একজোড়া পায়রা পর্ব -২৩

#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট২৩

কাল রাতে শুভ্রের সাথে খেলা দেখা নিয়ে ঝগড়া হয়েছিলো।খেলা দেখবি ভালো কথা। খাবার খেয়ে খেলা দেখ।তাহলে আমিও শুয়ে পড়তে পারি।কিন্তু তা না।খেলা দেখতে দেখতে যখন উনার খিদে পাবে উনি তখনই খাবেন।এই নিয়ে তার সাথে আমার প্রচুর কথা-কাটাকাটি হয়।শেষে আমি রাগে টিভির রিমোর্ট আছাড় দিয়ে ভেঙে অন্য রুমে গিয়ে দরজা আটকিয়ে শুয়ে পড়ি।কিন্তু সকালে উঠে নিজের ভুল বুঝতে পারি।একটা কথা আছে না?চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। আমার হয়েছে সেই দশা।যখন রিমোট ভেঙেছিলাম তখন টিভিতে খেলার চ্যানেল দেওয়া ছিলো।তাই রিমোট ভাঙার পরে শুভ্র টিভিতে খেলা দেখতে পারলেও আমি টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করে কার্টুন দেখতে পারছি না।আর পাঁচটা বাঙালি নারীর মতো আমি সিরিয়াল এডিক্টেড নই।কার্টুন হলেই আমার চলে।রান্নাঘর থেকে ড্রয়িংরুমে রাখা টিভিটা সরাসরি দেখা যায়।তাই বলা যায় আমি কার্টুন দেখতে দেখতেই রান্নাঘরের যাবতীয় কাজ করতাম।কিন্তু রিমোট ভেঙে ফেলায় আজ আর তা করা হয়ে ওঠে না।কোনো রকমে নাস্তা টেবিলে দিয়ে সোফায় বসি।ঘড়ির কাঁটায় তাকিয়ে দেখি নয়টা বাজে।আজ তো শনিবার।আর শনিবারে শুভ্রের দশটায় ক্লাস থাকে।গিয়ে ডাক দিই।না হলে লেট হয়ে যাবে।

আমি সোফা থেকে উঠি।ঘরের দিকে যেতে গিয়ে থেমে যাই।ওয়েট!আমি তো নিয়ত করেছি উনার সাথে কথা বলবো না।তাহলে আমি আবার উনাকে ডাকতে যাই কেন?আবার দায়িত্বে অবহেলা করার মেয়েও তো আমি না।কারণ সিলেট আসার পর উনি আমায় বলেছিলেন তাকে সকালে ডেকে কলেজের জন্য রেডি করার দায়িত্ব আমার।সেই হিসাবে উনাকে সকালে ঘুম থেকে ডেকে তোলা আমার দায়িত্ব।কি করা যায়?উমমম!আইডিয়া!একটা চিরকুট নিয়ে তাতে “ওঠেন স্যার। নয়টা বাজে ” লিখে চিরকুটটা তার পাশে রেখে আমি চলে আসি।তারপর ড্রয়িংরুমে এসে চকলেট খেতে খেতে ফেসবুক স্ক্রোল করতে লাগি।তখন পনে দশটা।মানে নয়টা পয়তাল্লিশ। চোখ কোচলাতে কোচলাতে রুম থেকে বের হয় শুভ্র।আমি দেখেও না দেখার ভান করে ফোন টিপতে লাগি।বাথরুম থেকে বেরোতে তার দশ মিনিট লেগে যায়।বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে দশটা বাজার আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি।এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,,,

-মেঘ আমি তোমায় আগেই বলে দিছি না শনিবারে আমার দশটায় ক্লাস থাকে।ডাক দাও নাই কেন?

আমি কোনো কথা বলিনা।উঠে গিয়ে চিরকুটটা এনে তার হাতে ধরিয়ে দিই।উনি চিরকুটের লেখাটা জোরে জোরে পড়েন।

-উঠেন স্যার। নয়টা বাজে।

চিরকুটটা পড়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে উনি আমার দিকে তাকান।আমি দেখেও না দেখার ভান করে শ্যামল দার Heavy relax..!See you not mind মুডে গিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে সোফায় গিয়ে বসি।উনি রেডি হতে রুমে যান।রেডি হয়ে এসে শার্টের হাতা ফোল্ডার করতে করতে এসে ডাইনিং টেবিলে বসেন।বিরক্তি নিয়ে বলেন,,

-খোদার তিরিশটা দিনই পাউরুটি,জ্যাম,ডিম ভাজি।একই খাবার খেতে খেতে মুখে ছাতা পড়ে গেছে।

