এক্কা দোক্কা পর্ব -২৩ ও শেষ

#এক্কা_দোক্কা – শেষ পর্ব
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

কি থেকে কি হয়ে গেল, ঐশী ভেবে পাচ্ছে না। তার শরীরে জুভানের গায়ের গন্ধ এখনো নাকে আসছে। কাল রাতে কি হয়ে গেছিল তার? সে কি করে এত বড় ভুল করে ফেলল? ঐশী কেঁদে ফেলল। জুভান পাশে বসে ছিল। ভ্রু কুঁচকে ঐশীর দিকে চেয়ে আছে সে। ঐশীর কান্না ক্রমে ক্রমেই বাড়ছে। একসময় জুভান বিরক্ত হয়ে দিল এক ধমক,
‘ এই মেয়ে, চুপ! একদম চুপ। আর একটা শব্দ মুখ থেকে বেরুবে ত এখনি গলা টিপে মেরে ফেলব! ‘

ঐশী থেমে গেল। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে কান্না আটকাচ্ছে সে। গা কাঁপছে মৃদমন্দ। জুভান পালঙের উপর থেকে ঐশীর জামা নিয়ে ঐশীর দিকে ছুঁড়ে ফেললো। বললো,
‘ যাও, শাওয়ার নিয়ে আসো। ‘

ঐশী চুপচাপ চলে গেল বাথরুমে। বাথরুমে গিয়েও আরো এক দফা কাঁদলো মেয়েটা।

ঐশী বাথরুম থেকে বের হলো। তার সামনে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির এক সার্ভেন্ট। তার হাতে কাল রাতে খাওয়া সেই ব্যথানাশক ওষুধ! ঐশী প্রশ্নবোধক চোখে জুভানের দিকে চেয়ে।
জুভান সার্ভেন্টকে জিজ্ঞেস করল,
‘ এই সিরাপ আমি তোমায় ফেলে দিতে বলেছিলাম না? ‘
‘ হ.হ্যাঁ স্যার! ‘
‘ তাহলে এটা ঐশীর ঘরে কি করে এলো?’
‘ আমি ভাবছি এটা প্যারাসিটামল। ম্যাম সেদিন মাথা ব্যথার ঔষুধ খুঁজেছেন। তাই আমি ইনারে এটা এনে দিসি। ‘
‘ ড্যাম। আমি তোমায় ফেলে দেওয়ার জন্যে বলা সত্বেও তুমি কোন আক্কেলে সেটা ঐশীকে দাও? বলো?;’
‘ আ.আর হইবো না, স্যার। ‘
‘ যাও, এখন। ‘
জুভানের ধমক শুনে সার্ভেন্ট বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

পুরো ব্যাপারটা ঐশী বুঝতে পারলো।কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে। করে ফেলা ভুলকে কি কখনো শুধরানো যায়? ঐশী দুহাতে চুল খামচে ধরে বেডে বসল। জুভান ঐশীর মনের অস্থিরতা বোধহয় বুঝতে পারল। আর পারবেই না কেন? এই মেয়েকে ভালো যে বাসে সে!
জুভান ঐশীর পাশে বসল। ঐশীর হাত চুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিল। ঐশী ধরা কণ্ঠে বলল,
‘ আমাদের এটা করা উচিত হয়নি, জুভান। আমরা ভুল করে ফেলেছি। ‘
ঘোরের বশে ঐশী এই প্রথম জুভানের নাম ধরে ডেকেছে। জুভানের বোধ হলো ,তার কান আজ স্বার্থক। জুভান ঐশীকে বুকে জড়িয়ে নিল। ঐশী ছোট্ট চড়ুইপাখির ন্যায় গুটিয়ে গেল জুভানের বুকে। জুভান ঐশীর মাথায় থুতনি রেখে বললো,
‘ কোনটা ভুল, ঐশী? আমাদের দুজনের প্রথম দেখা সেটা ভুল ছিল? মেলায় তোমাকে দেখে প্রথমবারের মত ভালোবেসে ফেলা, সেটা ভুল? মেলা থেকে তোমার পিছু নিয়ে শেষ পর্যন্ত তোমায় নিজের অর্ধাঙ্গিনী করা, সেটা ভুল? নাকি কাল রাতে আমাদের দুজনের কাটানো জীবনের সেরা মুহূর্ত, সেটা ভুল? ‘
ঐশী অবাক হলো বেশ। জুভান হয়তো তাকে আরো কিছু বলতে চাচ্ছে। ঐশী বাঁধা দিল না। বলতে দিল সব কথা। জুভান বললো,
‘ আমি ওই সিরাপটা নিজের জন্যে আনিনি। এনেছিলাম একটা কাজের জন্যে। মামা দেখে ফেলবেন দেখে আম সিরাপের লেভেল খুলে ব্যথানাশক লেভেল লাগিয়েছি। কাজ শেষ হওয়ায় আমি ওটা ফেলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সার্ভেন্ট ভুল করে সেটা তোমায় দিয়ে দিল। আমি দুঃখিত, ঐশী। এমন ভুল আর হবে না। ‘

