একজীবন শেষ পর্ব

একজীবন
পর্বঃ ৭ (শেষ পর্ব)

খুব ভোরবেলা ঘুম ভাঙার অভ্যেস আমার, ফজরের নামাজটা পড়েই নিজের পড়ালেখাটুকু শেষ করে নিতে হতো বাবার বাড়িতে থাকতে! এরপর তো সারাদিন ছুটোছুটি, স্কুল ফেরত বাড়ি এসে আবার ঘরের কাজকর্ম, ছোটো ভাইটার দেখাশোনা- আর পড়ার ফুরসতটাই মিলতো না! সেই অভ্যাসটা এখনো যায়নি। এ ক’দিন ভোরে উঠে নামাজটা পরে নিয়েই ছাদে চলে যেতাম, ভোরের হিম হিম পরিবেশটা এত ভাল্লাগে! আজ তো ছাই সেই ইচ্ছাটাও মরে গেছে, একলা একলা আর কাঁহাতক ছাদে ঘুরে বেড়ানো যায়? যে শালিক সঙ্গী খুঁজে পায় তার বুঝি আর একা চড়ে বেড়াতে ভালো লাগে?

কিন্তু এই ট্যাটনা হাবাটার ঘুম ভাঙানো যায় কীভাবে! নভেম্বর মাস চলে, গ্রাম এলাকা বলে এখানে ভাল শীত পড়েছে এরমধ্যেই….ঠান্ডা পানি এনে গায়ে ফেলে দেয়া যেতো কিন্তু সত্যি বলতে মায়া হচ্ছে বেচারার জন্য! নাহ! সবে জ্বর ছেড়ে উঠেছে এখন এই শীতে পানিটানি মারা যাবেনা। ধুর! থাকুক ঘুমিয়ে। জেগে গেলেই তো রাজ্যের অদ্ভুত অদ্ভুত সব আলাপ জুড়ে বসবে আর ওদিকে আমার হৃদপিণ্ডটার বারটা বেজে যাবে ধুকপুক করতে করতে, এরচে বরং ঘুমিয়ে থাকতেই যা বলার বলে নিই, তারপর ছাদে এক ঘুরান দিয়ে আসি!

-‘হাবাচন্দ্র, ক্যাবলাকান্ত, দস্যু সর্দার! দিব্যি তো নিষ্পাপ ফুলটির মত ঘুমাচ্ছো, কে বলবে যে তুমি এক নাম্বারের ট্যাটন! খালি ত ফটফট করো, দুনিয়ার এত কিছু বোঝ আর মন বোঝ না, কচুর ডাক্তার তুমি! কালকে যে জোর করে আমার ওপর ডাকাতি ফলালে, এখন যদি আমি তার প্রতিশোধ নিই আটকাতে পারবে? উহ-হু! পারবেনা! এখন আমি তোমার কপালে, তারপর নাকে তারপর দুই গালে আর তারপর… ’

-‘শুধু বলেই যাবে না কিছু করবে? কতক্ষণ মরার মত পরে আছি আশায় আশায়!’- হাত নেড়ে নেড়ে আবোলতাবোল বলে যাচ্ছিলাম আমি, খপ করে হাতটা ধরে নিয়ে বলল সে! ফিচলে ছেলেটা তারমানে এতক্ষণ জেগে ছিলো! কী খারাপ, কী খারাপ!

-‘আপনি আসলেও একটা খারাপ, একটা অসভ্য, একটা …. একটা…’

-‘একটা কী? হাবাচন্দ্র? ক্যাবলাকান্ত? নাকি দস্যু সর্দার? নাকি সবগুলাই?’

-‘জানিনা! ছাড়েন, আমি যাব!’

-‘কই যাবা এখন? সবাই ঘুমে কাদা… ওহ! ম্যাডাম তো আবার ভোরে ছাদে যান!’

-‘এটাও জানা হয়ে গেছে!’

-‘আমি হাত গুনতে জানি!’

-‘তাই? নিন গুনে দেখান ত আমার হাত’- দুই হাত সামনে মেলে দিয়ে বললাম।

খানিক্ষণ বুঝদারের মত চেয়ে চেয়ে হাত দুটো দেখলো সে। তারপর-

-‘নাহ, এতদূর থেকে দেখা যাচ্ছেনা, কাছে আসতে হবে’- বলে এক ঝটকায় নিজের দিকে টেনে নিলো, আমার ঝুঁকে থাকা কণ্ঠের চারিদিকে দুই হাতের বন্ধনী তৈরী করে ফিসফিসিয়ে বললো-

-‘আপনার হাত বলছে-

অচিন দেশের অচিন পাখি, আমি কেমন করে বাঁধি?
সোনার বেড়ি, রুপার খাঁচা বৃথাই তারে সাধি!

-‘এটাও কি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা?’

-‘নাহ! এটা আনিসেন্দু দোষ-এর লিখা, নির্মলেন্দু গুণ নয়!’

আচ্ছা! ফিচলেটা নিজে বসেবসে পয়ার বাঁধছে তারমানে! বেশ, তুমি ফিচলে হলে আমিও তোমার যোগ্য ‘অর্ধাংগী’- মনেমনে ফন্দি এঁটে সরল মুখ করে বললাম-

‘নাহ! এটা তো আমি পড়েছি আগে, আমার চেনা কবিতাটা!’

