গল্প : #একমুঠো_সোনালি_রোদ (পর্ব : ছয়/শেষ পর্ব)
একদিন দুপুরে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল সামির। সুমেহরা টলতে টলতে শোবার ঘরে এল। ধীর পায়ে এসে দুম করে বিছানায় পড়ে গেল। তার মাথা সামিরের পেটে। পা বিছানার বাইরের দিকে। সামির দ্রুত উঠে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে বলল, ‘এটা কী করলে তুমি! এভাবে হুট করে কেউ শুয়ে পড়ে?’
সুমেহরা জবাব দিলো না। একটু নড়লও না। আগের মতোই পড়ে রইল। চুপচাপ। তখনও চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। সামিরের সন্দেহ হলো। সুমেহরার কাছে গিয়ে বলল, ‘এ্যাই সুমেহরা, কী হয়েছে তোমার? এ্যাই, শুনতে পাচ্ছো আমার কথা?’
মিনিটখানেক বাদে সুমেহরা উঠে বসল। ধীর স্বরে বলল, ‘কিছু হয়নি।’
সামিরের বিশ্বাস হয়নি। কিছু না হলে এমন করবে কেন! সে নিশ্চয়ই কিছু একটা লুকাচ্ছে। এদিকে দিন দিন সুমেহরার অসুখ আরো বেড়ে যায়। সে প্রায়ই কেমন যেন হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দুম করে বিছানায় টলে পড়ে। সামির কিছু জানতে চাইলেও এড়িয়ে যায়।
একদিন রাতে সুমেহরা রান্না করছিল। হঠাৎ তার মাথাটা কেমন যেন ঘুরতে শুরু করল। হাত কাঁপছে। বুক কাঁপছে। চোখ দু’টো অন্ধকার হয়ে আসছে ক্রমশ। দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হলো না। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইল। মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাকে ডাকার শক্তিটুকু সুমেহরার নেই। এদিকে সামির বাইরে। কোথায় যেন বেরিয়েছিল সেই সন্ধ্যায়। এখনও আসেনি। ফাঁকা বাসায় সুমেহরা আর মা। এদিকে সুমেহরার যে মনে হচ্ছে, সে মরে যাবে। হয়তো এখনি। কিন্তু কেউ যে নেই তার পাশে! মৃত্যুর সময় সামির থাকবে না পাশে, তাই কি হয়?
সুমেহরা একবার উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। হলো উল্টো। মাথাটা আরো বেশি ঘুরতে লাগল। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। কিছুক্ষণ পর আর বসে থাকা সম্ভব হলো না। ফ্লোরেই শুয়ে পড়ল। মৃত্যু যন্ত্রণা বুঝি এতটাই কঠিন! কিন্তু সামির পাশে থাকলে এত কষ্ট হত না।
হঠাৎ ডোরবেল বাজল। সামির চলে এসেছে কি? সুমেহরা কান পেতে শুনল ঠিকই, দরজা খুলতে গেল না। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই, দরজা পর্যন্ত যাবে কীভাবে!
আরো একবার ডোরবেল বাজল। এরপর যদি আরো একশো বার ডোরবেল বাজে তবুও মা’র ঘুম ভাঙবে না। তিনি সব সময়ই এমন। এক ঘুমে ফজর হয়। সুমেহরা শুয়ে থেকে বলার চেষ্টা করল, ‘আসছি।’
কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। দুম দুম শব্দ হচ্ছে। দরজা ভেঙে ফেলা হচ্ছে কি?
কিছুক্ষণ পর সামিরের গলা শোনা গেল, ‘সুমেহরা, এ্যাই সুমেহরা!’ বলতে বলতে একসময় রান্নাঘরে এসে সুমেহরাকে পড়ে থাকতে দেখে দ্রুত দু’হাত বাড়িয়ে তুলে নিলো। বিছানায় নিয়ে শোয়াল। ততক্ষণে মানুষের ভীড় জমে গেছে। প্রতিবেশীরা উৎসুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। সুমেহরা স্পষ্ট শুনতে পেল, অনেকে সামিরকে দোষারোপ করছেন। কিন্তু তার যে দোষ নেই। সে তো অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছে। সুমেহরাই যায়নি। এ-কথা সে কাউকেই বলতে পারল না।
সেদিনই সুমেহরাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আত্মীয়-স্বজন সবাই দেখতে আসেন। একসময় বিকেল হয়। তারপর সন্ধ্যা। রাত নেমে এলে একে একে সবাই চলে যান৷ রয়ে যায় শুধু সামির। একলা একটা মানুষ উদাসীন ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। আর সুমেহরা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
দু’দিন পরের কথা। টেস্ট করা, রক্ত যোগাড় করা, ওষুধ নিয়ে আসা এসব করতে করতে সামির হাঁপিয়ে উঠেছে। শরীর যে আর সয় না! এ পর্যন্ত তিন ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। এখন আরেক ব্যাগ চলছে। ডাক্তার বলেছেন, সুমেহরার থেলাসিয়া হয়েছে। এ-ক্ষেত্রে রোগী রক্তশূণ্যতায় ভোগে। হিমোগ্লোবিন কমে যায়। এর বেশি কিছু বলেননি। সামির জিজ্ঞেস করেছে, বিপদের আশঙ্কা নেই তো? ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছেন, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। বাকিটা আল্লাহ তায়ালার হাতে।
সুমেহরা চোখ খুলে দেখল, সামির তার পাশে বসে আছে। সুমেহরার হাত দু’হাত দিয়ে সামিরের মুখের কাছে ধরে রেখেছে। চোখের কোণে এক ফোঁটা জল। সুমেহরা ধীর স্বরে বলল, ‘কী হয়েছে আপনার?’
