একমুঠো_সোনালি_রোদ পর্ব ২

গল্প : #একমুঠো_সোনালি_রোদ (পর্ব : দুই)

সামিরের গায়ে অদ্ভুত একটা গন্ধ আছে। অনেকটা কাচা হলুদের গন্ধের মতো। সুমেহরা সেটা অনুভব করতে পারে। সেই গন্ধটা এখন নাকে আসছে। সামির চলে এসেছে কি? সে কি আশেপাশেই কোথাও আছে?

সুমেহরা চোখ খুলল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নীল শাড়ি পরা যে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে সে সামিরের বউ। যাঃ! কী যা তা ভাবছে! লজ্জায় একবার চোখ বুজল। কিন্তু আবার যখন চোখ খুলল তখন তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সামিরের প্রতিচ্ছবি আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পেল। চমকে উঠে ফিরে তাকিয়ে দেখল, পেছনে কেউ নেই। পুরো ঘর খুঁজল। এমনকি বিছানার নিচ পর্যন্ত। কোথাও নেই৷ মনের ভুল কি?

হতে পারে। আজকাল প্রায়ই এখানে ওখানে সামিরকে দেখতে পায়। এক মুহূর্তের দেখা। তারপর গায়েব হয়ে যায়। এ-সবই তার মনের ভুল। তবে আজ সে সত্যি সত্যি আসছে। ভাবতেই গা শিউরে ওঠে!

চলে যাবার আগে সামির বলেছিল, ফিরে এলে দূরত্ব কমবে। কিন্তু কতটা দূরত্ব কমবে? এতটা? সুমেহরা ফিতা দিয়ে দু’ইঞ্চি মেপে দেখল। না কি তার থেকেও কম?

কেন জানি মনে হয়, সামির এসেই ডোরবেল বাজাবে। লাগেজ-টাগেজ সব দরজার সামনে ফেলে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। একসময় যখন সুমেহরা দরজা খুলে দেবে, সে দু’হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নেবে। এভাবেই স্তব্ধ হয়ে কেটে যাবে কিছুটা সময়। সুমেহরা ইতস্তত করবে। একসময় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলবে, ‘ভেতরে আসুন।’

ডোরবেল বাজতেই সুমেহরা ইতস্তত করল। এবার কী হবে! দরজা খুলে দেবে কি? যদি সামির সত্যি সত্যি তাকে জড়িয়ে ধরে! আশপাশের লোকজন দেখে ফেলবে না? ওঁরা কী ভাববে তখন?

দ্বিতীয়বার ডোরবেল বাজার সাথে সাথে সুমেহরা পা বাড়াল। অতো ভেবে লাভ কী, যা হবার তা তো হবেই! আগে মায়ের ঘরে উঁকি দিলো। মা বিছানায় শুয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওখানে একবার দৃষ্টি রেখেই দ্রুত ছুটে এল। দরজা খুলতেই দেখল সামির দাঁড়িয়ে আছে। সেই চার বছর আগের মানুষটা। একটুও পরিবর্তন হয়নি। একটুও না।

‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’ সামির বলল।

‘ঘরেই ছিলাম।’

‘দরজা খুলতে দেড়ি হলো যে?’

সুমেহরা এবার জবাব দিতে পারল না। সে অযথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এটা ওটা ভেবে সময় নষ্ট করেছে। তাই তার কাছে সঠিক জবাব নেই।

‘মা কোথায়?’

‘ঘরে। ঘুমাচ্ছেন। ইদানীং মা’র শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।’

‘তাই নাকি? আমাকে আগে বলোনি কেন?’

‘আপনি চলে আসবেন তাই বলিনি।’

সামির দ্রুত ভেতরে চলে গেল। সুমেহরা লাগেজ টেনে টেনে ভেতরে নিয়ে এল। একটাই লাগেজ। ভেতরে এনে মায়ের ঘরে রাখল। নতুন জিনিসপত্র যা কিছু আসে সব আগে মায়ের ঘরে স্থান পায়। এখনও তাই হোক!

ততক্ষণে সামির মা’কে দেখে শোবার ঘরে চলে এসেছে। অ্যাটাচ বাথরুম। ঘরে এসেই বাথরুমে ঢুকে পড়েছে। মিনিট দশেক পর বেরিয়ে এসে বলল, ‘তোমার বাড়ির লোকজন আসেনি?’

‘জি?’

‘বলেছি, তোমার মা-বাবা কেউ আসেননি?’

‘না।’

‘এতদিন পর জামাই দেশে ফিরেছে। উনাদের আসা উচিৎ ছিল না?’

‘মা বলেছে আপনাকে নিয়ে যেন বেড়াতে যাই।’

‘শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বসে থাকার মতো সময় আমার আছে?’

‘নেই বুঝি?’

‘না, নেই। শুধু তোমাকে সময় দিলেই হবে? আমার বাকি স্ত্রীদের সময় দিতে হবে না?’

