এক আকাশ ভালোবাসি পর্ব ৪০+৪১

#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_৪০
#নিশাত_জাহান_নিশি

রূপ এসব মনে করছে আর চোখ বুজে ঢুকরে কেঁদে উঠছে।

প্রায় বিশ মিনিট পর গাড়ি এসে পৌঁছে গেলো পুলিশ স্টেশানের সামনে। একে একে সবাই তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। রূপ সবার আগে গাড়ি থেকে নেমে থানার ভিতর ঢুকে গেলো। রূপের পিছু পিছু বাকিরা ও থানায় ঢুকে গেলো।

মাঝ বয়সী একজন পুলিশ অফিসারের মুখোমুখি বসে আছে রূপ। পাশেই মিঃ হাসিব এবং মৃন্ময় বসে আছে। মারু রূপের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রূপ কেঁদে কেটে অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“স্যার আমার হাজবেন্ড এবং শ্বশুড়কে আজ সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় গেছে আমরা কেউ জানি না। আমাদের কিছু বলে ও যায় নি। আদৌ আমার হাজবেন্ড এবং শ্বশুড় নিজে থেকে কোথাও গেছে নাকি কেউ তাদের তুলে নিয়ে গেছে তা ও আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অস্পষ্ট।”

পুলিশ অফিসার কিছুটা সিরিয়াস হয়ে রূপের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

—–“আপনি কি কাউকে সন্দেহ করছেন?”

—–“হুম করছি।”

—–“কাকে?”

—–“আমার ফুফুমনিকে!”

—–“আপনি কোন এঙ্গেলে উনাকে সন্দেহ করছেন?”

—–“দুটো এঙ্গেল থেকে আমি উনাকে সন্দেহ করছি। প্রথমত, উনি আমার হাজবেন্ডের সৎ মা। দ্বিতীয়ত, উনি আমার আম্মু এবং আব্বুর সম্ভাব্য খুনি।”

পুলিশ অফিসার কপাল কুঁচকে বললেন,,,,,,

—–“মানে? সম্ভাব্য খুনি বলতে আপনি কি মিন করতে চাইছেন?”

—–“স্যার আমার আম্মু, আব্বু গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্টে মারা যায়। গ্যাস লাইনের পাইপটা কি কাকতালীয় ভাবে আগে থেকেই লিক ছিলো নাকি কেউ ইচ্ছে করে লিক করেছে সে বিষয়ে এখানে উপস্থিত আমরা সকলেই যথেষ্ট সন্দিহান। তবে আমরা ধারনা করছি গ্যাস লাইনটা আমার ফুফুমনি আগে থেকেই লিক করে রেখেছিলো। ফুফুমনিকে সন্দেহ করার প্রধান এবং অন্যতম কারন হলো উনি খুবই লোভী। টাকা, পয়সা এবং ধন সম্পত্তিতে উনার লোভ বেশি। আমার আম্মু, আব্বুর মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পওির মালিকানা আমার হয়ে যায়। সেই খাতিরে ফুফুমনি আঠারো বছর আমাকে মানুষ করে। যখন আঠারো পেরিয়ে ঊনিশে পা রাখি তখনই উনি জোর জবরদস্তি করে আমার থেকে দলিলে সাইন করে নেয়। এখন আমার সব সম্পওি ফুফুমনির নামে। ফুফুমনির এই প্রতারনা সম্পর্কে এখানে উপস্থিত প্রত্যেকে খুব ভালো করে জানে। আর আমরা এ ও জানি আপনি যদি এখন ফুফুমনিকে গিয়ে আপনাদের ভাষায় জেরা করেন তবে ফুফুমনি গড়গড়িয়ে সব সত্যি বলে দিবে। কারন উনি পুলিশকে অনেক ভয় পায়। আস্তে আস্তে উনার মুখ থেকে আমার স্বামী এবং শ্বশুড়ের কিডন্যাপিং এর ঘটনাটা ও সামনে আসবে। মোট কথা হলো আমি এই মুহূর্তে যেমন আমার স্বামী এবং শ্বশুড়কে সুস্থ অবস্থায় ফেরত চাইছি তেমনি আমার মা, বাবার খুনিদের ও শাস্তি চাইছি। এতো বছর চুপ করে ছিলাম শুধু সম্পর্ক ভাঙ্গার ভয়ে। কিন্তু এখন যখন দেখছি আমার ফুফুমনি দিন দিন বর্বর হয়ে উঠছে তাই আমাকে উনার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হলো। না চাইতে ও মুখ খুলতে হলো। আমি জাস্টিস চাই স্যার। প্লিজ আপনি আমাদের সাহায্য করুন।”

