#এক্সিডেন্টলি_প্রেম♥
#পার্ট-৩৩♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
—– “এই এই বর এসে গেছে বর!”
সমস্বরে উচ্চারিত বাক্যটা কানের সুক্ষ্ম পর্দায় আঘাত হানতেই চমকে উঠলো অন্বিতা। তার হবু বর শাহীন এসে পৌঁছল তবে। আর কিছুক্ষণ বাদের সম্পন্ন হতে চলেছে তাদের বিবাহ! সারাজীবন একে-অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে চলেছে তারা দুজন। আচ্ছা অন্বিতা কী পারবে চিরদিনের মতো নিশান্তকে ভুলে যেতে? নাকি সারাজীবন আড়ালে আড়ালেই ত্যাগ করতে হবে দীর্ঘশ্বাস! স্মৃতি ভুলে যাওয়া বুঝি এতোটাই সহজ? হাজারও প্রেমাবেগ, ভালোবাসাময় অনুভূতি ভুলে থাকাটা বুঝি এতোটাই সরল? তবে সে কেনো পারছে না?
লোকে বলে সময়ের সাথে সাথে নাকি মানুষ বদলে যায়, সাথে বদলে যায় মানুষের অনুভূতিগুলোও! পুরোনো স্মৃতিগুলো সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে পিছিয়ে পড়ে অবলীলায়। তাদের উল্টেপাল্টে দেখার অভাবে তাতে পড়তে শুরু করে মরিচা! তবুও রসায়নের প্রতিটি মৌল কিংবা যৌগের মতোই ১০০% বিশুদ্ধ হয়না মন! হৃদয়ের গহীনে কোথাও না কোথায়ও থেকে যায় একগুচ্ছ হাহাকার। চাপা আর্তনাদ নিঃশব্দে ক্ষত-বিক্ষত করে চলে হৃদপিন্ডের প্রতিটি দেয়াল! কেউ জানতে পারে না সে লুকোনো আবেগ সাথে জড়িত অজস্র ক্ষুণ্ণতামাখা কান্না!
অন্বিতাকেও হয়তো সেই অভাগা মানুষগুলোর মতোই সারাটি জীবন দীর্ঘশ্বাস লুকিয়েই বাঁচতে হবে। হয়তো মিথ্যে হাসির তাড়নায় মুখরিত করতে হবে ঠোঁট! তবু তাকে হাসতে হবে। নিজের জন্যে না হোক, নিজের পরিবার পরিজনদের জন্য হলেও তাকে হাসতেই হবে।
______________________________
—- আপনাদের কাছে হাত জোর করে রিকুয়েষ্ট করছি, প্লিজ লেট মি লিভ! দয়া করে যেতে দিন আমায় প্লিজ!
—- সরি স্যার ইউ হ্যাভ নাথিং টু ডু! জাস্ট ইন ওয়ান মিনিট! এর মাঝেই ফ্লাইট ছেড়ে দেবে। আপনি প্লিজ ঝামেলা করবেন না, নিজের সিটে গিয়ে বসুন দ্রুত!
নিশান্ত এক চুল পরিমাণও সড়লোনা। আগের মতোই প্লেন থেকে নামবার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে লাগলো সে। দু’জন লেডি কেবিন ক্রিউ নিশান্তকে থামাবার চেষ্টা চালাতে চালাতে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই হাত চেপে আটকালেন। নিশান্ত থরথর করে ঘামছিল। তার কাছে এই একটা মিনিট শুধুমাত্র প্লেন উড্ডয়নের পূর্ব সময় নয়, এই একটা মিনিট তার নিয়তির মোড় ঘোরবার চূড়ান্ত সময়। এই এক মিনিটই সব ঠিক করে ফেলতে পারে, সব! আবার এই এক মিনিটই তিন তিনটে জীবন তছনছ কতে ফেলতে পারে, এও সম্ভব! তাকে যেতে হবে! যে করেই হোক, যেভাবেই হোক তাকে অন্বিতার বিয়ে হয়ে যাবার পূর্বেই বাড়ি পৌঁছতে হবে। ভুল হয়ে গেছে ভীষণ! ভুল করতে করতে কখন যে নিজের অজান্তে নিজেই জীবনের সবথেকে বড় ভুলটা করে ফেলেছে তা টেরই পায়নি নিশান্ত। ভুলের চরম পরিহাসে শেষ মুহুর্তে এসে এরকম একটা শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে কোনোদিনও কল্পনায়ও উপলব্ধি করতে পারেনি সে।
নিশান্ত ব্যাগ ঘাড়ে রেখেই নিজেকে যথাসম্ভব ছাড়িয়ে নেবার জন্য ছোটাছুটি করতে লাগলো। রুক্ষমূর্তি ধারণ করে চেঁচিয়ে বলল,
—- হেই লিভ মি ড্যাম ইট! ছাড়ুন বলছি! কি করছেন এসব আপনারা? আপনারা বুঝতে পারছেননা ফ্লাইট ছেড়ে দেবে? আমায় নামতে হবে ছাড়ুন!