এহহহ!আসছে রান্না নিয়ে কথা বলতে।ঝগড়ার পরও যে তোর জন্য রান্না করে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছি তাই ই কত!খাইলে খা নইলে নাই।জানতাম এই লোকটা কিছু না কিছু বলবেই।কথা বলবো না বলে হেরে যাবো?উউ!মেঘ ওমন মেয়েই না।আগে থেকেই খাতা কলম নিয়ে বসে ছিলাম।চট করে খাতায় উনার প্রতিউত্তর লিখে কাগজটা ছিড়ে বল বানিয়ে উনার দিকে ছুড়ে দেইই।উনি আগের মতো কাগজটা জোরে জোরে পড়তে লাগেন,,

-শোন আমি দেখে রাগ করার পরও তোর জন্য নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে।অন্য মেয়ে হলে সব ফেলে রেখে চলে যেত।আমি দেখে তোর সংসার করতেছি।আর শোন রান্না ভালো না লাগলে নিজে রান্না করে খা।আপাতত যা দিয়েছি তাই ই কত!খাইলে খা নইলে নাই। আমার কি তাতে।

কাগজটা পড়ে উনি আমার দিকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকান। আমি সেই আগের মতো,পাত্তা দিই না উনাকে।কোনো রকমে নাস্তা খেয়ে উনি তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যান।রিকশায় পাঁচ মিনিটের রাস্তা কলেজ।ইনশাআল্লাহ গিয়ে ক্লাস করাতে পারবেন।উনি বেরিয়ে গেলে আমি নাস্তা করে ঘরের কাজগুলো সেড়ে নিই।

মাথা ধরেছে প্রচুর।সিজন চেঞ্জের জন্য জ্বর ঠান্ডা হয়েছে। তারমধ্যে কালকে রাতে ঝগড়া।রাগে কালকে অর্ধেক রাত আমি কেঁদেই পার করেছি। বড্ড ঘুম পাচ্ছে।কোনো রকমে গোসল করে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিই।

ফোনের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙে আমার।চোখ মেলে দেখি আনহার মা ফোন করেছে।আমি ফোন রিসিভ করি।

-হ্যালো মেঘ।তুমি ঠিক আছো তো?
-জ্বী ভাবি।কিন্তু কেন?
-আরেহ শুভ্র মিনিট পনেরোর মতো দরজায় কড়া নেড়েছে।ফোন দিয়েছে তুমি নাকি ধরছো না।রাতে নাকি ঝগড়া করেছো তাই নাকি ফোন রিসিভ করছো না।আবার কোনো সাড়াশব্দও না পাওয়ায় শুভ্র তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।
-আসলে হয়েছে কি ভাবি সিজন চেঞ্জের জন্য কয়েকদিন ধরেই ঠান্ডা আমার।কোনো রকমে গোসল করে এসে বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছি ভাবি।আসসালামু আলাইকুম।

ভাবি আমার সালামের জবাব দিয়ে ফোন কেটে দেন।আমি দরজা খোলার জন্য উঠি।উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে দেয়।আমি দেয়াল ধরে নিজেকে সামলাই।কোনো রকমে জিনিসে দেয়াল ধরে গিয়ে দরজা খুলি।ঘুম ঘুম চোখে দেখি দরজায় ওপারে শুভ্র তীব্র বিরক্তি আর রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কিছু বুঝে ওঠার আগেই আর চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসে।


পানির স্পর্শে চোখ মেলে তাকাই আমি।পাশে শুভ্রকে দেখতে পাই।কপালে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। আমি চোখ মেলে তাকাতেই এক গুচ্ছ প্রশ্ন আমার দিকে ছুড়ে মারেন।

-ঠান্ডা জ্বর কয়দিন ধরে?আর আমি কি তোমায় কম খাইতে দেই যে প্রেসার লো হবে?

আমি উঠে বসি।কিভাবে তার প্রশ্নের উত্তর দেবো বুঝে উঠতে পারি না।উনি আবার প্রশ্ন করেন আমায়,,,

-খাওয়া দাওয়া করোনা কেন ঠিকমতো?এখন কি আমায় কলেজ থেকে এসে তোমায় খাইয়ে দিয়ে যেতে হবে?অসুস্থ হবা আর তোমার ভাই বলবে তার বোনের কেয়ার করি না।

আমি এইবারও চুপ।কারণ আমি নিয়ত করেছি এই লোকটার সাথে কথা বলবো না।আমায় চুপ করে থাকতে দেখে উনি রেগে যান। দুই বাহুতে ধরে বলেন,,,

-এখনও নাটক করবা?যা যা জিজ্ঞাস করছি এন্সার দিতে কি হয়?
-আমি তো নায়িকা।আর আমি নাটক করবো না তো কে করবে?তোর মতো ভিলেন?

এই যাহ!কথা বলে ফেললাম?জিহ্বায় কামড় দিই আমি।উনি মুচকী হেসে উঠে যান।কিছুক্ষণ বাদে দেখি আমার জন্য স্যুপ বানিয়ে আনেন।বিছানার পাশে টেবিলে স্যুপের বোলটা রেখে বলেন,,

-নিজে থেকে খাবা নাকি খাইয়ে দিতে হবে?

