একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব -৭+৮

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৭
#Saji_Afroz

আজিজা বানু এসে মানতাশার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলেন। তিনি আজরার হাতে ফোন দিয়ে বললেন, মানতাশার সাথে কাজ আছে আমার।

এই বলে মানতাশা কে নিয়ে সরে গেলেন তিনি। মানতাশা অবাক হয়ে বলল, কী হলো আন্টি? এমন হাত ধরে টানাটানি করছেন কেন?
-মা হয়ে যদি এসব আমায় বলতে হয়! ওরা কথা বলছে বলুক না। তুমি কেন বিরক্ত করছ বলো তো?
-বিরক্ত! আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম।

আজিজা বানু পরমুহূর্তেই মাথা ঠান্ডা করলেন। কথা ঘুরিয়ে বললেন তিনি, আমিও তোমার সাথে মজা করছিলাম। আসলে একটা কাজে তোমার সাহায্য প্রয়োজন।
-কী কাজ?
-ঘরে আসো বলছি।

এই বলে মানতাশা কে নিয়ে তিনি ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন।
মূলত তিনি চাননি ইনতিসার মানতাশার সাথে কথা বলুক। কারণ আজ মানতাশা কে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। অনেকেই তো বলাবলি করছে, কনের চেয়েও মিষ্টি লাগছে তাকে। আর তাই তিনি মানতাশার কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়েছেন।
মেয়ের জন্য ক’দিন ধরে দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে অঘটন তো একটা ঘটবেই।
সেটা মানতাশার দ্বারাও ঘটতে পারে! বিয়ে না হওয়া অবধি তাকে চোখে চোখে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন আজিজা বানু।
.
.
.
-সাজিরের কী হয়েছে? কী হলো? কিছু বলছেন না কেন?
.
ওপাশ থেকে এইবার হাসির শব্দ শুনতে পায় নাবীহা। সে অনেকটা অবাক হয়ে যায়। হচ্ছে টা কী! রাগ নিয়েই সে বলল, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন কী হচ্ছে?

ছেলেটি আর কথা বলতে পারলো না হাসির কারণে। সে কাউকে ফোন দিয়ে বলল, আর পারছি না। ধর ফোন নে।

এইবার সাজিরের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় নাবীহা। সাজির বলছে, হ্যালো নাবু?

নাবীহা তার কণ্ঠস্বর শুনে যেন প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই সেই ছেলের কথা মনে হতেই বলল, তোমার নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে?
-আরে না।
-তো এমন একটা জঘন্য কথা কেন বলেছে?
-দুষ্টুমি করেছে।
-কে সেই ফাযিলটা?
-আমার বন্ধু!
-এটা কোনো কথা সাজির! আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানো তুমি?
-আচ্ছা বাবা স্যরি! বন্ধু মানুষ একটু মজা নিয়েছে।

একটু থেমে নাবীহা বলল, ইটস ওকে! কবে আসবে?
-আমি আজ না আসি? আসলে আমার বন্ধুটি আজই কানাডা থেকে এসেছে। সব বন্ধুরা একত্রে হয়েছি তো। বেরুতে ইচ্ছে করছে না। কাল বিয়েতে আসব পাক্কা।
-আমি আরও ভেবেছিলাম তুমি আসবে!
-ওখানে গিয়ে কী করব বলো? তোমার ফ্যামিলিরও কেউ যায়নি আজ। একা একা লাগবে আমার। যদিও তুমি আছ। কিন্তু সবাইকে ছেড়ে আমার সাথে বসে থাকলেই হবে?

সাজিরের কথায় যুক্তি আছে ভেবে নাবীহা বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু কাল অবশ্যই আসবে।
-আচ্ছা।
.
.
.
চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায় ইনতিসার। তাকে নিশ্চুপ দেখে আজরা বলল, কী হলো?

ইনতিসার অনেকটা সংকোচ নিয়েই জানতে চাইলো, আপনার বান্ধবী কে কোথাও যেন দেখেছি আমি।
-কোথায় দেখেছেন?
-দেখেছি কোথাও। উনি আপনার কেমন বান্ধবী?

