একটুখানি বিশ্বাস পর্ব ৩৬+৩৭

একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৩৬
রোকসানা আক্তার

অরুন অধীর মনে মেসেজটি চেইক করে।লেখা-”কিছু জানালেন না যে।”
মেসেজটি করার সার্বিক অর্থ বুঝতে পারল অরুন যদিও তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার প্রয়োজন বোধ করেনি।পরক্ষণে ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভেবে একগাল হেসে দেয়। অশ্রুকে রাগিয়ে দিতে এর পাওল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে।লিখে পাঠায়,
“কি জানাবো?”
পাঠিয়েই অরুন হাসি থামাতে পারেনি।অশ্রুর প্রতিক্রিয়ার জানতে অপেক্ষা করতে থাকে।অশ্রু মেসেজটি পড়ে যেন বোকা বনে হারালো।কাল সন্ধেইতো কী সুন্দর করে বলল টেনশন না নিতে।সব ঠিক হয়ে যাবে।আর এখন এমন ভান করছে যেনো কিছুই বলেনি বা শুনেও নি।আসলেই গো এদের মন বোঝা বড় দায়!
অশ্রু আর কোনো মেসেজ দেয় নি।রাগে-ক্ষোভে মোবাইলটা একপাশে ছিটকে ফেলে।কিছুক্ষণ চুপ হয়ে বসে থাকার পর নিস্তব্ধতার ঘোর কারে পারুল বেগমের মোটা গলার ডাকে।মায়ের মোটা গলার আওয়াজে দু’খন্ড রাগ চেপে বসে মাথায়।ভালো সময় বোঝে না খারাপ সময়ও বোঝে না প্রায়ই ডেকে ডেকে হয়রান।যেনো বাসায় কেউ মারা পড়েছে।একটু যে নিরিবিলি বসে একাকীত্ব সময়টা পার করবে সেটুকু সুযোগ টুকুও হয়না।অতঃপর একরাশ বিরক্তি নিয়েই বিছানা ছেড়ে বাইরে যায়।
“সবকিছু কি গোছগাছ করে ফেলেছিস?”
“কিছুটা বাকি আছে।”
“আজ আর করা লাগবে না।পরসু করিস।”
মায়ের কথা শুনে চোখদুটো তাঁক করল উনার দিকে।বলল,
“বিপুল ভাই নাকি আজ আসবেন!”
“আজ আর আসবে না।হরতাল বসেছে।তাই আসতে দু’দিন দেরী হবে।”
“ওহ।”
“আর শোন…?”
“বলো।”
“এ দু’দিনে বাসা থেকে মোটেও বের হবি না।বারান্দায় যাবি না।প্রয়োজন হলে বারান্দার জানলা, দরজা বন্ধ রাখবি।বুঝতে পেরেছিস?”
অশ্রু প্রসঙ্গ পাল্টায়। বলল,
“বাবা অফিসে চলে গিয়েছেন?”
“হু।”
“নুজিফা?”
“স্কুলের জন্যে রেডি হচ্ছে।”
‘আমি যা বললাম মাথায় ঢুকেছে?”
“মোটামুটি।”
“মোটামুটি না পুরোপুরি ঢোকা।এ ক’দিনে আল্লাহর উপর তোয়াক্কেল করে নিজেকে সুরক্ষিত রাখলেই হবে।পরে চট্রগ্রাম চলে গেলে আর টেনশন নাই।”
অশ্রু দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে তার মায়ের কাঠিন্য মুখের দিকে তাকায়।ইদানীং তার মায়ের মাঝে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে।আগে হাজারটা খুনসুটি থাকলে গাঁয়ে মাখতো না।বাবার সাথে সম্মতি না হয়ে পাল্টা জবাব দিত।অথচ আজকাল তার বিপরীত।এইতো কিছুদিন আগের ঘটনা।সেদিন আলাউদ্দিন খুব রাত করে বাড়ি পেরে।দেরী আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন,
“একটা ক্রিমিনালকে নিয়ে বিপাকে পড়েছি।তার বিরুদ্ধে হাতে রিপোর্ট লিখতে লিখতে সময় চলে যায়।তবুও বেটার অপরাধের কথা লেখা শেষ হয় নাই।আমার মাথায়ই আসছে না একটা মানুষ এতগুলা অপরাধ কিভাবে করতে পারে!”