আমি চুপ।উনি মুচকী হেসে বলেন,,

-কথা যখন বলেই ফেলেছো আর বাড়তি ঢং করার মানে দেখি না।খাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।সারপ্রাইজ আছে একটা তোমার জন্য।

কথাটা বলে উনি ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ান।আমি পেছন থেকে ডেকে বলি,,,

-রান্না তো কিছু করা হয়নি।তুমি কি খাবা?
-আজ না হয় স্যুপ দিয়েই চালিয়ে দেবো।আর তুমি তো সকালে বললে ভালো না লাগলে নিজে রান্না করে খা।আর তাছাড়াও প্রতিদিন ভাত খেতে ভালো লাগে না।

উনি ওয়াশরুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য যান।আমি স্যুপ খেয়ে বোলটা ধোয়ার জন্য কিচেনে যাই। বোলটা ধুয়ে পানি ঝড়ার জন্য রেখে দেখি শুভ্র পেছনে।

-উঠতে বলেছে কে তোমায়?আবার যদি অঘটন ঘটতো?তখন তো আমি আছিলাম বলে রক্ষা!
-আমি অতটাও উইক না মিস্টার।
-জানা আছে।

কথাটা বলে উনি বোল নিয়ে স্যুপ বেড়ে খেতে লাগেন।স্যুপের সাথে নুডলস দিয়েছিলেন।যার কারণে অনেকটা রামেন রামেন লাগলো স্যুপ।লোকটা ভালোই রাঁধে।খাওয়া হয়ে গেলে আমি বাচ্চাদের মতো উনার পিছু পিছু সারপ্রাইজের জন্য ঘুরতে লাগি।উনার ভাব সাবে বুঝতে পারি আমার এমন বাচ্চাদের মতো পিছু পিছু ঘুরা উনি খুব পছন্দ করছেন।উনি হেসে বলেন,,,

-সকালেই তো ঢং করলে।কথা বললে না।এখন আবার পিছু ছাড়ছো না যে!
-দাও না সারপ্রাইজ!
-পরে দেবো
-পরে দিবে পরে বললেই হতো।শুধু শুধু কুড়কুড়ানি দিলে এখন দিতে হবে।

আমার কথা শুনে উনি ফিক করে হেসে দেন।আমি হাসির মানে খুঁজে পাই না।তাই জিজ্ঞেস করি ওকে,,,

-হাসলে যে?
-কুড়কুড়ানি! what is কুড়কুড়ানি?
-ওই কাতুকুতু টাইপের!
-দেবো কাতুকুতু?
-এই না!একদম না

কথাটা বলেই উনি আমার দিকে কাতুকুতু দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন।আমি পিছাতে লাগি। একসময় দৌড়ই দিইই।সেও আমার পেছন পেছন দৌড় দেন।হঠাৎ করেই পাপোশের সাথে পা পিছলে বিছানায় পড়ে যাই।উনি এই সুযোগ মিস না করে ঝাপিয়ে পড়েন আমার ওপর।আগে থেকেই আমার কাতুকুতু বেশি।শরীরে ধরলেই কাতুকুতু লাগে।এটা আমার দুর্বলতা শুভ্র জানে।অনেক সময় রাগ করলে এই কাতুকুতু দিয়েই সে আমার রাগ ভাঙায়।হাসতে হাসতে আমার দম আটকে যাওয়ার অবস্থা।শুভ্র বুঝতে পারে তা।তাই ছেড়ে দেয় আমায়।উফফ!হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে গেছি একদম।লম্বা শ্বাস নিয়ে বলি,,,

-একটু পর হইছে।এখন সারপ্রাইজটা দাও।

উনি আলমারি থেকে একটা প্যাকেট বের করে হাতে দেন।আমি প্যাকেটটা খুলে দুটো বই দেখতে পাই।আরিফ আজাদের লেখা প্যারাডক্সিকাল সাজিদ।যদিও বইটা আমি আগে পিডিএফে পড়েছি।কিন্তু এই বই দুটো সংগ্রহ করার আমার খুব ইচ্ছা ছিলো।কিন্তু এই কথা শুভ্র জানলো কিভাবে?আমি প্রশ্ন করি ওকে।ও উত্তরে বলে আমার ডাইরি পড়ে জেনেছে।আমি অভিমান নিয়ে বলি,,,

-মানুষের ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেওয়া একদম উচিৎ না।
-কিসের ব্যক্তিগত?আমার যা আছে সব তোমার।তোমার যা আছে সব আমায়।

আমি লাজুক হাসি।উনি আমার গাল টিপে বলে,,,

-জানো মেঘ?আমি না খুব লাকি।তোমার মতো এমন বইপাগল মেয়েকে বউ হিসাবে পেয়েছি

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here