আজরার হঠাৎ মনে হলো সেদিনের কথা। মাথা থেকেই চলে গিয়েছিল, নাবীহার সাথে মানতাশা কে দেখেছিল ইনতিসার৷ মানতাশা কে কী সে চিনে ফেলেছে!
-কেমন বান্ধবী আপনার?

আবারও একই প্রশ্ন করলে আজরা জবাব দিলো, অনেক ভালো বান্ধবী।

নাবীহার কথা কীভাবে তুলবে বুঝতে পারছে না ইনতিসার। আর এই মেয়েটি সেই মেয়েটিই কী না এই বিষয়েও সঠিকভাবে বলতে পারছে না সে।
আজরা ইনতিসারের অবস্থা বুঝতে পারে। তাই সে কথা কাটানোর জন্য তাড়া দিয়ে বলল, আমার অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে। পরে কথা বলি?
-নিশ্চয়।

এই বলে ফোনের লাইন কেটে দেয় আজরা। আর আপনমনে বলল সে, ভাগ্যিস সেদিন রেস্টুরেন্টে মানতাশাও আসেনি।
.
এদিকে ইনতিসারের কপালে পড়ে চিন্তার ভাজ।
সবকিছু ভুলে নতুন জীবনে মনোনিবেশ করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু আবারও নাবীহা নামক মেয়েটির কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। আজরার সাথে কী আসলেই তার কোনো সম্পর্ক আছে?
.
.
.
গতকাল বেশ আনন্দে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে আজরার। আজ তার বিয়ে। সকাল থেকেই মনের ভেতরে অন্যরকম এক অনুভূতি অনুভব করছে সে।
নানারকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়।
সঠিক সময়ে সাজ শেষ হবে তো, তাকে দেখতে ভালো লাগবে তো, ইনতিসার কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত সঠিক কি না, শ্বশুরবাড়ির সদস্য়রা কেমন হবেন, বাড়ির সবাই কে ছেড়ে সে থাকবে কীভাবে!

এসব চিন্তার জন্য নিজের উপরেই বিরক্ত সে। কেন যে মাথায় এসব ঘুরছে!

তাকে এভাবে চিন্তিত দেখে নাবীহা বলল, কী হলো?
-জানি না! হাবিজাবি চিন্তা ঘুরছে রে মাথায়।
-এটা খুবই স্বাভাবিক। নতুন জীবন শুরু করতে চলেছিস তো। আমরা নতুন কিছু করার আগে কত চিন্তাই করি। আর এটা জীবনের নতুন এক অধ্যায়। এমন মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।

-কনে কে এখানে?

আজরা কে সাজাতে চলে এসেছে। নামকরা পার্লারে আনা হয়েছে তাকে। নাবীহা তাকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, এই যে আমার বান্ধবী। এমনভাবে সাজাবেন যেন বর চোখ সরাতে না পারে!
.
.
.
সাজ শেষে ক্লাবে উপস্থিত হয় আজরা ও নাবীহা। মানতাশা অন্য পার্লারে গিয়েছিল। সে অনেক আগেই ক্লাবে চলে আসে।
আজ ক্লাবে উপস্থিত হয় নাবীহা ও মানতাশার পরিবারও।
আজরা কে স্টেজে তোলা হয়। ভারী মিষ্টি লাগছে তাকে দেখতে। সবাই তার বেশ প্রশংসা করতে থাকে। উপস্থিত অন্যান্য বান্ধবীরাও তার প্রশংসা করলে শুনলে মানতাশা বলল, লাখ টাকার শাড়ি-গয়না ও সাজ দিয়েছে। ভালো তো লাগবেই।

এক বান্ধবী বলল, ওর জামাই না কি কোটিপতি? কপাল নিয়ে এসেছে মেয়েটা। কখনো ভেবেছিস? আজরার মতো শান্তশিষ্ট মেয়ে ওমন ঘরের বউ হবে।

আরেকজন দুষ্টুমির ছলে বলল, আমি তো ভাবতাম মানতাশার এমন ঘরে বিয়ে হবে। ওকে দেখেই এমন হত। কিন্তু ভাগ্য দেখ! সুন্দর হলেই ধনীর বউ হতে পারে না। হ্যাঁ রে মানতাশা? তোর বফ এখনো জব পায়নি তাইনা?