নিশান্তের ধমকে খানিক কেঁপে উঠলেন কেবিন ক্রিউয়েরা। এতোক্ষণে প্লেনে বসা প্রত্যেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলেছে নিশান্তের উত্তেজনা! হুট করে ছেলেটার কী হলো যে শেষ মুহুর্তে এসে ফিরে যাবার বায়না ধরে সিনক্রিয়েট করছে সে? সেকি জানে না প্লেনে উঠার পর আর নামতে দেওয়া হয় না, তারওপর মুহূর্তের মাঝেই যেখানে ফ্লাইট মাটি ছেড়ে আকাশে উড্ডয়ন করবে, এই সময় এসে কী এমন শিক্ষিত ছেলের পাগলামি করা চলে? উহুম একদম না। সেতো উন্মাদ, বদ্ধ উন্মাদ!
তবে লোকেদের এসব ভাবনা বিন্দুমাত্রও প্রভাব ফেলতে পারছেনা নিশান্তের মনে। তার একমাত্র লক্ষ্য প্লেন ছেড়ে দেবার পূর্বে যে করেই হোক নেমে যাওয়া, সাথে বৈদ্যুতিক বেগে ছুটে হলেও গিয়ে অন্বিতার বিয়ে আটকানো। তাতে যদি তাকে শহীদও হতে হয় তবু সে রাজি। বেঁচে থাকতে অন্বিতার বিয়ে অন্য কারো সাথে হয়ে যাবে, তা দেখার শক্তি বা সাহস দুটোর একটাও নিশান্তের নেই।
ইঞ্জিন চালু হয়েছে, প্লেন কিছুদূর ভূ-স্পর্শ করে এগিয়ে হেলানো তল মাফিক উপড়ে উঠার প্রস্তিতে নিতে ব্যস্ত! আর এদিকে কেবিন ক্রিউয়েরা ব্যস্ত নিশান্তকে টেনে হিঁচড়ে হলেও নিজের সিটে বসাতে। ছোটাছুটির মাঝে হঠাৎ প্লেন এগোতে শুরু করেছে অনুভব করতেই ধপ করে বসে পড়লো নিশান্ত। তবে কী হাত থেকে বেরিয়ে গেলো সব? এতো এতো আশা, ১৫ টা বছর ধরে ভালোবাসা! সবটা মিথ্যে হয়ে গেলো? নিজের দোষেই হারিয়ে ফেললো সে নিজের “প্রিয়তমা”কে! নিশান্ত নিজেকে সামলাতে পারলো না। দু-হাতে হাটু চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। চিৎকার করে ক্রন্দন মিশ্রিত গলায় বলতে লাগলো,
—– সব শেষ হয়ে গেলো আয়ু সব শেষ হয়ে গেলো! আমি পারলাম না তোকে ফেরাতে! পারলাম না নিজের অঙ্গীকার রাখতে। নিজের দোষেই তোকে হারিয়ে বসলাম আমি আয়ু, সারাটাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম আমি তোকে। তুই আর আমার হলি না রে, তোর ওপর আজ থেকে অন্য কারো অধিকার থাকবে। যার বুকে মাথা রেখে হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলবি তুই। কিন্তু আমি? আমি কি করে বাঁচব? আমি যে মরে যাবো আয়ু, এই অবাঞ্ছিত অনুভূতিতে জ্বরে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবো আমি….!
ধরা গলায় এটুকু বলতেই আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লো নিশান্ত। পা’এর তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছে তার, দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে পিঠ! কিচ্ছু করার নেই আর! কিচ্ছুটি না!
সিটে বসা প্রায় প্রতিটি মানুষের চোখেই জলধারার অস্তিত্ব ফুটে উঠছে। কেউ কেউ অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন নিশান্তকে।
চোখ দিয়ে জল ঝড়াতে ঝড়াতে তার ফুপিয়ে আর্তনাদ করে উঠায় কেবিন ক্রিউয়েদের চোখদুটোও অশ্রুসিক্ত হতে বাধ্য হলো। ঠিক কতোটা ভালোবাসলে কোনো ছেলে এভাবে ডুকরে কেঁদে পাগলামোতে মত্ত হতে পারে! মেয়েটা বুঝি খুবই সৌভাগ্যবতী! নাহ! সৌভাগ্যবতী ছিলো কিন্তু এখন? এখন তো তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তবে কি মেয়েটা এমন সান্নিধ্যে মাখা ভালোবাসা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলবে? এই সামান্য ক্ষণিকতা ধ্বংস করে ফেলবে সব?