মিঃ হাসিব ও রূপের সাথে তাল মিলালো। মৃন্ময় আর মারু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ অফিসার কিছুক্ষন ভেবে চিন্তে বলল,,,,,

——“তাহলে কি আপনি উনাদের অভিযোগ করতে চাইছেন?”

—–“জ্বি চাইছি। দুজনের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ। প্রথম জন, আমার ফুফুমনি। দ্বিতীয় জন, আমার ফুফুমনির দেবর।”

—–“ওকে আপনি এতক্ষন যা যা বললেন তা আবারো বলুন। আমি লিখছি।”

রূপ আবারো সব অভিযোগ রিপিট করল। প্রায় কিছুক্ষন পর পুলিশ অভিযোগ পএ হাতে নিয়ে বসা থেকে উঠে রূপকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“ওকে চলুন। দেখি আপনার সন্দেহ কতটুকু সঠিক। ইনভেসটিকেশান করার পর যদি আপনার সন্দেহ সত্যি প্রমানিত হয় তবে আপনি চাইলেই উনাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন।”

রূপ বসা থেকে উঠে মিঃ হাসিব, মৃন্ময় আর মারুকে নিয়ে থানার বাইরে এসে গাড়িতে উঠে বসল। পুলিশ একজন মহিলা কন্সটেবল এবং একজন পুরুষ কন্সটেবল নিয়ে উনাদের গাড়িতে উঠে মৃন্ময়ের গাড়িকে ফলো করতে করতে সোজা মৃন্ময়দের বাড়ি পৌঁছে গেলো। পুলিশ অফিসার প্রথমে গাড়ি থেকে নেমে মৃন্ময়দের বাড়ির ড্রইং রুমে ঢুকে গেলো। পিছু পিছু রূপ, মিঃ হাসিব, মৃন্ময় আর মারু এলো। বাড়ির সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছিলো। রূপদের পাশাপাশি পুলিশকে দেখে ডাইনিং টেবিলের সবাই হকচকিয়ে গেলো। সবাই টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।

পুলিশ ঝাঁঝালো কন্ঠে ডাইনিং টেবিলের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“আপনাদের মধ্যে মায়া আহমেদ কে?”

সবাই শুকনো ঢোক গিলে মায়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়া আহমেদ বড় বড় চোখ করে পুলিশের দিকে তাকিয়ে আছে। রূপ দৌঁড়ে গিয়ে মায়া আহমেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,,

—–“স্যার উনিই মায়া আহমেদ। উনিই আমার হাজবেন্ড আর শ্বশুড়কে গায়েব করেছে।”

মায়া আহমেদ বেশ অবাক হয়ে রূপের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

—–“আমি তোর হাজবেন্ড আর শ্বশুড়কে গায়েব করেছি মানে? কি যা তা বকছিস? আমি নিজের স্বামী আর ছেলেকে গায়েব করতে যাবো কেনো?”

রূপ কিছু বলার আগেই পুলিশ অফিসার বলে উঠল,,,,,,,,,

—–“তাহলে বলুন, আপনার স্বামী এবং আপনার ছেলে কোথায়?”

