একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৩৪
রোকসানা আক্তার
নাম্বারের দিকে অনেকক্ষণ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে।অরুনের সাথে কথা বলেছে অথচ তার ঘোর এখনো কাঁটে নি।মনটা খুব আঁকুপাঁকু দিয়ে উঠল যদি আর কিছু সময় অরুনের সাথে কথা বলতে পেত তাহলে বড়ই তৃপ্ত হত।ইদানীং অশ্রুর মাঝে অনেকটা পরিবর্তন ঘটেছে।আগে যেমন অরুনকে দেখামাত্রই দু’চক্ষু বিষলতা হত; তার নাম মুখে আসা মাত্রই মুখটা বিবৎস হয়ে যেত; এখন আর তা হয় না।এখন অরুনকে নিয়ে হাজারটা ভাবলেও বাঁজে ভাবনা মাথায় আসে না।তার শাস্তির জন্যে আগ্রহ দেখায় না।অরুনকে ফাঁসায় মনে একটুখানি হলেও অনুশোচনার দ্বার জাগ্রত হয়,তবে ইচ্ছে হয় না নিজেকে বুঝাতে।
এ অনুভূতিগুলো শুরু হয় তার বাবাকে ছেড়ে দেওয়ার পর এবং স্মৃতির ওই অনাকাঙ্খিক ব্যবহারের কারণে।
অবশ্যি তা কারো চোখে পড়ে না। তা নিজেই নিজের মনে অতি সংগোপনে লালিত করে।।
পারুল বেগম গলায় খেঁকারি টেনে ভেতরে প্রবেশ করেন।অশ্রু শব্দ পেয়ে মোবাইলটা পাশে রেখে।তারপর ঠিকঠাক বসে মায়ের দিকে চোখ ফেরে।
তিনি বিছানার কাছে এসে অশ্রুর পাশ ঘেঁষে বসেন।নরম গলায় বলেন,
“আগামীকাল বিপুল আসবে তোকে নিয়ে যেতে।সবকিছু রাতের মধ্যেই গুঁছিয়ে নে।”
অশ্রুর ভেতরটায় একটা আর্তনাদ করে উঠে।মাথাটা চক্কর খায়।চোখের পানি টলমল হয়।অতি হুশিয়ারে নিজেকে আগলে বলল,
“মা,আমার না এখন চট্টগ্রাম যেতে একদম ইচ্ছে করছে না।”
“ইচ্ছে না করলেও যেতে হবে!উপায় নেই রে অশ্রু।দেখতেইতো পারছিস কি অবস্থা!”
“কিছুই হবে না মা।দুনিয়াটা কি মগের মুল্লুক পেয়েছে যা বলবে তাই হবে!তাছাড়া,আমিতো ছোট্ট নেই।সাহস নিয়ে নিজের বিপদ নিজেই সামলাতে পারবো!”
মেয়ের কথা শুনে পারুল বেগম মেয়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকান।এমনভাবে তাকালেন যেন সে একটা ধাঁঁধা বলেছে মাত্র।মায়ের এমন ভঙ্গিমা দেখে অশ্রু ক্ষীণ গলায় আবার বলল,
“বিশ্বাস হচ্ছে না,তাইতো?একবার তো সুযোগ দাও তারপর বিশ্বাস হবে।”
“বিশ্বাসের কোনো প্রয়োজন নেই।যা বললাম তাই কর।আর খেতে আস।”
বলেই চলে যান তিনি।অশ্রু গাল ফুলিয়ে মুখের হাওয়া ছাড়ে। তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে মা-বাবার উপর।হিতাহিতজ্ঞান শূন্য পড়ে।ডিসিশন নেওয়ার আগে দ্বিতীয়বার ভাবে না।
অরুন রাতের খাবার শেষ করে সোঁজা বাবার রুমে যায়।অসময় ছেলেকে দেখতে পেয়ে ভুট্টো পোদ্দার খানিকটা চমকে যান।সচরাচর কোনো দরকারি কথা ছাড়া সে রুমে আসে না।আজ কি কথা বলতে এসছে তাই ভেবে ভুট্টো পোদ্দার আগ্রহ চোখে ছেলের দিকে তাকান।বিলম্বিত না করে বলেন,
“কিছু বলবি?”