ঐশী এবার একটা প্রশ্ন করে বসলো,
‘ আচ্ছা, আপনার বাবা মা কোথায়?আপনার মামার সাথে আপনার কি সম্পর্ক? ‘
জুভান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজের জীবন বৃত্তান্ত সে সাধারণত কাউকে বলতে পছন্দ করে না। কিন্তু আজ ঐশীকে বলবে সে। ঐশীর জানা উচিত সবকিছু! জুভান বললো,
‘ ছোটবেলায় আমার বাবা মা একটা কার অ্যাক্সিডেন্ট মারা গেছেন। তারপর থেকেই আমি আমজাদ মামার কাছেই থাকি। ‘
‘ তিনি কি আপনার আপন মামা? ‘
‘ না! আমার মায়ের চাচাতো ভাই সে। আমার মা তার বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে ছিলেন। বাবা ভালোবাসে মাকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু আফসোস, তাদের ভালোবাসাটা পূর্ণতা পেল না। তিন বছরের মাথায়…..’
ঐশীর বুক ভার হলো। জুভানের কষ্টে নিজেও খুব কষ্ট পেল। ঐশী একটু দম নিয়ে জিগ্গেস করলো,
‘ আচ্ছা, আপনি কি আমায় বিশ্বাস করেন? ‘
জুভান অবাক হলো। তারপর হেসে বললো
‘ হ্যাঁ, অবশ্যই। ‘
‘ যদি আজ আমি এমন কিছু বলি যা শুনে আপনার আপন মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাবে, তাহলে আপনি কি করবেন? ‘
জুভান হতবাক হয়ে বললো,
‘ কি বলতে চাইছ তুমি,ঐশী? ‘
‘ আপনি কি জানেন, আপনার মামা একজন রেপিস্ট? ‘
জুভান আঁতকে উঠল যেন। ঐশীকে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো,
‘ কিসব আজেবাজে বকছ? ‘
ঐশী হাসল। যেন এটাই হওয়ার ছিল। ঐশী উঠে গেল। ড্রয়ার থেকে একটা রিপোর্ট বের করে জুভানের সামনে মেলে ধরল। জুভান রিপোর্ট হাতে নিল। ঐশী বললো,