এই বলে হেসে উঠলো সবাই।
এসব কথা শুনতে মানতাশার একেবারেই ভালো লাগছে না।
সে শুধু বলল, বফ সে। বর হয়নি এখনো। বর হলে তখন এসব গবেষণা করিস।

এই বলে সে সেখান থেকে সরে যায়। হঠাৎ চোখ পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এজাজের দিকে। এজাজ কে দেখে সে অবাক হয়ে সেদিকে যায়। তাকে বলল, তুমি এইখানে?

এজাজ বলল, সারপ্রাইজ!

মানতাশা বিরক্ত হয়ে বলল, কীসের সারপ্রাইজ? বিনা দাওয়াতে এভাবে কেউ আসে?
-দাওয়াত পেয়েছি বলেই এসেছি।
-কে করেছে দাওয়াত?
-আজরা।

আজরার উপরে চরম মাত্রায় মাথাটা খারাপ হলো মানতাশার। সে বলল, আমাকে না জানিয়ে ও এটা কেন করলো! আমার ফ্যামিলি আছে এখানে।
-ওহ তাই! চলো পরিচিত হয়ে নিই।
-ফাযলামো কম করো। আমি চাইনা এখুনি কেউ আমাদের সম্পর্ক টা নিয়ে জানুক। আর তুমি দূরেই থাকো আমার থেকে।

এই বলে মানতাশা হনহনিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। তাকে ডাকতে যাবে ঠিক তখনি কেউ এজাজের পথ আঁটকায়। পেছনে ফিরে একজন বয়স্ক মহিলা কে দেখলো সে। মরিয়ম বেগম কে চিনতে অসুবিধা হলো না তার। মানতাশার কাছে তার পরিবারের ছবি দেখেছিল সে। তাই সহজেই বুঝে গেছে, মহিলাটি তার মা৷
সর্বনাশ! কিছু শুনে ফেললেন না তো তিনি!
মরিয়ম বেগম গম্ভীরমুখে বললেন, একটু এদিকে এসো আমার সাথে। কথা আছে আমার।

মরিয়ম বেগমের পিছু নেয় এজাজ। জানে না আজ কী হতে চলেছে!
.
.
বরযাত্রী চলে আসে। গেইটে ফিতা ধরার জন্যে আগে থেকেই তৈরী হয়ে ছিল আজরার কাজিন বোনেরা ও বান্ধবীরা। মানতাশাও তাদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু নাবীহা যেতে চায় না। তা দেখে মানতাশা বলল, কেন? গেলে কী সমস্যা?
-এমনেই। তোরা যা না!
-আজরার বিয়ে নিয়ে কত এক্সাইটেড ছিলি তুই! আর ওর বিয়ের গেইটেই যাবি না? এত মজার পার্ট মিস করবি?

নিশ্চুপ নাবীহা কে দেখে মানতাশা বলল, আমি বুঝতে পারছি কেন! কিন্তু তোকে দেখে কী ইনতিসার বিয়ে ভেঙে এমন ভাবছিস নাকি?
-কীসব বলিস!
-তবে যেতে কী সমস্যা?

কোনো জবাব না পেয়ে আজরার দিকে তাকায় মানতাশা। আজরা ইশারায় কী হয়েছে জানতে চায়। মানতাশা তার কাছে এসে বলল, নাবীহা গেইটে যেতে চায়ছে না। যদি তুই কিছু মনে করিস এই ভয়ে!

বান্ধবীর বিয়ে নিয়ে প্রতিটি বান্ধবীর-ই অনেক ইচ্ছে থাকে। নাবীহারও ছিল এবং আছে। সবাই গেইটে যাবে আর নাবীহা এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকবে। বেচারির নিশ্চয় মন খারাপ হবে।

একটু পরেই ইনতিসারের সাথে তার বিয়ে। এখন তাদের দেখা হওয়াই যায়। যেটা পরে হবে সেটা নাহয় একটু আগেই হোক।
আজরা নাবীহা কে ডেকে বলল, আরে যা যা! গিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করে নে!