“জ্বী, বাবা।”
তিনি বিছানার উপর বসেন।ছেলেকেও বসতে বলেন। অরুন বাবার সাগ্রহে পাশের সোফায় বসে।ভুট্টো পোদ্দার হাই তোলে বলেন,
“বল কি বলবি..।”
অরুন নিজেকে স্বাভাবিকতায় রেখে খুব মার্জিত এবং স্পষ্ট গলায় বলতে লাগলো,
“আমি জানি বাবা, আমাকে নিয়ে তোমার খুব টেনশন হচ্ছে।এতবড় বিপদ সেখানে তোমার টেনশন হওয়া স্বাভাবিক।প্রতিটি পিতা-মাতার কাছেই তাদের সন্তান অমূল্য রতন।সন্তানদের বিপদে -আপদ,সংকুলান সবকিছুই পিতামাতার মাথার উপর দিয়ে যায়।পরম স্নেহাতীত তাদের সন্তানদের উপর আঘাত আসলে তারা তা চোখবুঁজে সহ্য করতে পারেন না।তুমিও তার ব্যতিক্রম নও।তবে বাবা,আরেকটা বিষয় হলো বিপদ-আপদ তো আর একপাক্ষিকে হয় না ভুল-ত্রুটি সবারই থাকে।আমারও যে ভুল ছিলনা এমন নয়।ভুল আমারও আছে।তাই আমি শাস্তি পাওয়া অস্বাভাবিক নয়।দেশের আইনানুযায়ী আমাকেও শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে!”
ভুট্টো পোদ্দার ছেলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকান।চোখ বড় করে বলেন,
“কি বলতে চাচ্ছিস তুই?”
“তেমন কিছু নয় বাবা।বলতে চাচ্ছিলাম যে ভুলটা তো আমিই করেছি, তাই ভুলের মাশুল আমাকেই গোনতে দাও। তুমি খামোখা এদিকওদিক ঘুরঘর না করে আমাকে আমার প্রাপ্য শাস্তি পেতে দাও।অন্যের উপর জিম্মি করে আমাকে বাঁচাতে নয়!”
ভুট্টো পোদ্দার ছেলের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকেন।অরুন বাবার কাঠিন্য চোখ দুটোকে উপেক্ষা করে।জানে, বাবার চোখে একবার চোখ নজর দিলে তার আর কথা বলা হয়ে উঠবে না।তাই সে তার কথার ফসরা চালাতে থাকে।
“বাবা তুমি হয়তো আমার কথায় কিঞ্চিৎ রাগ করতে পারো।আমি তোমার সম্মানের কথা ভেবেই বলছি।এখন তুমি আইনকে টাকা খাইয়ে থামাবে।একটা সাধারণ পরিবারকে হিংস্রভাবে জিম্মি করে কাজ হাসিল করবে।তোমার সব স্বার্থকই পূরণ হবে।কেবল স্বার্থপর থেকে যাবে সাধারণ পাবলিকদের কাছে।বিষয়টা একটু থিউরিক্যালি ভাবো বাবা।তাছাড়া,এখন তুমি যদি আমাকে শাস্তি পেতে কোর্টে হাজির করো তাহলে তোমার প্রতি দেশের মানুষের বিশ্বাস আসবে।ভক্তি হবে।তুমি মানুষদের কথা ভেবে আমায় শাস্তি দিচ্ছ।আর..!”
