একজীবন পর্ব ৬

একজীবন
পর্বঃ ৬

এই ঘরটা একেবারে পূর্বমুখী, ভোরের নরম রোদটা মুখে পরতেই ঘুম কেটে গেলো। বেশ ঠান্ডা পরেছিল গতকাল রাতে। খাটের ওপর শুয়েও কাঁথামুড়ি দিয়ে থাকতে হয়েছে। বিছানা থেকে নিচে পা ফেলতেই চোখে পড়লো আনিস হাবুচন্দ্র মেঝতে গুটিশুটি পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে এখনো, শীতে একেবারে কুঁকড়ে গেছে বেচারা! এ ঘরে একটা কাঁথা, সারারাত আমি যেটা গায়ে জড়িয়ে আরামে ঘুমিয়েছি। ওদিকে ক্যাবলা আনিসটা মেঝেতে পাতা বিছানার চাদরের ই এক মাথা দিয়ে কোনোমতে গায়ে মুড়ি দিয়েছে! বুকের ভেতরটা মুহূর্তেই মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। এত নির্বিবাদী, এত গোবেচারাও মানুষ হয়? আমি নাহয় কাথামুড়িয়ে ঘুমিয়েই ছিলাম সারারাত, সে নিজে তো অন্তত খাটের এক কোণায় এসে শুতে পারতো!

তাড়াতাড়ি কাঁথাটা নিয়ে তার গায়ে চাপা দিই, ভালো কর চারদিক ঢেকে মুড়িয়ে দিয়ে উঠতে যাব ঠিক তখনি নাড়াচাড়ায় তার হাতের একাংশ আমার হাতে এসে পরে। ইশ! জ্বরে সারা শরীর পুড়ছে! খোদা!- কার অপরাধের শাস্তি তুমি কাকে দিচ্ছো! দৌড়ে যেয়ে গামছা ভিজালাম, মাথায় জলপট্টি দিয়ে অন্তত তাপ তো কমানো যাক- ঘুম ভাঙ্গলে নাহয় ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করা যাবেখন!

মাথায় ঠান্ডা গামছাটা ছোঁয়াতেই বাঁশপাতার মত তিরতির করে উঠলো তার চোখের পাতাজোড়া, খানিক বাদেই পিটপিট করে চোখ মেললেন!

-‘কী করছো? আমি ঠিক আছি… উঠবো এখন, সরো!’

-‘গলা দিয়ে তো স্বরটাও বেরোচ্ছেনা ঠিকমত, ব্যাঙের মত শোনা যাচ্ছে! এই জ্বর গায়ে নিয়ে পণ্ডিতি শুরু না করলে হয়না? যেমন ঘুমিয়ে ছিলেন তেমন ঘুমিয়ে থাকেন, বেশি ফটফট করলে ভালো হবেনা বললাম!’

ক্যাবলাটা তার ঐতিহাসিক ফিচলে হাসিটা ঝুলালো ঠোঁটে, আমি নিশ্চিত এখন একটা না একটা হাবিজাবি আলাপ শুরু করবে সে!

-‘দিচ্ছো তো ঐ শুধু কপালটুকু মুছিয়ে! জ্বরে যেখানটায় পুড়ে যাচ্ছে সেখানে যখন হাতটাও ছোঁয়াবেনা তখন আর অযথা খাটাখাটনি কেনো?’

-‘বয়স তো কম হয়নাই, এখনো বদমাইশি কমেনা আপনার, না? একটা না একটা বদমাইশি আলাপ না করলে হয়না না? কীকী ঔষধ দিতে হবে বলে দেন… আমি খুঁজে নিয়ে আসি!’

-‘আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে….’

আমি জানিনা সেসময় ঠিক কী হলো আমার, কোন দুঃখের ভূত উড়ে এসে বসলো আমার বুকের ভেতর, আমি ঝরঝর করে কেঁদে ভাসিয়ে দিলাম সব! জ্বরতপ্ত কপালটার ওপর একরাশ শ্রাবণধারার মতো ঝরে যাওয়া ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রুজলের আভাসে বোধহয় সম্বিত ফিরলো উনার, চমকে উঠে বসলেন লাফ দিয়ে। বামহাতে চোখজোড়া আড়াল করে দৌড় লাগাতে যাব, খপ করে আমার ডানহাতটা চেপে ধরলেন উনি!

