একজীবন পর্ব ৫

একজীবন
পর্বঃ ৫

শয়তানটা সর্বশক্তি দিয়ে আমার মুখে কাপড় গুঁজে রেখেছে আর নিজের পকেট হাতড়াচ্ছে- খুব সম্ভবত কোনো অস্ত্র বা ছোরা বের করতে চাচ্ছে পকেট থেকে! এই সুযোগটা হারানো যাবেনা, শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ডান পা দিয়ে আমার পেছন বরাবর লাথি কষিয়ে দিলাম একটা। সম্ভবত জায়গামতোই লেগেছে- শয়তানটার হাতটা শিথিল হয়ে এলো! প্রচণ্ড ভয়ে বুকের ভেতর অবশ অনুভূতি হচ্ছে, চোখের সামনে সব অস্পষ্ট মনে হচ্ছে…বোধহয় জ্ঞান হারাব আমি! শেষ চেষ্টা হিসেবে কনুই দিয়ে ওর নাক বরাবর গুঁতো মেরে পেছন ঘুরে দৌড় দিতেই কারো সাথে জোরে ধাক্কা খেলাম। সর্বনাশ! সাথে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসেছে শয়তানটা! এখন?

আমার ডান হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের পেছনে নিয়ে গেলো আমাকে লোকটা। বাম হাতটা মুঠো পাকিয়ে লোকটার কোমরের নিচ বরাবর ঘুষি লাগাতে যাবো…ঠিক তখনই আবিষ্কার করলাম আমাকে পেছনে রেখেই খশরুর দিকে এগিয়ে গেলো সে! পেছন থেকে দেখেই চিনলাম এই লোক আর কেউ না, আনিস! খশরু ততক্ষণে পকেট থেকে ছোরা বের করে নিয়েছে। এক হাতে নিজের নাক চেপে ধরে অন্য হাতে ছোরাটা নিয়ে জানোয়ারের মত গোঁ গোঁ শব্দ করছে শয়তানটা। দ্রুতহাতে ওর ছোরা ধরা হাতের কব্জি বরাবর ধরে কীভাবে যেন মোচড় দিলেন উনি, সাথে সাথে ধপ করে মাটিতে পরে গেলো ছোরাটা! তারপর খশরুর বুক আর পেটের ঠিক মাঝামাঝি বাম হাতে একটা ঘুষি। ‘ঠকাস!’ করে একটা শব্দ হলো, কাটা কলাগাছের মত মাটিতে লুটিয়ে পরলো খশরু!

-‘বুক আর পেটের মাঝামাঝি- সোলার প্লেক্সাস, ঠিকমত মারতে পারলে এক আঘাতেই কাত করা যায়।’- আমার দিকে ঘুরে কথাগুলি বললেন উনি। উপরিউপরি এতগুলো ঘটনার ঘনঘটায় আমি তখন দিশেহারা। সম্ভবত হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম সামনের দিকে, কারণ উনি হেঁটে এসে দুইহাতে আমার মাথা আর চোয়াল ধরে আলতো চাপ দিয়ে বললেন-

‘বাঁশঝাড়ের পোকামাকড় ঢুকে যাবে মুখে, চলো বাড়ি চলো! এই বদমাইশটাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা, জ্ঞান ফিরলে আপনিই সুস্থ হয়ে যাবে। পিছন পিছন আসতে পারবে নাকি হাত ধরে নিয়ে যেতে হবে?’

-‘আসবো মানে পারতে আসব…ধুর!পারবো, আসতে পারবো!’

সারা পথ চুপচাপ উনার পেছন পেছন হেটে বাড়ি ফিরলাম। ভেবেছিলাম খশরু হয়ত সব শুনে মেনে নিয়েছে, আর যন্ত্রণা করবেনা! কিন্তু বদমাইশ জানোয়ারটা একটুও শোধরায়নি! ভালরকম শাস্তি হয়েছে ওটার আজকে, এরপরেও কি আদৌ শোধরাবে ইতরটা?

