ঘাটানো উচিৎ!”

মেহেদী-” কেন? আমার বোনের জীবন নিয়ে ছিনিমিনী খেলা হয়েছে আমি ওকে এত সহজে তো ছাড়বো না!”
ছাড়ছি ও না!”

মাহিনের স্ত্রী-” একবার ভেবে দেখো মেহেদী ভাই, মেহরিনের বিয়ে হয়েগেছে। আকাশকে টানা মানে মেহরিনকে নিয়ে টানা হেচড়া করা। আকাশকে নিয়ে বেশি টানাটানি করলে মেহরিনকে ও নিয়ে কথা উঠবে। আমি কি বলছি বুঝতে পারছো। আকাশের ব‍্যাপারে যখন কেইস উঠবে তখন মেহরিনকে প্রাক্তন স্ত্রী হিসেবে কাস্টোডিতে নেওয়া হবে। ভালোর জন‍্যই বলছি খারাপ মনে করো না প্লিজ!”

মেহেদী সব শুনে বুঝলো তার ভাবী ভুল বলেনি। এতে মেহরিনের ও সম্মান আছে, আর আকাশের যে দূর্গতি হয়েছে তাতে সে কোথাও কিছু করতে পারবে না।
_________________________________________
আকাশ থানায় বসে আছে, আফজালের দিকে রাগী চোখে চেয়ে আছে মনে হচ্ছে ভষ্ম করে দিবে সেই আগুনরুপী চোখ জোড়া দিয়ে।

আকাশ-” আমার ফোনটা দিন, আমি আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলবো।”

আফজাল-” এমন ভাবে কথা বলছেন, যেন আমরা আপনার খাস গোলাম!”

আকাশ- ” আমি তেমন কিছু বলিনি! শুধু বলেছি ফোনটা দিতে আমার পরিবারকে জানাতে।”

আফজাল-” থানায় কাউকে ফোন দেওয়া হয় না। আর সে যদি অপরাধী হয় তাহলে তো কথাই নেই!”
আকাশ রেগে গিয়ে দরজায় আঘাত করে বসল। অনেকবার রিকুয়েস্ট করার পর ফোন দেওয়া হলো তাও দশমিনিটের জন‍্য। আকাশ তার বন্ধুকে ফোন করলো।

নাফিস- “হ‍‍্যালো, হ‍্যা আকাশ বল কি বলবি?”

আকাশ- “দোস্ত একটা বিপদে পরছি! আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে আসছে। একটু হ‍্যাল্প কর!”

নাফিস সব শুনেও না শুনার মত বলতে লাগল -” কিরে কথা বলিস না কেন? আকাশ, দূর ব‍্যাটা ফাজলামি করিস!” ফোন কেটে দিয়ে মনেমনে বলতে লাগল –
বড় বাচাঁ বেচে গেছি, তারমানে কালকের ভিডিওটা সত‍্যিই ছিল।

এইদিকে আকাশ আবার তার আরেক বন্ধুকে ফোন করলো, সে উকিল। যদি তার সাথে এই বিষয়ে কথা বলা যায়। সেই বন্ধুকে ফোন করা হলেও সে ফোনটি আর ধরলোই না। আকাশ বারবার ট্রাই করার পর ও যখন কেউ তার ফোন ধরেনি বাধ‍্য হয়ে বাড়ীতে ফোন করল কিন্ত এর আগেই আফজাল তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল।

আফজাল-” দুঃখিত আকাশ সাহেব! দশমিনিটের বেশী আমি আপনাকে ফোন দিতে পারিনা। যা পেয়েছেন তাই যথেষ্ট!”
আকাশ আফজালের কলার ধরে আফজালের নাক বরাবর ঘুষি মেরে দিল। আফজাল যেন এটার জন‍্য একদম প্রস্তুত ছিল না। ক্ষুদ্ধ আফজাল রেগে গিয়ে বলে উঠলো –

” ভেবেছিলাম ছেড়ে দিব, কোর্টে চালান করবো না! কিন্তু এখন দেখলাম মাতাল আর অসভ‍্য শ্রেণির লোকদের এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না। কেইস টা কোর্টে তুলতেই হবে দেখছি!”

আকাশ-” যা পার গিয়ে কর!” আফজাল কথা না বাড়িয়ে চলেগেল। মেহেদীকে ফোন করে বলতেই মেহেদী রেগে গিয়েছে, কোর্টে চালান করতে বলে দিয়েছে। শীলা সেই যে এককোণে পরে রয়েছে। পরেই আছে সেখানে, কারোর সঙ্গে তার কথা হয়নি। থানায় থাকা লোকজন আর থানায় কাজে আসা লোকগুলো তারদিকে চেয়ে আছে। শীলার বারে বারে মনে হচ্ছে আকাশ তার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে। এই আকাশের জন‍্যই তো সে আবার তার জীবনে ফিরে এসেছে।
মেহরিনের সঙ্গে ডিবোর্স হওয়ার পর বিয়ের কথা বললেই সে এরিয়ে যেত। কেন করলো না বিয়েটা সে?
আজ যদি বিয়েটা সে করতো তাহলে কি এইদিন দেখতে হতো?

আফজাল আকাশের মোবাইল থেকে তার মায়ের ফোনে কল করে জানিয়ে দিল আকাশকে থানায় নিয়ে আসার ঘটনা। আকাশের মা সব শুনেই পুরো বাড়ি জুড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে পুরো এলাকা জুড়ে যেন হইচই পরেগেছে। আকাশ হোটেলে একটা মেয়ে নিয়ে ধরা পরেছে। এই জন‍্যই তো বউটা চলে গিয়েছে। অথচ আকাশের বোন আর আকাশের মা বলেছেন মেহরিন তার ছেলেকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।

পাড়া প্রতিবেশীদের মধ‍্যে বলাবলি হচ্ছে, আর যাইহোক
এমন নির্লজ্জ ছেলেকে এই পাড়ায় ঢুকতে দেওয়া হবে না। আকাশের বাড়ির সামনে সবাই দাড়িয়ে আছে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here