-‘এই বোকা মেয়ে! কান্নার কী হয়েছে? এটাতো নির্মলেন্দুর কবিতা আমি এমনিতেই শুধু বললাম, সত্যি সত্যি কী…’

-‘না সত্যি সত্যিই! আমার জন্যই জ্বর হয়েছে আপনার! আমার জন্য মেঝেতে…’

-‘আগে কান্না থামাও মেয়ে! পরে বলো যা বলার, যা খুশি! তুমি তো এক কোণায় যেয়ে শুতে, আমি চাইলেই খাটের অন্য কোণাটা ব্যবহার করতে পারতাম,ইচ্ছে করেই করিনি! এতে তোমার দোষ কই? বললাম তো ভুল হয়েছে,আর বলবনা কবিতা যাও!’

-‘কেন যাননি তবে আপনি?’

-‘কোথায় যাইনি?’

-‘উপরে… খাটে, ঘুমাতে!’

-‘কারোওওণ, খাটের উপরে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি থাকে যে!
বালিকা, তোমার আধফুট দূরত্বে থেকে ঘুমটা অন্তত আসবে না আমার, আর যা-ই আসুক!’

-‘আপনি একটা অসভ্য! মানুষ জ্বর হলে চুপচাপ পরে থাকে আর আপনি যা খুশি তাই বলে যাচ্ছেন কখন থেকে!’

-‘এইসব জ্বর ঠান্ডা দেখতে দেখতে চোখ পচে গেছে বুঝলে? রোগবালাই এখন আর কোনোরকম লাগেনা, দুই-তিনদিনে আপনা আপনিই ছেড়ে যাবে! White blood cell গুলিকে একটু সময় দাও, ওরা তো আছেই ফাইট করার জন্য! আর…’

-‘আর?’

-‘আর, শুকরিয়া করো যে যা খুশি তাই ‘বলে’ যাচ্ছি কেবল, যা খুশি তাই করে গেলে কিন্তু বিপদে…’

-‘ধুর! আপনার কাছে আসাটাই ভুল হয়ে গেছে আমার! হাতটা ছেড়ে দিন, আমি উঠবো… কাজ আছে আমার!’

-‘সন্ধিচুক্তি যখন করেইছি তখন হাত তো ছাড়তেই হবে ম্যাডাম! কিন্তু একবার যুদ্ধ ঘোষণা হলে পরে হাজার অনুরোধেও ছাড়বানা বলে দিলাম’- আলতো করে একবার চাপ দিয়ে হাতটা ছেড়ে দিলেন উনি, এত গরম তার হাতটা! জ্বর যেন চূড়ান্তে উঠেছে!

-‘গায়ে পানি ঢেলে নাস্তা করবেন আসুন, আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে!’- বলে উঠে পরলাম আমি। রাতে ভিজিয়ে রাখা পিঠাগুলো খাটের নিচ থেকে বের করে টেবিলে নিয়ে রাখলাম। ভালমতই জানি এগুলো নিয়ে হুলুস্থূল হবে আজ, কিন্তু এই ক’বছরে এটা বুঝে গেছি যতদিন নরম হয়ে সহ্য করে যাবো ততই এদের অন্যায় আচরণ বেড়ে যাবে। তাই ঠিক করেছি এখন থেকে সম্মুখ সমরের পথই বেছে নেবো!

-‘আনিসের মায়ে ক্যাটক্যাট করলেও হের মনডা ভালা বুঝছো বউমা! কাইলকা না না কইলেও ঠিকি আমার জন্য দুধচিতই পিঠা বানায়া রাখসে’- খেতে বসে সহাস্যে বললেন শ্বশুরমশাই। ওদিকে আলেয়া খাতুনের চোখমুখ পুরো মরিচ-লাল হয়ে আছে। আচমকা এমন অযাচিত প্রশংসা পাবার পরে মুখ ফুটে বলতেও পারছেন না যে এগুলো উনি বানাননি আবার না বলেও থাকা যাচ্ছেনা! খেলা পুরো জমে গেছে, আমিও স্রোতের দিকেই নৌকো ভাসালাম!

-‘হ্যাঁ বাবা! মা-ই তো বসে বসে এসব বানালেন আবার আমাকে বললেন চুপচাপ লুকিয়ে ভিজিয়ে রাখতে, সকালে বের করতে! সত্যিই, বেশ মজা হলো না বলেন?’

