এক্সিডেন্টলি প্রেম পর্ব ৩৬

#এক্সিডেন্টলি_প্রেম♥
#পার্ট-৩৬♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥

বসার ঘরে জমেছে উপচে পড়া ভীড়। এদিক সেদিক বাচ্চাদের ছোটাছুটি! শাহীনদের পরিবার নাক-মুখ সিটকিয়ে চলে যাবার পর থমথমে পরিবেশটা হঠাৎ করেই হয়ে উঠেছে জমজমাট। আজ দু’পরিবারেই যেনো আকাশ সমান আনন্দ। প্রত্যেকের চোখে মুখেই প্রশান্তি মাখা হাসি। নূহা-আনন্দর সে কি উচ্ছ্বাস! পুরো বাড়ি জুড়ে দাপিয়ে বেরোচ্ছে তারা দুটোয় মিলে। চিকুও কম কিসে? দিব্যি “মিয়াও, মিয়াও!” করে ছুটে চলেছে এদিক থেকে ওদিক। লোকে বলে এরা বোবা প্রাণী, নির্বোধ! অথচ এই প্রাণীগুলোই ভালোবাসার সংস্পর্শে এলে হয়ে উঠে প্রাণোচ্ছল! তাদের নাকি মন বলতে কিছু নেই, অথচ এই প্রাণীগুলোই বোঝেনা অহংকার কিংবা হিংসের অর্থ! স্বার্থপরতার সংজ্ঞা তাদের ছোট্ট মস্তিষ্কে না থাকলেও ভালোবাসার প্রতিদান যে ভালোবাসাই হয় তা ঠিকই নিজেদের হৃদয় দিয়ে অনুভব করে তারা। চিকুও সেরকমই! এতোদিন যাবৎ যারা তাকে লালন-পালন করে বড় করলো তাদের প্রতি এক অদ্ভুত মায়ার জড়িয়ে পড়েছে সে। লোকমুখে প্রচলিত সামান্য “বিড়াল” মানুষদের সাথে কতোটা মিশে গেছে তা না দেখলে সত্যিই অবিশ্বাস্য!

একজোড়া প্রাণ এক হলো আজ। বিনি সুতোয় বাঁধা দুটি হৃদয় পেলো তাদের ভালোবাসার চরম পরিহাস! ভালোবাসার চাদরে মোড়ানো দুই পথিক অবশেষে পেলো স্থায়ী ঠিকানা! সাথে এতোক্ষণ যাবৎ অপেক্ষায় ব্রত কাজী সাহেব ছুটি পেলেন অবশেষে। বাড়িতে বউ অপেক্ষা করছে সেই তখন থেকে। ফোনের পর ফোন দিয়ে চলেছে সে। “বিয়ে পড়াতে এতো সময় কখনোও লাগে নাকি?” এই প্রশ্নটাই বর্তমানে মুখরিত করে চলেছে তার ভোকাল কর্ড। কাজী সাহেব শত ব্যস্ততার মাঝেও একটু করে কল রিসিভ করে “শীঘ্রই ফিরছি গো!” বলেই কেটে দিচ্ছেন ফোন। এপাশ থেকে সামান্য কয়েকটা লাইনে আজকের এরকম এলাহি কান্ডের বর্ণনা করা সম্ভব নয় বিধায় স্বল্প বাক্যেই থমকাতে হচ্ছে তাকে। বিয়ে পড়াতে এসে এই প্রথম এতোটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তার। প্রথমে বিয়ে পড়াবার সময় দোয়া আওড়ানোর মুহুর্তে হুট করেই ব্যাঘাত ঘটা। ফ্লাইটের উদ্দেশ্য বেরোনো নিশান্তের প্রবেশ ঘটায় অনাকাঙ্ক্ষিত বিরতি, অতঃপর অন্বিতার মিথ্যে বিয়ে পড়াতে করা ইশারা! নিশান্ত মুখ লুকিয়ে চলে যাবার পর পাত্রির বিয়ের আসরে ঠিক করে রাখা বিয়ে ফেলে সবশেষে ছুট লাগানো! সবটা মিলিয়ে বড্ড বিপাকে পড়েছিলেন কাজী সাহেব। তার এই হযবরল টাইপ অবস্থাতেও কোনো বিরতি মিলছিলো না। বাড়ির লোকেদের অনুরোধে মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও পাত্র-পাত্রীর ফেরার অপেক্ষাতেই প্রহর গুনতে ব্যস্ত হতে হিয়েছিলো তাকে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব এক্সপেরিয়েন্স অর্জন করে অবশেষে নিশান্ত-অন্বিতার বিয়ে পড়ানো হতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। নতুন কোনো ঝড় উঠবার আশংকায় চটজলদি আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই ফিক করে হেসে ফেললো সবাই। আমজাদ হোসেন হাতের ইশারায় ধৈর্য্য ধরতে বললেন কাজী সাহেবকে। রফিক আহমেদ আস্বস্ত করবার তাগিদে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—– ভয় নেই কাজী সাহেব, আর কোনো সুনামি কিংবা ঘূর্ণিঝড় আসবেনা নিশ্চিন্ত থাকুন।