আজরার কথা শুনে নাবীহাও যেতে রাজি হয়। মানতাশা নিচে নেমে এলে সকলে গেইটের দিকে পা বাড়ায়।

গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ইনতিসার ও তার সাথে আসা মেহমানরা। শ্যালিকারা এসেই লম্বা ফিতা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
এক লাখ টাকার দাবি করে তারা। তা শুনে বরপক্ষও হাসি তামাশা শুরু করে। তারা বলে, দশ টাকার ফিতে ধরে লাখ টাকা চাও?

একথা শুনে মানতাশা বলল, টাকা দিলে দাও! না দিলে তোমরা তোমাদের ছেলে কে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও!

মানতাশার কথা শুনে তার দিকে তাকালো ইনতিসার। এই তো সেই পরিচিত মুখটি! সামনাসামনি দেখে তার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, এই মেয়েটিই সেদিনের দেখা মেয়েটি। যার সাথে কি না নাবীহার কোনো সম্পর্ক রয়েছে। তবে কী নাবীহাও এখানে আছে? না কি সে কেবল এই মেয়েটিরই পরিচিত কেউ?
এই ভেবে আশেপাশে তাকাতে থাকলো ইনতিসার। ভিড়ের মাঝে হঠাৎ একটি মেয়ের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো সে। মেয়েটি আর কেউ নয়, নাবীহা! গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে সবার পেছনে।
ইনতিসার তাকে আরও ভালো করে লক্ষ্য করলো। হ্যাঁ, সেই নাবীহা! নাবীহা এখানে! তার মানে সে যেটা ভাবছিল সেটা সত্যি হয়ে গেল? কী সম্পর্ক নাবীহা ও আজরার?
নাবীহা ও সে একে অপরের চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে ফেললো নাবীহা।
কিন্তু নজর এড়াতে পারলো না ইনতিসার। এক দৃষ্টিতে নাবীহার দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়লো সে।
.
চলবে#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৮
#Saji_Afroz

আজরার পাশে স্টেজে বসে রয়েছে ইনতিসার। একে একে সকলে এসে তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। সাথে ছবিও তুলছে। চারদিকে এত মানুষ, পাশে রয়েছে হবু স্ত্রী। তবুও ইনতিসারের দু-চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে নাবীহা কে। সে এখানে কেন এটা নিয়েও ভাবনায় পড়ে গেছে ইনতিসার।
আচ্ছা, নাবীহাও কী তাকে দেখে অবাক হয়েছে? নাকি সে আগে থেকেই জানতো, এই বিয়ের বর ইনতিসার!
.
.
নীরবে একা একা একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে নাবীহা। চারপাশ চোখ বুলিয়ে দেখছে সে। আজরা ও তার পরিবার বেশ খুশি। হবেই তো! ইনতিসারের মতো ছেলে ও ভালো একটা পরিবারের সাথে আত্মীয়তা হতে যাচ্ছে তাদের। আজরার বাবা আয়োজনেও কোনো অংশে কমতি রাখেননি। মনে হচ্ছে তার সারা জীবনের উপার্জনের জমানো টাকা বিয়ের পেছনেই খরচা করেছেন।
নাবীহার সাথে যদি বিয়েটা ঠিক হত, এমন আয়োজন তার বাবা করতে পারতো না। এসব জানার পরেও কী ইনতিসার তাকে বিয়েটা করতে চাইতো?
-একা একা কী করছিস?