-‘হ, হ! আমি ত এক্কারে বেক্কল হইয়া গেসি দেইখা…’

-‘চুপচাপ খাইয়া উডেন, এত রসের কিছু হয়নাই এইখানে!’- আলেয়া খাতুনের ধমকে শ্বশুরের হাসি মিইয়ে আসে। তবে সবদিক দিয়ে এই বেশ ভালো হলো, পিঠাগুলো সবার অগোচরে আমি বানিয়েছি জানিয়ে অশান্তি তৈরি করার চেয়ে এটাই বরং সুন্দর সমাধান হলো…কিন্তু আমার পোড়ামন! এও মনে চায় যে উনি অন্তত জানুন যে এগুলো আমার হাতের বানানো… উনার ছোটমাকে লুকিয়ে বহু কষ্টে শুধু উনার প্রিয় বলে এগুলো বানিয়েছে একজন- আহা এই সত্যিটুকু যদি কেউ অন্তত তাকে জানিয়ে দিতো!

আলেয়া খাতুন সম্ভবত খেপেছেন, সকাল থেকেই আছড়া আছড়ি করে কাজ করে গেলেন, সাজুখালাকে অযথাই দু’কথা শুনিয়ে দিলেন। যার ওপর চটেছেন সেই আমাকে কিছু বলতে পারছেন না বলে কেবল গুমরে গুমরে ফুলছিলেন, টের পেলেও চুপচাপ থেকেছি আমি। হুহ, যেমন কুকুর তেমনি মুগুর হওয়া চাই, না হয়তো আনিস হাবাচন্দ্রটাকে আজীবন কলুর বলদ হয়েই থাকতে হবে! সেই যে বাড়ি থেকে কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়েছিলাম, সেখানে হাত ই দেয়া হয়নি এখনোও! আমার সব খরচাপাতি তো উনি করেই যাচ্ছেন…আজ সেখান থেকে কিছু টাকা বের করে সাজুখালাকে দিয়ে কবুতরের বাচ্চা কিনিয়ে আনালাম। জ্বরমুখে হালকা স্যুপ হয়ত ভাললাগবে, বেকুবটা তো জ্বর গায়েও দিব্যি টিনের ঘরে রোগী দেখতে বসে গেছে, এদিকে চিন্তার যন্ত্রণায় আমার মরণের দশা!

আলেয়া খাতুন বারকয়েক এদিকে ঘুরে গেছেন, বোঝার চেষ্টা করছেন আমি কী করছি! অথচ সকালের ঘটনার পর নিজে সেধে কথাটিও বলতে পারছেন না তাই জিজ্ঞেসও করতে পারছেন না আমায় কিছু! সেজন্যই বোধহয় কিছুক্ষণ পর রুপাকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়ে দিলেন-

-‘কি করো অরু? কইতরের বাইচ্চা না এইডা?’- আমার হাতে ধরা কবুতরটার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে রুপা।

-‘হ্যা ভাবী! উনার রাত্রে থিকা জ্বর আসছে, তাই ভাবলাম স্যুপ করে দেই।’

-‘স্যুপ জিনিসটার নাম শুনছি অনেক কিন্তু বানাইতে পারিনা। আমারে শিখায়া দেন না একটু! ’

রুপা মেয়েটা বেশ সরল সোজা, অত সাতে পাঁচে নেই! দিব্যি পাশে বসে বসে স্যুপ বানানো শিখতে লাগলো। খানিক বাদে নিজের মনেই বলে উঠলো-

‘আনিস ভাইএর জন্যি মায়া লাগে বুঝলা অরু। আহা জন্মের সময় বেচারা মায়েরে হারাইসিলো, তারপর এতগুলা দিন ত কেউই আছিল না নিজের কইতে! মিশুয়ে দাদাভাই কইয়া অজ্ঞান আছিল, হইলে কী হইব আম্মার জন্যি কিছু করতে পারত না! আল্লায় বোধহয় তুমারে আর আনিসবাই রে মিলায়া দিসে…’

-‘বিষ, বিষ! বিষের গাছ ঢুকসে আমার সংসারে! অখন আমার পোলার বউডারেও বিষাইতাসে!’- আচমকা একটা চিৎকারে থমকে গেল রুপা। ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম আলেয়া খাতুন রণমূর্তি ধারণ করেছেন।