‘ এটা আমার ডিএনএ টেস্ট রিপোর্ট। কাল রাতে আমাদের কাছে আসার পর আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, আমার দেহে আপনি ব্যতীত অন্য কারো ছোঁয়া আছে? ‘
জুভান মুখ বুজে রইল। হ্যাঁ, সে বুঝতে পেরেছিল। ঐশীর গায়ের বিভিন্ন জায়গায় খুব গভীর ক্ষত ছিল। একটা পুরুষ খুব সহজেই বুঝতে পারে, তার বেড পার্টনার কতটা পবিত্র। তেমন করেই জুভানও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু জুভান ঐশীর উপর আঙ্গুল তুলে নি। ঐশীর অতীত নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণ সে জানে, ঐশী বর্তমান ও ভবিষ্যৎ শুধুই জুভানকে ঘিরে। ঐশী আরো বললো,
‘ আমি জানি আপনি বুঝতে পেরেছেন। এটাই সেই প্রমাণ। আমি তখন এগারো বছরের ছিলাম। দেহে, মনে ছোট্ট শিশুর ন্যায়। এতিম ছিলাম। থাকতাম চাচার বাসায়। ছোট্ট শিশু ছিলাম, যে ধর্ষন, শারীরিক সম্পর্ক সম্পর্কে কিছুই বুঝত না। ঠিক তখন, আমার জীবনে এক অভিশাপ নেমে এল। আমাদের গ্রামে তখন ইলেকশন চলছিল। পাড়ার মেয়েরা মিলে আমরা সেই ইলেকশন দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের দেশে পুরুষ নামক কিছু নরপশু আছে, যাদের কাছে মেয়ে মানেই ভোগ্য বস্তু। তারা মা, শিশু, বুড়ো, যুবতী কিছুই মানে না। তাদের কাছে মেয়ে হলেই হয়। সেইসময় তিন নর পশুর নজরে পড়ি আমি। এক, রিয়াদ তালুকদার। যে তখন শয়তান আমজাদ হোসেনের কিশোর চেলা ছিল। দুই, সাজ্জাদ হোসেন। আমজাদ হোসেনের ডান হাত। তিন, আপনার মামা, আমজাদ হোসেন।
তারা এক গভীর রাতে আমাকে তুলে এনে একটা জঙ্গলে নিয়ে অত্যন্ত হিংস্র ভাবে ধর্ষন করে। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। শুধু বুঝেছিলাম, আমার কষ্ট হচ্ছে। এত কষ্ট আমি আমার এগারো বছরের জীবনে অনুভব করিনি। তারা তাদের কাজ শেষ করে আমায় মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু কিসের দয়ায় তারা আমায় বাঁচিয়ে রেখেছিল। আমি সেদিন আর বাড়ি ফিরিনি। জঙ্গলে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিলাম। গ্রামের কিছু এনজিও সংস্থা আমার দেখে তাদের আশ্রমে নিয়ে যায়। সেখানেই আমি বড় হই। ধীরে ধীরে এই তিনজন নর পিশাচের মৃত্যু ছক সাজাতে থাকি। তারপর আপনাকে বিয়ে করি, আমজাদ হোসেন অব্দি পৌঁছানোর জন্য। একে একে রিয়ার, সাজ্জাদকে আমি মারি। এবার বাকি শুধু মেইন শয়তান, আমজাদ। ওকেও আমি মেরে ফেলব। কাউকে ছাড়বো না আমি। ‘

জুভানের চক্ষু চড়কগাছ। সে একবার ডিএনএ টেস্টের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার ঐশীর দিকে তাকাচ্ছে। ঐশী হাউমাউ করে কাদছে তখন। জুভানের খুব কষ্ট হচ্ছে। যাকে সারাটা জীবন আপন ভেবে এসেছে, সেই এত বড় নির্দয়, নরপশু বের হলো। জুভান ঐশীর কাধে হাত রাখল। ঐশী জুভানের বুকে মুখ গুজলো। বুকের কাছের শার্ট খামচে ধীরে হাউমাউ করে কাদছে। ঐশী ধরা গলায় বললো,
‘ আমি অপবিত্র। আমায় ছুবেন না। আমি নষ্ট, আমি নষ্ট। ‘
জুভান ঐশীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
‘ তুমি নষ্ট নও ঐশী। আমার কাছে তুমি সদ্য ফোঁটা ফুলের ন্যায় পবিত্র। আজ থেকে তুমি একা নও, ঐশী। আমিও আছি তোমার সাথে। ‘
ঐশী ঘুমিয়ে পড়েছে। জুভান ঐশীকে আলতো হাতে বিছানায় শুইয়ে দিল। ঐশীর কপালের উপর থাকা চুলের গোছা সরিয়ে দিয়ে চুমু আকলো তার দু ভ্রুয়ের মাঝখানে।
কানের কাছে মুখ এনে বললো,
‘ অপেক্ষা করো, ঐশী। আগামিকাল দুপুরের খবর হবে তোমার জন্যে প্রিয খবর। কাউকে খুন করতে হলে, তার বিশ্বাস আগে অর্জন করতে হয়। পৃথিবীতে বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে বড় কোনো মরণস্ত্র নেই। ‘
___________________________
দুপুর হতেই জুভান ঘরে টিভির সামনে ঠায় বসে আছে। ঐশীকেও জোরপূর্বক টিভির সামনে বসিয়ে রেখেছে। ঐশী জুভানের কাধে মাথা রেখে চুপটি করে বসে আছে। দুপুর দুইটা বাজতেই জুভান খবরের চ্যানেল দিল। তাজা খবর দিচ্ছে,
‘ বিশিষ্ট মন্ত্রী আমজাদ হোসেনের আত্মহত্যা! আজ সকালে তার নিজ কক্ষে বিষক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তার সুইসাইড নোট পুলিশের আওতায় আনা হয়েছে। তার সুইসাইড নোটে তিনি লিখেছেন,
‘ দেশবাসীর কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি গত কয়েক বছর ধরে বহু অন্যায় করেছি। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি ছাড়া পায়নি। বেচেঁ থাকা আমার আর ভালো লাগছে না। তাই আমি সাদরেই আত্বহত্যা করলাম। ‘

