একজোড়া পায়রা পর্ব -২৬ ও শেষ পর্ব

#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট২৬

এইমাত্র ঢাকা এসে পৌছালাম। ছয় মাসের মতো সিলেটে ছিলাম।একটানা এতদিন বাসায় বসে থাকতে থাকতে মন মেজাজ পুরো বিগড়ে গিয়েছিলো।অহনাও ভাইয়ার ফোন রিসিভ করছে না।এই নিয়ে ভাইয়ারও মন মেজাজ ভালো নেই।ভেবেছিলাম সবাই আসায় একটু সবাইকে নিয়ে ঘুরবো।কিন্তু তা আর তেমন ভাবে করা হয়ে উঠে না। ভাইয়ার ব্যাপারটা শুভ্রের সাথে শেয়ার করি।সবটা শুনে শুভ্র বলে,,

-যেহেতু ভাইয়া তোমায় পাইয়ে দিতে আমায় সাহায্য করেছে সে হিসাবে আমাদেরও কর্তব্য ভাইয়াকে সাহায্য করা।যেভাবেই হোক অহনাকে ভাইয়াকে পাইয়ে দেবোই।

শুভ্র অহনার ব্যাপারটা নিয়ে ভাইয়ার সাথে ট্রেনেই কথা বলে ফেলেছিলো।মা-বাবা আর দাদিকে রেখে এসে সেদিনই ভাইয়া ঢাকায় ব্যাক করবে।তারপরেই ভাইয়ার নেতৃত্বে অহনার রাগ ভাঙানোর যুদ্ধে আমরা নামবো।

পরের দিন সকালে আমরা অহনার বাসার দিকে রওনা দিই।মিরপুরের এক বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে অহনা থাকে।ধনীর দুলালি হয়ে যে ভাইয়ার মধ্যে কি দেখলো!বড়লোকের মেয়ে হওয়ায় আমি একটু দ্বিধাদ্বন্দে আছি যে এই মেয়ে আদোও পরিবারের জন্য ভালো হবে কিনা!বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধনীর দুলালিরা বলে পরিবারের অশান্তির কারণ হয়।

অহনার বাবা ভাইয়া অহনার সম্পর্কের কথা জেনে যাইয়ার পর বাংলা সিনেমার মতো বন্ধুর ছেলের সাথে অহনার বিয়ে ঠিক করে।তাই এইবার অহনাকে বের করে আনা ছাড়া কোনো উপায় নেই।প্ল্যান অনুযায়ী আমি অহনার বান্ধবী।আর শুভ্র আমার নতুন বিয়ে করা বর।আমরা কথায় অহনার বাবা মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখবো।আর ভাইয়া সুযোগ বুঝে অহনাকে বুঝিয়ে বের করতে পারলেই খেল খতম।

গিয়ে কলিংবেল দিই।একটা ভদ্র মহিলা দরজা খুলে দেন।

-তোমরা?
-আসসালামু আলাইকুম আন্টি।আমি অহনার ফ্রেন্ড।নতুন বিয়ে করেছি তো তাই ভাবলাম আপনাদের থেকে দোয়া আশীর্বাদ নিই।

কথাটা বলেই মহিলার পায়ে সালাম করি।শুভ্রকেও বলি সালাম করতে।আমাদের এমন অদ্ভত আচরণে মহিলা ভেবাচেকা খেয়ে যায়।তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি আর শুভ্র ঘরে বসে থাকার অহনার বাবার কাছে চলে যায়।পেছন পেছন মহিলাও আসে।এভাবে দুজন আগুন্তককে বেড রুমে ঢুকতে দেখে লোকটাও হকচকিয়ে যায়।তাকেও কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমরা সালাম করি।

-আংকেল আন্টি আমরা কিন্তু আজকে আপনাদের বাসায় থাকবো।

আমি বলি।ভদ্রমহিলা ভদ্রলোক আমার কথার মানে বুঝতে না পেরে আমার দিকে হা করে চেয়ে থাকে।আমি হেসে বলি,,,

-থাকতে দেবেন না?
-হ..হ্যাঁ মা দেবো না কেন?অবশ্যই থাকবে।

আমি গিয়ে বিছানায় বসি।বিছানাটায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলি,,,

-আংকেল আন্টি আমরা কিন্তু এই বিছানায় থাকবো!