-‘শহরের বেদ্দপ মাইয়া, নিজের মায়েরে খাইসে অখন আমার সংসারে নজর পরসে! এতবছর যেন আনিসের চলেনাই, এতবছর যেন হেয় না খায়া না পইরা থাকসে! দুইদিনের বৈরাগী, ভাতেরে কয় অন্ন! আনিসেরে বশ করছে অখন রুপার কানেও বিষমন্তর ঢালতাসে- আসুক আইজকা অগো বাপে বাড়িতে এর একটা বিহিত যদি না করসি…’

-‘আপনে খামোখাই এমন করতেসেন! আমি রুপারে কিছুই বলিনাই! আর রুপাও এমন কিছু বলেনাই যেটা কেউ জানেনা, সবারই চোখ-কান আছে…’

আমার কথা শেষ না হতেই কেউটের মত ফোঁসফোঁস করে উঠলেন আলেয়া খাতুন-

‘কী কইলা তুমি? হাডুর বয়সী মাইয়া তুমি আমারে চোখ-কান দেখাও? তা ত করবাই, নিজে ত মা-খাগি আর জুটায়া নিসো আরেকজনেরে। অপয়া পুলা, জন্মাইয়াই আমার বইনডারে খাইলো, আমার জুয়ান বইনডা না মইরা এই অপয়া পোলাডা মরলেও তো পরাণডা জুড়াইতো…আমার সংসারে আগুন লাগাইলে অভিশাপেই ঐ পোলার মরণ হইব কইয়া দি…’

-‘ছিহ! এই আপনে উনার মা? পেটে না ধরেন, যারে পাইলা-পুইষা বড় করলেন তারে নিয়ে এইগুলা বলতে একবার বাঁধলো না আপনের? অনেক্ষণ ধইরা আপনে যা খুশি বলতেসেন আমারে, আমি জবাব দিইনাই। তারমানে এইটা না যে আপনে উনারে নিয়াও যা মুখে আসে বলবেন! পেটের ছেলে আপনেরও আছে, আর অভিশাপ আমিও দিতে পারি- এইটা মাথায় রাইখা এরপরে থেকে কথা বলবেন।’ – সম্ভবত এই কথাগুলিই তখন বলেছিলাম আমি, টের পাচ্ছিলাম দুই চোখ বেয়ে ঢল নেমেছে ততক্ষণে। পরে অবশ্য শুনেছিলাম, আমার কথাগুলি নাকি চাবুকের মত আছড়ে আছড়ে পড়েছিল সেদিন। কার থেকে শুনেছিলাম? কার থেকে আবার! ক্যাবলাকান্ত যে ঠিক তখনই মিশুকে সাথে নিয়ে হেলেদুলে বাড়ি ফিরছিলেন!

মিশু বেড়াতে এসেছে এ বাড়িতে, বেছে বেছে আজ এই সময়েই বেচারিকে আসতে হলো! আমি তখন সাপের মত ফুঁসছিলাম, আলেয়া খাতুন যদি সমবয়সী হতেন তো হয়ত মারামারিই লেগে যেতো ততক্ষণে! রাগে গা হাত-পা কাঁপছিলো আমার, মিশু দৌড়ে এসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বসায় আমাকে। আর যে এলে রাগ গলে জল হতো, সেই হাবাগংগারাম তখন দেবদারুর মত ঠায় দাঁড়িয়ে উঠোনে!

-‘অরু বসো এইখানে! চিল্লায়া লাভ নাই, উলটা নিজেই খারাপ হইবা। মায়েরে আমি চিনি, হের লগে পারতে হইলে যত নিচে নামন লাগব অত নামতে তুমি পারবানা বইন! মাথা ঠান্ডা করো, যা করতাসিলা হেইডা শেষ করো। আমি দাদাভাইরে নিয়া ঘরে যাইতাসি…’

রুপা ওদিকে ফ্যাচফ্যাচ করে কাদছে। মিশুই ওকে আর আনিসকে টেনে ঘরে নিয়ে গেলো। আলেয়া খাতুনকেও শাসিয়ে গেলো-

‘আমি য্যান আর একটা কথাও না শুনি আম্মা! ঘরে চলেন!’