বিয়ে বিয়ে আমেজ কাটতে সেদিনের পরে আরো দিন দুয়েক চলে গেলো। খশরুর ঘটনাটা বাড়িতে কাউকে বলিনি, আনিসই নিষেধ করেছেন- অযথা সবাই চিন্তা করবে বলে। প্রায় সব আত্নীয়রা চলে গেলে বাড়িটা প্রায় ফাঁকা হয়ে এলো- মিশু এখনো যায়নি, ও বাদে কেবল আমি, আমার শ্বশুড় আর শ্বাশুড়ি আলেয়া খাতুন, আমার দেবর আকবর আর তার স্ত্রী রুপা এবং ক্যাবলাকান্ত আনিসভাই- এই জনা ছয় প্রাণী পরে রইলাম বিশাল পুরনো আমলের বাড়িটাতে। ঐ বাঁশঝাড়ের ঘটনাটা বাদ দিলে এই দু’দিন বেশ ভালই কেটেছে আমার, দিনে নতুন বউ সেজে ঘুরে বেড়ানো আর রাতে মরার মত ঘুম! আনিসভাই তো মেঝেতে পার্মানেন্ট বাসস্থান গেড়ে বসেছেন, আমি খাটে। টুকটাক এদিক-সেদিক কথাবার্তা ছাড়া তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথাও হয়নি উনার সাথে আমার! বেশ আছ দু’জনে দু’জনের মত করে। আজকে সকাল সকাল উঠে রান্নাঘরে গেলাম, সাজুখালা রুটি বেলছে মেশিনের মত তরতর করে।

-‘আমি ভেজে দিই রুটিগুলো? দ্রুত হবে..’

-‘হ দ্যান ভাবী! তাইলে আমার ভালাই হয়, কাজ আগায়!’

এক এক করে রুটিগুলো ভাজতে আরম্ভ করলাম, তারপর ফ্রিজ খুলে ছয়টা ডিম বাটিতে করে নিয়ে আসলাম ভাজার জন্য।

-‘ডিম এতডি আনসেন ভাবী? বড় ভাইয়ে ত খায়না ডিম!’- সাজুখালা বললেন।

-‘ক্যান? ডিম খায়না ক্যান? অদ্ভুত ত!’

একটা অর্থহীন শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান সাজুখালা, তারপর মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন-

‘দিলে ত খাইব! দশ বচ্ছর ধইরা কাজ করি এই বাড়িত…মিশু খালাও অনেক চেষ্টা কইরাও পারেনাই… খালাম্মা হেরে ফিরিজের জিনিস ছাড়া কিছু দেয়না সকালে…’

সৎ মা কী জিনিস সে আমি ভালই জানি, সাজুখালার কথায় বুঝলাম আনিসের অবস্থাও আমার মতই। দু’দিন হলো এ বাড়িতে পা রেখেছি, আমার পক্ষে তো আর সবকিছু বদলে ফেলা সম্ভব না! তাই ফিরে যেয়ে দুটো ডিম আবার ফ্রিজে রেখে এলাম, বাকি সবার জন্য ডিমভাজি করে সাজুখালাকে জিজ্ঞেস করলাম-

‘দেন আপনের বড় ভাইরে কি দিবেন দেন। বাটিতে নিয়ে ঢাকনা দিয়ে রাখি!’

-‘অইযে ফিরিজে কাইলকা রাইতের তরকারি আছে হেইডি…’

-‘মানে! আলাদা কোনো ভাজিভুজিও করেন না ওর জন্য?’

-‘খালাম্মায় না করতে কইলে আমি ক্যামনে করুম? আর আগের তরকারিডি নষ্ট হইব কেউ না খাইলে…’

-‘কেউ না খাইলে ফালায়া দিবেন! উনারে একলা বাসি তরকারি খাইয়া শেষ দিতে হবে- এইটা কেমন নিয়ম! সরেন দেখি, আমারে দুইটা বড় আলু দেন এইদিকে…কারোর কিছু করতে হবেনা। আমিই পারব!’