-‘কীহ! এটা আমি মাত্র বানালাম ভেবে ভেবে, মিছেকথা!’- হাবাটা বোধহয় দ্বিধায় পরেছে, এর আগে তো কোনোদিন এভাবে মিথ্যেমিথ্যি ফাঁদে ফেলেনি তাই এই ডাহা মিথ্যাটাও অবিশ্বাস করতে পারছেনা! আসলেই ক্যাবলা!

-‘অন্যের লিখা নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন! আপনাকে তো ভালমানুষ জানতাম আমি!’- রীতিমত কঠিন গলায় বললাম।

-‘আচ্ছা, বেশ। তবে পরের লাইনগুলি বলো শুনি! তবে বিশ্বাস করব…’

-‘দাঁড়ান, মনে করতে হবে!’

খানিকক্ষণ মাথা চুলকে নিয়ে বললাম-

‘সোনা-রুপা, পান্না-চুনি তাই কি পাখি চায়?
ভালোবাসার বেড়ি হতো, পরতো পাখি পা’য়!’

ক্যাবলার চোখ ততক্ষণে রসগোল্লা হয়ে গিয়েছে!

-‘আচ্ছা! এই কথা! ষোড়শীর পেটে পেটে এত বুদ্ধি, আর আমি কীনা আঠারোর অপেক্ষায় বসে আছি! সন্ধিচুক্তি বাতিল….!

শেষমেশ আর ছাদে যাওয়া হলোনা আমার, বদলে বিষপিঁপড়ের ছোবলে সর্বাংগ জ্বলেপুড়ে গেলো!

সকালে সাজুখালা এলে আমিও তার সাথে রান্নাঘরে গেলাম সাহায্য করতে। দুমুঠো দুধ-রুটি মুখে দিয়েই আনিস দৌড়ে বেরিয়ে গেছে, প্রতি শুক্রবার সকাল সকালই সদর হাসপাতালে যেতে হয় তাকে। আজকে শুক্রবার, বাড়িতেই থাকবে সবাই তাই খাবারের আয়োজনটাও একটু ভাল কর‍তে হবে। মাঝে মাঝে নূরজাহান দাদীর কথা খুব মনে পরে, সেইযে একবার গেলাম এরপর আর যাওয়াই হলোনা! অবশ্য ভালমন্দ রান্না হলে সাজুখালাকে দিয়ে দাদীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিই প্রায়ই। আজকেও সাজুখালাকে বলে সব একটু বেশি বেশি রান্না করিয়ে নিয়েছি, সময় সুযোগ মিললে আমিই নিয়ে যাব নয়ত সাজুখালাকে দিয়েই পাঠিয়ে দেব। মনে মনে এসব ভাবছি কিন্তু কোথাও একটা খচখচে অনুভূতি হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না। সকাল থেকে কিছু একটা খটকা লাগছে কোথাও, ঠিক বুঝতে পারছি না খটকাটা কোথায়! কি যেন নেইনেই বলে মনে হচ্ছে…

-‘আইজকা খালাম্মার কুনু সাড়াশব্দ পাইনা। সক্কালবেলাডা চিল্লাচিল্লি ছাড়া গ্যালো আইজকা আমার, দিনডা মনেহয় ভালা যাইব আইজকা!’- সাজুখালার উছ্বসিত কথায় ভাবনার সুতো কাটে আমার।

ওহ! তাইতো! আলেয়া খাতুনের চিৎকার চেঁচামেচি নেই আজ, তাই এমন খালি খালি মনে হচ্ছে! রান্না প্রায় শেষ, এখনো ওঠেনি না কি! যাকগে, আমার কী? সকালটা শান্তিতে গেলো এইই ঢের!

অন্যদিনের চেয়ে আজ আলেয়া খাতুনকে বেশি প্রাণবন্ত আর হাসিখুশি লাগছে! সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন, কোনো বকাবকি, চিৎকার-চেঁচামেচি নেই এমনকি আমার সাথেও বেশ ভালভাবেই কথা বলে যাচ্ছেন। রাক্ষুসী শূর্পনখার তবে সুমতি হলো বোধহয়! সকালের নাস্তাপর্ব শেষে আমাকে ডেকে বললেন-

-‘আইজ ত অনেক খাবার বেশি হইসে, দুপুরের আগে আগে তুমার দাদীরে কিছু নিয়া দিয়াইসো আর তুমিও দাদীর লগেই দুপুরের খানা খাইয়া আইসো, হেয় একলা থাকে….। সাজুরে দিয়া তো পেরায়ই পাঠাও, আইজকা নিজেই যাইও। বন্ধের দিন আছে, হেরে দেইখ্যাও আইলা…’

শেষমেশ এই বাক্য! এই মহিলার মুখে! আমার চোখ রীতিমত রসগোল্লা হয়ে গেছিলো বোধহয়, কোনোরকমে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম আমি! আনিস হাঁদারাম টা থাকলে ভালো হতো, একসাথে যাওয়া যেতো! কিন্তু প্রতি শুক্রবারই সদর হাসপাতালে যেতে হয় তাকে, বিকেলের আগে ফিরতে পারেনা। আজও সেখানেই গিয়েছে।

এ বাড়ি থেকে দাদীর বাড়িতে যেতে সেই বাঁশঝাড়টা পেরুতে হয়- ভাবতেই কেমন গা গুলিয়ে আসে আমার! সাজুখালাকেও একগাদা কাপড়-চোপড় ধুতে বসিয়ে দিয়েছে, রুপাটাও বাড়িতে নেই-বাবার বাড়ি বেড়াতে গেছে! অবশ্য এই দিনদুপুরে আর কি-ই বা এমন হবে? তাছাড়া খশরুকে সেদিনের পর আর দেখিওনি, বোধহয় শিক্ষা হয়েছে শয়তানটার! এইটুকুই তো রাস্তা, তাতে দিনের আলো- একটা ব্যাগে খাবারগুলি ভরে নিয়ে একাই রওনা দিচ্ছিলাম। মিশু এসে পথ আটকালো হঠাত।

-‘তুমারে একলা ছাড়ন যাইবনা, দাদাভাইয়ের নিষেধ আছে! আমিও যামু সাথে, চলো!’