সকালটা খারাপ গেলেও বিকালটা অনেকদিন পর বেশ ভালো কাটলো আজ! ডাক্তার সাহেবকে জোর করে ধরেবেঁধে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে, মিশুই উদ্যোক্তা আমি কেবল সরব সমর্থক ছিলাম এই কাজে! ঝাল ঝাল মুড়িমাখা দিয়ে বিকেলে জমিয়ে আড্ডা দেয়া গেছে মিশু আর রুপাকে সাথে নিয়ে, চারজনে মিলে। কিন্তু রাত হতেই ক্যাবলাটা সেই পুরানো ক্যাবলামি করে মেজাজটা খিঁচড়ে দিলো একদম! শুতে যাবার সময় সেই চাবি দেয়া কলের পুতুলের মত চাদর পেতে মেঝেতে বিছানা করা শুরু করে দিলো। আমিও কম যাই না, খাট থেকে এক ঝটকায় নিজের বালিশটা নিচে ফেলে দিলাম!

-‘এটা কেমন হলো? বালিশ ফেললে যে?’

-‘এতা তেমুন হলু? বালিত ফেল্লে দে?’- চোখ মুখ কুচকে ভেংচি কাটলাম আমি।

-‘উত্তর দেবেনা? আমায় রিপিট করবে?’

-‘উত্তুল দেবেনা? আমার লিপিত কব্বে?’

-‘আচ্ছা! বেশ! অরু না না, অরুন্ধতি আনিসকে ভালবাসে… এবার বলো?’

লোকটা তো আচ্ছা বদ!

-‘সরুন,আমি মেঝেতে শোব! আপনি উপরে যান!’

হোহো করে হেসে সে বললো
-‘জানতাম পারবেনা বলতে! বলতে পারলে যাব উপরে, নয়ত যাবনা!’

-‘বয়েই গেছে আমার বলতে! আমি মেঝেতেই শোব, সে আপনি খাটে যান, না যান…’

-‘ও বাবা! আমি খাটে না গেলেও মেঝেতেই শোবে আমার সাথে? এত সাহস থাকবে তো বাকি রাত?’

-‘অসভ্য আলাপে আমার সময় নেই!’- বলে ঘাড় ঘুরিয়ে মেঝের এক কোণায় শুয়ে পরলাম। মন জানে, গোটা রাতটাই আমি ঐ মুখের দিকে চেয়ে কাটিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু মনের কথা যদি মুখেই বলে দিই তবে আর নারীর আজন্ম অপবাদ- ছলনার ষোলকলা পূর্ণ হবে কেমন করে?

-‘আমার জন্য এতটা না করলেও পারো তো, অরু! শুধু শুধু ছোটমার সাথে লেগে গেল তোমার,মিশুটাও এরকম করতো আগে, এখন তুমি!’ – মুহূর্তেই তার গলাটা কেমন বিষাদমাখা শোনালো। বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো আমার।

-‘কিছুই করিনি আমি আপনার জন্য…’

-‘সে আমি জানি! সবাই না জানলেও আমি জানি সেদিন সবার চোখের অলক্ষ্যে ঐ পিঠাগুলো তুমিই বানিয়েছিলে! আর আজ তো নিজেই দেখলাম…’

ও খোদা! এ তো তলে তলে তালতলায় যাওয়া ছেলে, আর আমি নাকি একে হাবাগোবা ভেবে বসে আছি! এও ধরে ফেলেছে যে সেদিনের সেই কাজ আমার করা!

-‘কে বলেছে আপনাকে আমি ঐ পিঠা বানিয়েছি? বয়েই গেছে আমার আপনার জন্য বেগার খাটনিতে! কে হন আপনি আমার….’

অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়েই বানিয়ে-ছানিয়ে মিছে কথাগুলো অনর্গল বকে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই একটা প্রবল দস্যুর আক্রমণে মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো আমার! এক ঝটকায় আমাকে পাশ ফিরিয়ে নিজের দুই হাত আমার দুইদিকে চওড়া করে দিয়ে একটা দুর্ভেদ্য দুর্গের ভেতর আমাকে বন্দি করে নিলো দস্যুটা। মৃদু উত্তপ্ত দুই হাত শেকলের মত চেপে ধরলো আমার দুই হাতের তালু, তারপর যেন দখলদারের দাবি নিয়ে প্রশ্ন করলো-

‘কেনো মিছে কথা বলছো অরু? আমি তোমার কী হই সে তুমি আমার চে ভালো জানো, জানোনা?’

এ প্রশ্নের কি উত্তর হয়? আর হলেও বা সে ছাই আমার পোড়া মগজে এলে তো! প্রচণ্ড একটা বিবশ অনুভূতি আমার পুরো অস্তিত্বকে ততক্ষণে গ্রাস করে ফেলেছে!