আমি জানিনা সেসময় ঠিক কী মনে হচ্ছিলো আমার! সৎ মায়ের অত্যাচার তো জীবনে কম সহ্য করিনি! আমি নিজেই তো বাসিপচা খেয়ে, স্টোর রুমে বড় হওয়া মেয়ে… অথচ আজকে দুইদিনের চেনাজানা একজনের একবেলার খাওয়া আমার কাছে এত গুরুত্বের হয়ে গেলো কী করে? অদ্ভুত তো!

যাকগে, মরুকগে! রান্নাবান্নার অভ্যাস আমার আছে, ভালই আছে! ফটফট করে দুটো বড় আলু ছিলে, ঝিরিঝিরি করে কেটে, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাজি বসিয়ে দিলাম। মিনিট তিরিশের মধ্যে ঘ্রাণ ছড়িয়ে ভাজিটা হয়ে এলো, ততক্ষণে বাকিরাও ঘুম ভেঙে উঠে পরেছে। যার যার পাতের খাবারগুলি নিয়ে টেবিলে বসে গেল সবাই, গরম গরম ভাজিটার উপরে হালকা ধনেপাতা আর ঘি ছড়িয়ে দিয়ে সিরামিকের হাফপ্লেটে নিয়ে আনিসের সামনে রাখলাম আমি, নিজের জন্যেও নিলাম।

-‘বাহ আলুভাজিডা ত খুব ঘ্রাণের হইসে, আমারেও একটু দিও অরুভাবী!’- খেতে বসতে না বসতেই আনিসের ছোট ভাই আকবর বললো। আকবর আর ওর স্ত্রী রুপার প্লেটে ভাজি দিতে না দিতেই আলেয়া খাতুনের চিকন কণ্ঠ কানে এলো আমার-

-‘আলুভাজি কই পাইলা বউ?’

-‘উনি নাকি ডিম খায়না, তাই আলুভাজি করলাম!’

-‘ক্যান! ফিরিজে কাইলকার তরকারি নাই?’

-‘আছে মা! কিন্তু সকাল সকাল বাসি খাবার দিয়ে মুখ খোলা তো ভালনা! সেই তরকারি নাহয় আমিই দুপুরে খেয়ে নেবখন…’

আলেয়া খাতুন হতভম্ব দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন! সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আমি নিজের খাওয়া চালিয়ে যেতে লাগলাম। সবচে অদ্ভুত কাজটা করলেন আনিস বোকাচন্দর, মিনমিন করে বলে ফেললেন-

‘আচ্ছা, আমিই বের করে নিচ্ছি ফ্রিজ থেকে। ভাজি লাগবেনা…’

-‘লাগবেনা মানে কি দাদাভাই? সারা জনম চেষ্টা কইরাও যে কাজ আমি করতে পারিনাই সেইটা যদি আজকে তর বউ করে,আর কিছু না পারস তারে অন্তত সমর্থন টা দিস! চুপচাপ ভাজি দিয়া খাবি তুই এখন, আর অরুভাবী! দুপুরেও ঐ বাসি জিনিস তুমার একলা খাওয়ার দরকার নাই, খাইলে সবাইই খাইব নাইলে কেউনা!’- মিশুর গলায় আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস শুনে বাকি সবাই চুপ হয়ে গেলো একদম! বাকি সময়টুকু শান্তিমতই কাটলো।

আনিস বাইরে যেতেই উনার ঘর গোছানোর কাজে নামলাম আমি। একেবারে যাচ্ছেতাই দশা ঘরের! মনে হয়না কেউ কোনোদিন গুছিয়েছে! এক পলিথিন ভর্তি ধূলো-ময়লা জমিয়ে নিয়ে বাইরে ফেলতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই আলেয়া খাতুনের কণ্ঠ কানে আসে-

‘হাডুর বয়সী মাইয়া, সে কিনা আমার লগে টেক্কা নেয়! নিজের প্যাটের মাইয়াডা ত হইসে আনিছছ্যার চ্যালা! অখন আরেকজন আইয়া জুটসে! আমার এতদিনের সংসার এত সুজায় ভাইসা যাইতে দিমুনা, আমিও কইয়া থুইলাম তোরে সই!’