সুমেহরা কেঁপে উঠল।

‘আরে আরে, তুমি দেখছি কেঁদেই ফেলবে! আমি তো মজা করছিলাম! এই সামান্য ব্যাপার ধরতে পারো না!’ বলে মুচকি হাসল সামির।

সুমেহরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। কথাটা সত্যি না হলেও বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধেছে।

মা ঘুম থেকে উঠে জানতে পেরেছেন, তার ছেলে দেশে ফিরেছে। হঠাৎ চার বছর পর নিজের ছেলেকে পেয়ে তার কী আনন্দ! আনন্দে কেঁদেই ফেললেন। মা-ছেলের কান্না দেখে সুমেহরা চোখের জল সামলে রাখতে পারেনি। তার চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে। একসময় সে একা একা ছাদে চলে এসেছে। রেলিং বিহীন ছাদ। বাতি নেই। চাঁদের আলোই ভরসা। অবশ্য সামনের ভবন থেকে কিছুটা আলো এখানে এসেছে।

ছাদে এসে দাঁড়াতেই দৃষ্টি পড়ল ওপাশের ভবনের দ্বিতীয় তলায়। ফাঁকা বেলকনিতে চোখ পড়তেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। ওখানে কেউ নেই। কে জানে, হঠাৎ সেই মেয়েটি চলে আসে! যদি সামির আবার সেই মেয়েটিকে দেখতে পায়?

ভাবতেই গা শিউরে উঠল। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। শোবার ঘরে গিয়ে বেলকনিতে দৃষ্টি রাখল। সামির সত্যি সত্যি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ফুঁকছে।

সুমেহরা সামিরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সামির পকেট হাতড়ে কী যেন একটা বের করল। এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাও।’

সুমেহরা সেটা হাতে নিলো। এক জোড়া কানের ঝুমকো ইলেক্ট্রিক বাতির আলোয় চিকচিক করছে।

‘দেখছো কি! খাটি সোনা। দাম কত জানো?’

‘কত?’

‘সেটা তোমার না জানলেও চলবে।’

এক সময় গভীর রাত নেমে এল। রাতের খাবার খেয়ে হাতের কাজ শেষতে করতে একটা বেজে গেল। সুমেহরা ঘড়ি দেখে অবাক হলো। এত রাত! দ্রুত শোবার ঘরে এল। ততক্ষণে সামির ক্লান্ত দেহ বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে। তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা চাদরটা বুক পর্যন্ত টেনে দিয়ে সুইচবোর্ডের দিকে পা বাড়াল। বাতি নিভাতে গেল কিন্তু না নিভিয়েই ফিরিয়ে এল। সামির বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে পারে না। সুমেহরার ব্যাপারটা উল্টো। সে বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাতে পারে না। এতদিন সামির ছিল না তাই বাতি নিভিয়েই শুয়েছে। কিন্তু এখন তো সামির আছে। বাতি নিভানো যাবে না।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামিরের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সামির উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে কি? সুমেহরা একবার মাথা তুলে চেয়ে দেখল। হ্যাঁ, গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়েছে। সুমেহরার ইচ্ছে করছে সামিরকে জাগিয়ে দিতে। কিন্তু এরকম ইচ্ছের কোনো মানেই হয় না। মানুষটা এতটা দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে।

সুমেহরা ফিসফিস করে বলল, ‘কিন্তু আপনি বলেছিলেন আমাদের দূরত্ব কমবে…’

তখনই সামির ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কমেনি বুঝি? কতখানি দূরত্ব রয়ে গেছে, মেপে দেখেছো? খুব বেশি হলে চার ইঞ্চি?’

সুমেহরা হকচকিয়ে উঠল। কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম, আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন…’

না, ঘুমায়নি। দ্রুত উঠে বসে বালিশের কাছ থেকে বেনসন অ্যান্ড হেজের আর লাইটার হাতে নিয়ে চলে গেছে বারান্দায়। গ্রিলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সিগারেটে আগুন জ্বালাল। সুমেহরা হাঁটু ভাঁজ করে বিছানায় বসে রইল।

‘এদিকে এসো।’ সামির ডাকতেই সুমেহরা দ্রুত উঠে গেল। কিছুক্ষণ ধোঁয়া ফুঁকে সুমেহরার দিকে তাকাল। বিস্মিত হয়ে বলল, ‘নীল শাড়িতে তোমাকে বেশ মানায় তো! খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু চুলগুলো এমন কেন? চুল সব সময় এলোমেলো করে রাখবে।’

বলে একগোছা চুল সুমেহরার কাঁধে এনে রাখল। সুমেহরা তখনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলার মতো অবস্থা তার নেই। সামির বলল, ‘চেষ্টা করবে একটু অগোছালো থাকার। মেয়ে মানুষ অগোছালোই সুন্দর। বুঝেছো?’

সুমেহরা শুধু মাথা নেড়ে বলল, ‘হুঁ।’

‘একটা বিষয় কী, জানো?’

‘কী?’ সুমেহরা মুখ তুলে তাকাল।

‘আই অ্যাম ইন লাভ…’ বলে আরো একটা সিগারেট জ্বালাল।

সুমেহরা লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। এবার বুঝি সামির প্রপোজ করবে!

(চলবে)
মো. ইয়াছিন
/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here