#কিছু_অধ্যায়(পর্ব_৩)
#লেখায়_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
সকালবেলা সেই অনাকাঙ্ক্ষিত নাম্বার থেকে কল আসে। মেজাজ কিঞ্চিৎ খারাপ হয়। তবে রিসিভ করা মাত্রই থমকে গেলাম। কণ্ঠধ্বনি শুনেই বোধহয় অপরপাশে পরিচিত কোনো মুখকে আন্দাজ করতে পেরেছি। অকস্মাৎ ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছ্যাৎ করে উঠলো। আমি কি কোনোকিছুতে জেলাস! কী জানি! অপরপাশের ব্যক্তিটির কথা কানে আসলো না। আমি নিজের ভাবনায় বিভোর। তবে সে হ্যালো হ্যালো করছে। হঠাৎই আমি ভাবতে ভাবতে কল কেটে দেই। সবকিছু তো গতকালই শেষ হল৷ তাহলে এখন তার সাথে আর একটা কথা বলারও মানে নেই কোনো। প্রয়োজনই মনে করি না। যা হওয়ার নয়, তা ভাবনায়ও থাকতে পারে না।
আচ্ছা! আমার কি কোনো ভালো লাগা কাজ করছে? নাকি খানিক আবেগও হতে পারে! আবার, একটা হামবড়া ভাবেরও কিছু হতে পারে। আর তা হল, সরাসরি অপছন্দের কথা বলেছে এরজন্য। ধুর মাথা গেল বুঝি এইবার, এসব ভাবতে ভাবতে। কোন হ্যাবলাকান্ত যে এলো আমার জীবনে। পরপর তাকে নিয়েই ভাবতে হয়। কোনোক্রমে ভুলে গেলে সে নিজেই উদয় হয়।
রাতে ফোন রিসিভ করতে পারলাম না বলে অস্থিরতা ছিল৷ এরজন্য সকাল সকাল আধখেয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে ছুটে আসি। কেন আসি আমি জানি না। না তাকে কল দিতাম, আর না ছিল কোনো ইচ্ছে৷ তবুও দৌড়ঝাঁপ করে আসলাম। খানিক বাদে সে নিজেই কল দিল। তবে কী যেন হয়ে গেল আমার। রিসিভ করে আজেবাজে ভাবতে ভাবতে কেটে দিলাম। চাইলেও গতকালের ঘটে যাওয়া অধ্যায়টা মুছে ফেলতে পারি না। এই ব্যর্থতা কোথায় রাখি! মা সত্যিই বলে, আমি কোনো কাজের না। আসলেই তাই।
ক্যাম্পাসে যথাযথ সময়ের আগেই উপস্থিত হলাম। তবে আমার বান্ধবীও এসেছে। প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণেই ভাবলাম, যাক একজন তো পাওয়া গেল! কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়া যাবে।
তড়িঘড়ি করে ওর দিকে হাস্যজ্বল মুখে যাওয়া মাত্রই থমকে যাই। কেউ এসে ওর পাশের বেঞ্চিতে বসে। আরেহ ব্যস! এ যে গতকালের পাত্র। মাটি, পিতল, তামা, দস্তা, লোহার যা-ই হোক না কেন তাতে আমার কী? তবে তাসবিহার পাশে এসেই বসলো কেন? তাও তাসবিহা হেসে হেসেই কথা বলছে। গতকাল তার মুখ থেকে অপছন্দের কথা শুনে তাকে ভালোভাবে পরখ করলাম না। তবে আজ তো বেশ লাগছে। স্বাস্থ্য, উচ্চতা, গায়ের রং সবকিছুতেই মানানসই। আবারও খানিক চমকাই। তাকে নিয়ে এত ভাবার কী আছে? সে থাকুক না তার মত।
আমার মনে হচ্ছে, আমি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। হামবড়া ভাব তো কখনও ছিল না আমার মধ্যে। তবে এখন তার অস্তিত্ব কেন পাচ্ছি! শুধুই কি অপছন্দ করেছে বলে তার জন্য? যা-ই হোক, কাটিয়ে উঠতে হবে।
অতঃপর তাসবিহাকে এড়িয়ে চলে যাই। ও দেখেছে কি-না জানা নেই। বোধহয় দেখেনি। না হয় ডাক দিতো। তাও চিল্লাপাল্লা করে।
হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে লাগলাম, তাসবিহার সাথে ওই হ্যাবলাকান্ত কেন? আত্নীয়? না-কি পরিচিত কেউ? আবার, তার গার্লফ্রেন্ডই তাসবিহা নয়তো! তাসবিহা তো কখনও বলল না যে, ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। ও তো সে-ই আমার মতোই সিংগেল। যে পছন্দ করে তাকে ভালো লাগে না। অথচ যে অপছন্দ করে তাকেই মনে ধরে। এটা কেমন ধরনের মন? নিঃসন্দেহে বলতে পারি, এই মন যার আছে তার কাঠখড় পোহাতে হচ্ছে।
বকুল’তলায় বেঞ্চিতে বেশ আয়েশ করে বসলাম। সাথে ঝালমুড়িও আছে। ঝালমুড়ি খেতে খেতে চারিপাশ দেখছি। কয়েক বেঞ্চিতে আড্ডা চলছে। আবার কেউ-বা গল্পগুজবে ব্যস্ত। আর আমি? আমার ভাবনায়। ভাবনার ফাঁকে সময় করে ঝালমুড়ি খাই।
আচ্ছা! সেদিন যদি পাত্র বিয়েতে রাজী থাকতো, তখন কী আমি দ্বিমত পোষণ করতাম? না-কি ধেইধেই করে বিয়ের পীড়িতে বসতাম? ভাবতে ভাবতেই হেসে ফেলি।
প্রেমের বয়সটা বুঝি পাড় হয়ে গেল। এরজন্য বিয়ে বিয়ে করেই যাচ্ছি৷
হঠাৎই কেউ পাশে এসে বসে। চকিতেই থমকে যাই।
সে ভাবলেশহীন ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। এই হ্যাবলাকান্ত আবার এখানে কী করে?
আমি ছোটোখাটো ঢোক গিলে বলি,” সবকিছু ঠিক তো?”
সে ক্ষীণ চোখে তাকায়। কোনো উত্তর দিল না।
আমি দারুণ কনফিডেন্সে বলি,” আমার ব্যপার বাদ দিন। যে ঘরে বিয়ে ভেঙে যায়, সে ঘরে কোনো মেয়ে আত্নীয়তা করতে যাবে না। এতটুকু ভরসা তো রাখতেই পারেন। এবং আপনার সেজন্য কোনো ঝামেলাও পোহাতে হবে না। গতকাল মজা করেই বলেছিলাম সবকিছু। তবে আপনার সব ঠিকঠাক তো?”
আমার কথাগুলো শুনে সে কোনো জবাব দিল না। সে তার কালো হুডির পকেটে হাত দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইল। যেন আমার কথাগুলো তার কর্ণ অবধি যায়নি। আমিও কথা বাড়ালাম না। বেশি বাচালতা করতেছি বোধহয়।
এত চঞ্চলতা ঠিক নয়। মেয়ে মানুষ একটু নম্র, ভদ্র হতে হবে। মুখমণ্ডলে লাজুকতা থাকতে হবে। আর যদি সম্ভব হয় তাহলে কথা না বলে থাকাই ভালো। মানুষ তখন শান্তশিষ্ট ভাববে। এগুলো সবই আমার মায়ের কথা। আমি বরাবরই কথাগুলো শুনলে খিলখিল করে হেসে দিতাম। আর মা রেগে যেত।
আজ কেন যেন সেই কথাগুলোকেই মনে পরছে। এরজন্য চুপ রইলাম।
তবে বেশিক্ষণ তো আর আমার দ্বারা সম্ভব নয়। হঠাৎই গতকালের ফোনের কথা মনে পরলো। আমি দ্রুত প্রশ্ন ছুড়লাম, ” এই যে মহাশয় ! রাত বিরেতে এত কল দিয়েছিলেন কেন? মা যদি শুনতো কতকিছুই না ভাবতো আমায়। আপনার জন্য মাঠে মারা যেতাম।”
সে না জানার ভান ধরে তাকায়। বলে,” আপনাকে কেন কল দেব?”
আমি সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললাম,” সত্যিই আপনি ছিলেন না? তাহলে কে দেবে শুনি?”
” আমি আপনার ফোন নাম্বার কীভাবে জানবো?”
” হতেই তো পারে মায়ের কাছ থেকে নিয়েছেন।”
” কেন নেব? আপনি কী হন আমার?”