কাজী সাহেব ভেতরে ভেতরে সামান্য লজ্জিত হলেও বাহির থেকে ঠাট বজায় রেখে লেফাফাদুরস্ত ভাব ফোটালেন। সবার সাথে কুশল বিনিময় এবং দেনা-পাওনা মিটিয়ে চলে যেতেই নিশান্ত-অন্বিতাকে ঘিরে বসলো সবাই। নিশান্ত সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির তোয়াক্কা না করে আমজাদ হোসেনকে নিজের সামনে বসালো। দু’হাত মুঠো করে জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বলল,

—– “আংকেল” শব্দটা আজ থেকে তো বেকার হয়ে গেলো আজীবনের জন্য! আজ থেকে আপনি আমার দ্বিতীয় বাবা, আর আমি আপনার দ্বিতীয় ছেলে। বাবা, আমার মনে শতশত প্রশ্নের জাল বুনে জট পাকিয়ে চলেছে। একমাত্র আপনিই পারেন সব ধোঁয়াশা মিটিয়ে নিমিষেই আমায় শান্ত করতে! আপনার ছেলে বায়না ধরেছে আজ অতীতের স্মৃতি ঘাটবার, আমায় দয়া করে বলুন বাবা, অন্বিতা হুট করে শাহজীবাজার থেকে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল? আমাদের কক্সবাজার থেকে ফেরার পর কেনো ওর কোনো উদ্দেশ পাওয়া যায়নি? আপনি যদি জেনে থাকেন তবে বলুন প্লিজ! আমার জানা মতে ওর বাবা আই মিন আপনি বিদেশে ছিলেন। আয়ু ওর মায়ের সাথেই ভাড়া বাড়িতে থাকতো, তবে হুট করে বলা নেই কওয়া নেই, এভাবে নিরুদ্দেশ কেনো হলো সে?

আমজাদ হোসেন নিশান্তের কাঁধে হাত রেখে তাকে শান্ত হতে ইশারা করলেন। নিশান্ত আগ্রহী চোখে চেয়ে নড়েচড়ে বসলো। অন্বিতাও উদ্বিগ্ন চোখে তাকালো। নিজের অতীতে ঘটে যাওয়া আবছা স্মৃতির পাতা আওড়াতে তারই আকাঙ্ক্ষা যেনো শতভাগ! এতোক্ষণ যাবৎ চলা হৈ-হুল্লোড় যেনো হঠাৎ করেই রূপ বদলে নিস্তব্ধতার আকার ধারণ করলো। আমজাদ হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখে-মুখে গম্ভীর ভাবমূর্তি প্রকট করে বলা শুরু করলেন,