তা শুনে অশ্রু অনেকটা ভয় পেয়ে যায়।চমকে বাবার পাশে বসে।বলল,
“বাবা তুমি যে এধরনের রিপোর্ট লিখেছো তোমার কোনো ক্ষতি হবে নাতো?”
তৎক্ষনাৎ পারুল বেগম তার টাসটাস গলা ছেড়ে দেন।হুংকার মেরে বলেন,
“কি যে বলিস!ভয় পেলে চলবে?এগুলার অপরাধগুলো যদি জনগণকে না অবহিত করে তাহলে দেশে দিনেক দিন অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাবে।আর তখন এগুলা আরো মারাত্মক মারাত্মক অপরাধ করতে ভয় পাবে না।এগুলারে নস্যাৎ করতে হলে বুকে সাহস রেখে হলেও সামনে চলতে হবে।বাঁধা, ভয়,বিপত্তিতে কাবু হলে চলবে না।”
আলাউদ্দিন পারুল বেগমকে ছ্যাঁতিয়ে দিতে বিপরীত বলেন,
“মুখ দিয়ে এমন সাহসের বড়াই সবাই গাইতে পারে।বাস্তবে এস প্রতিফলন ঘটাতে সেও চিপা হয়ে যায়..এই যেমন তোর মা!”
“হা হা হা হা হা।”
“আমাকে নিয়ে উপহাস করা হচ্ছে?আমি ঠিকই বলেছি!”
“বলোনি।বলেছো আন্ডা!”
তারপর বাপ-বেটির তামাশা দেখে রাগে-ক্রোধে ফেটে চৌচির।পারুল বেগমের একটা অভ্যেস আছে যখন তর্ক করে পেরে উঠতে না পারে তখন জায়গা ত্যাগ করে।
অশ্রু বিচক্ষণ চোখে মায়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।সন্তানের সুরক্ষার জন্যে কতই রূপ এদের।সন্তানের কিছু হলে যেন পৃথিবীটা লন্ডবন্ড হয়ে যাবে।এদের ভালোবাসার কখনো মাপকাঠি হয়না গভীরতা অতল!নিঃশব্দে একটা ঢোক গিলে নিজের রুমে আবার চলে আসে অশ্রু।বিছানার উপর ফেলে রাখা মোবাইলটা কাঁপা হাতে তুলে নেয়।ডিসপ্লে অন করে।অরুন আর কোনো মেসেজ দেয়নি!মনে কিঞ্চিৎ আশা থেকেও তা ছাড়তে হলো।

অরুন অশ্রুর অপেক্ষায় চেয়ে থাকতে থাকতে আবরারের উপস্থিতিতে তার অবসান ঘটলো।দু’ঘন্টার জায়গায় আড়াই ঘন্টা লেগে গেলো আবরার আসতে।অরুন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এই তোর আসার সময় হলো?”
“অপেক্ষা করেছিস অনেক।তাই না?”
“জানলে আবার প্রশ্ন করছিস কেন!”
আবরার চোখমুখে হাত রেখে মাথা উঁচিয়ে হাসল।বলল,
“আচ্ছা,আই’ম স্যরি ফর লেট!”
“বললেই হলো?”
আবরার চুপচাপ দাড়িয়ে কিছু একটা ভাবে।হঠাৎ মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপে। বলল,
“এই তোর ফোনটা দে তো আমায়?”
“কি করবি আমার ফোন দিয়ে?” ভ্রু উঁচিয়ে।
“দরকার আছে।”
“ক-কি দ-র….
অরুনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত থেকে হাতরে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে নেয়।ওমনি ইনবক্সে ঢোকে।ঢুকেই চোখ জুড়ানো কনভারসন দেখতে থাকে।অরুন হাতরা হাতরি করে মোবাইল নিতে কিন্তু ব্যর্থ। আবরার চোখ রাঙ্গিয়ে বলল,
“খুব কথা হচ্ছে বুঝি?”