মায়া আহমেদ বেশ সাহস নিয়ে বলল,,,,,,,

—–“ইদানিং আমার স্বামীর সাথে আমার সম্পর্ক তেমন ভালো না। তাই ওর বিষয়ে তেমন এক্টা খবর রাখা হয় না। আর ছেলে তো ওর বউ নিয়ে আলাদা ই থাকে। নিশ্চয়ই আমার ছেলের খবর ওর বউ ই রাখবে। ওর মা না। আমার কাছে থাকলে না হয় আমিই রাখতাম।”

পুলিশ মায়া আহমেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বেশ কঠোর কন্ঠে বলল,,,,,,,

—–“ভালোয় ভালোয় বলছি মুখ খুলুন। সত্যিটা বলুন। আপনার স্বামী এবং ছেলেকে কোথায় আটকে রেখেছেন বলে দিন। নয়তো আমি কঠোর হতে বাধ্য হবো। আপনাকে এরেস্ট করে টেনে হেছড়ে থানায় নিয়ে যাবো।”

রেজাউল আহমেদ তেড়ে এসে পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,,,,

—–“আপনি কিসের ভিত্তিতে উনাকে এরেস্ট করার কথা বলছেন? আপনার কাছে কোনো প্রমান আছে?”

—–“প্রমান নেই তবে অভিযোগ আছে। প্রমান থানায় নিয়ে জড় করব। অপরাধী নিজেই অপরাধ স্বীকার করবে।”

পুলিশ আবারো এক ভ্রু উঁচু করে রেজাউল আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

——“বাই দ্যা ওয়ে আপনিই কি সেই রেজাউল আহমেদ? যার বিরুদ্ধে মিসেস রূপ অভিযোগ করেছেন?”

রেজাউল আহমেদ মুহূর্তেই হকচকিয়ে গেলো। উনি আমতা আমতা করে বলল,,,,,,

—–“হোয়াট? আমার বিরুদ্ধে কিসের অভিযোগ? আমি কি করলাম?”

—–“মিসেস রূপ আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। আপনি ও মায়া আহমেদের সাথে জড়িত।”

——“দেখুন ইন্সপেক্টর, প্রমান নিয়ে আমার বিরুদ্ধে কথা বলতে আসবেন। অযথা আমার সাথে লাগতে আসবেন না।”

মায়া আহমেদ ও তেড়ে এসে পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,

—–“হুম প্রমান দেখান। আমাদের দুজনের বিরুদ্ধে। যথেষ্ট প্রমান দেখিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে লড়তে আসুন।”

পুলিশ অফিসার কিছু বলার আগেই রূপ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,,

—–“এক এক করে আমি দুজনের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ গুলো পুলিশের কাছে তুলে ধরতে চাই। যা প্রমান হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত আমি মায়া আহমেদের বিরুদ্ধে করা আমার অভিযোগ গুলো এক এক করে বলছি।

রূপ কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,,

—–“প্রথমেই আমি কয়েকটা ব্যাপার ক্লিয়ার করতে চাই। ফুফুমনির বিরুদ্ধে দু দুটো অভিযোগ আছে আমার। প্রথমত, উনি আমার আম্মু্, আব্বুর খুনি। দ্বিতীয়ত, উনি মুহিতের সম্পওির লোভে মুহিত আর আঙ্কেলকে আটকে রেখেছে। এই সম্পূর্ন অভিযোগের প্রমাণ আমি নিজেই। যে মহিলা সম্পওির জন্য তার আপন ভাই এবং ভাবীকে মারতে পারে তার পক্ষে সবই সম্ভব। আঠারো বছরের আগ পর্যন্ত উনি আমাকে নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করে। বুঝতেই দেয় নি আমি উনার ভাইয়ের মেয়ে। কিন্তু যখন আঠারো বছর পেরিয়ে ১৯ এ পা রাখলাম তখন ই উনি উনার আসল রূপ দেখালেন। জোর জবরদস্তি করে আমার থেকে সাইন নিয়ে আমার সমস্ত সম্পওি হাতিয়ে নিলেন। বাড়ির দলিল এখন উনার কাছেই। পুলিশ যদি পুরো বাড়িটা সার্চ করেন তো সম্পওির দলিল পেয়ে যাবে। এছাড়া ও ফুফুমনির বিরুদ্ধে আমার আরেকটা অভিযোগ আছে। উনি আমার হাজবেন্ডের আসল মা কে এতোটাই নির্যাতন করেছেন যে উনি আত্নহত্যা করতে বাধ্য হয়। এক প্রকার আত্নহত্যার প্ররোচনা দিয়েছেন উনি। হলো ও ঠিক তাই। আমার শ্বাশুড়ী মা সত্যি সত্যি সুসাইড করেছে।”