-‘আমি জানি অরু, আমি জানি তুমি কী চাও! অধিকারের জোর দাবি নিয়ে তোমার সমগ্র সত্তা একান্ত আমার করে নেবার জন্য ছটফট কি আমিও কম করছি অরু? শীতে কেঁপে মরেছি তবু তোমার উষ্ণতার ভাগ চাইতে যাইনি,কেন জানো? যে আগুন অহর্নিশ তোমার বুকের ভেতর জ্বলছে, সে আগুনে সবার আগে আমিই যে ঝাঁপ দিয়েছি অরু! তোমার উষ্ণতার ভাগ চাইতে গেলে সেই আগুনে যে তুমি জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যেতে, সে আমি জানি বলেই যাইনি! মাত্র পনের বছর বয়স তোমার, সভ্যতা বলো আইন বলো সবই আমাদের দু’জনের মাঝে বাঁধা…’

-‘ষোলো! গতকাল আমার জন্মদিন ছিলো…’

-‘কীহ! এই কথা এতক্ষণে বলার সময় হলো মহারাণীর? আগে বলোনি কেন?’

-‘কী হতো বললে? মা চলে যাবার পর আমার জন্মদিন কেউ করেনা আর…কারো কিছু যায় আসেনা আর…’

-‘আমার যায় আসে, অরু!’- ডাকাতটার দুই হাতে যেন অসুরের জোর ভর করেছে, রীতিমত পিষে ফেলছে আমার কব্জি জোড়া!

-‘উফ! লাগছে হাতে!’

-‘লাগুক, এটা আমায় না জানানোর শাস্তি।’- মুখে একথা বললেও হাতের জোর কমিয়ে এনেছে গণ্ডারটা! ভেবেছিলাম হয়ত ছেড়ে দেবে এবার, কিন্তু এযে আসন্ন ঝড়ের আগ-মুহুর্তের নিস্তব্ধতা তা কে জানতো?

আচমকা একজোড়া উত্তপ্ত ঠোঁটের সবল আক্রমণ যেন পুড়িয়ে দিয়ে গেলো আমার চোখ,নাক, গাল…সমস্ত মুখটা! আর শেষে ঠোঁটজোড়াও…

-‘আর এটা উপহার! জন্মদিনের!’

আমার সমস্ত ছেলেমানুষি রাগ, জেদ যেন এক লহমায় কেউ ধুয়ে মুছে দিলো, একটা বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব এসে আমার ভেতর-বাহির সব কেমন লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেলো! তিরতির করে কাপছিলো আমার পুরো শরীর,বুকের ভেতরে যেন যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছিল কেউ! আমার সম্পূর্ণ সমর্পণ বোধহয় সম্বিত ফেরালো তার, হঠাৎই আমায় মুক্ত করে দিয়ে বললো-

-জেদ করোনা আর, যাও খাটে শুয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পরো এখন, আর জেগো না!’

দখলদার দস্যুর হাত থেকে নিষ্কৃতির বদলে তার বন্দিত্বের আরাধনায় ছটফট করে- এমন পোড়ারমুখো মন জগতে আর কারো আছে?

বন্দিত্বের নীরব দাবি নিয়ে অনড় সেখানেই পড়ে রইলাম, শেষমেশ আমারই জিত হলো। দস্যুরাও হার মানে তবে!

একরাশ ভাললাগায় পরদিন সকালটা ঘুম ভাঙালো আমার। নিজের মানুষটার ঘুমন্ত অবচেতন আলিঙ্গনও বুঝি এতো মধুর হয়? জ্বরটাও একদম নেমে গেছে তার!

-‘একজীবনে এত সুখ কপালে রেখেছিলে বলেই কি আগে আগে দুঃখের ভাড় পূর্ণ করে নিয়েছিলে খোদা?’- মনে মনে হাজার শোকর জানিয়ে প্রশ্ন করলাম অন্তরীক্ষে।

-‘দুঃখের ভাড় এখনো ভরেনি, কানায় কানায় ভরলে তবে সুখের দেখা পাবি!’- হয়ত এই উত্তরটাই ভাগ্য দিয়েছিলো সেদিন,আমি শুনতে পাইনি! বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহে এক পশলা বৃষ্টির সন্ধান পেয়ে ভুলেই গেছিলাম- কালবৈশাখী এখনো আসেনি…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here