—– সময়টা ছিলো ২০০৫ সাল! তখন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছেয়ে ছিলো পৌষ মাসের আমেজ। বেকার ছেলেকে ভাইয়ের ব্যবসার কাজে যোগ দিতে আমায় মালেশিয়া পাঠিয়েছিলেন বাবা। আমি তখন খুব বেশি বড়ও নই, বয়স আর কতই হবে? এই সাতাশ কিংবা আটাশ! হাজার হোক স্ত্রী-সন্তানের দেখভালের জন্য নিজ থেকে কিছু করা উচিত ভেবেই আমিও দ্বিমত পোষণ করিনি। অন্বিতার পাঁচ বছর বয়স চলাকালীন বিদেশেই বিচরণ হয়েছিলো আমার। আয়রা তখন ২৫ বছরে পা দিয়েছিল সবে। ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে একলাই দিন কাটাতে হয়েছিল তাকে। আমি অবশ্য কিছু ইনকাম করে দেশে চাকুরী কিংবা ছোটখাটো ব্যবসা খাঁড়া করার টাকা ম্যানেজ করবার উদ্দেশ্যেই ভিন দেশে পাড়ি জমিয়েছিলাম, স্থায়ী ঠিকানা অচেনা কোনো রাজ্যে বানাতে নয়। স্ত্রী-সন্তান ছাড়া বড্ড একা একা লাগতো আমার। প্রথমপ্রথম মানিয়ে নেওয়াটা অত্যন্ত ভুগিয়েছিল আমায়। তবে সময়ের সাথে সাথে মানিয়ে নিতে শিখেছিলাম। প্রথম কয়েক মাস ভীষণ কষ্ট হলেও অতঃপর বাস্তবতার কাছে হারতে হয়েছিল আমার। প্রতিদিন মুঠোফোনের আলাপন, মেয়েটার অস্ফুটস্বরে “বা…বা..! বাবা!” ডাক সবই বড্ড পোড়াতো আমায়। তবু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই সকল মায়া ত্যাগ করে থাকতাম আমি। আয়রাকেও বোঝাতাম, কান্নার বদলে হাসি-খুশি মুখটায় স্নিগ্ধতা ফোটাতে বারংবার দূর থেকেই প্রচেষ্টা চালাতাম। সবই প্রায় ঠিকঠাক চলছিলো, আয়রা মেয়ে নিয়ে আমার অপেক্ষায় আর আমি অপেক্ষার প্রহর শেষ হবার প্রতিক্ষায় দীর্ঘশ্বাস ফেলেই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে চলতাম। তবে হঠাৎ একদিন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। হয়তো রাত জেগে লাগাতার খাটা-খাটনিরই ফল ছিলো তা! ভয়ে কল ধরিনি দু দুটো দিন! যদি মুখ ফসকে অসুস্থতার কথাটা বেরিয়ে যায় তবে আর আয়রাকে থামিয়ে রাখা যাবে না বুঝেই চুপ করে রয়েছিলাম। কিন্তু ওইযে দেয়ালেরও কান থাকে, সেরকম আমার চাচ্চুরও কানটা বড্ড খাড়া ছিলো। ঠিকই মানা করা সত্ত্বেও আয়রাকে জানিয়ে দিয়েছিল আমার অসুস্থতার ব্যাপারখানা। আয়রা দুশ্চিন্তার চরম পর্যায়ে পৌঁছে আমায় না জানিয়েই মেয়েকে নিয়ে চলে আসে মালেশিয়া। আমি তার আসার খবর সম্পর্কে অবগত ছিলাম না বিধায় আটকাতেও পারিনি। ব্যাগ-ট্যাগ সব গুছিয়ে আয়রা যখন আমার বাসার সামনে এসে কলিংবেলে চাপে তখন আমি চরম পর্যায়ে হতবাক হয়ে পড়েছিলাম। ব্যাচেলর কোয়াটারে বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকাটা ভীষণ ডিফিকাল্ট ছিলো। অবশেষে না চাইতেও চাচ্চুর বাড়িতে উঠতে হয় আমায়। অবশ্য আমিও দুশ্চিন্তা মুক্ত হই, এতোদিনে এরকম সাহসের একটা কাজ না করলে বোধহয় পাছে আরোও দুশ্চিনার বোঝা মাথায় নিয়েই কাজ ফেলে বসে থাকতে হয় সেই আশংকায়। এভাবেই দিন যেতে লাগলো। সব ঠিক থাকলেও ঠিক ছিলো না অন্বিতা মা! মেয়েটা হুটহাট কান্না করে বসতো, “রাই ভাইয়া, রাই ভাইয়া” বলে চেঁচিয়ে উঠতো। আমি বুঝতাম না কে এই রাই ভাইয়া। আয়রাও হয়তো ততোটা জানতো না এই বিষয়ে। শাহজীবাজার থাকতে মেয়ে স্কুলে কিংবা খেলতে বেরোলে প্রায়ই একটা ছেলের সাথে খেলতে দেখা যেত এইটুকুনি জানা-শোনার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো সে। অন্বিতা বলতো তার খুবই ভালো বন্ধু রাই! তবে কোনো যোগাযোগ মাধ্যম না থাকায় পরবর্তীতে আর খোঁজ-খবর নেওয়া হয়ে ওঠেনি৷ মেয়ের কান্নাকাটির জন্য বড্ড দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম দুজনেই। চেষ্টা করেছিলাম কোনোভাবে তার বন্ধুটার সাথে কথা বলাতে কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি৷ না ছিলো নম্বর আর না জানা ছিল সঠিক ঠিকানা। ওতোদূর থেকে মেয়ের ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারিনি আমরা। ওর গলায় একটা “R” লেটারের লকেট দেখেছিলাম অবশ্য, তবে দূর্ভাগ্যবশত একদিন পাশের ফ্ল্যাটের বাবুটার সাথে খেলতে গিয়ে লকেটটা হারিয়ে ফেলেছিল অন্বিতা।