ভদ্রলোকটা ভদ্রমহিলাকে কি যেন কানে কানে বলে।তা দেখে আমি বলি,,,

–Very bad uncle! Very bad!আপনি জানেন না মানুষের সামনে কানাকানি করতে নেই?

আমার কথার কোনো কর্ণপাত না করেই ভদ্রমহিলা অহনার ঘরের দিকে যায়!এই রে!ভাইয়া কি আদোও অহনাকে নিয়ে বের হতে পেরেছে?এরই মধ্যে ভদ্রমহিলা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়।অহনা নাকি ঘরে নেই।যাক বাবা বাঁচলাম।আমাদের প্ল্যান সাকসেস হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।

-এই মেয়ে অহনা কই?

হুংকার দিয়ে বলে ভদ্রলোকটা।আমি ভেংচি কেটে বলি,,,

-আপনার ছেলের বউ কই আমি জানবো কিভাবে?আর আমায় ধমক দেন কেন?দেওয়ার থাকলে আপনার ছেলের বউকে ধমক দেন।
-ছেলের বউ?অহনা আমার মেয়ে।
-অহ!আচ্ছা।মিস্টেক।আমার ফ্রেন্ড অহনা তো বললো এটাই ওর শ্বশুর বাড়ি আর তাই তো আমরা….সরি আংকেল ভুল হয়ে গেছে।

কথাটা বলেই আমি আর শুভ্র দিই এক দৌঁড়।এক দৌড়ে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে পাশের গলিতে গিয়ে দাঁড়াই।সেখানেই ভাইয়া আর অহনা ছিলো।তারপর বাইক নিয়ে সোজা কাজী অফিস। রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে ভাইয়া শুভ্রের হাত ধরে বলে,,,

-থ্যাংক্স শুভ্র।তোমার এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না।
-ভাইয়া আপনি যা করছে তার ঋণ কি আমি শোধ করতে পারবো?এই মাথামোটা মেঘ তো ধরেই নিয়েছিলো শান্তর সাথে সংসার করবে!আপনি হেল্প করলে কি পেতাম এই পাগলটাকে?
-আমি পাগল?তুই পাগল তোর চৌদ্দ গুষ্টি পাগল।
-ভাইয়া দেখছেন?আপনার আনরোমান্টিক নিরামিষ বোন কেমন করে?

আফসোস নিয়ে আমার কথার জবাব দেয় শুভ্র।আমি চেতে বলি,,,

-আফসোস লাগে?যা না যা বুশরাকে বিয়ে কর গিয়ে।
-ওর সাথে শান্তর বিয়ে হয়েছে।তোদের সাথে পড়েছে না?কালো খাটো করে?

ভাইয়া বলে।এহ!ওর সাথে শান্তর বিয়ে হয়েছে?রতনে রতন চিনে।কিন্তু ভাইয়া জানলো কিভাবে?

-তুই জানলি কিভাবে?
-বাড়িতে গিয়েছিলাম।কাকি বললো।সাড়ে তিনলাখ টাকা নাকি যৌতুক দিয়েছে।
-ভালোই।শ্বশুরবাড়ি থেকেই নেশার টাকা পাবে।বাই দ্যা রাস্তা তোর আমায় থ্যাংক ইউ দেওয়া উচিৎ।কারণ পুরো ঘটনাটা আমিই হ্যান্ডেল করেছি।শুভ্র শুধু ল্যাঞ্জা ধরে গিয়েছিলো।

আমার কথা শুনে সবাই হেসে দেয়।অহনা হেসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলে,,,

-মাহি তোমার কাছে ঋণী কিনা জানি না।তবে আমি তোমার কাছে সারাজীবনের মতো ঋণী হয়ে গেলাম।