রূপ পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

——“স্যার এতক্ষন পর্যন্ত আমি যা যা বললাম তা কি ঐ মায়া আহমেদের বিরুদ্ধে প্রমান হিসেবে যথেষ্ট না? আপনি ইনভেসটিকেশার করে দেখুন। সত্যিটা আপনা আপনি সামনে চলে আসবে।”

রূপ এবার রেজাউল আহমেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“স্যার এবার আমি এই লোকটার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর এই লোকটা ও আমার শ্বশুড় এবং স্বামীর কিডন্যাপিং এর পেছনে রয়েছে। কারন কিছু দিন আগে উনার সাথে আমার স্বামী এবং আমার শ্বশুড়ের টক ঝক হয়। এর কারন হলো, উনার ছেলে এবং মেয়ে দুজনই ড্রাগ এডিক্টেড। আমার স্বামী ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে বাড়িতে পুলিশ ডেকে আনে। ঘটনাস্থলে পুলিশ উনার ছেলের রুমে ড্রাগস পায়। যার কারনে পুলিশ প্রমানসহ উনার ছেলে এবং, মেয়েকে থানায় নিয়ে যায়। এই ব্যাপারটাতে আমার স্বামীর সাথে আমার শ্বশুড় ও যুক্ত ছিলো। মানে আমার শ্বশুড়ের ফুল সাপোর্ট ছিলো আমার হাজবেন্ডের উপর। মূলত আমার হাজবেন্ড এবং আমার শ্বশুড়ের জন্যই উনার ছেলেমেয়েরা থানায় আছে। আর এই আক্রোশ থেকেই উনি আমার হাজবেন্ড এবং শ্বশুড়কে কিডন্যাপ করে।”

মায়া আহমেদ আর রেজাউল আহমেদ দুজন দুজনের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রূপের কথার উপর ভিত্তি করে পুলিশ স্বয়ং পুরো বাড়িতে সার্চ করে। স্টাডি রুমের সিন্দুকে সত্যি সত্যি রূপের বাড়ির দলিল পাওয়া যায়। দলিলে রূপের সাইন আছে। পুরো দলিলটাতে উল্লেখ আছে রূপ স্ব ইচ্ছায় মায়া আহমেদের নামে ওর পুরো প্রোপার্টি লিখে দিয়েছে। পুলিশ বাড়ির দলিলটা হাতে নিয়ে মায়া আহমেদ এবং রেজাউল আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“এই যে প্রমান পেয়ে গেছি। চলুন এবার থানায়।”

মায়া আহমেদ চোখে অজস্র জল নিয়ে রূপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রূপের হাত চেঁপে ধরে বলল,,,,,,,