নাহ তা হতে দেওয়া যায় না। হোক না আজ একটু অনিয়ম! উপরমহল থেকে গালি-মন্দ শুনতে হবে? হোক! কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডে যে একটা তিন তিনটে জীবন তছনছ হয়ে যেতে পারে, তখন তার দায়ভার কে নেবে? কে ভাঙবে পাওয়া না পাওয়ার অসম্ভব যন্ত্রণায় ঘেরা পাহাড়? উহুম কেউ না! শুধুমাত্র ঠোঁট বাঁকিয়ে আফসোস করা ছাড়া আর কিচ্ছুটি করবে না কেউ! যা যাবে তা এই ভালোবাসার তীব্র দহনে পোড়া মানুষগুলোরই যাবে। অন্য কারো নয়!
এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই বুক ফুলিয়ে শ্বাস টানলেন আমরিন নামের অধিকারী একজন কেবিন ক্রিউ! কারো কোনো প্রশ্নের পাত্তা না দিয়েই ছুট লাগালেন পাইলটদের নিকটে। প্লেন এখনও শুণ্যে অবতারণ করাবার মুহুর্তে পৌঁছোয়নি। সমতল ভূমিতেই চলমান তার চাকার ঘূর্ণন!
হঠাৎ প্লেন ভাসমান না হয়ে থেমে গেছে অনুভব করতেই চমকালো সবাই। নিশান্ত নিজেই ফোঁপাতে ফোপাঁতে হুশ ফিরে পেলো। ভেতর থেকে একজন পাইলট এবং সেই লেডি কেবিন ক্রিউ বেরিয়ে এলেন ঠোঁটে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে। নিশান্ত আশায় ভরা ছলছল চোখে মুখ তুলে তাকালো। পাইলট নিজের মাথায় পড়ানো হ্যাটটা খুললেন। এই ফাঁকে প্লেনের গেইট খুললেন আমরীন। তার সামনে হাটু গেড়ে বসে কাঁধে হাত রেখে চোখের পলক ফেলে পাইলট বললেন,
—- গো ইয়ং ম্যান! রান ফাস্ট…..!
___________________________
এয়ারপোর্টের কাছাকাছি একটি রেস্টুরেন্টে টেবিলের এক কোণে মুখ ফুলিয়ে বসে ছিলো রিভান। সামনেই মারিয়ার সাথে খোশগল্পে কম ফ্লার্টিং এ মত্ত হয়ে রয়েছে সানি। আজকের মতো একটা দিনেও কি মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট না করে থাকা যায়না? একটু আগেই কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়া ছেলেটা কিভাবে পারে চোখ-মুখে পানির ঝাপটা মেরে ৩২ পাটি দাঁত বের করে মেয়েদের সাথে ফ্লার্টিং করতে তার সাইন্সটা এখন পর্যন্ত ঘটে ঢুকছেনা তার। এদিকে অন্বিতার বিয়েতেও যেতে হবে শীঘ্রই! পাত্রপক্ষ বোধহয় এতোক্ষণে চলেই এসেছে। তখন রফিক আহমেদ’দের সাথেই রওনা হওয়ার মাঝ পথে হঠাৎ মারিয়াকে দেখে থমকে দাঁড়ায় সানি। ইউজলেস কাজেও নিজের মহামূল্যবান বাহানা জুড়ে দিয়ে একটু পর ফিরবে বলেই কেটে পরে সে। সানির মতে তার একমাত্র ভাবির বিয়েতে থাকার চেয়ে হাফ লিটার কোকাকোলা খেয়ে সুইসাইড করা উত্তম! সেখানে ফ্লার্টিং করার মতো মেয়ে পাওয়া তো মেঘ না চাইতেই জল! সানির এমন আহাম্মকের ন্যায় কান্ডকারখানায় না চাইতেও মাঝথেকে বিপাকে পড়ে রিভান। সানিকে টেনে হিঁচড়ে হলেও বিয়েতে নিয়ে যেতে চিপায় পড়ে বর্তমানে সানি-মারিয়া মিষ্টিমিষ্টি আলাপনের সাক্ষী হতে হয়েছে তাকে। রিভান চোখ-মুখ কুঁচকে সানির দাঁত কেলিয়ে রাখ মুখের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল,
—— একটা ছেলে এতো নিখুঁতভাবে এতোগুলা মাইয়ার লগে কেম্নে ফ্লার্ট করে? সারাজীবন সাইন্সে পড়েও আজ পর্যন্ত এই সাইন্সটা বুঝবার পারলাম না কেন! শালা ঠ্যাংগামারানি কপাল! কী ছিঁড়লাম জীবনে?