গতমাসে আমার পিরিয়ড স্কিপ করেছে।এই মাসেও ডেট পেরোনোর অবস্থা।কেমন যেন চিন্তা হচ্ছে।এরই মধ্যে শুভ্রর কলেজে আমিও চাকরি পেয়ে যাই।আল্লাহ মনে হয় আমাদের আলাদা করতে চান না।কোনো না কোনো কারণে আমাদের এক করে রাখছেনই তিনি!আজ আবার কলেজে নবীন বরণ। সেই ভার্সিটির ফাংশনগুলোর মতো আমরা ম্যাচিং করে শাড়ি পাঞ্জাবি পরে গেছি।কি সুন্দর মুহুর্তগুলোই না আমরা কাটিয়েছি ক্যাম্পাসে।প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো কারণে আমি তার সাথে ঝগড়া করতামই।রুম নাম্বার একশো এগারো আমাদের প্রথম দেখার সাক্ষী।যদি এর আগে অনেক বারই দেখা হয়েছিলো তাকে।কিন্তু সেই রুমে আমি নতুন করে শুভ্রকে দেখি।এগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে ঠোঁটের কোণে মুচকী হাসি এসে যায় বুঝতেই পারিনি।একদৃষ্টিতে ড্রেসিনটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুহুর্তগুলো মনে করে চুলে বেনুনী করছিলাম।শুভ্রের ডাকে ধ্যান ভাঙে।তাড়াতাড়ি করে বেনুনীর আগায় গার্ডার গিট্টু দিয়ে বেরিয়ে পরি।
কলেজের সামনে কিছু ফুলের দোকান আছে।সেখাব থেকে একটা বেলী ফুলের গাজরা নিয়ে শুভ্র আমার চুলে লাগিয়ে দেয়।আজ মনে হচ্ছে নতুন করে আমরা প্রেমে পড়েছি।ওই আলসেমির জন্য আমাদের সেভাবে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি তাই হয়তো আজকের দিনটা অন্যরকম লাগছে।কিন্তু এইদিনেই যে আমার শরীর খারাপ হতে হলো!কাল রাত থেকেই কেমন গা গুলাচ্ছে।শুভ্রকে বলতে গিয়েও বলিনি।শুধু শুধু টেনশন নেবে।

বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না।গান বাজনার শব্দে আরও খারাপ লাগছিলো।তাই স্টাফ রুমে এসে বসলাম।একটু পরেই শুভ্র হাওয়াইমিঠাই হাতে আসে।

-তোমার না মেঘ হাওয়াই মিঠাই পছন্দ!

আমি উঠে দাঁড়াই।কিছু বুঝে উঠার আগেই চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আসে।


চোখ মেলে নিজেকে হসপিটাল বেডে আবিষ্কার করলাম।পাশে শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি।আমি উঠে বসতেই আমায় জড়িয়ে ধরে বলে,,,

-মেঘ আমাদের টুনি আসতেছে।

উনার কথার আমি মানে খুঁজে পাই না।সন্দিহান দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে বলি,,,

-মানে?
-মানে আমার মেঘের কোল আলো করে একটা ছোট্ট মেঘ আসতে চলেছে।তুমি মা হতে চলেছো।

কথাটা শুনতেই কেমন এক অবর্ণনীয় অনুভূতির স্পর্শ পেলাম আমি।এর থেকে খুশীর খবর আর কি হতে পারে।একটা মেয়ের জীবনের সেরা মুহুর্ত হচ্ছে মাতৃত্ব কালীন সময়।আমিও সেই সময়ে প্রবেশ করেছি।কিন্তু শুভ্র মেয়ের কথা বললো কেন?এত তাড়াতাড়ি তো ছেলে মেয়ে নির্ণয় করার কথা নয়!সবে একমাস হলো পিরিয়ড স্কিপ করেছে।

-কিন্তু আমি রেগে আছি মেঘ!