-‘কেন অযথা খাটনি করবেন মিশুআপা! আমার সমস্যা হবেনা…’

-‘দাদাভাই যদি শুনে তুমারে একলা ছাড়সি,আমারে ধইরা ঘারাইবো! বারবার বইলা গেসে যতদিন আমি আছি আমার ভরসায় তুমারে রাখতেসে, এই মাসের বেতন হইলেই তোমার জন্য মোবাইল কিনা দিবো তখন আর… ‘

আমি রসগোল্লা চোখ করে তাকাতেই জিব কেটে থেমে গেলো মিশু।

-‘কিহ! এইসব বলছে সে আপনারে?’

-‘আমারে না করসিলো জানাইতে, মনের ভুলে বইলা দিসি। অরু,তুমি কইলাম দাদাভাইরে কইও না কিছু! আর ফোন একটা দরকার ও তুমার, আমি ত আর সবসময় এইখানে থাকুম না, বিপদ-আপদে অন্তত দাদাভাইরে সাথে সাথে জানাইবার পারবা…’

-‘কী যে সব কাজকর্ম করেন আপনেরা দুই ভাইবইনে! আচ্ছা চলেন যাই এখন, খাবার এইগুলা ঠান্ডা হইলে দাদীর আবার গরম দিতে হইব পরে! কিন্তু আপনে আমার সাথে গেলে আপনের আম্মা আবার রাগ করব না তো? দেখেন…’

কথাটা বলে শেষ ও করতে পারিনি, আলেয়া খাতুনের রণমূর্তিটা একেবারে সটান আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো, নিশ্চিত এখন দু’কথা শুনিয়ে দেবে মিশুকে আর আমাকে…

কিন্তু কী অদ্ভুত সব ব্যাপার হচ্ছে আজ সকাল থেকে! আলেয়া খাতুন নিজে যেচে এসে বরং হাসিহাসি মুখ করে মিশুকে বললেন-

‘যা তো মিশু মা অর লগে নূরি দাদীর বাড়িত। আনিসে ত অরে একলা ছাড়তে মানা কইরা গ্যাসে বারবার…’

সত্যি, সকাল থেকে একের পর এক চমক! আর নেয়া যাচ্ছেনা।

-‘আম্মার হইসে কী আজকা? যাদুটোনা করসে নি হেরে কেউ? সকাল থিকা এত মধু ঝরতাসে গলায়…ঘটনা ভাল্লাগতাসে না কইলাম আমার! তুমি একটু সাবধানে থাইকো অরু!’ – বাইরে বেরিয়েই আমার হাত ধরে বললো মিশু।

-‘আরে ধুর! আপনে অযথা চিন্তা করতেসেন মিশু আপা, আম্মা হয়ত আমারে মাইনা নিসেন!’

-‘দাদী! ও দাদী! বাড়িতে আছেন নাকি?’- দাদীর উঠানটায় যেয়ে দাঁড়ালাম অবশেষে আমরা!

-‘ক্যাডা? ও নাতিন তুই! কতদিন পর আইলি, মিশুও আইসস লগে, তয় তর জোড়ায় কই?’

-‘জোড়ায় নাই! গ্রামে গ্রামে ডাক্তরি কইরা বেড়ায় আপনের নাতিয়ে, আমার জন্য সময় আছেনি তার?’

-‘শ্যাম যদি হইত পোষাপাখি প্রানসখি
শ্যাম যদি হইত পোষাপাখি ।।
রাখিয়া হৃদয়পিঞ্জরে পুষিতাম যতনকরে
এ জনমের মতো হইতাম সুখি , প্রান সখি ।।’- দাদী আচমকা মাথা নেড়ে নেড়ে গান ধরলেন! এদিকে দাদীর কান্ড দেখে মিশু মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসছে!

-‘ধুরু দাদী! জ্বালাইয়েন না তো! পোষাপাখি! এমনেই যার ফটফট কথার জ্বালায় বাঁচিনা, তারে পোষাপাখি বানায়া আরো মরি!’-শেষ অংশটুকু বিড়বিড়িয়ে বললেও দাদীর কানে ঠিক পৌঁছে যায়!

-‘ক্যাডায় জ্বালায় তরে? আনিসে নি? স্বোয়ামীর জ্বালায় যদি না জ্বলিবে রাই, বৃথা তুমার নারী জনম জেনে রাখো তাই!’

-‘কত্ত শোলক জানেন আপনে? সারাদিন খালি শোলক গাইতেই থাকেন!’

