একই সুতোয় বাধা পর্ব ২

#একই_সুতোয়_বাঁধা

পর্ব-২

সপ্ত শীখা

গোলাম রহিম খুবই ভয়ে ভয়ে পুষ্প কে ডাকতে এসেছেন। এ ধরনের ব্যাপারে মায়েরাই এগিয়ে যায় কিন্তু পুষ্পর ক্ষেত্রে ব্যাপার ভিন্ন। কারন গত তিনদিন ধরে সে মুখ ফুলিয়ে ঘুরছে। যতদিন সায়নের সাথে ঝগড়া চলে পুষ্প আর সায়ন দুজনেই মুখ ফুলিয়ে ঘোরে। মেয়ে খুব জেদি। তাই রহিম সাহেব পরে কথা বলতে চাইলেও সাদেকুর রহমান খবর পাঠিয়েছেন যে আজই কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তার মায়ের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন।

— পুষ্প ? আমার আম্মাজান কই গো ?

— কি হইছে আব্বা। ডাকো কেন ?

— কি করেন গো আম্মাজান…

— কি আর করব। স্কুলের থেকে বাড়ির কাজ দিছে সেগুলা করতেছি। স্যার ও যদি এইর জন্য মাইর দেয় তাইলে কি করমু ? সবাইর মাইর খামু নাকি সারাদিন বসে বসে !

— পুষ্প আম্মাজানের তো মেজাজ অইত্যন্ত খারাপ মনে হইতেছে !

— হু অনেক খারাপ।

— কি দিলে ঠিক হইবে ?

— কিছু না।

— এইটা দিলেও হবে না ?

— আমসত্ত্ব !! 😍😍😍😍

পুষ্প বাবার হাত থেকে আমসত্তের পুরো গোছাটাই তুলে নিয়ে নিজের ঘরে ছুটে গেল। ঘরে রেখেই আবার ছুটে এসে বাবার গালে চুমো দিলো। রহিম সাহেব হাসলেন। কিন্তু দুই মিনিট ও গেল না… আবার দৌড়ে এল পুষ্প।

— আব্বা দাদি আমার আমসত্ত্ব খায়া ফেলে।

— আহারে ! দাদিকে এক টুকরা দিয়া বাকিটা খাও।

— না না না আমি কাউরে দিব না…

— আহহা পুষ্প। দাদি লাগে না তুমার।

— আচ্ছা দিতেছি। 😒

রহিম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কান্না পেয়ে যাচ্ছে তার। এত আদরের বাচ্চা মেয়েটার বিয়ে দেবেন কিভাবে ! ভাগ্যিস… মেয়ে নিজের কাছেই রাখবেন। নইলে কখনো বিয়ে দিতেন না।

— পুষ্প আম্মাজান একটু শুন তো।

— কি আব্বা ?

— শুন আমরা সায়ন গোর বাড়ি যামু এখন-

— না না আমি অই বাড়ি আর জীবনে যামু না।

— আহহা পুষ্প ! সায়নের আব্বার ডাকছে। সাদেক চাচা না তোরে কত আদর করে !

— হু।

— যা বলব তাই তাই করবা মা গো। সব কথা শুনলে আরেক পাতা আমসত্ত্ব আইনা দিব হাট থিকা।

— আইচ্ছা। কখন যাবা ?

— রইদ টা পড়লেই যামু। তোমার আম্মা তোমারে তইয়ার করতে আসব। তার হাতে তইয়ার হও।

— অই বাড়ি যাইতে আবার-

— পুষ্প গুরুজনের সাথে তর্ক করবা না। এখন থিকা আইজ রাত পর্যন্ত সব কথা শুনলে কাইল বড় এক পাতা আমসত্ত্ব পাইবা কিন্তু। এখন যাও তোমার আম্মা আর দাদি বইসা আছে।

💜💜💜💜💜

সায়ন মুখ গোঁজ করে মায়ের বকা খাচ্ছে। ও কিছুতেই পাঞ্জাবি পরবে না।

— আম্মা বলতেছি না পাঞ্জাবি পরলে গায়ে কাতুকুতু লাগে ! পরমু না নিয়া যাও !

— পর না বাপ আমার। দেখ পরে কিন্তু তোর আব্বায় আইসা আমারে বকব। তুই চাস তোর জইন্য আম্মা বকা খাই ?

— বকব না আমি বলব আব্বারে।

— সায়ন ! ডাইলঘুটনির এক বারি খাইলেই পরবা তুমি সুন্দর মতন। চিনিনা তুমারে ! বেশি বাড় বাড়ছে তোর-

বকাঝকা খেয়ে শেষে পরতেই হল ওকে পাঞ্জাবি। মায়ের গালি খাওয়ার পরে সায়নের যে কি মন টা খারাপ হয় ! এতবড় একটা ছেলে ও। তিন মাস পরেই চৌদ্দ পেরিয়ে পনেরো তে পড়বে… মা এসব দেখে না !

— সায়ন ! এই লাইলি ! সায়ন তইয়ার হইছে ?

— হ হইছে। কিন্তু মুখ ফুলাইয়া আছে আপনে আসেন।

সাদেকুর রহমান বিয়ের জন্য কাজিকে খবর দিতে গিয়েছিলেন। আইনে ঝামেলা হতে পারে তাই আগাম কাজ এগিয়ে রেখে এলেন। বেশ অবস্থাপন্ন হওয়ায় এসব ব্যাপার তার কিছুটা আয়ত্ত্বের মধ্যে থাকে।

— সায়ন বাপ কি হইছে তোমার ?

— কিছু না আব্বা।

— মন খারাপ ?