সম্পূর্ণ কথা অরুন শেষ করতে পারেনি।তার আগেই ভুট্টো পোদ্দার হাত উঁচিয়ে ছেলেকে থামিয়ে দেন।ক্রন্দনে রাগ চেপে বলেন,
“মাথা খারাপ হয়েছে তোর?মুখে যা আসছে তাই বলছিস!আর কে বলল আমি তোকে বাঁচাতে চাইছি!আমি তোকে কোন দুঃখে বাঁচাবো রে!পরিবারের মানসম্মান সব ডুবিয়ে দিয়ে এখন আসছিস আগ বাড়িয়ে ন্যাঁকা করতে?ভুলিস না তুই শাস্তি পাবি না। কঠিন শাস্তি পাবি।এখন তুই রুম থেকে আসতে পারিস।”বলেই তিনি লাইট অফ করে অন্যদিকে কাঁত হয়ে শুয়ে যান।অরুন ড্রিম লাইটের আলোয় তার বাবাকে আবছা আবছা দেখছে।অনেকটা অভিমান করে এসব বলছেন তিনি তা অরুন ভালোভাবেই বুঝতে পারছে।।অরুন বিষম মুখে সংগোপনে একটা ঢোক গিলে।সে জানে তার বাবা তাকে অনেক ভালোবাসে। হয়তো সেদিন অতিক্রদ্ধতায় উল্টোপাল্টা বকেছে কিন্তু মনে মনে নিজে ঠিকই কষ্ট পেয়েছে।তবে,অরুনের এক্ষেত্রে কিছুই করার নেই।সে যেটার প্রাপ্য সেটা পেতেই হবে।নাহলে নিজের ভুলগুলো কখনো শুধলাবে না।কষ্টহীন শুধলালে তা কখনো শুদ্ধ হয় না।অশুদ্ধ থেকে যায়।
তারপর ক্লান্তি মনে সে নিজের রুমে চলে আসে। এসেই সুইচড টিপে বাতি বন্ধ করে।আর ড্রিম লাইট অন রাখে।উদাসীন মনে পিঠ বিছানায় ঠেকিয়ে ড্রিম লাইটের আলোর দিকে তাকায়।চোখদুটো নিবু আলোর দিকে নিবদ্ধ রেখে মাথায় চিন্তার রাজ্য বয়ে যায়।বাবাকে সে এত সহজে বুঝাতে পারবে না।আর বুঝাতে গেলেও ততদিনে দেরী হয়ে যাবে।এরমধ্যে অশ্রুর উপরও কোনো আঘাত আসতে পারে।ভাবতে ভাবতে অরুন এপাশ-ওপাশ মাথা ঠেকায়।কিছুতেই বুঝ হচ্ছে না কি করবে।ভাবনার দিকে মগ্নতা থেকে দু’চোখে আস্তে আস্তে ঘুম জড়িয়ে যাচ্ছে।অরুন বুঝতে পারছে সে আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘুমিয়ে যাবে।তার চিন্তার রাশ ভারী হলে তৎক্ষনাত চোখে ঘুম চলে আসে ।আর রাত হলেতো কথাই নেই।এই অভ্যেসটা একদম তার বিরক্তি লাগে।কত চেষ্টা করছে এই অভ্যেসটা ছাড়াতে–কাপের পর কাপ রং চা খেয়ে,হাঁটাহাঁটি করে তবুও লাভ হয়নি।অতঃপর
মোটা শ্বাস টেনে এক নিমিষে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল হয়।ইমতিয়াজ হাত থেকে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে সুড়ং হয়ে দাড়িয়ে যায়।অবাক চোখে ভুট্টো পোদ্দারকে বলল,
“বাবা,তোমার মাথা খারাপ?এসব তুমি কি বলছ!?”