-‘কি করুম বইনে? আমারে ত জ্বালানির কেউ নাই!’- দাদী কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

-‘কে বলছে কেউ নাই? এইযে আমরা আইসা পরসি জ্বালাইতে! আপনের সাথে আজকে দুপুরে খাবো, সব নিয়াসছি। চলেন বসি!’- মিশু বললো ফট করে।

-‘আয় বয়! তরে আইজকা নাগালের কাছে পাইসি যখন তখন সব শিখায়া দিমুনে… ’

-‘কী শিখাইবেন আপনে? আমি পারি সব!’- আমি সগর্বে উত্তর দিলাম।

-‘হের নমুনা ত দেখতাসিই! গলায় দাগ-নিশান বানায়া ঘুরতাসো, উদুইল্যা মাইয়া কুনহানকার, বয়স হইসে বুদ্দি অয়নাই! আনিস্যাডারও তালতওবা নাই… ’

দ্রুত শাড়ির আঁচলটা দিয়ে দুই প্যাঁচে কাঁধের কাছটা ঢেকে নিলাম আমি, মিশু ততক্ষণে হাসি চেপে না রাখতে পেরে হোহো করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে!

-‘কুনদিক দিয়া এর সময় গেলগা ট্যার ও পাইলাম না! নূরি দাদী এক্কারে আউলাঝাউলা, এত কথা কয়! শুনতে শুনতে সময় যায়গা…’

বাড়ি ফেরার পথে মিশু বলে।

-‘হু! তবে দাদী খুব ভাল মানুষ আর বেশ চালাক চতুর ও!’

-‘হ! বয়স হইলে কি হইব, এখনো টনটনা!’

দুপুরের রোদটা মরে গেছে, শান্ত একটা বিকেলের আরম্ভ হচ্ছে কেবল। আশেপাশে সব নিস্তব্ধ, মাঝেমাঝে ঝলক ঝলক পূবের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে… গ্রামের পথঘাটগুলি এত সুন্দর লাগে মাঝেমাঝে! মিশুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে কখন বাড়ি ফিরে এসেছি বলতেও পারবনা। উঠোনে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছিলেন আলেয়া খাতুন, পেছন দিয়ে যে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি সেটাও টের পাননি। ঘুরে তাকিয়ে আমাদের দেখতে পেয়েই যেন চমকে গেলেন!

-‘এত দেরি হইল তুমাগো আইতে! সইয়ে আইসিল মিশুরে দ্যাখতে তা ত সে বাড়িত আছিলোনা, এই পিঠাডি দিয়া গ্যাসে। নেও তুমি একটা খাও মিশু এইডা খা…- বলে দু’জনের হাতে দুইটা পিঠা ধরিয়ে দিলেন উনি! কী আজব, এই মহিলা আমাদের জন্য পিঠার বাটি হাতে উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন এতক্ষণ! এ তো পরে ধীরে সুস্থে বসেও খাওয়া যেতো… অদ্ভুত!

-‘আনিসে এখনো আসেনাই, পিঠা খাওয়া হইলে যাও ঘরে গিয়া বিশ্রাম নেওগা। আর মিশু আমার লগে চল, সইয়ের বাড়িত যামু একটু!’

-‘মা আমি মাত্র আসছি এখন আর যামুনা, আপনে যান!’

-‘সই তরে দেখবার চাইসে, এইবার আইয়া ত দেখাও করস নাই! চল চল, কাইলকা ত আবার যাবিগা শ্বশুরবাড়িতে,আইজকা দেখাডা কইরা আসি চল!’ – মিশুকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলি বলেই আমার দিকে ঘুরলেন আলেয়া খাতুন।

-‘কী হইল, মিশু খায়া ফালাইলো তুমি এখনো পিঠা হাতে নিয়া দাঁড়ায়া আছো ক্যা? ভাল বানাইসে পিঠাডি, আকবর আর আনিসের জন্যিও রাখসি… খাও খাও… বলে একপ্রকার জোর করেই প্রায় আমার মুখে ওটা গুঁজে দিয়ে একপ্রকার টেনেই মিশুকে নিয়ে গেলেন বগলদাবা করে!

আনিস এখনো ফেরেনি, রুপাটাও বাপের বাড়ি গেছে দু’দিন হলো, এই প্রথম পুরো বাড়িটাতে আমি একদম একা! একটু ভয় ভয় লাগলেও বেশ ভালও লাগছে সাথে, যাই ছাদে যেয়ে ঘুরে আসি! গত শুক্রবার কিছু গাছের চারা লাগিয়েছিলাম ছাদে টব বসিয়ে… রোজ ভোরে যেয়ে জল-পানি ছিটিয়ে আসি। আজ তো যাওয়া হয়নি, এই সুযোগে যেয়ে দেখে আসি একবার!

পিঠেটায় দ্বিতীয়বার কামড় বসাতেই একটা তিতকুটে স্বাদ জিহবায় এসে লাগলো… কেমন যেন একটা তেতো তেতো অনুভূতি! নাহ, বাকিটা আর খাওয়া সম্ভব নয়… ছাদ থেকে বাড়ির পেছনে ফেলে দিলাম ওটা। গাছগুলি ভালই ডালপালা ছেড়েছে। ধুর! আসার সময় মনে করে বালতিতে গাছের জন্য পানি নিয়ে এলেই হতো, যাকগে এখন নিচে যেয়ে নিয়ে আসি…

প্যাঁচানো মরচে ধরা লোহার সিঁড়িটার মাথায় দাঁড়াতেই মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো, রেলিং ধরে সাবধানে নামছিলাম, চোখের সামনে সব কেমন ঘুরছিলো মনে হলো… একহাতে শক্ত করে রেলিংটা ধরে কোনোমতে সোজা দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম, সামনে একটা আবছা মানব অবয়ব,পরিচিত কিন্তু…কিন্তু না, পছন্দ করিনা আমি একে একদমই, এগিয়ে আসছে আমার দিকে… দৌড়ে পালানো উচিত আমার মস্তিষ্ক সাবধান করছে বারবার অথচ চোখের সামনে সবকিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে আসছে…. ব্যস এটুকুই শেষ পরিপূর্ণ স্মৃতি আমার! এরপর সব কেমন আবছা…

জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি আমি, কিন্তু অদ্ভুত ঘোরের মত ঘুম আমাকে ধীরে ধীরে কাবু করে দিচ্ছে। লোকটা ততক্ষণে এগিয়ে আসে আমাকে ধরে ফেলেছে, হ্যাঁচকা টানে আমাকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা আমার ঘরের দিকে যাচ্ছে। একটা বোঁটকা গন্ধ তার গায়ে, বিচ্ছিরি এই দুর্গন্ধটা আমি আগেও পেয়েছি… সেদিন বাঁশঝাড়ে…

খশরু!