মানতাশার ডাকে ঘোর কাটে নাবীহার। সে বলল, কিছু না।
-চল।
-কোথায়?
-স্টেজে! মালা পরাবো বর কে। সাথে মিষ্টিমুখও করাতে হবে না? দ্বিতীয় দফা টাকা নিতে হবে তো।
-তোরা যা। গেইটে তো গেলামই।
-তুই না গেলে কীভাবে! আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড বলে কথা! আয় তো…

এই বলে নাবীহা কে টানাটানি করে নিয়ে আসে মানতাশা। স্টেজের সামনে আসতেই থমকে যায় সে। স্টেজের দিকে পা বাড়ানোর সাহস হয় না তার। কেমন যেন লাগছে তার।
এদিকে নাবীহার দিকে চোখ পড়তেই ইনতিসার তার দিকে মনোনিবেশ করলো। নাবীহাও যে অসস্থিবোধ করছে তা সে বুঝতে পারলো।
শ্যালিকারা সবাই স্টেজে আসে। সাথে আসে নাবীহাও। আজরা আড়চোখে ইনতিসারের দিকে তাকালো। সে নাবীহার দিকে চেয়ে রয়েছে। বিষয়টা কে হালকা ভাবেই নেওয়ার চেষ্টা করলো আজরা। কারণ ইনতিসার তাকে হঠাৎ এখানে দেখছে। হয়তো তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন। নাবীহার পরিচয় নিয়ে চিন্তিত হওয়াটা স্বাভাবিক।
মানতাশার কথাতে নাবীহা কে মালা ধরতে হলো। দু’জনে মিলে মালা পরালো ইনতিসার কে। এভাবে নাবীহার হাতে মালা পরে অশান্তিতে উশখুশ করতে লাগলো ইনতিসার। মালা তো সে পরতেই চেয়েছিল! তবে তার বর হিসেবে।
মিষ্টি খাওয়ানোর পর্ব শেষ হতেই সবাই ছবি তুলতে শুরু করে। মানতাশা ইনতিসারের দিকে তাকালো তার চেহারার অবস্থা দেখার জন্য। ফ্যাকাসে চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে, নাবীহা কে দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে সে।
আচ্ছা! দেখাটা আর কিছুদিন আগে হলে কী বিয়েটা হত?
ভাবতে ভাবতেই
স্টেজের সামনে থাকা এজাজের দিকে চোখ যায় তার। তাকে দেখে মানতাশা ইশারায় সরে যেতে বলল। কিন্তু সে সরলো না। হেসে তার ছবি তুলতে থাকে এজাজ। এজাজের এমন কাণ্ডে মেজাজ খারাপ হতে থাকে মানতাশার। ছেলের সাহস তো কম না!

ছবি তোলা শেষে একে একে সবাই নেমে যেতে থাকলেও কারও ডাকে থেমে গেল নাবীহা। সাজির এসেছে। সে স্টেজে উঠতে উঠতে বলল, ওয়েট ওয়েট! আমরা একসাথে ফ্রেমবন্দী হয়ে নিই।

এই বলে নাবীহা কে নিয়ে আজরার পাশে এসে দাঁডায় সে। আজরাও সুযোগটা কাজে লাগায়। সে ইনতিসারের উদ্দেশ্যে বলল, ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নাবীহা। বলেছিলাম না দু’জন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আছে আমার? একজন ও। আর ওর পাশের জন হলো সাজির ভাইয়া। নাবীহার ফুফাতো ভাই। তবে ওর হবু বরও। সামনেই ওদের বিয়ে।

সাজির ইনতিসারের সাথে পরিচিত হয়ে নেয়। এরপর নাবীহা কে নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে পড়ে।

ইনতিসার বুঝতে পারলো, কেন নাবীহা তার বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। তবুও ধারণা কতটুক মিলেছে তা জানার জন্য আজরা কে জিজ্ঞাসা করলো, সম্পর্কের বিয়ে?
-পুরোপুরি তা নয়! একে অপরকে পছন্দ করতো।
-ওহ।

ইনতিসার খেয়াল করলো, সাজিরের সাথে নিচে বেশ হাসিখুশি ভাবেই কথা বলছে নাবীহা। সাজির তার কপালের সামনে চলে আসা চুলগুলো ঠিক করে দিচ্ছে। এসব দেখে নাবীহার দিক থেকে মনোযোগ সরানোর চেষ্টা শুরু করলো সে। দু’জন দুই পথের বাসিন্দা তবে কেন অন্যদিকে মনোনিবেশ করে নিজের সুন্দর মুহুর্ত টাকে নষ্ট করবে সে!