তিনি চায়ে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেন,
“যা বলছি ঠিকই বলছি।অরুন আমার ছেলে।সে যাই করেছে ভুল করেছে এবং তার জন্যে সে নিজেই নিজের কাছে অনুতপ্ত।আমি তার প্রতি কার্পণ্যতা হয়ে তাকে শাস্তি দিতে পারি না।”
“ও ওর কাজের জন্যে অনুতপ্ত হয়েছে?এই তোমার ধারনা!আরেহ তুমি ওর অভিনয় বুঝ?তোমার ছেলে অভিনয় করছে অভিনয়! যাতে এখন মুক্ত হয়ে পরে আবার ওই অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পরতে পারে।বুঝলে?তুমিতো বুঝবে না।অন্ধ ভালোবাসো তো এজন্যে ওর এতো পাখনা গাঁজিয়েছে! ”
পাশ থেকে রুমকি ইমতিয়াজকে থামানোর চেষ্টা করছে।বলল,
“আহা,তুমি এত কথা বলছ কেন?বাবার যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করবেন।”
“রুমকি, তুমি জানো না আমি যেদিন আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ ব্যাক করি সেদিন ও আমার সাথে এমন সুন্দর মিথ্যা বানিয়ে বলল অবিশ্বাস করার মতো নয়।আমিতো ওকে সেদিন বিশ্বাসই করে ফেললাম।সত্যিকার অর্থে জানতামই না যে ও এসব অনৈতিক কাজে জড়িয়ে সাধু সাজছে।বসে বসে অন্যের দোষ দিচ্ছে!”
“প্লিজজ চুপ করো।বাবা আছেন না? যা বলার যা করার বাবাই করবেন।”
“প্রশ্রয় পেয়ে মাথা চড়ে বসে আবার আমাদের পরিবারের বুকে গুলি মারতো সেটাই চাচ্ছ?”
“আহা,ইমতিয়াজ বাবা,কথা বাড়াস না।সুন্দর মতো খেয়ে উঠে যা!”(তোহিয়া রাণী)
” আন্টি,আমি কথা বাড়াচ্ছি না।আমি তোমাদের সবার সামনে সাফ সাফ কিছু কথা বলে দিচ্ছি…
বাবা যদি ওকে কোনো শাস্তি না দেয় তাহলে বলবো উনি ওকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি।সঠিক শিক্ষার অভাবে আজ ও এরকম অনৈতিক কাজ করার সাহস পেয়েছে।দ্বিতীয়ত, দেশের মানুষের কাছে ঠায় মিলবে কি না ভাবতে বলো।উনার ছেলে দোষ করল আর সাফাই গাইলো আমার ছেলে নির্দোষ।দেশের জনগণ কি এতই বোকা যে যাই বলবে তাই মানবে!তাই নিজের আভিজাত্য, খ্যাত,যশ,সম্মান সব ধরে রাখতে চাইলে বলো ছেলেকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতে।আর তার প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে।নাহলে নিজের স্বার্থকতার জন্যে অন্যের ভালোবাসা হারাবে!”
বলেই ইমতিয়াজ বসে থাকে নি।খাবার প্লেটে রেখেই চলে যায়।তোহিয়া রাণী,রুমকি সেদিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে।ভুট্টো পোদ্দার ও সেদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে একটা নিঃশ্বাস ফেলেন আর আক্ষেপ হৃদয়ে বলেন,
“ও তো ওর মায়ের পেটেরই ভাই।আমার থেকেতো ওর বেশি মায়া হওয়ার কথা।কিন্তু আফসোস, ছেলেটা এটাই বুঝলো না যে মানুষ সর্বদিক দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়না!”
