একজোড়া পায়রা পর্ব -০৯

#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট৯

কালোর প্রতি আমার আলাদা দুর্বলতা আছে।ক্লাসে আসার সময় হঠাৎই পাশে করে রাখা সাড়ি সাড়ি হাজারো লাল গোলাপের মাঝে আমার চোখ কালো গোলাপে আটকে যায়।বড্ড ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করলো কালো গোলাপটাকে।সাধ্যের মধ্যে থাকা কোনো ইচ্ছে অপুর্ণ রাখি না।তাই যাই কালো গোলাপের কাছে।আমায় দূর থেকে দেখে শুভ্র আসেন।আমি দেখেও না দেখার ভান করে গোলাপটাতে আলতো করে হাত বুলাতে লাগি।হঠাৎই ঘড়ির কাঁটায় চোখ যায়।আর মাত্র পাঁচ মিনিট আছে ক্লাস শুরুর।দৌড় লাগাই ক্লাসের দিকে।হঠাৎ করেই খেয়াল করি কে যেন আমার ওড়নাটা ধরে রেখেছে।শুভ্র ছাড়া তো কাছে কেউ নেই।উনিই ধরেছেন হয়তো ওড়না।আমি কাঁধে ওড়নায় হাত দিয়ে শান্ত গলায় বলি,,,

-ওড়না ছাড়ুন আমার ক্লাস আছে।
-ওড়না ছাড়ুন মানে?বুঝলাম না মেঘ!
-বুঝাচ্ছি মানে।

পেছন ঘুরে গালে বসিয়ে দিই এক চড়।উনি থতমত খেয়ে যান।গালে হাত দিয়ে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন।আমি ক্লাসের দিকে পা বাড়াতেই আবার খেয়াল করি ওড়নার আগের অবস্থায়ই আছে।পেছন ঘুরে দেখি গোলাপ গাছের কাঁটার সাথে ওড়না আটকে আছে।প্রেজটিজের ফালুদা!ভাবলাম সিরিয়াল সিনামা সিরিয়ালের মতো শুভ্র আমার ওড়না ধরেছেন।তাই একটু ভাব ধরতে লোকটাকে চড় মারলাম।কিন্তু ভাব ধরতে গিয়ে নিজেই লজ্জায় পরলাম।তাকিয়ে দেখি উনি আমার দিকে একরাশ বিরক্তি আর ক্ষোপ নিয়ে তাকিয়ে আছেন।এখনই মনে হয় আমায় খেয়ে ফেলবেন!আমি উনার দিকে তাকিয়ে ভয় চাপা হাসি দিই।

-সরি ভাইয়া!ভুলে থাপ্পড় লেগে গেছে।

উনি কিছু বলেন না।সেই আগের চাহনি নিয়েই উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি দাঁত বের করে হাসি দিয়ে ক্লাসের দিকে রওনা দিই।
ক্লাসে গিয়ে পড়ি আরেক বিপদে।দশ মিনিট লেট হওয়ার জন্য পাঁচ মিনিট আমাকে ক্লাসের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়!আমি প্রায় কেঁদেই দিয়েছিলাম।আমার চোখে পানি দেখে স্যার আরও দু চারটে কথা শুনিয়ে ক্লাসে ঢোকার অনুমতি দেন।ক্লাসে ঢুকে গিয়ে ফুলের পাশে বসি।আমার চোখে তখনও পানি জ্বল জ্বল করছে।ফুল আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,,,

-তুই জানিস না আজকে নতুন স্যারের ক্লাস?আর উনি খুব কড়া!তোকে আজকেই লেট করতে হলো?
-কি করবো বল?ভাব….