“ম-মানে?”
আবরার মোবাইলটা অরুনের সামনে তুলে ধরে বলল,
“মিস অশ্রুর কথা বলছি।”
“ওই আর-কি একটু আধটু।দরকারি কথা বলি।”
আবরার হো হো হো করে হেসে উঠে।
“হাসছিস কেন!”
“হাসির কথা বলছিস।হাসি তো আসবে!”
“মাথা খারাপ করতে আসছিস এবার বুঝলাম।”
“মাথা তো তোর এমনিতেই খারাপ।মেয়েটা তোকে এই পরিস্থিতিতে ফেললো তারপরও ওর সুরক্ষার কথা ভাবছিস!ইউ আর ভেরী ট্যালেন্টেড ম্যান!”
“মোবাইল দে আমার!”
“কথাতো এখনো শেষ হয়নি!”
“বলতে বলিনি।”
অাবরার মোবাইলটা অরুনের হাতে দিয়ে এবার সরু হয়ে দাড়ায়।ভদ্রবেশে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে বলল,
“অনেক ভালোবাসিস তাই না?”
অরুন চুপ হয়ে থাকে।আবরার পকেট থেকে হাত বের করে এবার বুকের সামনে ভাঁজ করল।বলল,
“জানি, উত্তর করবি না।কিন্তু ফ্যামিলির কথা ভাবলে দ্যাট’স অল ইম্পসিবল।আর তোদের কথা ভাবলে দ্যাট ইজ পসিবল।”
“আমার মাথাটা যেন বাজখাঁই। ভেবে উঠতে পারছি না কিছু।”
“আঙ্কেল চাচ্ছেন তুই জেলে যেতিস না।আর তুই চাচ্ছিস যেতে।রাইট?”
“ঠিক ধরেছিস।তবে,জানলি কিভাবে?”
“মা আমায় সব আপডেট জানান।আজ ইমতিয়াজ ভাইয়ার সাথে আঙ্কেলের যে তর্কাতর্কি হয়েছে তাও জানি।”
“আমিতো এ ব্যাপারটা জানতাম না।”
“জানবি না তুই তখন ঘুমে ছিলি।”
“আচ্ছা, আমায় বলতো ব্যাপারটা..।”
আবরার অরুনকে সবটা খুলে বলল।অরুন চোখমুখে একরাশ অনুশোচনা ফুটিয়ে বলল,
“হুম।ভাইয়ারও বিশ্বাস ভেঙ্গে ফেললাম।জীবনে কতবড় পাপ করলাম ধারণাই ছিলনা।”
“এখনতো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস।”
“বুঝেও কি লাভ! প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করলেই পূর্ণতা পাবো।নাহলে সারা জীবন মনে একটা অপরাধী বোধ থেকে যাবে।”
“সারেন্ডার্ড করেই ফেলবি?”
“হু!”
“আঙ্কেলের বিষয়টা?”
“কিভাবে মানবো বল?বাবা অশ্রুকে এই কেইসে এমন ধারায় টানবে এখন নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে খুব!”
“ওটা নিয়ে প্রবলেম নেই।তুই ওইটা সামলাতে পারবি!”
“কিভাবে?”
“মোবাইল দে।”
“আবারো?কি ভেজাল মেশাবি আল্লাহই জানেন।”
“ভেজাল মেশাবো না প্রটেক্ট করবো।বুঝলি?”
অরুন ভ্রু উঁচায়।আবরার বলল,
“বেচারীকে অর্ধ কথা বলেতো লটকে রাখলি!এবার মেসেজগুলো তোর হয়ে আমিই করি!”
“এই না আবরার!”
অরুনের থেকে মোবাইলটা নিজের হাতে দখল করে
অরুনের নাম দিয়ে তরহর অশ্রুকে মেসেজ করতে থাকে।অরুন বাঁধা প্রদান করতে যেয়েও আবরারের দমকে চুপ হয়ে যায়।

টোন টোন শব্দ কানে আসতে অশ্রু চমকে উঠে।বাম সাইডে ফিরে তড়িঘড়ি মোবাইল হাতে নেয়।অরুন পাঠালো,
“খুব রাগ করেছো,না?রাগ করবে না একদম।তোমার কিছুই হবে না আমার উপর ভরসা রাখো!”