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৩৫(পাওনা পর্ব)
রোকসানা আক্তার
আজকের নাস্তাটা ঠিকঠাকমতো কারোই করা হয়নি।একেতো ইমতিয়াজ অর্ধ খাবার রেখে চলে গেল তারউপর ভু্টো পোদ্দার চা,ডিমের অমলেট,রুটি,ফল সবকিছু ফেলে গুমোট মুখরে বসে রইল।এহেন কান্ডে বেচারী তোহিয়া রানী এবং রুমকি প্রায়ই নিস্তব্ধ।ইচ্ছে করেও যে পুরো খাবারটা শেষ করবে সে জো টুকু ছিলনা।সবার হট মেজাজ দেখে তাদের মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল।
তোহিয়া রাণী বাপ-ছেলের এমন কান্ড দেখার অপেক্ষা না করে অরুনের জন্যে খবার নিয়ে উপরে চলে যান।দরজার সামনেই এসে বুঝলেন অরুন এখনো ঘুমচ্ছে। তিনি ভেতরে ঢোকে নাস্তার ট্রে টি-টেবিলের উপর খুব আলতোভাবে রাখেন।তারপর জানলার দিকে এগিয়ে যান।গ্লাস খুলে দিয়ে পর্দা গুলো সরাতেই অরুনের চোখমুখে সূর্যের মৃদু রোদ চেয়ে যায়।হঠাৎ রৌদ্রের তাপ চোখে পড়ায় অরুন ঘুম জড়ানো চোখে তা উপলব্ধি করতে পারে।চোখের পাতা মেলার চেষ্টা করে। পারে না।তোহিয়া রাণী সেদিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকেন।মনের অজান্তে ঠোঁটের কার্নিশ বেয়ে একটা হাসি ফুটে ওঠে উনার।সেই ছোটবেলায় অরুন যখন খুব ছোট ছিল তখন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতেই চাইতো না।তিনি কত কি করতেন! এই চোখে পানির ঝাপসা দিতেন,ঘুমাবস্থায় দু’হাত ধরে সোজা উঠিয়ে বসাতেন। অরুন বসে বসে টলমলে চোখে দুলতে থাকতো।সে-কি ঘুম!ঘুমে চোখজোড়া খুলতেই পারতো না, সাথে দু’খানা গোলাপি ঠোঁটও থরথরে কাঁপতো।আর ফর্সা মুখে কালো কচকচে চুলগুলোও কপালের উপর উপচে পড়তো।সে দৃশ্যটা তোহিয়া রাণী খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতেন। ঠোঁট কাঁপার মাঝে মুখের ভেতরটা লাল টকটকে দেখাতো যেন পুরো মুখটাই লাল গোলাপে ফুটে আছে।এতটাই মনোমুগ্ধকর ছিল সে দৃশ্য!তোহিয়া রাণী অপলক চাহনিতে অরুনের সেই সুন্দর মুখখানার দিকে তাকিয়ে সংকুচিত বোধ করতেন ছেলেটার তো নজর লেগে যাবে ভেবে।তাড়াতাড়ি হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটি কাজল বের করে কানের পেছনটায় লাগিয়ে দিতেন।আর কপালে একটা চুম্বন দিতেন।
আজও অরুনকে সেই ছোটবেলার গোলাপ মনে হচ্ছে।ছোটবেলার প্রতিটি প্রতিকৃতি এখনো যেন ঠোঁট, নাক,গাল,কান,গলায় ছিটে আছে।তোহিয়া রাণী ধীরপায়ে অরুনের কাছে যান। নুইয়ে কাঁধে হাত রেখে খুব মিহি গলায় অরুনকে ডাকতে থাকেন।
“অরুন আব্বু?আব্বু?এই আব্বু?”
অরুন নড়েচড়ে উঠে।ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
“খালামণি ঘুম আসছে।”
“আহা আব্বু,এত ঘুমালে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
“হলে,হউক।প্লিজজ খালামণি ঘুমাবো।”
“আমি কিন্তু তাহলে রাগ করে এ বাড়ি থেকে চলে যাবো।”
অরুন ঘুমকে পাশ কাটিয়ে তড়িঘড়ি উঠে বসে।চোখ ঢলতে ঢলতে বলল,
“খালামণি এটা বলো না।আমি এখনই যেয়ে হাতমুখ ধুঁয়ে আসছি।”
বলেই ঢিলেঢালা অবস্থায় বাথরুমে চলে যায়।তোহিয়া রাণী হেসে দেন।বলেন,”পাগল ছেলে একটা।”
তারপর চলে যান।অরুন ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে বসে।চায়ে চুমুক দেওয়ার সময় ফুলমতির আওয়াজ আসে।দরজার কার্নিশ ঘেঁষে উঁকি দিয়ে বলল,
“ভাইজান ভেতরে আমু?”