—–“রূপ বিশ্বাস কর আমি এসবের কিচ্ছু জানি না। তুই এতক্ষন যা যা বললি সব আমার মাথার উপর দিয়ে গেছে। আমি আমার ভাই আর ভাবীকে মারি নি। বিশ্বাস কর। ওদের মেরে ফেলার চিন্তা আমার মাথায় কখনো আসে ই নি। তবে এটা ঠিক আমি আমার হাজবেন্ডের দ্বিতীয় স্ত্রীকে মানসিক ভাবে অনেক অত্যাচার করেছি। যার কারনে সে বাধ্য হয়েছে সুসাইড করতে। তোর উপর নির্যাতন করেছি তাও ঠিক। ভাই, ভাবীর বিশাল সম্পওি দেখে আমি লোভে পড়ে গিয়েছিলাম। যার বশে আমি বাধ্য হয়েছি আঠারো বছর পর তোদের সস্পওি হাতিয়ে নিতে। তুই চাইলে আমি দলিল ফিরিয়ে দিবো। তোর সম্পওি তোর নামে হস্তান্তর করে দিবো। এরপরে ও আমার বিরুদ্ধে এতো বড় অপবাদ দিস না।”

মায়া আহমেদ কিছুটা থেমে আবারো বলল,,,,,,,,

——“বিশ্বাস কর রূপ আমি মুহিত আর সানোয়ারের ব্যাপারে কিছু জানি না। ওরা দুজন কোথায় আছে তা ও জানি না। সানোয়ারকে যে পাওয়া যাচ্ছে না, তাও আমার জানা নেই। আমি ভেবেছি সানোয়ার অফিসে। তাই ওর খোঁজ নেওয়া হয় নি। তুই তো জানিস ই ইদানিং সানোয়ারের সাথে আমার সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। আমি বা রেজাউল এই বিষয়ে কিছু জানি না। তোর করা প্রত্যেকটা অভিযোগ ভুল রূপ। না আমি ভাই, ভাবীকে মেরেছি না মুহিত আর সানোয়ারের কিডন্যাপিং করিয়েছি। আমায় বিশ্বাস কর রূপ। প্লিজ বিলিভ মি।”

রূপ মায়া আহমেদের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে মৃদ্যু চিৎকার দিয়ে বলল,,,,,,

—–“ফুফুমনি প্লিজ। তুমি মিথ্যা কান্না দিয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করতে এসো না। তুমি নাটক করে কাঁদছ। পুরোটাই তোমার নাটক। আমার করা প্রত্যেকটা অভিযোগ সঠিক। তুমি খুনি বুঝেছ? খুব ঠান্ডা মাথার খুনি। তুমিই আমার মা বাবাকে মেরেছ। সিলিন্ডারের লাইনটা তুমিই আগে থেকে লিক করে রেখেছিলে বলো? ঘটনার আগের দিন রাতে তুমি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলে। আমার খুব জ্বর ছিলো আমাকে দেখতে গিয়েছিলে। তুমি নিজের মুখে আমাকে বলেছ এই কথাটা। তুমি যাওয়ার পরের দিন সকালেই সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়। কি অদ্ভুত মিল। এরপরে ও তুমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যে বলবে?”

রূপ কিছুটা থেমে আবারো বলল,,,,,,,,

——“মুহিত আর আঙ্কের কোথায় আছে তাড়াতাড়ি বলে দাও। না হয় তোমার দ্বিগুন শাস্তি হবে। রেজাউল আঙ্কেল ও তোমার সাথে জড়িয়ে আছে বলো?”

মায়া আহমেদ কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি পুরোপুরি নির্দোষ। কিছুই জানে না। মৃন্ময় অশ্রুসিক্ত চোখে মায়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে আছে। চেয়ে ও মায়া আহমেদের কাছে যেতে পারছে না। এদিকে আবার মায়ের কষ্টটা ও সহ্য করতে পারছে না। মারু মৃন্ময়কে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

মিঃ হাসিব বুকের উপর দু হাত গুজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটা ঘটনা পর্যবেক্ষন করছে। উনি কিছুই বলছে না। শুধু দেখেই যাচ্ছে। হয়তো চাইছে ভাগনী নিজের মতো করে প্রতিবাদ করুক। পিছে না হয় উনি ছায়া হয়ে রইল।