অশ্রু ভাব নিয়ে একটু। লিখলো,
“এত ঢং করবেন নাতো!এধরনের ঢং আমার পছন্দ না!”
“আহা রেগে আছো কেন?এই অরুনের প্রতি তোমার বিলিভ হয় না বুঝি?”
অশ্রু দুইজোড়া ভ্রু এক করে।মনে মনে ভাবল,ব্যাপার কী মুখের ভাষা হুটহাট এত চ্যান্জ!হাউ স্ট্যান্জ ম্যান হি!সত্যিই বোঝাই দায়!
ভাবনা শেষ করে নিজেকে শক্ত মোডে আনে। পাঠালো,
“স্যরি আমি আর আপনার সাথে কথা বলছি না।ইউ’র ভেরী লায়ার্ড পার্সোন।”
“ওকে বিলিভ হয় না।তাইতো!একটা রিকুয়েষ্ট রাখবে আমার?”
“কেমন রিকুয়েষ্ট?”
“বলছি…
আবারো পাঠায়,
আজতো হরতাল।রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল খুবই কম।আমি চাচ্ছি একটু বের হবো তোমার সাথে দেখা করতে!”
“হোয়াট!?”
“অশ্রু আমার বাবার ওই ব্যাপারটা নিয়ে তোমার সাথে একটু নিরিবিলি একান্তে কথা বলতে চাচ্ছি।আসলে বাসায় কথা বলতে প্রবলেম হচ্ছে।বাবা আমার রুমের চারপাশে সিকিউরিটি গার্ডের পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা অন করে রেখেছেন।অবশ্য তিনি ইদানীং আমাকে সন্দেহাবসরে দেখছেন ওই নিউজগুলোয় সারেন্ডার্ড করায়।তাই এই মুহূর্তে তোমার সাথে ক্লিয়ারলি কথা বলা হয়ে উঠছে না।আমার একটা কাজিন আছে।বাবাকে কিছু একটা বুঝিয়ে কাজিনকে নিয়ে বের হবো।”
অশ্রু মেসেজটা পড়ে থম মেরে যায়।আবারো টোন বাজল,
“প্লিজজ অশ্রু?”
অশ্রু নাজেহাল অবস্থায় পড়ে।সেও তার মাকে কি বলে বাসা থেকে বের হবে ভেবে উঠতে পারছে না।উপায় একটা বের করতে হবে। নাহলে সবার কথার যাতাকলে পড়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হবে!তাছাড়া,অরুনের কথাও কি হুটহাট বিশ্বাস করা ঠিক? এ যদি তার কোনো ফাঁদ হলো,তখন?
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৩৭
রোকসানা আক্তার

কারো আবেগী কথা অনেক সময় সুযোগ সন্ধানের হাতিয়ার হয়ে থাকে।বিপদগ্রস্ত মানুষ নিজের সমস্যার সমাধান না করে প্রতিপক্ষের ভালো চাইবে এমনতো হয়না।অনেক সময় দেখা যায় তা ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার মতো অবস্থা! তাহলে বিশ্বাস করাটাও একপ্রকার সন্দিহান হয়ে দাড়ায়!চোখবুঁজে ভাবতে থাকে অশ্রু।
“অরুনের সবকথা কি বিশ্বাসের সামিল?মোটেও নয়।শত শত যুগ একই মানুষের সাথে একই প্রহরে কেটে গেলেও তাঁকে বোঝা যায় না।তাহলে স্বল্প কথা স্বপ্ল চেনা একজন মানুষকে কিভাবে বিশ্বাস করা যায়!”
চোখজোড়া খুলে জোরে একটা দৃঢ় নিঃশ্বাস ছাড়ে অশ্রু।চোখের দৃষ্টি বাতাসে নড়া পর্দাগুলোর দিকে স্থবির করে আবারও ভাবনাতে চলে যায়।ইদানীং তার হলোটা কি!অরুনের প্রতি সহানুভূতি হওয়া।দুই ফোড় কথাতেই ভরসা করা।কথা বলতে মনের ভেতরটা আকুপাকু দিয়ে ওঠা,সময়-অসময় তাকে নিয়ে ভাবা এই সবটাকে কি বলে?একটাতো নাম দেওয়া যায় তাই না?আচ্ছা কি দেওয়া যায়?গালে তর্জনীর রেখে ভাবে!