আমি চুপ হয়ে যাই তার কথায়। সত্যিই তো। সে কল দিবে কেন ওত রাতে! তাছাড়া এত সকাল সকালও তো দেওয়ার কথা নয়। ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে ফিরে তাকাই। তার কথাটি বোধহয় পছন্দ হয়নি আমার। ‘আপনি কী হন আমার?’ কথাটি বোধহয় সরাসরি বলায় সরাসরিভাবেই আঘাত হানলো!
সে বলল,” তা এত সকালে ক্যাম্পাসে আসলেন যে!”
” ইচ্ছে হয়েছিল।”
” এত কীসের ইচ্ছে?”
” বয়ফ্রেন্ডের জন্য।” মিথ্যে বললাম। কোনো কারণ ছাড়াই।
” বয়ফ্রেন্ড আছে?”
” আপনার গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারলে আমার কেন থাকতে পারে না!”
” থাকতেই পারে।”
” আপনি এখানে কী করছেন?”
” কারো জন্য এসেছি।”
” গার্লফ্রেন্ডের জন্য?”
” বোধহয়।”
” এখানে পড়ে? কোন ডিপার্টমেন্ট?”
” হুম, হবে একটা।”
” ক্লাসের সময় হয়ে গেল, আসি তবে।”
বলার সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালাম। সে কিছু বলতে চাইলো। চোখমুখ কেমন যেন অগোছালো। আমি দাঁড়ালাম না। কয়েকপা সামনে এগোনোর পরেই সে বলল,” না গেলে হয় না?”
হতবুদ্ধি হয়ে তার মুখপানে তাকাই। সে মাথার চুল টেনে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
” ট্রিট নিবেন?”
” কীসের জন্য?”
” গতকালের জন্য।”
” সবকিছু ঠিক হল বুঝি?”
” খানিকটা।” হেসে বলল।
আমি কেন জানি খুশি হতে পারলাম না। সে সম্মুখে এসে দাঁড়াল। বলল,” একটা ছোটোখাটো তো নিতেই পারেন।”
‘ অন্য একদিন।’
‘সত্যি তো?’
‘ মিথ্যে কেন বলবো?’
‘কোনো কারণ ছাড়াই বলা যায়।’
‘এমন মনে হল কেন?’
‘মানুষের মন বিচিত্র ধরণের। কখন কী হয়, বুঝা বড়ো দায়।’
‘হয়তো সত্যি।’
‘ হয়তো না, সত্যিই। গ্যারান্টি দিচ্ছি।’ হেসে বললেন তিনি।
‘আমি ক্লাসে যাব। আপনি নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবেন?’
‘করেছি।’
‘তাসবিহা?’
‘ বোন হয়।’
‘কখনও শুনিনি তো।’
‘বান্ধবীর কাজিন সম্পর্কে কি জানানো জরুরি ?’
‘ হয়তো না।’ হেসে বললাম।
‘মধ্য দিয়ে তাসবিহার ভাইকে পছন্দ করলেন?’
‘কখন? ওর ভাই সম্পর্কে তো কিছুই জানি না। তাহলে পছন্দ করব কেন? মুখে বলতে পারি, ননদ বানাব ও’কে।’
‘ সে-কি, ভুলে গেলেন? গতকাল বেশ তো জেঁকে ধরছিলেন আমায়।’
‘ড্রয়িং রুমে যে বসা ছিল, সে তাসবিহার ভাই?’
‘জি।’
‘ ইশ! ঠাট্টার ছলে বলেছিলাম। আপনি আবার কিছু বলেননি তো?’
‘ বললে কী হবে?’
‘ এই, না! এহেন কিছু করবেন না। তাসবিহা বান্ধবী হয়। পরবর্তীতে কিন্তু লজ্জায় পরব।’
‘ আমিও কিন্তু ওর ফুফাতো ভাই হই।’
‘ তো?’
‘ কিছু হলে কিন্তু আপনার মুখে বলা কথাটি সত্য হতে পারতো।’
‘ হয়নি তো।’
‘ আপনি বেশ চঞ্চল প্রকৃতির। তাই না?’
‘মানুষ বলে, আমি জানি না। তবে আপনি বেশ শান্তশিষ্ট। ‘
‘ মানুষ ভেদে ভিন্ন হই।’
‘ তা আমার সামনেই এত শান্তশিষ্ট কেন?’