চকিতে মস্তিষ্কের একটা কোণ সজাগ হয়ে ওঠে আমার, কিন্তু শরীরের বাকি অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো নিঃসাড়। মস্তিষ্কের সজাগ অংশটা বারবার যেন সতর্ক করে দিচ্ছে আমাকে, কিন্তু আমার এতদিনের বিশ্বস্ত হাত-পা সহ শরীরের প্রত্যেকটা অস্থি-পেশী যেন আজ বিদ্রোহ করেছে… সামান্য নাড়াচাড়ার ক্ষমতাটুকুও আজ বড় আকাঙ্ক্ষিত মনে হচ্ছে আমার!

ঘরে ঢোকার সময় দরজার সাথে ঠকাস করে মাথাটা বাড়ি খেলো আমার, মুহুর্তের জন্য হাত দুটোও যেন সচল হয়ে উঠলো। দু’হাতে খশরুর গলাটা পেছনে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গেলাম, কিন্তু ততক্ষণে একটা কাপড়ের দলার মত আমাকে ছুঁড়ে বিছানায় ফেলে দিয়েছে পশুটা!

-‘ত্যাজ কতো শালীর! হারামজাদি, বে…..’- খশরুর উচ্চারিত কুৎসিত শব্দগুলো যেন একদলা নোংরা মাছির মত উড়ে বেড়াচ্ছে ঘরে, এদের ভেতর দিয়েই বেরোতে হবে, নিজের ঘর থেকে আজ নিজেরই পালাতে হবে আমায়… যত দ্রুত সম্ভব! কিন্তু প্রচণ্ড ঘুমের অনুভূতি আমাকে বিবশ করে দিচ্ছে যে…

-‘এমুন অবস্থা করুম, তর পরাণের স্বামী আর তরে ঘরে নিবনা শালী, …’- খশরু হাঁপাচ্ছে আর হাসছে, হায়েনার হাসি- কোথায় যেন পড়েছিলাম… আহ, মাথাটা আউলে গেছে একদম আমার। আমাকে পালাতে হবে, যেভাবেই হোক…. একবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম… আনিস! আনিস কই? কমলাপুরে থাকবে… আমাকে যেতে হবে…

অতীত আর বর্তমান মিলেমিশে জট পাকিয়ে ফেলেছে মাথার ভেতরটা! এরমধ্যেই একটা নোংরা বিষধর সাপের মত হাতের স্পর্শে সমস্ত সত্তা রি-রি করে ওঠে আমার। গোঙানোর মত শব্দ করতে থাকি আমি, খশরু দ্রুত কিছু একটা মুখে গুঁজে দেয়, দুর্গন্ধভরা কাপড়টা মুখ থেকে ছুঁড়ে ফেলতে চাই কিন্তু খশরুর জান্তব হাতটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রচণ্ড ঘোরের মধ্যে আমার দুর্বল শরীরটা শেষমেশ হাল ছেড়ে দেয়, মস্তিষ্কের সজাগ অংশটা নিস্তেজভাবে তখনো সাবধান করে চলেছে……

…..
……..
কতক্ষণ পার হয়েছে জানিনা, বোধহয় অনন্তকাল! চোখ মেলতেই মিশুকে দেখলাম, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর পাশে আরেকটি মেয়ে…চেনা মুখ, কোথায় দেখেছিলাম? যাকগে, সে যে খুশি হোক… আর কেউ নেই?

আর কেউ…

-‘বেশি শীত করছে অরু? ফ্যান কমিয়ে দেবো?’- একটা গমগমে কণ্ঠে স্বস্তি ফেরে আমার।

আহ! এইতো সেই কণ্ঠস্বর! শিয়রে বসে চুপচাপ মাথায় বিলি কাটছিলো এতক্ষণ, তাই দেখতে পাইনি। ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার কপালের ওপর দিয়ে ঝুঁকে আছে মুখটা… একটা শান্ত, শুভ্র মুখ!

মাথাটা কেমন জট পাকিয়ে আছে, ঠিক কীভাবে এখানে এসে ঘুমিয়ে গেলাম, এরা সবাই কীজন্য এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে সব কেমন অদ্ভুত লাগছে! কিছুই মনে করতে পারছিনা। গলাটা তেতো লাগছে, ঢোঁক গিলে বললাম-

-‘পানি খাবো!’

আনিস দৌড়ে পানি এনে দিলো। উঠে বসতে যেয়ে টের পেলাম হাতে স্যালাইন লাগানো, আধশোয়া হয়ে পানির গ্লাসটা হাতে নিলাম। ওদিকে মিশু তখনো কেঁদেই চলেছে, সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে আরেকবার তাকাতেই মনে পরলো কোথায় দেখেছি একে- খশরুর নতুন বিয়ে করা বউ এই মেয়েটা!