অরুন খাওয়ার দিয়ে মনোযোগ দিয়ে জবাব প্রদান করলে।বলল,
“আসো।”
ফুলমতি কোমর নাঁচিয়ে নাঁচিয়ে ভেতরে ঢোকে।ফুলমতীর এ বাড়িতে গোছগাছ করা,ঝাঁড় দেওয়ার কাজ।বয়স বেশি হবে না আটারো/উনিশ।বিয়েসাদী এখনো হয়নি।তার অভ্যেস আছে যখনি অরুনের রুমে আসবে তখনি কোমরের দিকটায় শাড়ির কিছু অংশ অনাবৃত করে রাখবে।উদ্দেশ্য অরুনকে আকর্ষিত করা।ফুলমতী রুমে আসলে অরুন কখনোই ফুলমতীর দিকে অন্যচোখে তাকায় নি বা তাকানোর চেষ্টাও করেনি।নিজের দরকারি দু-তিনটে কথা ছাড়া কথাও বলেনা।নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।তাই ফুলমতীর প্লানটা বরাবরের মতোই বিনে পানিতে যায়।আজও ব্যতিক্রম হয়নি।কালো একটা জর্জেট শাড়ি পড়ে এসছে।একেবারে কোমর থেকে নাভি পর্যন্ত দেখা যায়।গায়ের রং ঘোর হওয়ায় শাড়িতে ওতোটা ফুটে ওঠেনি।।
কোমর নাচিয়ে নাচিয়ে বলল,
“ভাইজান,হরেন একটু।সোফার বালিশ গুলা গোসামু।”
“বিছানাটা অগোছালো। ওইটা আগে গোছাও।”
“উহহ,ভাইজান আমার অভ্যাস। একটা আগে সোফা গোসামু,হরে বিছানা।”
“দেখতেইতো পাচ্ছ খাচ্ছি!”
“আচ্ছা আমি দাইড়া থাকি।আপনে খাওন শেষ করেন।”
“দাড়াতে হবে না।টুকটাক জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলো।”
“ক-কিন্তু ভাইজান..”
“নো এক্সকিউজ। যেটা বলছি সেটা করো।”
ফুলমতী আর কথা বাড়াতে পারলো না।বাধ্য হয়ে ড্রেসিং টেবিলের জিনিসপত্রে হাত লাগালো।মনে মনে বলল,
“ঢং,দ্যাখায়।কিছু একটা কইলেই হের উল্টাডা কয়।কয়দিন হরে জেলে যাইয়া আধমরা হইবো এহনো বাহাদুরি ছারে না।আমি এত্ত সুন্দর একটা মাইয়া আমারে দেইখাও একটু টলে না।ভাব যত্ত!”
অরুনের খাওয়া প্রায়ই শেষ হয়ে আসলে বিছানার উওর ওর ফোনকল বেঁজে উঠে।ফুলমতী সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইজান আপনের কল আইসে।”
বলেই বিছানার দিকে যায় ফোন এগিয়ে দিতে।অরুন মাঝপথে থামিয়ে দেয়।বলল,
“তোমার দিতে হবে না।আমিই নিচ্ছি।”
উঠে গিয়ে নিজের ফোন অরুন নিজেই তুলে নেয়।আবরার কল করেছে।অরুন কল রিসিভ করে বারান্দার দিকে চলে যায়।আবরার বলল,
“অরুন কি অবস্থা তোর?ঠিক আছিস তুই?”
“এইতো।কোথায় তুই?”