আলেয়া খাতুন থামতেই একটা পরিচিত গলা কানে আসে-

-‘মাইয়াডা ত ভালানা আলেয়া! আমাগো খুশরুর লগে বিয়া দিবার চাইসিল, তা আমার অত পছন্দ হয়নাই। এই মাইয়াই খুশরুর পিছনে ফেউয়ের মত ঘুরতো! রুপের ঝলক ত ভালই আছে, তাই দেইখা খুশরুও গইল্লা গেসিলো! আমি সাফ সাফ কইয়া দিসিলাম এই মাইয়ারে আমার পুলার লগে বিয়া দিমুনা,অপয়া অলক্ষী একটা! আনিসের মাথাডা খাইয়া বাড়ি থিকা পলায়া আইয়া বিয়া বইলো- এইডা কুনু ভদ্র মাইয়ার কাম আলেয়া, তুইই ক?’

ওহ! খশরুর মায়ের সাথেই তাহলে কথা বলছেন আমার শাশুড়ি! তাইতো বলি গলাটা চেনা চেনা লাগছে কেন! মিথ্যুক মহিলা আবার একগাদা মিছেকথা বানিয়ে বলছেন! যেমন ছেলে তেমন তার মা- বেয়াদব অসভ্য পরিবার একটা! রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিলো আমার, ময়লাভর্তি পলিথিন হাতে নিয়েই গটগট করে বেরিয়ে একদম ঐ মিথ্যুক মহিলার নাক বরাবর দৌড়ে যাই। ইচ্ছে করে ধাক্কা লাগিয়ে ধূলো-ময়লা ভরা পলিথিনটা উপুর করে উনার শাড়ির ওপর ফেলে দিই!

-‘অ্যা ছিছিছিছি! মাইয়া চউখে দেখনা নাকি? দিলা তো আমার অজুডা নষ্ট কইরা!’

-‘কুটনি বুড়ি! তোমার আবার অজু-নামাজ কীসের?’- বিড়বিড়িয়ে বলেই দৌড়ে উঠোন পেরিয়ে বাইরে বেরোলাম আমি।

-‘কী কইলা! কী কইলা? অই মাইয়া দাঁড়াও দাঁড়াও…- পেছনে খশরুর মা চিল চিৎকার করছেন!

আনিস লোকটা….উঁহু ছেলেটা (বয়স অত বেশি না যে লোক ডাকবো, ছেলেই মিলছে ভালো!)- আসলেই একটা বোকাচন্দর, ক্যাবলাকান্ত! বাড়িতে আয় রোজগার সবচে বেশি তার, বিদ্যা-বুদ্ধিতেও বাকি সবার চে’ আগানো অথচ এই বাড়ির সবচে গুরুত্বহীন লোকটা হলো সে! একবেলা খায় তো দুইবেলা খায়না, বিকেলে সবাই নাস্তা খায় সে তখন বাইরে রোগী দেখে বেড়ায়, রাতে খেতে বসে সবার শেষে…মুড়োটা, পেটিটা বাকিরা খেয়ে নিয়ে লেজ আর ঝোল যেটুকু বাকি থাকে তাই দিয়ে নিরুপদ্রবে খেয়ে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে। তা সেই ঘরখানাও আবার আমার দখলে এখন, মেঝেতে বিছানা করে কোণায় জুবুথুবু হয়ে রাতটা কাটায় সে…সকাল হতেই আবার একই রুটিন! আমার হয়েছে চৌদ্দ জ্বালা, চোখের সামনে মানুষটার এই একলা জীবন না পারি সইতে, অথচ কিছু যে করব তার উপায় কই? সেই অধিকারটুকু থাকলে তো! এই তো এক নামেমাত্র বিয়ে তার আবার অধিকার-হুহ! হওয়ার মধ্যে যা হলো, আমায় নিয়ে উপজেলার একটা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন উনি। ভর্তির দিন ফিরতি পথে বইখাতা, ব্যাগপত্র ও কেনা হলো, এও বলে দিলেন- ভাল রেজাল্ট হলে আমার মেডিকেলে পড়ে ডাক্তার হওয়ার সব দায়িত্ব নাকি উনার…শুধু আমার আর বলে ওঠা হলোনা-