এই ভেবে সে আজরা কে বলল, আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে।

হঠাৎ একথা শুনে লজ্জা পায় আজরা। মাথা নিচু করে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল সে, আপনাকেও!
.
.
এদিকে নাবীহার পরিবার আগে থেকে জানতো, আজরার বর ইনতিসার। আজরার জন্য তারাও বেশ খুশি। মেয়েটার জীবনে এমন কেউই আসার কথা ছিল।

ইলারা জামান উপস্থিত মেহমানদের সাথে কথা বলছেন। হঠাৎ তার চোখ গিয়ে আঁটকায় দাঁড়িয়ে থাকা নাবীহার দিকে। পাশে সাজিরও রয়েছে। তাকে না চিনলেও নাবীহা কে চিনতে ভুল করলেন না তিনি। ইনতিসার ঘটকের কাছ থেকে ছবি দেখে ও তার সম্পর্কে জেনে বেশ পছন্দ করেছিল মেয়েটাকে। কিন্তু তাদের পরিবার আগ্রহ দেখায়নি বলে কথা আগায়নি। এই মেয়ে এখানে কী করছে?
ভাবতে ভাবতে আজিজা বানুর দেখা পান তিনি। আজিজা বানু বললেন, আপা সবাই কে চিনছি না। আপনিও একটু খেয়াল রাখবেন৷ সবাই খাচ্ছে কিনা দেখবেন। আর কিছু লাগলে বলবেন আমায়।
-সেসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। ভালোই আয়োজন করেছেন আপনারা।
-ধন্যবাদ আপা।

একটু থেমে তিনি নাবীহা কে দেখিয়ে বললেন, মেয়েটি আপনার কী হয়?

আজিজা বানু তার এমন প্রশ্নের কারণ বুঝতে পারলেন। কিন্তু তিনি সবটা জানেন তা বুঝতে না দিয়ে বললেন, আমার মেয়ের বান্ধবী। আর পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা তার হবু বর।
কেন আপা?
-নাহ এমনিই!

কথা না বাড়িয়ে তাড়া দেখিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন আজিজা বানু।
ঘটক বলেছিল তারা এই প্রস্তাবে রাজি নয়। কেন নয় এই বিষয়ে ঘটকও জানেনা বলেছিল। তবে এই কারণ!
যাক, আজরা নাবীহার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বরং আজরার মতো মেয়ে কে পুত্রবধূ হিসেবে পেতে চলে তিনি অনেক খুশি। তার উপর ভরসা আছে ইলারা জামানের। নিশ্চয় তার পরিবার কে আলোকিত করে রাখবে সে।
.
.
-তোমার খাওয়া হয়েছে?

মানতাশার কথা শুনে এজাজ বলল, চলো না একসাথে খাই?
-মাথা খারাপ? তোমার সাথে খেতে বসি এরপর মা দেখলে ঘটনা বাড়বে। এটা চাচ্ছ তো?

এজাজ তার কথা শুনে হাসলো। মানতাশা বলল, খেয়েদেয়ে চলে যাও তো। আমি চাচ্ছি না তুমি এখানে থাকো।
-আমি তো থাকবোই। আমার হবু বউ এর আশেপাশেই থাকব।

মানতাশা ভেবেছিল, আজ ইনতিসারের আত্মীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে সে। ইনতিসারের মতো যদি প্রস্তাব পাওয়া যায় এই ভেবে সে অনেক টাকা দিয়ে নামি দামি পার্লার থেকে সেজেও এসেছে। এখন এজাজ তার পেছনে ঘুরঘুর করাতে চরম বিরক্ত হচ্ছে সে। এমন করলে কোনো ছেলে কী তার দিকে দৃষ্টি দেবে? উফফ! কেন যে আজরা একে দাওয়াত দিতে গেল। এই ভেবে আজজার উপরে মেজাজ খারাপ করলো মানতাশা।
.
.
অবশেষে সেই বিশেষ মুহুর্তটা চলে আসলো! কবুল বলার মুহুর্ত …
কাজি সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছেন। আজরা ও ইনতিসারের পাশে রয়েছে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন। তাদের মধ্যে রয়েছে মানতাশা ও নাবীহাও।
কবুল বলতে বলা হলে না চাইতেও নাবীহার দিকে চোখ যায় ইনতিসারের।
আজ আজরার বদলে সে যদি তার পাশে থাকতো!
-কবুল বলুন?