রেজাউল আহমেদ রূপের দিকে তেড়ে এসে বলল,,,,,,,

——“রূপ তুই যা বলছিস সব কিন্তু অনুমানের বশে। আমি আর ভাবী কিচ্ছু জানি না। মুহিত আর ভাই কোথায় আছে এই ব্যাপারে আমাদের কিছুই জানা নেই। তুই খামোখা আমাদের ব্লেইম করছিস। এক তো আছি আমি দুই ছেলে, মেয়ের টেনশানে। দ্বিতীয়ত তোর এসব উটকো প্যারা। প্লিজ দয়া করে কেইসটা তুলে নে।”

—–“না তুলব না। যতক্ষন পর্যন্ত আমি আমার স্বামী এবং আমার শ্বশুড়কে খুঁজে না পাবো ততক্ষন পর্যন্ত আমি কেইস তুলব না।”

পুলিশ একজন লেডি কন্সটেবলকে ইশারা করে বলল মায়া আহমেদকে গাড়িতে তুলতে। লেডি কন্সটেবল মায়া আহমেদকে টেনে হেছড়ে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। আরেকজন পুরুষ কন্সটেবল এসে রেজাউল আহমেদকে টেনে গাড়িতে উঠিয়ে নিলো। মৃন্ময় চোখের পানি ছেড়ে মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। সোহেলী আহমেদ মাথা চাপড়াচ্ছে আর কেঁদে চলছে। স্বামী, সন্তান উভয়ই এখন জেলে। পুরো বাড়িতে উনি একা। দোলা গতকাল রাতে শ্বশুড় বাড়ি ফিরে গেছে।

রূপ কাঁদতে কাঁদতে মৃন্ময়ের পাশে বসে মৃন্ময়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,,,,,,

—–“ভাইয়া থানায় চলো। দেখি ফুফুমনি কিছু স্বীকার করে কিনা। যদি ফুফুমনি সত্যিটা বলে দেয়। আমি কথা দিচ্ছি ফুফুমনির বিরুদ্ধে করা অভিযোগ আমি তুলে নিবো। আমার আম্মু, আব্বুর খুনের কেইসটা ও তুলে নিবো। ফুফুমনিকে ভয় না লাগালে উনি কখনো সত্যিটা স্বীকার করবে না। তাই আমাকে এই পথটা বেছে নিতে হলো। আমায় ভরসা করো মৃন্ময় ভাই। আমি ফুফুমনিকে বেশি দিন জেল হাজুতে থাকতে দিবো না।”

মিঃ হাসিব রূপের কাঁধে হাত রেখে বলল,,,,,,,

—–“এতোটা উদার হয়ো না রূপ। উনি যদি খুন করে থাকে অবশ্যই উনাকে খুনের শাস্তি পেতে হবে। তুমি কোন রকম কেইস তুলবে না। এখন খুনের টপিকটা বাদ দাও। আগে মুহিত আর সানোয়ার ভাই কোথায় আছে তা খুঁজে বের করতে দাও।”

রূপ কিছু বলল না। শুধু ওর মামুর দিকে তাকিয়ে রইল। মৃন্ময় চোখের জল মুছে বসা থেকে উঠে রূপকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,

—–“থানায় চল। দেখি আম্মু সত্যিটা স্বীকার করে কিনা।”

মৃন্ময়ের কথায় সবাই এক এক করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। ওদের সাথে সোহেলী আহমেদ ও আছে। প্রায় পনেরো মিনিট পর ওরা থানায় এসে পৌঁছে গেলো। মায়া আহমেদ আর রেজাউল আহমেদের জবানবন্দি নিচ্ছে পুলিশ। ওরা কিছুতেই সত্যিটা স্বীকার করছে না। বার বার বলছে উনারা কিছুই জানে না। এরপরে ও পুলিশ উনার গোয়েন্দা গিরি বহাল রাখছে।