“হুম পেয়ে গেছি।আবেগ!আবেগের বশে অরুনকে নিয়ে ভাবনার জগতে বিরাজ করছি নাতো?”
সারা শরীর শিরশিরে কাঁটা দিয়ে ওঠে অশ্রুর।তৎক্ষনাৎ মুঠোয় চাঁপা ফোন অন করে অরুনের নাম্বারে মেসেজ করে,
“স্যরি আমি বেরুতে পারবো না।এতবার রিকুয়েষ্ট করে খামোখা মুখ খোয়াবেন না!”
আবরার বিষম খায়।ভ্রু দু’টো হালকা উঁচিয়ে কাহিল মনে বলল,
“দাৎ,মেয়েটা অনেক শক্ত!”
অরুন আবরারের দিকে হালচোখে তাকায়।বলল,
“হঠাৎ এ কথা বললি যে?”
“মেসেজগুলা দেখ।”
বলেই অরুনের দিকে মোবাইল এগিয়ে দেয়।অরুন মোবাইল হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে মেসেজগুলো পড়তে থাকে।পড়েই চোখদুটো ছানাবড়া। অবাক চোখে আবরারের দিকে তাকায়।বসা থেকে দাড়িয়ে রাগী গলায় বলল,
“এটা তুই কি করলি আবরার?”
আবরার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অরুনের দিকে দৃষ্টি ফেরে।ধাঁধায় পড়ার মতো ভান করে বলল,
“কি করলাম?”
পাল্টা প্রশ্নে অরুনের তেলে-বেগুনে অবস্থা!নিজেই বুঝে উঠছে না আবরারকে কি বলবে!কিসব মেসেজ করলো অশ্রুর সাথে?অশ্রু যদি এখন তাকে খারাপ ভেবে বসলো!এমনিতেই তো ঘৃণা চোখে দেখে তারউপর এমন রসিকতা খাটে!অস্থির মনে চুলগুলো আঁকড়ে ধরে।বলল,
“বেশি ফাজলামো না করা ছাড়া তোর তৃপ্তি মেটে না।জানতাম যদি এমন বাঁশ দিবি তাহলে এতটা খুশি হতাম না!”
বলেই একটু থামে।তারপর আবার বলল,
“জায়গা দে।শোব!”
“এই অবেলায় ঘুম পাচ্ছে তোর?হা হা হা হা হা।ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ আমিতো ভুলেই গেলাম তুই যখন বেশি টেনশন করিস তখন তোর চোখে ঘুম চলে আসে।”
“প্লিজজ আবরার কথা বাড়াস নাতো!জায়গা দে!”
আবরার বুঝল অরুন ক্ষেপে গেছে।তারউপর অশ্রুর মনোভাবের প্রশ্নে টেনশন করছে। এখন এক লাদাখ না ঘুমলে মনকে শান্ত রাখতে পারবে না।তাই ঘুমুতে দেওয়া উচিত পরে নাহয় বুঝিয়ে বলা যাবে।
ভেবেই বিছানার কর্ণারে এসে বসে আবরার।আর বলল,
“জাস্ট একঘন্টা সময় দিলাম এরইমধ্যে শোক পালন কর।পরে জাগলে বিষয়টা তোকে ক্লিয়ার করবো।”
“লাগবে না।”
বলেই বিছানার উপর উৎভাবে গাঁ এলিয়ে দেয়।পাশের কোলবালিশ টেনে বুকের নিচে নিয়ে নেয়।সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে আবরার মৃদু হাসে।তারপর রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

অরুন ঘুমোয় নি।তবে ঘুমা ঘুমা ভাব।ঘুমুতে ইচ্ছে হয়না এখন।আবরারের পাঠানো মেসেজগুলো বারংবার হৃদয়ে ঠকঠক শব্দ তুলছে।লাস্ট মেসেজে অশ্রুর কড়া বারণে অরুন বিচলিত,বাকরুদ্ধ।রাগটা বোধহয় এখানেই থেকে গেল তার আবরারের প্রতি।তা আর আবরারকে বুঝতে দেয়নি।কি দরকার ছিল এধরনের মেসেজ করা?এধরনের মেসেজ না করলেতো আর অশ্রু এমনটি বলতো না।তাছাড়া অশ্রুরও এখানে দোষ দেওয়া যায় না।বলা নেই কওয়া নেই হুটহাট একজন শর্ট-নউন পার্সোনের এমন অফার একসেপ্ট করার মতো মেয়েতো অশ্রু নয়আর আবরার গাধা সেটা বুঝলো না!