কাজির ডাকে ঘোর কাটলো তার। আর সময় নিলো না সে। আজরার দিকে তাকিয়ে বলল, কবুল।
এরপর আজরার পালা আসে। সেও কবুল বললে কাজি সাহেব তাদের দিকে বিয়ের কাবিননামা এগিয়ে দিলেন। দু’জনে সাক্ষর করার মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়।

সকলে একে অপরকে মিষ্টিমুখ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

ইনতিসারের কিছু আত্মীয় এসে আজরা কে আদর দিয়ে নানারকম উপহার পরিয়ে দিতে লাগলেন। সবই ছিল ডায়মন্ড ও সোনার গয়না। যা দেখে নাবীহার উদ্দেশ্যে মানতাশা ফিসফিসিয়ে বলল, শরীরে কী কম আছে যে আরও পরাতে হচ্ছে?

নাবীহা বিরক্তির সুরে বলল, কেউ শুনবে!

এই বলে সে স্টেজ থেকে নেমে পড়ে৷ তার পিছু নেয় মানতাশা। তাকে থামিয়ে বলল, সত্যি করে বল তো? এতটুকুও তোর খারাপ লাগছে না?
-কেন লাগবে?
-ওকে বিয়ে করলে এসব গয়নাগাটি সব তোর হত।

নাবীহা কে দেখে তার কাছে আসছিল সাজির। এসেই সে মানতাশার বলা কথাটি শুনে ফেলে। যা বুঝতে পারে নাবীহা ও মানতাশা। কথা ঘুরানোর জন্য নাবীহা বলল, খেয়েছ তো তুমি?
-হু অনেক আগেই।

মানতাশা আর কিছু না বলে সেদিক থেকে সরে যায়। সাজির বলল, যে প্রস্তাবটা তোমার জন্য এসেছিল তা কী ইনতিসারের পক্ষ থেকে ছিল?

নাবীহা শান্তস্বরে জবাব দিলো-
হু।
-কেন নিষেধ করেছিলে?

কিছু না ভেবেই নাবীহা বলল, তোমার জন্যে। তোমাকে ভালোবেসে।

সাজিরের ইচ্ছে করছে খুব করে বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে নাবীহা কে। কিন্তু ভরা মজলিশ এ তা সম্ভব না বলে ইচ্ছে টাকে দমিয়ে রাখলো। সে নাবীহার হাতটা ধরে বলল- এত ধন সম্পদ হয়তো আমার নেই। কিন্তু কথা দিচ্ছি, অনেক বেশি ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখব তোমাকে।

নাবীহাও তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, এটাই প্রয়োজন আমার।

দূর থেকে তাদের দেখছে ইনতিসার। কেন যেন নাবীহা কে সাজিরের পাশে দেখতে ভালো লাগছে না তার। বেহায়া মন কে মানাতে কষ্ট হচ্ছে, নাবীহা তার হয়নি!
আচ্ছা, এই সাজিরের এমন কী আছে যে তার মধ্যে নেই? যার কারণে নাবীহা তাকে প্রত্যাখ্যান করে সাজির কে জীবনে গ্রহণ করছে?
এদিকে তাকে লক্ষ্য করলেন ইলারা জামান। নাবীহার প্রতি ছেলের এই চাহনি দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি। ইনতিসারের মনে কী বিয়েটা নিয়ে দ্বিধার সৃষ্টি হয়ে গেল?

দূর থেকে সাজির ও নাবীহা কে দেখে মানতাশা আপনমনে বলল, তুই বোকা। তাই ইনতিসারের মতো কাউকে বাদ দিয়ে সাজির কে বেছে নিয়েছিস। কিন্তু আমি এমনটা করব না। আমার তো ইনতিসারের মতোই কাউকে চাই! তাতে করে কারও মন ভাঙতে হলে নাহয় ভাঙলাম!

.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here