রূপ বুঝতে পারছে আসামীরা এতো সহজে সত্যিটা স্বীকার করবে না। রূপ হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারছে না। মৃন্ময় আর মারুকে নিয়ে সে ছুটছে মুহিতের সব ফ্রেন্ডসদের বাড়িতে। রূপ উন্মাদের মতো পুরো ঢাকা শহরকে চুষে ফেলছে। বাট মুহিত এবং সানেয়ার আহমেদের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।

কেটে গেলো প্রায় দুই দিন। মায়া আহমেদ আর রেজাউল আহমেদ কিছুতেই সত্যিটা স্বীকার করছে না। পুলিশ অনেক ভয় দেখিয়ে ও সত্যিটা ওদের মুখ থেকে বের করতে পারছে না। তবে উনারা মুহিতের আম্মুর সুসাইড কেইসটা ইনভেসটিকেশান করে প্রমান পেয়েছে যে, মায়া আহমেদ পরোক্ষভাবে হলে ও ঐ সুসাইড কেইসের সাথে জড়িত ছিলো। রূপের আম্মু, আব্বুর খুন এবং মুহিতদের কিডন্যাপিং এই বিষয়ে মায়া আহমেদ কিছুতেই মুখ খুলছে না। বার বার বলছে উনি কিছুই জানে না।

এই দুই দিনে মায়া আহমেদের শরীরের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। হার্টের প্রবলেম দেখা দিয়েছে। রেজাউল আহমেদের অবস্থা ও তেমন ভালো না। ছেলে, মেয়ে, ওয়াইফ সবার টেনশান করছে উনি। পুলিশ এখন যথেষ্ট সন্দিহান। আসলেই রূপের অভিযোগ ঠিক ছিলো কি না!

ঐদিকে রূপ খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে শুকিয়ে একদম পাতলা হয়ে যাচ্ছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। চোখ, মুখ সবসময় ফুলে ফেঁপে থাকে। সারাক্ষন সে কান্না করে। পাগলের মতো পুরো এলাকা ঘুরাঘুরি করে। এই দুই দিনে ফেরার দুজনের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশরা ও চেষ্টা করছে মুহিতদের খুঁজে বের করতে। ঢাকা শহরের প্রতিটা থানায়, হসপিটালে ও খুঁজ নেওয়া হয়ে গেছে কোথাও মুহিতদের আভাস পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।

মৃন্ময় আর মিঃ হাসিব ও পাগলের মতো মুহিতদের খুঁজে যাচ্ছে। খুঁজতে খুঁজতে সবাই ক্লান্ত। তবে কিছুতেই যেনো মুহিত আর সানোয়ার আহমেদের দেখা মিলছে না। একে একে সবাই হতাশ হয়ে পড়ছে।

ঘড়িতে রাত বারোটা বাজছে। রূপ জলজ্যান্ত এক্টা লাশের মতো ফ্লোরে শুয়ে আছে। চোখে ঘুম নেই ওর। চোখ দুটো বড় বড় করে সে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। এই দুই রাত সে চোখ মেলেই কাটিয়ে দিয়েছে। চোখ বুজলেই শুধু মুহিতের মুখটা ভেসে উঠে। মুহিতের স্মৃতি গুলো রূপকে তাড়া করে। মাথায় প্রচন্ড পেইন হয়। হার্টবিট বেড়ে যায়।

রূপের পাশেই এক্টা খাবারের প্লেইট রাখা আছে। মারু সেই দু ঘন্টা আগে এসে খাবারের প্লেইটটা রূপের পাশে রেখে গেছে। এই দুইদিন ধরে রূপ মুখে কিছুই তুলছে না। শুধু নির্বাক হয়ে বসে থাকে, শুয়ে থাকে। আর হুট হাট করে বাড়ির বাইরে চলে যায়। রাস্তায় দৌঁড়াদৌঁড়ি করে আর মুহিত মুহিত বলে চিৎকার চেঁচামেচি করে। কিছুটা মানসিক রোগীদের মতো। মিঃ হাসিব অনেক চেষ্টা করে ও রূপকে মানসিক ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে পারছে না। রূপ জায়গা থেকে নড়তেই চায় না। যার কারনে রূপের মানসিক অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। রূপের অবস্থা দেখলে অতি শত্রুদের ও চোখে জল চলে আসবে। খুবই বর্বর অবস্থা ওর।