খশরু!

এক পলকে অনেকগুলো দৃশ্য আবছা, সাদাকালো ছবির মত ভেসে উঠলো চোখের সামনে… আমি ছাদে গেছিলাম গাছগুলো দেখতে, পানির জন্য নিচে নামতে যেয়ে মাথাটা কেমন ঘুরে গেলো তারপর একজন কেউ এগিয়ে আসছিলো… তারপর… তারপর…

হায় খোদা!

খয়েরী মলাটের ডায়েরীটা নিয়ে দৌড়ে নিচতলায় যায় মেয়েটা!

–‘তারপর?’- উস্কোখুস্কো রুক্ষ চুল, জবার মত লাল টকটকে চোখের নিচে কালি- দৌড়ে আসা মেয়েটা উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করে।

কম্পিউটার ডেস্কে কাজ করতে থাকা থাকা শাড়ি পরা মহিলা চোখ তুলে তাকায়, বুকের কাছে সাদা নেমপ্লেটে সোনালি অক্ষরে ওর নাম ঝলমল করে ওঠে- ‘ঊষা।’

-‘তারপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত শাহনাজ! এরকম একটা ঘটনার পর যা হওয়া উচিত, তাই হয়েছিল সেদিন!’- গমগমে গলায় উত্তরটা দিয়ে সরু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ঊষা।

-‘আমি জানতাম! সব মিথ্যে, সবাই মিথ্যে প্রবোধ দিচ্ছে আমাকে! আমি জানি অরুকে আনিস আর ফেরত নেয়নি,ভাসিয়ে দিয়েছিলো খড়কুটোর মত… সব মিথ্যে! সত্যিকারের ভালোবাসা বলে কিছু নেই, কিচ্ছুনা…সব শরীরসর্বস্ব!’- শাহনাজ দু’হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

–‘সে যদি তুমি এরকম ভাবো তবে তাই-ই! কিন্তু, আপাতত আমার কাউন্সেলিং এর অংশটুকু শেষ। তুমি তো জানোই আমি এখানকার নার্স। ডায়েরিটা পড়া শেষ হলে দু’জন ডক্টর মিলে এই পোস্ট ট্রমাটিক কাউন্সেলিংটার বাকি অংশ সম্পূর্ণ করবেন। চোখটা মুছে ২০৫ নাম্বার রুমে চলে যাও, আমি বলছি তোমার ভালো লাগবে!’

শাহনাজ মেয়েটা চোখ মুছে দাঁড়ায়, তারপর নেশাগ্রস্তের মত হেটে যায় দোতলায়। একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনার পর post traumatic stress disorder- এ ভুগছিলো সে বহুদিন ধরে। অনেক চেষ্টার পরেও সতের বছরের এই মেয়েটাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে না পেরে আজ সকালেই ওকে এই ট্রমা সেন্টারটায় নিয়ে এসেছিলেন ওর বাবা আতিফুস সালাম।

২০৫ নাম্বার রুমের সামনে যেতেই দরজার গায়ে সাঁটানো মাঝারি আকৃতির নেমপ্লেটটার দিকে চোখ পরে শাহনাজের।

‘ডক্টর অরুন্ধতী রহমান!’- নামটা পরে বুকের রক্ত ছলাত করে ওঠে শাহনাজের। এক ঝটকায় দরজাটা খুলতেই চোখ পড়ে শান্ত, সুন্দর চেহারার মেয়েটির দিকে। শাহনাজকে দেখেই চোখেমুখে একটা মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি কবিতার মত গলায় বলে

–‘শাহনাজ! তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম মামনি! এসো বসো!’

–‘আপনি! আপনি অরু? অরুন্ধতী? আনিসের অরু… আপনি?’

-‘হ্যা, আমিই অরু!’

-‘আর আনিস? সে চলে গেছে তো আপনাকে ছেড়ে, না? আমি জানি সে চলে গেছে,আমাকেও ফেলে চলে গেছে…’

– ‘আরেকজন ডক্টর যিনি তোমার কাউন্সেলিং এর দায়িত্বে আছেন তার নামই আনিস,আনিসুর রহমান!’

অরুন্ধতী যেন আচমকা একটা বোমা ফাটিয়েছে, হতবিহ্বল দৃষ্টিতে শাহনাজ তখন তাকিয়ে আছে অরন্ধতীর দিকে। ডক্টর অরুন্ধতী ততক্ষণে ফোন বের করে কাউকে ডাকছিলেন, খানিক বাদেই সৌম্য চেহারার আরেকজন ডক্টর প্রবেশ করেন ঘরটায়।

–‘কেমন আছ শাহনাজ? আমি ডক্টর আনিস!’

–‘কিন্তু.. আপনি..’