থেমে যাই আমি।মন সায় দিচ্ছে না ঘটনাটার কথা ফুলকে জানাতে।ফুল আমায় ধাক্কা দিলে আমার ধ্যান ভাঙে।

-থেমে গেলি যে?বল!
-মানে এশার সাথে ভাব ধরতে গিয়ে লেট হয়ে গেছে!
-কিসের ভাব?
-বুঝবি না।
-বুঝালেই বুঝবো!
-ক্লাস কর।না হলে নতুন স্যার রাজ্যের কথা শুনাবে।


আজ একটু তাড়াতাড়িই শিশিরকে পড়াতে যাই।মনে মনে ওপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করি যাতে শুভ্রের সাথে দেখা হয়।ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটা যেন অন্তত পাই।কিন্তু পাই নি তার দেখা।খুব বিরক্তি নিয়ে শিশিরকে পড়াতে লাগলাম।কোনো কাজেই মন বসছে না।ছাড়া পেলে বাঁচি।কোনো রকমে টিউশন করিয়ে হলের দিকে রওনা দিই।রাস্তায় শুভ্রর সাথে দেখা হয়।

-হ্যালো মিস্টার!

আমার ডাকে সে পিছন ফিরে তাকায়।শান্ত গলায় বলেন,,,

-কিছু বলবেন?
-আপনি আমার ওপর রাগ করে আছেন তাই না?
-রাগ করবো কেন?
-ঐযে অকারণে চড় দিলাম।

আমার কথা শুনে উনি অট্টহাসিতে হেসে উঠেন। আমি তার এই হাসির মানে খুঁজে পাই না।

-হাসছেন যে?
-এমনি।শিশিরকে পড়ায় আসলা?
-জ্বী।
-চলো তোমায় হলে ছেড়ে আসি।
-না,না ঠিক আছে।দুপুরে নিশ্চয়ই খান নি।চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন।
-না,না ঠিক নাই।তোমার সাথে আমার কিছু কথাও আছে।আর একদিন না খেলে মানুষ মরে যায় না।
-দুর্বল হয়ে যায়।আর আপনি বিভিন্ন কাজ করেন।দুর্বল হলে চলবে না।
-বকবক না করে বাইকে ওঠো।

আমি আর কোনো কথা বলি না।উনার কথা মতো বাইকে উঠি।লোকাল বাসে যাওয়স্র চেয়ে উনার বাইকে যাওয়া অনেক ভালো।একদিকে যেমন টাকা বেঁচে যায় অন্যদিকে তেমন আমিও বেঁচে যাই।বড্ড আনইজি লাগে লোকাল বাসে।কখন কে না জানি কোন ক্ষতি করে দেয়।একটি জরিপে বলা হয়েছে বাংলাদেশে প্রায় ৯৪ভাগ নারী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হয়!জানোয়ারে ভরে গেছে আমার সোনার বাংলা।মনে আছে?গত বছরের কথা?ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে পুরো দেশ বিক্ষোভে ফেটে উঠেছিলো।আর পাঁচটা ইস্যুর মতো আমরা এই ইস্যু টাকেও ভুলে গেছি!সেই আগের মতোই নারী শিশু নির্যাতিত হচ্ছে।শুধু নেই গতবছরের মতো প্রতিবাদ,ব্যানার,ফেস্টুন,স্লোগান।আরবার,সাগর-রুনি,তনু,নুসরাত আরও অনেককে আমরা ভুলে গেছি।ভুলে গেছি এদের ওপর হওয়া অবিচারের কথা।সাধে কি বলে হুজুগে বাঙালি?স্বার্থপরের মতো আমরা নিজেকে নিয়ে বাঁচি।হঠাৎ করে একদিন দেখবেন কোনো এক ইস্যু নিয়ে আবার দেশ বিক্ষোভে ফেটে উঠেছে।তারপর হুট করেই সে ইস্যু নতুন ইস্যুর আড়ালে ধামাচাপা পরে যাবে।এটাই আমার সোনার বাংলা।বিচারহীনতা অনিয়মের সোনার বাংলা!

উনি মনে হয় ইচ্ছে করেই বাইক আস্তে চালাচ্ছেন।আমি নির্দিষ্ট একটা দুরত্ব বজায় রেখে উনার পেছনে বসে আছি।শান্ত গলায় বলি,,,

-ক্ষমা করেছেন আমায় ঐ কাজের জন্য?
-মাইন্ডই করি নাই আর ক্ষমা!
-কথা আছে বলছিলেন!
-হুম আছেই তো!
-বলেন না কেন তাহলে?
-এমনি!