আমজাদ হোসেন থামলেন। টেবিল থেকে পানি ভর্তি গ্লাসটায় চুমুক দিয়ে সামান্য দম নিলেন। সকলের দৃষ্টি পূর্বের তুলনায় আরো খানিকটা গাঢ় হয়ে এলো। তিনি আবার নিশান্তের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালেন। কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,

—– আচ্ছা নিশান্ত, অন্বিতার সাথে তোমার পরিচয় কতোদিনের ছিলো?

নিশান্ত পলক ফেলে অন্বিতার দিকে তাকালো। তার শুকনো মুখে মায়া ভরা চাহনি নিক্ষেপ করে বলল,

—– খুব বেশি দিন না বাবা, ৩/৪ মাস হবে।

আমজাদ হোসেন মাথা নাড়লেন। গম্ভীর মুখে আবারও বলতে শুরু করলেন,

—– আমি এরকমটাই ভেবেছিলাম। তোমরা নিশ্চয় “ইনফ্যান্ট অ্যামনেশিয়া” অর্থাৎ “শিশুর স্মৃতিলোপ” শব্দটির সাথে পূর্ব-পরিচিত! গবেষকেরা বলেন শিশু-মস্তিষ্কের ক্ষমতা বিস্ময়কর। এটা প্রতি সেকেন্ডে ৭০০ নতুন স্নায়ু সংযোগ গড়ে তোলে। ফলে শিশুরা একসাথে অনেক ভাষা শিখতে পারে সহজেই। কিন্তু এও সত্য “মানুষ যত নতুন জিনিস শেখে, প্রতি ঘন্টায় তার অর্ধেক মুছে ফেলে মস্তিষ্ক।” গবেষকদের দাবি, মানুষের মধ্যে শিশুকালের স্মৃতি ভুলে যাওয়া শুরু হয় সাত বছরের কাছাকাছি সময়ে। তারা এও বলেন ” আট থেকে নয় বছর বয়সী একটি শিশু তিন বছরের স্মৃতির মাত্র ৩৫ শতাংশ মনে রাখতে পারে।” এর কারণ সাত বছর বয়সের পর মানুষের স্মৃতি তৈরি হওয়ার পদ্ধতি পরিবর্তন হতে থাকে। পূর্ণবয়স্ক হয়ে বেশিরভাগ মানুষই কয়েকটা ভাসা ভাসা স্মৃতি ছাড়া প্রায় সবই ভুলে যায়। তেমনটাই হয়েছে অন্বিতার সাথেও। সময়ের সাথে সাথে অতীত ভুলতে শুরু করে সেও। একটা সময় গিয়ে তোমার নামটাও আর মাথায় থাকেনি তার। আয়রা আর আমিও পুরোনো স্মৃতি মনে রাখতে সেই বিষয় নিয়ে আড্ডার মহল জমাইনি, এইসব কারণেই অন্বিতা হয়তো ভুলে গিয়েছিল সব। কিন্তু তুমি যতোদূর সম্ভব তখন ৯ বছরের শিশু। তোমার পক্ষে বিশেষ কোনো স্মৃতি মনে রাখাটা খুব বেশি কঠিন ছিলোনা বিধায় মনে রাখতে পেরেছ সব। তারপর যখন আনন্দ আয়রার গর্ভে এলো তখন যথেষ্ট উপার্জনও হয়ে গিয়েছিলো প্রায় আমার। গর্ভাবস্থায় আমার একার পক্ষে ওর সঠিক দেখভাল করা সম্ভব হয়ে উঠছিলোনা, দেশ থেকে অন্বিতার নানুমা বলেছিলেন ফিরতে। আর না হলে মেয়েকে পাঠাতে। আমারও যেহেতু আর থাকবার তেমন প্রয়োজন ছিলোনা তাই সব কাজ গিছিয়ে অতঃপর তিন মাসের মাথায় বউ-বাচ্চা নিয়ে রওনা হয়েছিলাম দেশে ফিরবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভাগ্য সাথে ছিলোনা! সেইদিন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নিয়ে দেশে ফিরবার দিনটাই আমাদের জীবনের সবথেকে বিভৎস দিন হয়ে দাঁড়ায়! পুরো পৃথিবীটাই যেনো উলোট-পালোট হয়ে পড়ে আমাদের।