-‘ভাল মেয়ের মত চোখটা মুছে বসো, বলছি সব! সদর হাসপাতালে ছিলাম সেদিন আমি, দ্রুত কাজ গুছিয়ে বাড়ি যেতে যেতে বিকেল হয়ে যায়। বাড়িতে ঢোকার একটু আগেই মিশু আর ঊষার সাথে দেখা হয় আমার, ঊষা হচ্ছে সেই খশরুর বউ মেয়েটা! দু’জনে দৌড়ে যাচ্ছে আমাদের বাড়ির দিকে, আমাকে দেখে হাউমাউ করে কিছু একটা বললো দু’জনে মিলে। কতটা বুঝলাম কতটা বুঝলাম না, কিন্তু কিছু একটা হয়েছে এটুকু বুঝে দৌড় লাগালাম বাড়িতে। ভেতরে ঢুকতেই আমার ঘর থেকে একটা মৃদু গোঙানির আওয়াজ কানে এলো, তারপর একটা কর্কশ পুরুষ গলায় কতগুলো বিশ্রী গালি…

ঘরের দরজাটা লাগানো ছিলো, তবে ভাগ্য ভালো সেটা প্লাস্টিক বোর্ডের দরজা। রান্নাঘর থেকে বড় দা এনে দুটো কোপ দিতেই চুরমুর করে ভেঙে পড়ে।ভেতরে অরু তখন অজ্ঞান, আর খশরু শয়তানটাও সেখানে। দরজা খুলতেই খশরু লাফিয়ে ওঠে, ঊষাকে দেখে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে ওর পেছন দিয়ে বের হবার চেষ্টা করে। মিশু ততক্ষণে দৌড়ে অরুর কাছে গেছে, আমি খশরুকে ধরতে যাই কিন্ত তার আগেই শাড়ির আঁচলের নিচ থেকে রামদা টা বের করে খশরুর ঘাড় বরাবর কোপ বসিয়ে দেয় ঊষা! কোন ফাঁকে মাটিতে পরে থাকা দা টা কুড়িয়ে নিয়েছিলো মেয়েটা…

অরুর জ্ঞান ফেরার আগেই এগুলো হয়ে যায়। ওর প্রেশার লো, তাতে কড়া ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে বুঝতে পেরে সাথে সাথে দ্রুত স্যালাইনের ব্যবস্থা করি।
শয়তানটার লাশ তখনো ঘরের বাইরেই পড়ে ছিলো, ওটাকে ফেলে রেখে আগে অরুর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করি আমি।

খশরুর এত সাহসের পেছনে অবশ্য আলেয়া খাতুন ও ছিলেন। নাম ধরে বললাম কারণ আমি তাকে মা বলে ডাকি না আর এখন! গ্রামে ভাল চিকিৎসার অভাবে আমাকে জন্ম দিতে যেয়ে আমার মা মারা যান, সেজন্য নিজের কষ্ট সহ্য করেও আমি গ্রামেই থেকে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারজন্য অরুকে এতবড় খেসারত দিতে হবে জানলে… সে যাক! পরদিনই আমি অরুকে নিয়ে ঢাকা চলে আসি।

এরপরের ঘটনা আমাদের দু’জনের সংগ্রামের। অরুও তোমার মত হয়ে গেছিলো জানো শাহনাজ? কথা বলতো না ঠিকমত, খেতে চাইতো না, পালিয়ে যেতে চাইত সব ছেড়ে আর নয়ত মরে যেতে চাইতো! দু’টো বছর, পুরো দু-টো বছর আমাদের জীবন থেকে ঝরে গেছে এজন্য! একটু একটু করে আস্তে আস্তে অরুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছিলাম আমরা সবাই মিলে- আমি,মিশু আর নূরজাহান দাদী! আমাদের প্রাণান্তক চেষ্টা শেষে সফল হলো!

সেই অরু কলেজে ভর্তি হলো, ঢাকা বোর্ডের সেরা রেজাল্টটা হাতে নিয়ে দেশের সবচেয়ে নামকরা মেডিকেল কলেজটায়ও চান্স পেলো! আমি নিজেই সেখানে চান্স পাইনি, কিন্তু আমার অরু দেখিয়ে দিলো সবাইকে!

মেডিকেলের এতগুলো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে সেই মেয়েটা প্রথম জায়গাটা কেড়ে নিলো নিজের প্রচণ্ড জেদ আর পরিশ্রম দিয়ে! অথচ ক’বছর আগে এই মেয়েটা আত্নহত্যা পর্যন্ত করতে চাইতো! দিনরাত ওকে চোখে চোখে রাখতাম আমরা তিনজনে মিলে, মিশু তো ওর পরিবার, স্বামী-সন্তান সব নিয়ে আমার পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো তখন! বটগাছের মত ছিলেন দাদী, একচুলের জন্যও অরুকে একলা হতে দিতেন না…সে এক বিষন্ন, বিপর্যস্ত ইতিহাস শাহনাজ! সে তোমার না শুনলেও চলবে, শুধু এটুকু জেনো- সেদিন যদি বিষাদের স্রোতে সেই গ্রামের বউ অরু ভেসে যেতো তবে আজকের এই ডক্টর অরুন্ধতী নামের তারাটা কি এভাবে এত আলো ছড়াতে পারতো? তুমিও কি সেই একই ভুল করবে যেটা অরু সেদিন করতে চেয়েছিলো? যে শয়তানটা তোমার জীবনকে নষ্ট করে দিতে চায় তার সেই ইচ্ছেটা যদি তুমি পূরণ করে দাও তবে তো তারই জিত হলো! তোমার বাবা,মা, ছোট বোনটা- এদের কথাটা ভেবে দেখো একবার… ‘- ডক্টর আনিস কথা বলে চলেন, যেন এই সব কথাগুলি মুখস্থ তার। কিন্তু এই ছোট্ট ঘরটার প্রতিটা ইট জানে মনের কী ভীষণ গহীন থেকে এক-একটা ধ্বনি, এক-একটা শব্দ ভেসে আসছে তার কণ্ঠনালী বেয়ে! এত বছর, এত্তগুলো বছর পেরিয়ে গেছে তবু এখনো সেদিনের ঘটনাগুলো একদম জীবন্ত মনেহয়! মিশুর কাছেই পরে জেনেছে আনিস, আলেয়া খাতুনের সাথে খশরুদের বাড়িতে যাবার পরপরই ঊষা মিশুকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে বলে কিছুক্ষণ আগেই খশরুকে আলেয়া খাতুনের সাথে ফোনে কথা বলতে শুনেছে ও, যতটুকু বুঝেছে সম্ভবত আজই অরুকে নিয়ে গ্রামে বদনাম রটাবে ওরা। ফোনে কথা শেষ করেই খশরু দৌড়ে বেরিয়ে যায়, ঊষা দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলো কী করবে,কাকে জানাবে। এরপর মিশুকে ঢুকতে দেখে দৌড়ে যায়। আলেয়া খাতুনের আচরণে মিশুর এমনিতেই সন্দেহ হচ্ছিলো, ঊষার কথা শুনে ওকে নিয়ে পড়িমরি করে বাড়ির দিকে ছুটে যায় সে। তখনই আনিসের সাথে দেখা হয় আর তারপর…