ধুর ছাতা!এই লোকটা আবার দেবের মতো লাগালো নাকি।শুধু শুধু এমনি এমনি করছে।বলে রাখি দেব আমার প্রাক্তন ক্রাশ।এখন একে দেখলে মন বলে জুতা মারি নিজেকে! কী দেখে এই বুড়োর ওপর ক্রাশ খেতে গিয়েছিলাম আল্লাহই জানেন।এই লোকটার ওপরও তো আমার ছোটখাটো ক্রাশ আছে।বিশেষ করে চোখ আর পার্সোনালিটির ওপর।ছেলেরা মেয়েদের রূপের প্রেমে পড়ে।আর মেয়েরা ছেলেদের ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ে।কোনো ছেলে যদি কোনো মেয়েকে ইমপ্রেস করতে যায় তাহলে আমি ছেলেটাকে বলবো পার্সোনালিটি ভালো করতে।তাহলেই একটা মেয়ে শেষ!আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমিও এই লোকটার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছি।কিন্তু কাওকে জানতে দেবো না।থাক না আমার ভালোবাসাটা গোপন।ইবাদত আর ভালোবাসা আমার কাছে গোপনই শ্রেয়।প্রকাশ্য তা শুধুই লোক দেখানো।

-আচ্ছা আপনি কাওকে মুখ দেখান না কেন?
-বেডলাক আই মিন কুফা আমি।মুখ দেখলেই বিপদ।

লোকটার ত্যাড়া উত্তর শুনে মুহুর্তেই আমার মেজাজ বিগড়ে যায়।ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিই লোকটার পিঠে।

-আসছে সবজান্তা।আপনি মোটেও কুফা না।আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনাকে দুনিয়ার পাঠিয়েছেন কারও না কারও ভালোর জন্য।এমন বাজে উত্তর দিয়ে নিজেকে মানুষের কাছে খারাপ আর ছোট করবেন না।

উনি মুচকী হাসেন।

-আচ্ছা তুমি কি কাওকে ভালোবাসো বা পছন্দ করো?

প্রশ্ন ছুড়ে মারেন আমার দিকে।আমি তাজ্জব হয়ে যাই।হঠাৎ লোকটা এমন প্রশ্ন করলো যে!কিছু বুঝতে পারেনি তো আবার?কাঁপা কন্ঠে বলি,,,

-জ্বী, একজন আছেন।
-তাই আমায় পাত্তা দিচ্ছো না তাই না?

তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলেন আমায়।আমি উনার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,,

-জোর করবেন না আমায়?ভালোবাসা পাবার জন্য?
-জোর করে অনেক কিছুই করা যায় কিন্তু ভালোবাসা যায় না।তবে আমার বিশ্বাস একদিন না একদিন তুমি আমায় ভালোবাসবেই।আর সেই একদিনেরই অপেক্ষা করছি আমি।
-ধৈর্য্যে কুলোবে?
-ইনশাআল্লাহ কুলোবে।

যেখানে হলে পৌঁছতে আমার মিনিট পনেরোর মতো সময় লাগে সেখানে আধঘন্টায় আমি হলে পৌঁছাই।বাইক থেকে নেমে আমি হলে যাচ্ছিলাম।উনি পেছন থেকে ডাক দিন।আমি ফিরে তাকাই পিছনে। উনি সংকুচিত কন্ঠে বলেন,,,

-ছয় ছয়টা মাস পেরিয়ে গেলো কিন্তু আমি উত্তর পাই নি!
-কিসের উত্তর?
-ঐযে তুমি আমায় ভালোবাসো কি না!বা এই ছয়টা মাসে কি আমার জন্য কোনো অনুভূতি জন্মিয়েছে কি না!
-কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।
-পজিটিভ?

আমি মুচকী হাসি।

রাত্রে দেখি উনি আবার সেই একই বিষয় নিয়ে মেসেজ দিয়েছেন।আমি বার বার বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও উনি ঘুরেফিরে সেই একই টপিক আনেন।শেষে দেখি উনি আমায় এফবিতে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসের রিকুয়েস্ট দিয়েছেন।আমি একসেপ্ট করি।

“In a relationship with Nowrin Ahmed Megh”

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here