‘যে জন দেয়না দেখা
যায় যে দেখে ভালোবাসে আড়াল থেকে
আমার মন মজেছে সেই গভীরে
মন মজেছে সেই গভীরে
গোপন ভালোবাসায়
আমার সকল নিয়ে বসে আছি
সর্বনাশের আশায়।’

যত দিন যাচ্ছে তত বেশি করে বিয়ের রাতে মিশুর বলা কথাগুলির মানে বুঝতে পারছি! এ বাড়িতে পদে পদে আনিসকে অপদস্থ করা হয়। যদিও বাড়ির খরচের সবচেয়ে বড় অংশটা সে-ই বহন করে, কিন্তু সবদিক দিয়ে সবচে বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আলেয়া খাতুনের নিজের পেটের ছেলে আকবর আর তার স্ত্রী রুপা! সকালের নাস্তার ব্যাপারটা আমি নিজের সুবিধামত ঘুরিয়ে নিয়েছি, প্রতিদিনই কিছু না কিছু ব্যবস্থা করি নিজেদের জন্য কিন্তু বাদবাকি দিকগুলো এত বেশি এলোমেলো হয়ে আছে যে ওতে হাত দিতে গেলে যে অধিকারের দাবিটুকু লাগে সেটুকু এখনোও পাইনি। অথচ দিনের পর দিন উনাকে এইভাবে অসম্মানিত হতে দেখতেও ভাল লাগেনা! বিকেলের দিকে পদার্থবিজ্ঞান বইটা পড়তে পড়তে এসব হাবিজাবি ভাবছি বসে বসে, আলেয়া খাতুনের ডাকে ঘোর কাটে আমার।

-‘অরু? ও অরুন্দতি, এইদিকে আসো!’

উনার ঘরে গেলাম আমি।

-‘মাগরিবের আযানের বাদে আইজকা সই আইবো আমাগো এইখানে বেড়াইতে! পোলা বিয়া করাইসে, নতুন বউরে নিয়া মিষ্টিমুখ করতে আইব। এট্টু পায়েশ আর পিঠা বানামু, রান্নাঘরে যাও আমি আইতাসি!’

আমার শ্বশুর পাশেই বসে ছিলেন। পিঠার নাম শুনতেই হাসিমুখ করে বললেন-

‘ও মিশুর মা, কইতাসি শীত ত পড়ব পড়ব করতাসে, এট্টু দুধচিতই পিঠা বানাইবানি? আইজকা রাইতে ভিজায়া রাখলে সকালে ফুলা ফুলা পিঠা.. আনিসের ও খুব পসন্দ… ‘

-‘আকবরের দুই চউখের বিষ দুধচিতই পিঠা, দুধের গন্ধ তো হেয় সইবার ই পারেনা! হুদামুদি এই ব্যাগার খাটনি অখন খাটবার পারুম না, শখ হইলে বাপে পুতে বানায়া খানগা যান!’- শ্বাশুড়ি মুখ ঝামটা দিয়ে উঠে এলেন।