নিজ মনে এরকম হাজারও উদ্ভট প্রলাপ বকতে বকতেই ফোনের স্ক্রিনের দিকে অলস ভঙ্গিতে তাকালো রিভান। প্রায় সাথেসাথেই কেঁপে উঠলো ফোন। ফোনের স্ক্রিনে বড়বড় অক্ষরে ভেসে উঠলো “Nishant”. রিভান তৎক্ষণাৎ চোখ বড়বড় করে ফোনটা হাতে তুলে নিলো, সানি-মারিয়া’র কথোপকথনে নিশান্তের মৃদুমন্দ কন্ঠস্বর শ্রবণগোচর হবে না বিধায় কাঁচের দেয়ালের নিকটে চেপে এলো সে। দৃষ্টি দেয়ালের ওপারে ফেলে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই চোখ দুটো রসগোল্লা হয়ে এলো তার। একি দেখছে সে? সে কি ঠিক দেখছে? এরকম একটা মিরাকল বুঝি কল্পনার জগত ছেড়ে বাস্তবেও হওয়া সম্ভব, যেই মিরাকল ঘটানোর জন্য শতশতবার ওপরওয়ালা নাম আওড়ে চলেছিলো যে! রিভানের আনমনে কল রিসিভ করায় ওপাশ থেকে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে নিশান্ত বলে উঠলো,
—– রিভান, কোথায় তোরা? যেখানেই থাক এক্ষুনি গিয়ে অন্বিতার বিয়ে থামা! আমি আসতেছি ফাস্ট!
নিশান্তের কথাটা ততোটা মাথায় আঘাত হানলোনা রিভানের। চোখের সামনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটন্ত নিশান্তেই অবাক চোখদুটো থেমে গিয়েছে তার। রিভান জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। হতাশাগ্রস্ত কন্ঠে বলল,
—– কোনো লাভ নাই ভাই! তুই যেই রাস্তা দিয়া দৌড়াইতাছোস তার সামনের রেস্টুরেন্টেই আমরা।
মুহুর্তেই বুকটা ধক করে উঠলো নিশান্তের তবু পায়ের গতি থামালোনা সে। একই বেগে ছুটতে ছুটতে ধমকের সুরে বলল,
—– তোদের দিয়ে কিচ্ছু হবার নয়! বলদের দল!
বলেই ফোন কেটে দিয়ে আবারও ট্যাক্সির খোঁজে ছুটে চললো নিশান্ত। রিভান এতোক্ষণে বুঝলো এ কোনো স্বপ্ন কিংবা ভ্রম নয়! এ বাস্তব, মিরাকল ঘটেছে তবে! নিশান্ত ফিরেছে, দেরি করে হলেও ফিরেছে সে। রিভান চটজলদি রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোবার উদ্দেশ্যে ছুট লাগালো। সানিকে আনবার সময় নেই বিধায় শুধুমাত্র জানিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে উঁচু গলায় বলল,
—— নিশান্ত ইজ ব্যাক সানি লিওন! এক মারিয়া মরিয়া গেলে আরো বহুত মারিয়া পাবি। আগার দোস্ত পেয়ারি হ্যায় তো ভাগ…..!
নিশান্তের নাম শ্রবণগোচর হতেই ঠাস করে সিট থেকে উঠে পড়লো সানি। মারিয়া কপাল কুঁচকে তাকালো। সানি সামান্য কেশে নিয়ে “জানেমান, যুগ বদলেছে! বিলটা আজ নাহয় তুমিই দিয়ে দিয়ো গো!” বলেই এক ছুটে পগারপার হলো! মারিয়া হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো দুজনের ছুটে বেরিয়ে যাবার পানে। পাশ থেকে ওয়েটার হাতে বিলের কাগজ এনে পাশে রেখে বলল,
—– ম্যাম, বিলটা?
মারিয়া বিলের কাগজে ভয়ার্ত দৃষ্টি ফেললো। টোটাল ৩২০০৳ বিল! বিলের এমাউন্ট দেখেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল তার। সাথে মনের রেডিওতে বেজে উঠলো একটিমাত্র গান, “ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে…!”