‘ ভয় পাই।’
‘ একটা মেয়েকে?’ খিলখিল করে হেসে বললাম।
‘ যে গুন্ডী মেয়ে!’
‘ তা কী গুন্ডামী করলাম?’
‘ কতকিছুই তো করতে চেয়েছেন।’
‘ গতকাল হ্যাবলাকান্ত ভেবে এতকিছু বলেছিলাম।’
‘ হ্যাবলাকান্ত! এটা আবার কী?’
‘ নিরামিষ নিরামিষ ভাব, চঞ্চলতার অভাব।’
‘ আজ?’
‘ চালাকচতুর মনে হচ্ছে।’
কথাটি মুখ ঘুরিয়ে বললাম। সে হোহো করে হেসে দেয়।
‘ আপনার কি সত্যিই বয়ফ্রেন্ড আছে?’
‘ মিথ্যে কেন বলব?’
‘ এই ভার্সিটিতেই পড়ে?’
‘ হয়তো।’
‘ এতক্ষণ কথা বললেন একটা ছেলের সাথে। সে রাগ করবে না?’
‘ করলে করুক।’
‘ সত্যিকারে থাকলে কিন্তু এত সহজে কথাটি বলতে পারতেন না।’
‘ মিথ্যাকার অর্থে কেন মনে হল?’
‘ মুখ দেখে মন বুঝতে পারি।’
‘ প্রেমিক পুরুষ! ‘
‘ বউয়ের জন্য।’
‘ ভাগ্যবতী সে।’
‘ বানাতে চাই।’
‘ আরেকদিব কথা হবে।’
‘ এড়িয়ে যাচ্ছেন যে!’
‘ কারণ আছে কোনো?’
‘ জানি না।’
আমি কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ হেঁটে চলেছি। একবার পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, সে দাঁড়িয়ে আছে। স্থির দৃষ্টি নিয়ে আমার যাওয়ার পানে। চোখাচোখি হতেই সে এলোমেলো করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। আমারও একই অবস্থা।
ডিপার্টমেন্টে আসার পরে তাসবিহার সাথে দেখা হল। বলল,
” এত দেরি হল যে?”
” কিছুর জন্য হল। তুই কখন আসছো?”
” ভাইয়ার সাথে আসছি। মোটরসাইকেল তো এরজন্য বায়না ধরে নিয়ে আসছি।”
” বায়না ধরতে হল কেন?”
” এত সকাল সকাল ঘুম ভেঙে কেন আসবে? তা যে রাগী ভাই আমার। ধমক শুনেই কেঁদেকেটে দেব।”
” কতখানি রাগ?”
” আদ্রিয়ান ভাইয়া! মানুষটা যতখানি লম্বা তার দ্বিগুণ রাগ।”
” ক্যাম্পাসে তোর সাথে যে বসেছিল, সে?”
” হ। তুই দেখছো?”
” হুঁহ।”
“কাছে গেলি না ক্যান?”
” এমনিতেই।”
” আচ্ছা।”
” সে শুধুমাত্র তোর জন্যই আসছিল?”
” হ রে বোন৷ ঘুম থেকে টেনে নিয়ে আসছি। বলছি, মোটরসাইকেলে দিয়ে যেতে। ভাই বলে কথা! ক্যাম্পাসে আসার পরে ফুচকা, চটপটি খাওয়ালো। আর তার ফাঁকে আমায় পঁচালোও হেসে হেসে। ফাজিল ভাই একটা।”
তাসবিহার কথায় হেসে দেই। তবে মনে মনে প্রশ্ন ঘিরে আছে। সে কেনই-বা মিথ্যা বললো আমায়। ধুর! হয়তো বোন বলে ওকে বলল না। তবে আমায় সত্যটাই বলতে পারে। কিন্তু যার এত রাগ সে কীভাবে পরিবারকে বুঝাতে পারল না তার সম্পর্কের কথা! ঘাপলা তো আছেই কোনো। আমি আর এ ব্যপারে মাথা ঘামালাম না।
আজ এক বান্ধবীর জন্মদিন। ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ক্লাসমেটকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ট্রিটের জন্য গেল। আমিও আছি তারমধ্যে। তবে রেস্টুরেন্টে গিয়ে আবারও থমকে যাই…।
#চলবে