ভেবেই অরুনের মনে আরেকটা কম্পন নড়ে উঠে।মেসেজগুলো এখন একান্তে নিরিবিলি আরেকবার দেখবে। তখন আবরারের উপস্থিতিতে কি থেকে কি দেখলো!
মাথা থেকে খানিক দূরত্বে ধপসে ফেলা মোবাইলটা হাতে চেপে নেয়।নিবু নিবু চোখে মেসেজগুলোতে আরেকবার চোখ বুলায়।মনের গোপনে পড়ার মাঝে কখন যে অতল ঘুমে তলিয়ে যায় তা টেরই পায়নি।

“অরুন ঘুমায়?”
“হুম,মম।”
“এসময়ে ঘুম!
বলেই আবরারের পাশে বসেন।চিন্তিত গলায় আবারো বলেন,
কিছু হলো নাকি তার?”
“নাহ মা।এই বললো আর কি শরীরটা খুব ক্লান্ত।ঘুমালে ভালো লাগবে তাই ঘুমিয়ে গেছে।”
“ওহহ।চা নিয়ে আসি থাক।”
“আচ্ছা।”
তোহিয়া রাণী কিচেনের দিকে চলে যান।আবরারের কল বেজে উঠে।বেখেয়ালে রিসিভ করে কানের পাশে গুঁজতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো,
“এই তুমি নাকি আমায় কল দাও!এখন কোথায় তুমি?”
ঝংকার শব্দ কানে ঠেকতেই আবরার ভড়কে উঠে।তড়িঘড়ি চোখের সামনে মোবাইল ধরতে দেখে নূরীর নাম্বার।থতমত খেয়ে গলায় শুকনা কাশি ভাঁজে।কাশির আওয়াজ শোনে তোহিয়া রাণী কিচেন থেকে বলে উঠেন,
“কাশছিস কেন?”
অাবরার তটস্থ হয়ে যায়।চারদিক চোখ বুলিয়ে বলল,
“ইয়ে মা-নে মম,ঠা-ঠান্ডা লেগেছে খুব!”
“কি ঠান্ডা!”
হন্তদন্ত হয়ে চায়ের কাপ ফেলে ছেলের কাছে চলে আসেন।আবরার হারপার না পেয়ে কেটে দিয়ে মোবাইলটা নিচে নামিয়ে নেয়।তিনি ছেলের কাছে বসে কপাল,গলা,মাথায় হাত রাখতে রাখতে বলেন,
“ঠান্ডা কবে হয়েছে আব্বা!আমাকে যে কিছু জানাস নি?”
“ইয়ে মানে মম,সময় হয়নি।পড়া,তাছাড়া পোলাপানপর ক্যাচর-ম্যাচরে..!”
এবার তিনি বিভোর চিন্তায় ডুবে যান।নাক টেনে টেনে বলেন,
“কত্তবার বললাম গণহলে থাকার কোনো দরকার নাই।কত পোলাপান ওখানে থাকে। বালিশ,কম্বলের টানাহেঁচড়া!শুধু পড়া পড়া নিয়ে থাকলেই হবে?নিজের শরীরতো দেখবি।বাঁচলেইতো পড়া।আর আমার কাছে থাকলে একটুতো তোকে দেখার সুযোগ পেতাম,যত্ন করতে পারতাম!”