— না না।

— শুনো বাপ। আজকে বিকালে একজন হুজুর আসব। উনি যা যা কইব তাই তাই করবা। ঠিক আছে?

— জ্বি আব্বা।

সায়ন এর গলা শুকিয়ে যায় বাবার সাথে কথা বলতে গেলেই। খুবই ভয় লাগে তাকে। তিনি কখনই কড়া গলায় কিচ্ছু বলেন না সায়ন কে তবু সায়ন জমের মত ভয় পায়।

💙💙💙💙💙

আসরের আজান পড়ে গেছে।

সায়ন কে তার রুমে আটকানো হয়েছে যেন সে পুষ্পর উপস্থিতি বুঝতে না পারে। পুষ্প আছে অতিথিশালায়। সায়ন আর পুষ্প কেউই যেন কাজি সাহেবের কথা শুনতে না পারে এজন্য নেয়া হয়েছে অভিনব পন্থা। দুজন কে এক বাটি করে কটকটি আর বাতাসা খেতে দেয়া হয়েছে। চিবালে এর শব্দে কাজে সাহেবের কথা ঢাকা পড়ে যাবে।

প্রথমে পুষ্পর কাছে গেলেন কাজি। সে তখন শাড়ির ভিতরে পা ঝুলিয়ে অনভ্যস্ত ভাবে বসে আছে। কাজি সাহেব এলেও তার ভ্রুক্ষেপ হলনা। নিজের মত কড়মড় করে বাতাসা খাচ্ছে। কাজি সাহেব শুরু করলেন…

— বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। জনাব সালাতুর রহমান সায়ন, পিতা মোঃ সাদেকুর রহমান ও মাতা লাইলি বেগম, এর সাথে ইশরাত জাহান পুষ্প, পিতা মোঃ গোলাম রহিম ও মাতা আছিয়া খাতুন, এর ১০ লক্ষ টাকা দেন মোহরে বিবাহ ধার্য হইয়াছে। আপনি কি এই বিবাহে সম্মত ?

পুষ্পর মায়ের চোখে পানি এসে পড়েছে। তিনি আচঁলে মুখ ঢেকে কাঁদছেন। গোলাম রহিম পুষ্পর কানে কানে বললেন…

— আম্মাজান বল আলহামদুলিল্লাহ কবুল। তিন বার বলবা। আব্বার সব কথা শুনবা কইছ না ?

— হু। আলহামদুলিল্লাহ কবুল। আলহামদুলিল্লাহ কবুল। আলহামদুলিল্লাহ কবুল।

সায়ন এর কাছেও একই ব্যাপার করা হল। বাপের ভয়ে সে কবুল ও বলে দিলো। মনের ভিতর একটা খচখচানি থাকলেও কবুল বলা ছাড়া আর কিছুই শোনেনি সে তাই সেটাই বেশিক্ষন রইল না।

পুষ্প বাসায় যেতে অস্থির হয়ে ওঠায় তাকে বাসায় আনা হয়েছে। ঘরে ঢুকেই পুষ্প শাড়িটা টেনে খুলে বিছানায় ছুঁড়ে দিলো। দাদি তাই দেখে হা-হা করে ছুটে এসে ওর শরীরে কাপড় জড়িয়ে দিলেন।

— এইই নচ্ছার মাইয়া ! বিয়ার শাড়ি এম্নে খুললি ক্যান ? এইসব ছ্যারাবেরা স্বভাব দেখলে আর শ্বাশুড়ি নিত না তোরে।

— উফ দাদি চুপ থাক। আমি কখনই বিয়া করব না। এনেই থাকব।

— যা যা তাত্তাড়ি কাপড় পিন্দা আয়। ব্লাউজ পইরা ঘরের মাঝে ঘুরতাসে বেশরম মাইয়া।

💙💙💙💙💙

সায়ন পাঞ্জাবি খুলতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বেচেঁছে। মনে হচ্ছিল কেউ জাল দিয়ে পেচিঁয়ে রেখেছে ওকে। গেঞ্জি পরে পেয়ারা খেতে খেতে বই নিয়ে একটু বসল। সামনে ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষা আসছে। ভাল না করলে ইজ্জত থাকবে !

— সায়ন।

— জ্বি আব্বা।

— কি কর বাপ ?

— পড়তে বসছি একটু।

— ভাল ভাল। শুন বাপ। আজকে যেইটা হইল কাউরে বলবা না। সবচেতে ভাল বন্ধুরেও না। ঠিক আছে ?

— জ্বি আব্বা।

— কসম কাটো।

— কসম আব্বা। বলব না কাউরে।

— নাও এইটা রাখো। কিছু কিন্না খাইও। পুষ্পরে নিয়া খাইবা।

বাবা চলে যেতে হতভম্ব হয়ে রইল সায়ন। স্বপ্ন দেখছে না তো ! আব্বা তার হাতে পুরো পাঁচটা ১০০ টাকার কড়কড়া নোট দিয়ে গেছে। স্বপ্নের মতই তো লাগছে…

সায়ন একটা নোট সরিয়ে বাকি চারটা ওর গোপন সংগ্রহে তুলে রাখল। তারপর আবার পড়তে বসল। যদিও পড়ায় মন বসছে না। হঠাৎ টাকা পেয়ে পুষ্পের উপর থেকে রাগটাও চলে গেছে। কাল পুষ্পকে মানাতে যেতে হবে। উফ এই পিচ্চি মেয়ের কি যে ভাব ! রাগ করল তো দুনিয়ার কারুর কথা শুনবেনা।

দুই কিশোর কিশোরি নিজেদের জীবনে বিভোর। বুঝতেও পারল না কি আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল তাদের জীবনে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here