সামির ইতস্তত করে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘কিছু না তো! কিছু না।’
‘কয়টা বাজে?’
সামির ঘড়িতে চোখ রাখল, ‘দশটা একুশ।’
‘রাত?’
‘হুঁ।’ সামির মাথা নিচু করে আসামির মতো বলল, ‘সুমেহরা!’
‘জি?’
‘আমি তোমাকে ঠকিয়েছি।’
সুমেহরা উঠে বসতে চাইল। সামির তাকে সাহায্য করল। পিঠের কাছে বালিশ ঠেকিয়ে দিয়ে বলল, ‘কীভাবে ঠকিয়েছি জানতে চাইবে না?’
‘কীভাবে?’
‘আমি বিবাহিত।’
সুমেহরা বলল, ‘সে তো আমিও জানি। আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন।’
‘না। তুমি কিছুই জানো না।’ বলে চুপ করে গেল সামির।
‘কী হয়েছে বলুন তো আপনার?’
‘তুমি আমার দ্বিতীয় স্ত্রী।’
সুমেহরার গা শীতল হয়ে এল, ‘তাহলে আপনার প্রথম স্ত্রী কে?’
‘মুনতাহা।’
‘ওপাশের বিল্ডিংয়ের মেয়েটা?’
‘হুঁ।’
‘তাহলে আমাকে বিয়ে করলেন কেন?’
সামির কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘কিন্তু তার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে।’
সুমেহরা ধীর গলায় বলল, ‘ডিভোর্স? কী কারণে ডিভোর্স হয়েছে?’
‘জানি না। মুনতাহা নিজে থেকে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার বড়ো দুর্বলতা কী, জানো? আমি সহজে কারো সাথে মিশতে পারি না। মুনতাহার বেলায়ও তাই হয়েছিল। বিয়ের তিন মাসের মাথায় সে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়।’
‘এই সামান্য কারণে ডিভোর্স?’ সুমেহরা বলল।
সামির খপ করে সুমেহরার হাত ধরে বলল, ‘কিন্তু এখন আমি মিশতে শিখে গেছি। এখন আমি একজনকে ভীষণ ভালোবাসি। ভীষণ।’
সুমেহরা শক্ত হয়ে বলল, ‘কে সে?’
সামির অসহায়ের মতো বলল, ‘তুমি। বিশ্বাস করো, বিদেশ থেকে ফিরে আসার আগে শেষ কয়েকটা দিন তোমাকে খুব মিস করেছি। সব সময়ই তোমার কথা মনে পড়ত। কিন্তু দেশে ফিরে মায়াটা আরো বেড়ে গেল। আমার জীবনে এত পরিবর্তন, এত ভালোলাগা… বিশ্বাস করো…’
সুমেহরা মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘এগুলো আগেও বলতে পারতেন।’
‘হ্যাঁ, পারতাম। কিন্তু বলিনি। আজ যখন তুমি অসুস্থ, কেন জানি মনে হচ্ছে, তোমার কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যাব। কেন এমন হচ্ছে বলো তো? সুমেহরা!’
‘হুঁ?’
‘তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?’
সুমেহরা হেসে ফেলল, ‘আমি রাগব আপনার উপর, হিঃ হি!’
তিন মাস পর।
সামির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে সিগারেট। সুমেহরা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাত টেনে তার পেটের কাছে ধরে রেখে বলল, ‘নতুন মেহমান আসছে।’
সামির স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘কে, তোমার মা?’
সুমেহরা ইতস্তত করে বলল, ‘মা আমার পেটে আসবেন কীভাবে? আমি বলেছি নতুন মেহমান।’
সামির কৌতূহলী ভঙ্গিতে বলল, ‘তাহলে কে আসছেন? তোমার বাবা?’
সুমেহরা সামিরের হাত ছেড়ে দিয়ে মুখ ভার করে শোবার ঘরে চলে এল। সামির দ্রুত এসে তার হাত টেনে ধরে বলল, ‘বোকা মেয়ে, রাগ করেছে! আমি তো এমনি এমনি বলেছি। তুমি কি মনে করো, আমি কিছুই বুঝি না?’
‘কী বুঝেন আপনি?’
‘সেটা তুমি না জানলেও চলবে। তবে শুনো, এই মুহূর্তে একটি কথা বলি।’
‘কী কথা?’
‘একবার আমার তিনটি দুর্বলতার কথা বলেছিলাম, মনে আছে?’
‘দু’টো বলেছেন। তৃতীয়টি বলেননি।’
‘আমার তৃতীয় দূর্বলতা তুমি।’
সুমেহরা বলল, ‘আপনি এমন কেন?’
‘কেমন?’
‘এই যে, একদম আমার মনের মতন!’ বলেই সামিরের বুকে মাথা লুকিয়ে রাখল।
(সমাপ্ত)
মো. ইয়াছিন