“আহা মম,তুমি এত কাহিল হচ্ছ কেন!হালকা-পাতলা কাশি-সর্দি কিছুই না।তাছাড়া,গণহলে না থাকলে পড়ালেখার বারোটা বাঁজতো আমার।বাসা থেকে ভার্সিটিতে প্রতিনিয়ত যাতায়াত তোমার ছেলে আরো অসুখ বাঁধিয়ে আসত।এখন যে সামথিং রোগে আছি আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া আদায় করো।”
তোহিয়া রাণী বিভোর মনে নাক টানতেছেন শুধু।
“মম,প্লিজজ?আচ্ছা যাওতো আগে আমায় চা টা দাও।যাও প্লিজজ?”
“চা খাওয়া শেষ হলে ডাক্তারের থেকে কাশি,সর্দির ওষুধ নিয়ে আসিস।মনে থাকবে?”
“মনে থাকবে।”
তোহিয়া রাণী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ছেলের জন্যে চা নিয়ে আসে।আবরার চা হাতে নিতে নূরী আবারও কল করে।তোহিয়া রাণী তা লক্ষ করেন
বলেন,
“রিং হয়। রিসিভ কর।”
“আপাতত সুইচট অফ,মম।”
“কেন?”
“পাজি বন্ধু।খালি ডিস্টার্ব করে।”
“কেন ডিস্টার্ব করে?”
“ওর সাথে একটু যমুনা পার্ক যেতে।ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে নাকি দেখা করবে।একা যেতে নাকি ওর কাছে আনইজি লাগে।তাই আমাকেও সাথে গাট্রি বেঁধে নিতে চায়।আমিতো একদম নারাজ যেতে।আর এসব উটকো ঝামেলা পছন্দ হয়, বলো?”
“তুই যাবি ওর সাথে?” ভ্রু কুচকে।
“আরেহ না, মম।তোমার ভদ্র ছেলে এসব থেকে দূরে।”
তোহিয়া রাণী ভ্রু জোড়া মসৃণ করে এবার মুখে হাসি ফোঁটান।
আবরার কোনোমতে চা’টা শেষ করে।তারপর ফার্মেসী যাওয়ার নাম করে বাসা থেকে বের হয় ।বাড়ির বাইরে পা রাখতেই হাঁপিয়ে যায় আবরার।তারপর তড়িৎ বেগে ফোনটা বের করে।নূরীর নাম্বারে করে।নূরী রাগে-ক্ষোভে ওপাশ থেকে গরম মাথায় বলল,
“আমার কল রিসিভ হয় নি কেন?”
“পাশে মা ছিল নূরী!অনেকগুলো মিথ্যে বলে বাসা থেকে বেরিয়েছি” কাঁপা কন্ঠে।
“মিথ্যের কোনো অজুহাত দেখাবে না।তুমি যে ভালো মিথ্যে বানিয়ে বলতে পারো তা আমি জানি।শেখাতে এসো না।আজ কি কথা ছিল?”
“ক-কি কথা?”
“জানিতো ভুলে যাবে।ভুলা তোমার রোগ!”
“সত্যি আমার মনে নাই!”
“রাখি!”
“প্লিজজ কল কেটো না।আজ আমি খুব ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম।কিছুক্ষণ আগে হল থেকে অরুনদের বাসায় এসছি।”
“ভালো করেছ।”
“প্লিজজ রেগো না।বল।”
“আজ কি বার?”
“ফ্রাইডে!”
“ফ্রাইডে তে করবে যেন?”
আবরার ভাবতে থাকে।পরমুহূর্তে মনে পড়তেই জিব কাটে।কাঁপা গলায় বলল,
“আ-স-লে বিশ্বাস করো আজ যে তোমার সাথে দেখা করবো সত্যিই তা আমার মনে ছিলনা।আমি আজ এতটাই ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম।”
“বুঝলাম।যা হয়েছে মেনে নিলাম।এবার তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হও।আমি সাজুগুজু করে বসে আছি।আর বের হওয়ার আগে নক দিও।আমিও বের হচ্ছি।”
“আ-চ্ছা,শুনো?”
“আবার কি?”