আনিস তারমানে একলা না, আমার শ্বশুরটাও একই নায়ের মাঝি! এই আলেয়া খাতুনের প্রবল প্রতাপের সামনে এরা দু’জনেই ভেড়া বনে গেছে! মনে মনে ঠিক করে নিই, এসপারওসপার যা করার আমাকেই করতে হবে এবার…

পায়েশটা চুলায় বসিয়ে দিয়ে পানিতে চালের গুঁড়ো গোলাতে বললেন আলেয়া খাতুন, তেলের পিঠা ভাজবেন।

-‘আপনি যান, আমি তেলের পিঠা বানায়ে রাখব।’- আমি উত্তরে বললাম।

-‘হ রান্ধনের হাত ত ভালাই তুমার, ত্যালের পিঠা বানাইবার পারতো ঠিকমত?’

-‘পারি!’

-‘আচ্ছা তাইলে আমি গেলাম, আসরের নামাজটা পইরা আসি গিয়া।’

-‘আপনের আর না আসলে চলবে, আমি ডাক দিবনে আপনেরে সব শেষ হইলে…’

উনি চলে যেতেই আমার কাজ শুরু করে দিলাম। বেশি করে চালের গুঁড়ো গুলিয়ে এক চুলায় তেলের পিঠা অন্যটায় চিতই পিঠা ভাজতে আরম্ভ করলাম। দুধ জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা হবার জন্য আমার ঘরে নিয়ে রেখে এলাম এক ফাঁকে। এদিকে ততক্ষণে দুইরকম পিঠাই বানানো শেষ, চিতই পিঠার বাটিটা আমার ঘরে রেখে এসে আলেয়া খাতুনকে রান্নাঘরে ডাকলাম। উনার হাতে সব বুঝিয়ে দিয়ে আমি আমার ঘরে চলে এসে পিঠাগুলিকে ভিজিয়ে ঢাকনা দিয়ে খাটের তলায় রেখে আবার পড়তে বসে গেলাম।

মাগরিবের পরপর সেই ‘সই’ এলেন, খশরুর মা! ভালই মিলেছে, রতনে রতন চেনে আর শুয়োরে চেনে কচু! দুই জাঁদরেল মহিলা সই পাতিয়ে বসে আছেন! খশরু বেয়াদবটাকে আবার এর মধ্যে বিয়েও করিয়ে ফেলেছেন মহিলা, কমবয়েসী মেয়েটাকে বেশ সরল সোজা বলেই মনে হলো দেখে আমার! আহারে, বেচারির কপালটা এই বয়সে পুড়লো!

কুটনি বুড়ি খশরুর মা ছেলের বউয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বাড়ি মাতিয়ে গেলেন। তারা বিদায় নেবার আগ দিয়ে আলেয়া খাতুন আমায় ডেকে বললেন-

-‘অরু! আকবরের জন্যি চাইরডা পিঠা রাইখা বাকিডি সই-রে বাক্সে কইরা দিয়া দেও, হের বাড়িত নিয়া যাউক।’

আমি কোনো জবাব না দিয়ে গোটা পনের তেলের পিঠা আলাদা রেখে বাকি কয়েকটা বক্সে ভরলাম।

-‘কিগো! আর পিঠা কই? এত কম ক্যা বাক্সে?’- আলেয়া খাতুনের চিকন চিৎকার কানে এলো!

-‘আব্বার জন্য আর আপনের বড় ছেলের জন্যও রাখসি মা! খালি আকবর ভাইএর জন্য রাখলে ক্যামনে হবে!’