আমজাদ হোসেনের কথার মাঝেই নিশান্ত হাত খামচে ধরে চোখের পানি আটকাবার প্রচেষ্টায় দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো অন্বিতা। নিশান্ত খানিক চমকালো। অন্বিতার কোমড় জড়িয়ে আস্থার আখ্যা স্বরূপ আগলে সযত্নে নিলো। আমজাদ হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধরা গলায় আবারও বললেন,

—– এয়ারপোর্টের কাছাকাছি পৌঁছেছি তখন। আয়রা বরাবরের মতোই সিটবেল্ট বাঁধেনি। অনেক করে বলেছিলাম সিট বেল্টটা বাঁধতে। কিন্তু ওর নাকি বড্ড অসুবিধে হয়, ফোলা পেটে চাপ লাগবে বিধায় আমিও আর জোড় করিনি। মালেশিয়ার সড়কেও ৪০ কিলোমিটার পার আওয়ারে গাড়ি চালানো হাস্যকর ঠেকলেও আমি ধীরেসুস্থেই গাড়ি চালানোতে ব্রত ছিলাম। তবু ভাগ্য যে বড়ই কঠিন! এতো সুরক্ষা নিয়ে ফিরছিলাম তারপরও কোথায় থেকে একটা নিয়ন্ত্রণহীন প্রাইভেট কার এসে ধাক্কা মেরে দেয় আমাদের ভারা করা গাড়িটাকে। অনেক চেষ্টা করেছিলাম যাতে খুব বেশি ক্ষতি না হয়। ব্যালেন্স হারিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে একটা গাছের সাথে গিয়ে ধাক্ক লাগায় আছড়ে পড়ি আমরা। অন্বিতা ছিলো পেছনে বসা। আমাদের খুব বেশি চোট না লাগলেও সিট বেল্ট না বাঁধার কারণে আয়রার পেটে আঘাত লাগে ভীষণ। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠা আয়রাকে নিয়েই মানুষের সাহায্যে হসপিটালে নিয়ে আসি তৎক্ষণাৎ। ডক্টরেরা ইমার্জেন্সি অপারেশনের ফর্মালিটিস পূরণ করিয়ে নিয়েই ওটিতে নিয়ে যায় তাকে৷ তখন মা’য়ের গর্ভে আনন্দ ৯ মাসে পা দিয়েছিলো মাত্র! এদিকে ৯ বছরের অন্বিতাকে বুকে আগলেই প্রহর গুনছিলাম আমি, শুধু একজন স্বামী নয় আরো দুটো সন্তানের বাবার দায়িত্বও কাঁধে রেখে নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রাখবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ আমায় জীবনের সবথেকে কঠিন পরীক্ষাতেই ফেললেন। আয়রাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিয়েছিলেন চিরতরে। ডক্টরেরা ওটি থেকে বেরিয়ে তোয়ালায় মুটিয়ে ফুটফুটে আনন্দকে এনে তুলে দিয়েছিলেন আমার কোলে। আয়ারার কথা জিজ্ঞেস করতেই মুখ লুকিয়ে “সরি” শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন শুধুমাত্র, এর থেকে বেশি আর কিছু বলবার মতো খুঁজেই পাননি বোধহয়। আমি সেখানেই থমকে গিয়েছিলাম। গোটা পৃথিবী জুড়ে যে ছিলো সে মুহুর্তেই নাই হয়ে ফেলে গিয়েছিল আমায় একা করে। “আনন্দ-অন্বিতা” এই দুটো সন্তানের মুখের দিকে চেয়েই বাঁচতে হয়েছিলো আমায়৷ খাঁ খাঁ বুক নিয়েই অবশেষে দেশে ফিরেছিলাম, আনন্দকে বগুড়া ওদের খালামুনির কাছে রেখেছিলাম প্রথম ৬ মাস অন্তত মায়ের মতো লালন-পালনের উদ্দেশ্যে। এরপর প্রায় দু দুটো বছর স্বাভাবিকতায় ফিরতে পারিনি। আজ আমি এতোটা স্বাভাবিক তার মূলে আমার এই দুটো সন্তান, আর অন্বিতার বুকে পাথর চেপে করা সেই উক্তিটা। অন্বিতা সেদিন ঠোঁটে মলিন হাসি ফুটিয়েছিলো। আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলো, “আব্বু, তুমি কষ্ট পেয়ো না, আম্মু তো ডেলিভারির সময়ই আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছে তাইনা? তারমানে আম্মু সোজা জান্নাতে গিয়েছে। আম্মু ভালো আছে আব্বু, তুমি চিন্তা করো না খুব খুব খুব ভালো আছে আম্মু!”