ঐশী অবাক হয়ে চেয়ে রইলো জুভানের দিকে। জুভান বাঁকা হেসে আপেলে সুখী সুখী কামড় বসাচ্ছে। ঐশী আনন্দে কাপছে। জুভানের দিকে চেয়ে বলল,
‘ এসব আপনি করেছেন? ‘
জুভান একটানে ঐশীকে নিজের বুকের উপর ফেলে দিল। ঐশীর নাকে নাক ঘষে বললো,
‘ উহু, তুমি করেছ। তুমি নিজেই তোমার প্রতিশোধ পূরণ করেছ। আমি তো জাস্ট সাহায্য করলাম। ‘
ঐশী হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে চোখে জল চলে এল। জুভানের বুকে ঘাপটি মেরে শুয়ে রইলো এ নারী। অবশেষে তার প্রতিশোধ পূরণ হলো।
_________________________
ফুটপাথের রাস্তা ধরে এলোমেলো হাঁটছে অনল। ঐশীকে নিয়ে তার একটুখানি আশা ছিল। জুভান ঐশীর মধ্যে ভালো সম্পর্ক না থাকায়, সে ভেবেছিল একটু চেষ্টা করলে ঐশীকে সে পেয়ে যাবে। তাই তো সেদিন প্রতিশোধে ঐশীকে সাহায্য করেছে সে। ভেবেছিলে, এই সুযোগে সে আর ঐশী কাছাকাছি আসবে। ঐশীর মনে নিজের জন্যে একটুখানি জায়গা তৈরি করবে। কিন্তু আজ জুভানের মুখে ঐশীর কথা শুনে সে আশায় ঝরঝর করে পানি পড়ল। জুভান ঐশী এক হয়ে গেছে, ভাবতেই তার চোখে জল চলে আসতে লাগল। একপাক্ষিক ভালোবাসার ন্যায় মরণযন্ত্রণা সে আর সইতে পারছে না। ক্লান্ত সে! অনেক ক্লান্ত!
হঠাৎ অনলের ফোন বেজে উঠলো। অনল ফোন রিসিভ করল। পুষ্পিতা হন্তদন্ত হয়ে বললো,
‘ অনল, দ্রুত অ্যাপোলো হসপিটালে আয়। অপর্ণা সুইসাইড করেছে। ‘
অনল অতি স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
‘ বেচে আছে তো? ‘
‘ এসব কি বলছিস তুই, অনল। অপর্ণা তোকে ভালোবাসে, তা তুই ভালো করেই জানিস। তা সত্ত্বেও তুই এমন কথা কি করে বলতে পারিস? ‘
‘ শালা, রাখ তোর ভালোবাসা! আমি ওরে ভালোবাসি? না, বাসি না। আর না কখনো বাসবো। আমি শালা ওয়ান সাইড লাভ নিয়ে মরার মত বেচে আছি। ওকেও ভুগতে দে। যন্ত্রণা ছাড়া ভালোবাসা হয়না। ভালোবাসা মানেই যন্ত্রণার সহস্র সূচ। কষ্ট পেতে দে। খাটি হবে ভালোবাসা! রাখছি। ‘

অনল ফোন কেটে দিল। পুষ্পিতা ওপরপাশে হতবম্ব হয়ে চেয়ে রইলো ফোনের দিকে। হুট করে অনলের কি হয়ে গেল? পুষ্পিতা ঘাড় কাত করে তাকাল। অপর্ণার বেডে শুয়ে আছে। হাতে স্যালাইন। ঘুমুচ্ছে । পুষ্পিতার বুক থেকে হাহাকার বেরিয়ে এল। ভালোবাসা, কি মিষ্টি এক যন্ত্রণা!

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here