পুরো ঘরে পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে এলো যেন। খশরুর মা তার ডান হাতটা তুলে হাঁ করা মুখের কাছে নিয়ে গেলেন-

‘ও মালোমা! কত কী দেখুম, চিতি পিঠার চাইর ঠ্যাং! দুইদিন হয়নাই বিয়া হইসে এখনি জামাইএর জন্যি পুইড়া যায়! আমাগোর য্যান আর বিয়া হয়নাই, আমাগো য্যান আর জামাই নাই! তলে তলে এত দূর! সই, আগেই কইতাসি এইবার টাইট দে নাইলে পরে পস্তাবি। না তর প্যাটের পুলা, তার আবার বউ- যে কীনা বাপ মায়ের বাড়ি থিকা পলায়া আইয়া জামাইর বাড়িত উইঠা বইসে, তার এত দেমাগ? যেমন বালপাকনা পোলা হইসে আনিসে হের তেমন বেহায়া বউ, আগেই কইয়া রাখতাসি…’

-‘আমার যদি দরদ থাকে তো নিজের জামাইএর জন্যই আছে, আপনের এত জ্বলে ক্যান? নিজের ছেলেরে গিয়া টাইট দেন যান! রাস্তাঘাটে মেয়ে মানুষ দেখলেই তো ছোঁক ছোঁক করে, আসছেন আরেকজনরে জ্ঞান দিতে! মেহমান, মেহমানের মত থাকেন, উনারে নিয়া কোনো বাজে কথা বলবেন না!’- বাহিরঘর ছেড়ে নিজের ঘরে চলে এলাম আমি, দড়াম করে মহিলার মুখের ওপর দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। কাজের কাজ হয়েছে যেটা, আসতে সময় পিঠার বাটিটাও সাথে করে নিয়ে এসেছি…আমি সব করতে রাজি আছি কিন্তু উনারে বঞ্চিত হইতে দেখতে পারবনা- এইটা আলেয়া খাতুন যত দ্রুত বুঝে ততই মঙ্গল!

ঘরে ঢুকতেই দেখলাম ক্যাবলাকান্ত আনিস বড় বড় চোখে ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! এই লোক তো ঘুমিয়ে ছিল,ঘুম ভেঙে উঠেছে কখন কে জানে!

-‘নেন! পিঠা খান! সব খাইয়েন না আবার হাবার মত, আব্বা আর আকবর ভাইএর জন্য রাখবেন।’- বাটিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম আমি।

-‘এত যুদ্ধ করে এগুলা না আনলেও চলতো, আমি তো…’

মাথায় যেন শর্ট সার্কিট হয়ে গ্যালো আমার! যার জন্য করি চুরি সে কয় চোর! শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে যুদ্ধংদেহী চেহারা করে আনিসের একদম সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম, নাকের সামনে ডানহাতের তর্জনী উঁচিয়ে কিড়মিড় করে বললাম

-‘যুদ্ধের য ও দেখেন নাই আপনে! ভদ্র মানুষের মত চুপচাপ এইগুলা খাবেন, নাইলে সবই দেখবেন বলে দিলাম!’

আনিস মাথা নিচু করে তার সেই বিখ্যাত ফিচলে হাসিটা দিলো, তারপর বামহাতে আমার তর্জনীটা খাবলে ধরে মৃদু গলায় বললো-

‘সব দেখবো বলেই বসে আছি সেই কবে থেকে! খেলাম না তোমার পিঠা, দেখাও কী দেখাবা…’

ইশ! কী বিচ্ছিরি অবস্থা! মোচড়ামুচড়ি করতে যেয়ে উলটে নিজের আঙুলেই ব্যথা পেলাম, জলহস্তীটার হাত থেকে একচুল ছুটতে পারলাম না! উলটে আমার কোমরে প্যাঁচানো আঁচলটা খুলে দিয়ে তাতে নিজের মুখটা মুছে নিলো সে। তারপর বাতাসের গলায় বললো-

-‘এবারের মত অল্পের উপরে ছাড়লাম, নাবালিকা তুমি সাবালিকা হলে বাকি যুদ্ধ ঘোষিত হবে,আপাতত সন্ধি করো!’

তারপর আস্তে করে আঙুলটা ছেড়ে দিয়ে পিঠার বাটিটা নিয়ে বসলো।

আমার বুকের ভেতর ততক্ষণে একশো হাতুড়ি মাথা কুটে মরছে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here