_______________________________
আকাশে থালার ন্যায় চাঁদ উঠেছে আজ। হুট করেই কিভাবে যেনো নির্ঘাত বৃষ্টির হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে অনুষ্ঠান। আকাশের ঘন কালো মেঘ কেটে গিয়ে উঠেছে মস্ত একখানা চাঁদ। সকলের ধারণা শাহীনদের আগমনের খুশিতেই কেটে গিয়েছে মেঘ। মেঘেরাও হয়তো এতোক্ষণ যাবৎ তাদেরই অপেক্ষায় প্রহর গুনছিল। যার দরুন সকলের মুখেই খুশি খুশি ভাব, শুধুমাত্র একটি ছোট্ট প্রাণ ব্যতীত। অথচ দেখো, তাকে নিয়েই এই বিশাল আয়োজন! সত্যিই ব্যাপারখানা বড্ড অদ্ভুত তাইনা?
এতোক্ষণে চারিদিকের হৈচৈ থেমে গিয়েছে। বিয়ে বাড়ির চূড়ান্ত নিস্তব্ধতা ছেয়ে রয়েছে কাজী সাহেবের আগমনে। তিনি একমনে পাত্র-পাত্রীর জন্ম সনদ নিয়ে গম্ভীরমুখে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করছেন।
স্টেজে পাশাপাশি বসানো হয়েছে শাহীন এবং অন্বিতাকে। তাদের ঘিরে আসর জমিয়েছে আত্মীয়-স্বজন! নূহা মায়ের কোলে চুপটি করে বসে আছে। আনন্দর মনেও বইছে ভারী বাতাস! মাঝ থেকে পাথর হয়ে বসে আছে অন্বিতা। মুখের মিথ্যে হাসিটাও যেনো ধ্বংশের শেষ সময়ে এসে বিলীন হয়ে চলেছে তার! এখনই যদি মিথ্যে হাসি হাসতে বুক কাঁপে তবে পরবর্তীতে কভু মন খুলে হাসতে পারবে সে? হয়তো নয়, আবার হুট করে কোনো মিরাকল ঘটে গেলেও হয়। তবে অন্বিতা সেসব নিয়ে ভাবছেনা মোটেই। যে নিজেকে নিজ ইচ্ছায় কুরবানী করতে চলেছে তার কী কুরবানী পরের জীবন নিয়ে ভাবা শোভা পায়? উহুম কানাকড়ি পরিমাণেও না!
কাজী সাহেব বেশকিছুক্ষণ যাবত পর এটা-ওটা নিয়ে পর্যালোচনা পর্ব শেষ করলেন। নির্দিষ্ট পরিমাণে দেনমোহর ধার্য্য করে সর্বপ্রথম পাত্রের বিয়েতে মত নেবার জন্য কথা পাড়লেন। প্রায় সাথে সাথেই এক প্রকান্ড চিৎকারে চমকে উঠলো সবাই। চিৎকারটা আর কারোর নয়, স্বয়ং নিশান্তের! নিশান্তের পেছন পেছন সানি-রিভানও হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির হলো। ঘটনা আকস্মিকতায় যে যার স্থান থেকে উঠে দাঁড়ালো। অন্বিতা অবাক চোখে একদৃষ্টি ফেলে রইলো নিশান্তের ওপর। কী হচ্ছে এসব? নিশান্ত এই সময় এখানে! এতোক্ষণে তো প্লেন বহুদূর পাড়ি জমাবার কথা ছিল, যতোদূর একটা পাখিরও উড়ে যাওয়া সম্ভব হবেনা বোধহয়! তবে কি তিনি জাননি? কিন্তু কেনো?
এমন হাজারো প্রশ্নের বর্ষণ অন্বিতার মেঘাচ্ছন্ন মনে আছড়ে পড়তেই ঘাড় থেকে ট্রাভেলিং ব্যাগটা আস্তে করে নামিয়ে রাখলো নিশান্ত। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই এক ছুটে পৌঁছে অন্বিতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে। অন্বিতা স্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো! মাথাটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। নিশান্ত ডুকরে কেঁদে উঠলো! অশ্রুসিক্ত নয়ন দুটো সমস্ত বাঁধা ভেদ করার আনন্দে নোনাজল ছেড়ে দিলো তার। ধরা গলায় কম্পিত কণ্ঠে সে বলে উঠলো,
—— আ…আ…আমি পেরেছি! অবশেষে পেয়েছি আমি তোকে আয়ু! হারাতে দেইনি, আর কক্ষনও দিবনা প্রমিজ!
#চলবে_____________________