খুনের দায়ে ঊষাকে যখন পুলিশের গাড়িতে ওঠানো হচ্ছিলো, মিশু তখন সকলের সামনে জোর গলায় বলে ওঠে আলেয়া খাতুন এরচেয়ে বেশি দোষে দোষী। মিশুর সাক্ষ্যেই তাকেও গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে আলেয়া খাতুন নিজের দোষ স্বীকার করে যে সাক্ষ্য দেন তা অনেকটা এরকমঃ

‘খশরুয়ে আমারে কইসে অরুরে নিয়া পলায়া যাইবো, তারপর অরুরে বিয়া করবো! অরুর ব্যাগ গুছায়া রাখতে কইসে, আর অরুরে অষুধের পিঠাটা খাওয়াইতে কইসে। আমি সকালে অরুরে নূরিদাদীর বাড়িত পাঠায়া সব গুছাইসিলাম, হেরপর খশরুয়ে আইলে আমি অরে ভিত্রে লুকায়া রাইখা মিশুরে নিয়া গেসিলামগা… খশরুয়ে এইরকম করব জানলে আমি কুনুদিনি এইসব করতাম না…’

ঊষার সাজা অনেকটা কমে আসে সবার সাক্ষ্যপ্রমাণে।

আনিসের জন্মদাত্রী মায়েরা কেবল দুই বোন ছিলেন, তাদের বাবা ছিলেন আড়তের বড় ব্যবসায়ী। নানার তরফ থেকেই ঢাকার অদূরে বেশ খানিকটা জমিসহ একটা পুরনো বাড়ি পেয়েছিল আনিস। সেটাকেই সংস্কার করে একপাশে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করেছে, আর অন্যপাশে ছোট্ট একটা ট্রমা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর ঊষাকে এখানেই নিয়ে এসেছে আনিস আর অরু। ওদের সাথেই ঊষা কাজ করছে নার্স হিসেবে।

সপ্তাহ দু’য়েকের জন্য এখানেই থেকে যায় শাহনাজ। এরমধ্যেই বেশ অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে সে। সন্ধ্যার কোচিং শেষে বাসে করে বাসায় ফিরছিলো শাহনাজ সেদিন, বাসের ভেতরেই…। সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে খবরটা ছাপা হয়েছিলো, দোষী ড্রাইভার আর হেল্পারকে গ্রেফতার ও করা হয়েছে কিন্তু এই প্রচন্ড যন্ত্রণার মধ্যে বিষের শিশি ঢেলে দিয়ে শাহনাজের চূড়ান্ত ক্ষতিটা করেছে আরেকজন- সুমন্ত! এই ঘটনার পর দু’বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক এক মূহুর্তে ছিন্ন করে মেয়েটাকে একদম খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছিলো, অরুন্ধতি আর আনিসের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় একটু একটু করে ফেরানো গেছে মেয়েটাকে!

-‘নাতিন বোলই খা,বোলই খা! হাতে নিয়া নুন
নাতিন আমাল পইলা গেছে বোলই গাছে থুন!’- ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে আধো আধো গলায় গান গাচ্ছে দু’বছরের বাচ্চা মেয়েটা! পাশে বসে বসে নূরজাহান বেগম লাঠি ঠুকে ঠুকে তাল দিচ্ছেন, মনে মনে ভাবছেন

‘আইজকা অরু আর আনিসে আইলে গেদির গানডা শুইনা চমকায়া যাইব! হুহু, নূরজাহান বেগম যত শোলক আর গান জানে, সবডি এই গেদিরে শিখায়া তবে মরবো!’

তাল পেয়ে বাচ্চাটা ততক্ষণে কোমর দুলিয়ে নাচতে আরম্ভ করে দিয়েছে, প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে নূরজাহান বেগম দেখছেন- ‘আহা! এক্কারে আনিসের মুখটা যেন কাইটা বসায়া দিসে মাইয়াডার চেহারায়!’

সমাপ্ত!

নোটঃ যে আপুদেরকে এক জীবনে অরুন্ধতীর মত বিভীষিকার মুখোমুখি হতে হয়েছে, ‘একজীবন’ গল্পটা তাদের জন্য উৎসর্গিত। নিশ্চয়ই এই কষ্টের পর আল্লাহ আপনাদের জন্য সুখ লিখে রেখেছেন, এক জীবনে না হোক অন্য জীবনে, ইহজনমে না হোক পরজনমে!

শুধু হাল ছাড়বেন না, প্লিজ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here