শুভ্রের কথায় ধ্যান ভাঙে আমার।শান্ত গলায় বলি,,

-কেন?
-তুমি আগে থেকে কিছু বলো নি কেন আমায় যে তোমার শরীর খারাপ!
-শুধু শুধু টেনশন নিতে তাই আর কি…
-আর না বলে যে পুরো কলেজকে টেনশন দিলে?যদিও আমি গুড নিউজটা আমি উনাদের দিয়ে দিয়েছি।এখন উনারা ওটা সেলিব্রেট করছেন!আর আমাদের বলে তারা মিষ্টি ছাড়া কলেজে ঢুকতে দেবেন না।

আমরা দুইজন হেসে দিই।


আমিই বোধহয় একমাত্র কনে যে নিজের মেয়েকে নিয়ে স্টেজে বসে আছে।প্রেগ্ন্যাসির সময় আমি শুভ্রকে বল্টুর বাপ আর শুভ্র আমায় টুনির মা বলে ডাকতো।আর ও নাকি নিশ্চিত ছিলো আমাদের প্রথম সন্তান মেয়ে হবে।অবশেষে শুভ্রই জিতে গিয়েছে।আমাদের কোল আলো করে আল্লাহ আসমানের এক পরীকে দিয়েছেন।সেও মায়ের সাথে সেজে বসে আছে।মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগলে নানা দাদার কোলে চড়ে পুরো কমিউনিটি সেন্টার ঘুরছে সে।আমাদের বিয়ের ধুমধামে অনুষ্ঠান করার।কিন্তু প্রেগ্ন্যাসির জন্য তা আর করা হয়ে ওঠে নি।অবশেষে মিশমিশের প্রথম জন্মদিনের সাথে নিজেদের বিয়ের অনুষ্ঠানটা করেই ফেললাম।

-মাম্মাম নানু খাইয়ে দিয়েছে।লিপতিক উঠে গেছে দিয়ে দাও তো!

কথাটা বলতে বলতে দৌড়ে আসে আমার দিকে মিশমিশ।এমন সময় হঠাৎ করে গাউনের সাথে পা বেজে সে পরে যাওয়ার উপক্রম।এমন সময়ই শুভ্র তাকে খপ করে ধরে ফেলে।নিরাপদ হাত পেয়ে মিশমিশও তা ধরে ফেলে।শুভ্র মিশমিশকে কোলে তুলে বলে,,,

-আমি থাকতে আমার প্রিন্সেসের কিছুই হবে না।
-পাপ্পা লিপতিক উঠে গেছে দেখো।

শুভ্রকে ঠোঁট দেখায় মিশমিশ। শুভ্র মিশমিশকে নিয়ে এসে আমার পাশে বসে।পার্স থেকে লিপস্টিক বের করে সযত্নে মিশমিশের ঠোঁটে লাগিয়ে দেয়।তারপর নাক টিপে বলে,,

-আমার লাল পরীটা।

মিশমিশও শুভ্রের গালে চুমু দিয়ে বলে,,,,

-লাপিউ পাপ্পা।
-ওহ আচ্ছা!শুধু পাপ্পাই ভালো।তাকে হামি দেওয়া যায়।জড়িয়ে ধরা যায়।আর মাম্মাম খারাপ তাই না?
-এ বাবা!মাম্মাম লাগ কলেছে।সলি মাম্মাম।

কথাটা বলে আমায়ও চুমু দেয় মিশমিশ।আমি হেসে জড়িয়ে ধরি তাকে।

-মাম্মাম আমলা চবি তুলবো না?
-কেন তুলবো না?অবশ্যই তুলবো।

শুভ্রকে বলার আগেই শুভ্র ফটোগ্রাফারকে ডাক দেয়।শুভ্রের মতে মিশমিশ নাকি পুরো আমার মতো হয়েছে। লিপস্টিক প্রেমি আর ছবি তুলতে ভালোবাসে।

আমরা বাইরে যাই।বেশ কয়েকটা ছবি তুলার পর আমি বলি,,,

-এই শোনো তুমি আমার কপালে চুমু দিবা আর আমি মিশমিশের কপালে চুমু দিবো।
-মানুষের সামনে কি বলে না বলে।

শুভ্র নাক শিটকে বলে।আমি ভেংচি কেটে বলি,,

-এহ!বিয়ে একবারই আসে।এই দিনটা আর ফিরে আসবে না।নাও এইবার যা বললাম করো।
-কলো কলো।মাম্মাম যা বললো কলো!

মিশমিশ বলে।আমরা সবাই ফিক করে হেসে দিই।সৃষ্টিকর্তা যেন সব সময় আমাদের এমন হাসিখুশি রাখেন।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here