“আমিতো হলে অরুন।ক’দিন নাগাদ হলেই থাকছি।
মিডটার্ম এক্সামের প্যারায় আছি রে।
নেক্সট মান্ডে এক্সাম শুরু হবে। তাছাড়া,বাসায়ও তেমন যাই না।কাল হঠাৎ করেই মা এ ব্যাপারে আমায় বললেন।শুনে আমি একদমই শকড।আচ্ছা শোন,তোকে ওই অশ্রু মেয়েটাই ফাঁসিয়েছে,না?”
অরুন প্রসঙ্গ পাল্টায়।বলল,
“পরিক্ষা কী সকল বর্ষেরই হবে?”
“আরেহ নাহ!শুধু আমাদের ফোর্থ ইয়ারের।”
“ওহ।”
পরিক্ষার প্রসঙ্গ টেনে আনার কারণ ছিল অশ্রুর পরিক্ষার কথা জানতে।আবরারও অশ্রুর ভার্সিটিতে অনার্স করছে।তাই অশ্রুর যদি মিডটার্ম এক্সাম থেকে থাকে থাকলো তাহলে ব্যাপারটা তারজন্যে ক্রিটিকাল হয়ে দাড়াতো।আবরার ওপাশ থেকে বলল,
“অরুন,আমি তোদের বাসায় আসবো।একটা বিষয়ে মিট করতে।”
অরুন খুশিতে ডুগডুগি খায়।কতটা মাস হয়ে গেলো আবরার তাদের বাসায় আসেনি।আজ আকস্মিক আসার কথা শুনে খুশি হওয়াটা স্বাভাবিক।হাসি চেপে বলল,
“সত্যি আসবি?”
“হু।”
“কখন?”
“এই এক/দু ঘন্টা পর।”
“আচ্ছা আস। ইমতিয়াজ ভাইয়া মে বি বাসায় নেই।”
“উনি থাকলেও আমার সমস্যা নাই।তোর বিপদের সময় আমি অন্যের উপর রাগ চেপে এভাবে দূরে থাকবো তাতো হবে না।”
“বাহ,খুশি হলাম।তাড়াতাড়ি আসিস,দেরী করবি না।”
“অবশ্যই না”
অরুন কল রেখে ভেতরে ঢুকতেই ফুলমতী বলে উঠলো,
“ভাইজান,আবরার ভাই আইবো?”
“হয়তো।”
ফুলমতী দাঁত চেপে হাসে।অরুন ভ্রু কুঁচকায়।বলল,
“হাসার কি হলো?”
“ওইযে আবরার ভাই আইবো।ইমতিয়াজ ভাইতো দেখবো!”
“তো?!তোমাদের কোনো কাজকর্ম নেই নাকি?নিজের কাজ ফেলে অন্যের বিষয় নিয়ে তামাশা করা কোনধরনের বদভ্যাস!?তাড়াতাড়ি সব গোছগাছ করে বেরিয়ে যাও!”
বলেই অরুন রুম থেকে বেরিয়ে যায়।তারপর ছাদে গিয়ে রেলিং ধরে দাড়ায়।দাড়িয়ে আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা করে।হুট করে একটা মেসেজ টোন বাঁজল।অরুন ভ্রু বেঁকে সেদিকে তাকায়।মুহূর্তেই চোখে-মুখে চিকচিক করে উঠে।মেসেজটি অশ্রুর!”
চলবে…
(আকর্ষণটা থাকুক আজ।কাল জানবেন।আবরার আসলে বোধহয় আরো জমবে।😁😁😁।)
চলবে….
(ভুট্টো পোদ্দারের চরিত্রটা সম্পূর্ণই নিজের ছেলের প্রতি অতি ভালোবাসায় নিজের স্বার্থকতাকে আগে দেখেছেন।আলোচ্য চরিত্রে এটাই ফুটে উঠলো।আর হ্যাঁ
যদি সম্ভব হয় একটা বোনাস পর্ব দিয়ে দিব।)