ঘরে উপস্থিত সকলের চোখেই জমেছে নোনাজল। পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চাগুলোও কি এমন বুঝলো তাতেই চুপসে ফেললো মুখ। আমজাদ হোসেনের ভারী দীর্ঘশ্বাস ঘুরে ফিরে সকলের বুকের যেনো আঘাত করে বসলো। এতোক্ষণ যাবৎ ফাজলামি করে চলা সানি-রিভানও মুখ কালো করলো। সাথে শোনা গেলো কারো ফুঁপিয়ে ওঠা চাপা আর্তনাদ। নিশান্ত তৎক্ষণাৎ বুকে টেনে নিলো অন্বিতাকে। চোখ বেয়ে নোনাজলের স্রোতধারা বইবার পূর্বেই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ফেললো। অন্বিতাকে নিজের বুকে চেপে ধরেই নিজের চোখে জমা জলগুলো আড়ালে মুছে ফেলে অপরাধী কন্ঠে আমজাদ হোসেনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—— আমায় ক্ষমা করবেন বাবা, আ…আমি আসলে জানতাম না এতোবড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে গিয়েছিল আপনাদের জীবনে। অন্বিতার মন খারাপ হবে বিধায় আলাদা করে কখনো জিজ্ঞেসাও করা হয়নি মা’য়ের গত হওয়ার কারণ কিংবা সময়। এসব জানলে বিশ্বাস করুন আমি কক্ষনও অতীত নিয়ে কথা উঠাতাম না!

আমজাদ হোসেন নিশান্তের মাথায় হাত বুলালেন। তাকে শান্ত করবার উদ্দেশ্যে বললেন,

—— ব্যাপার না, এখন তুমি আমাদের পরিবারের একটা মূখ্য অংশ! কখনোও না কখনোও ঘটনাটা তোমার সামনে আসতোই। জেনে রাখা ক্ষতি কিসের?

নিশান্ত নিজের অশান্ত মনটাকে যথাসম্ভব শান্ত করবার চেষ্টা চালালেন। অন্বিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশান্তের বুক থেকে উঠে বসতেই আফসানা বেগম এগিয়ে গেলেন নিজের পুত্রবধূ কম মেয়ে বেশি মেয়েটার নিকটে। এই ফাঁকে আনন্দকেও হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। আনন্দকে নিজের কোলে বসিয়ে অন্বিতার পাশে আসন গ্রহণ করলেন আফসানা। দুজনের কপালেই মায়াভরা চুম্বন এঁকে দিয়ে বললেন,

—— আজ থেকে আমি তোদের দুটো মা বুঝলি! আর আন্টি-আংকেল বলে ডাকবি না আমাদের। আর কোনো কান্না নয়, তোরা কাঁদলে বেয়াইন আমার রাগ করবে না বুঝি? কান্না থামিয়ে হাস, হাস বলছি!

আফসানার আদরে মাখা ধমকে হেসে ফেললো দু ভাই-বোন মিলেই। ওদের ঠোঁটে হাসির বিচরণ দেখে একে একে হেসে ফেললো সবাই। নূহা চিকুকে কোলে নিয়ে ভাইয়ের কোলে এক লাফ মেরে উঠে বসলো। মাঝখান থেকে তমা দু’হাতে তালি বাজিয়ে বলে উঠলো,

—– কি মতা কি মতা, বিয়েল ফুল ফুতেচে সবাই আবার হেতেচে!

#চলবে_________________

(

3 COMMENTS

  1. Sotti golpota khub sundar hoyacha…..bolar baira….ami love story r bisal fan…..R ai golpota atulonio….plz golpota end part gulo di didivai….amra apakhay achi…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here