“ন-না কিছু না।আমি বের হচ্ছি।”

দুপুরের দিকে অরুনের ঘুম ভাঙ্গে।জানলার দিকে তাকাতেই বুঝলো অনেক বেলা হয়েছে।তারপর বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যায়। চোখ-মুখে পানির কয়েটা ঝাপটা দিয়ে টাওয়ালে মুখটা মুছে নেয়।এখন চোখ থেকে ক্লান্তির ঘোর অনেকটা কমেছে। তাছাড়া শরীর-মনেও সতেজতা অনুভূত হচ্ছে।তারমানে ঘুমটা বেশই হলো।অরুন টাওয়াল টা সোফার চৌকাঠে রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে খানিক ভেঁজা চুলগুলো উপড়ে ভাঁজিয়ে নেয়।তারপর রুম থেকে বাইরে আসে।নিচে নেমে দেখে বাবা, মাহবুব আঙ্কেল, তোহিয়া রাণী কপাল চাপড়ে সোফায় নিস্তব্ধতায় বসে আছে। রুমকি তোহিয়া রাণীর পাশে দাড়িয়ে একমগ্নে একদিকে তাকিয়ে আছে।সবার চোখ-মুখ থেকে একরাশ চিন্তার আভা যেন ভেসে আসছে।অরুন কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সবার সামনে গিয়ে দাড়ায়।তারা অরুনকে দেখেও যেন দেখছে নি।অরুন নাজেহাল অবস্থায় পড়ে।সবার আবার কিছু হলো নাতো!
অতি সংগোপনে সোফার এককোণে বসে গলায় খেঁকারি টানে।বলল,
“ক-কিছু হয়েছে?”
ভুট্টো পোদ্দার বিভোর মুখে ছেলের মুখপানে তাকান।তারপর মলীন চাহনি বজায় রেখেই বলেন,
“কালরাত তোর এসপি অরূপ কুমারের সাথে কথা হয়েছে?”
অরুন ভুট্টো পোদ্দারের কথা শুনে অপরাধ চোখে একবার বাবার দিকে তাকায়,আরেকবার তোহিয়া রাণীর দিকে তাকায়।তারপর মাথাটা হালকা নিচু করে জবাব দিল,
“হ্যাঁ।”
“বাহ,ভালো কাজই তো করেছিস!এবার জেলের চারদেয়ালে থেকে থেকে জিকির করিস।”খুবই রাগ এবং অভিমানী কন্ঠে বলেন।
পাশ থেকে তোহিয়া রাণী বলেন,
“আব্বা তুই কেনো সারেন্ডার্ড করলি?উনারাতো কালই তোকে নিয়ে যাবে!”
“যেতেই কল করেছি।বাসায় আরো বেশি থাকলে পাপের বোঝা বেড়ে যাবে!”
“বাহ ছেলের মুখে দেখছি বুলি ফুটেছে!পাপ/নিষ্পাপ সংজ্ঞা কবে থেকে শিখলি শুনি?” দাঁত কেলিয়ে ভুট্টো পোদ্দার বলেন।
“অরুন,তুমি তোমার বাবার কথা,ফ্যামিলির কথা একবারও ভাবো নি?তোমার বাবা তোমাকে সেইভ করতে কত যে মরিয়া হয়ে আছে তুমি জানো?ওদিনতো এসপিকে বলেই দিলেন তোমার বাবা তেমাকে নির্দোষ প্রমাণ করে ছাড়বে এর আগে জেলে পাঠাবে না।এসপি তাই মেনে নিলো।আর তুমি কি করলে?
অরুন সোফা ছেড়ে দাড়িয়ে যায়।স্পষ্ট ভাষায় বলল,
“ঠিক করেছি আঙ্কেল।পুলিশ কালইতো আসবে আমায় নিয়ে যেতে তাইনা?আমি রেডি!
ভুট্রো পোদ্দার ছেলের দিকে হতভম্ব চোখে তাকান!তাকান তোহিয়া রাণী,তাকায় রুমকি এবং মাহবুবও।তাছাড়া বাড়ির কাজের লোকগুলোও!

চলবে…..
চলবে…
(পরে কি হতে পারে বলুনতো?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here