রূপ রুমের দরজা লাগিয়ে এই শীতের রাতে ও পাখা ছেড়ে শুয়ে আছে। আর চোখ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে পাখাটাকে পর্যবেক্ষন করছে। এর মাঝেই আচমকা রূপের ফোনটা বেজে উঠল। সাথে সাথে রূপের ধ্যানটা ও ভেঙ্গে গেলো। শোয়া থেকে উঠে রূপ ডেস্কের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিলো। এক্টা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। রূপ কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করল। ফোনটা পিক করার সাথে সাথে ঐপাশ থেকে কেউ একজন এক নিশ্বাসে বলে উঠল,,,,,,,,

—–“এটা কি মুহিতের ওয়াইফের নাম্বার?”

রূপ অস্পষ্ট স্বরে বলল,,,,,,,

—–“জ্বি। আআআপনি কে?”

—–“আমি আপনার শুভাঙ্ক্ষী। প্লিজ দেরি না করে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকা হাইওয়ের দিকে চলে আসুন। মুহিত এবং ওর বাবা রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তার বাম সাইডে পড়ে আছে। আমি চেয়ে ও ওদের হেল্প করতে পারছি না। কারন আমি নিজেই এখন আহত।”

কথা গুলো বলেই লোকটা ঠাস করে কলটা কেটে দিলো। রূপ ফোনটা কানের কাছে ধরেই মুর্তির মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ থেকে তার অঝড়ে পানি পড়ছে। রূপ ঠিক মতো শ্বাস নিতে পারছে কিনা তা ও সঠিক বুঝা যাচ্ছে না। কথা বলার শক্তিটা ও যোগাতে পারছে না সে। চিৎকার করে যে কাউকে ডাকবে তার ও জো নেই।

প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে রূপ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আচমকা বুক ফাঁটা চিৎকার দিয়ে বলল,,,,,

—–“মামু, মৃন্ময় ভাই তোমরা কোথায়? আমার মুহিতকে তোমরা বাঁচাও প্লিজ। আমার মুহিত হয়তো আর বেঁচে নেই।”

রূপ আর দাঁড়াল না। ফোনটা হাত থেকে ছুড়ে মেরে পাগলের মতো হন্ন হয়ে রুম থেকে বের হয়ে সদর দরজা পাড় হয়ে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে গেলো। রূপের পিছু পিছু মৃন্ময়, মিঃ হাসিব, মারু ও দৌঁড়াতে লাগল।
#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_৪১
#নিশাত_জাহান_নিশি

রূপ আর দাঁড়াল না। ফোনটা হাত থেকে ছুড়ে মেরে পাগলের মতো হন্ন হয়ে রুম থেকে বের হয়ে সদর দরজা পাড় হয়ে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে গেলো। রূপের পিছু পিছু মৃন্ময়, মিঃ হাসিব, মারু ও দৌঁড়াতে লাগল।

মৃন্ময় রূপকে ক্রস করে রূপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,,,

—–“এই কি হয়েছে তোর? এইভাবে চিৎকার করে দৌঁড়াচ্ছিস কেনো?”

রূপ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর মৃন্ময়কে ঝাঁকিয়ে বলছে,,,,,

——“ঢাকা হাইওয়ে চলো প্লিজ। আমার মুহিত ঐখানেই আছে।”

মৃন্ময় কপাল কুঁচকে বলল,,,,,,

—–“কে বলল তোকে? কার থেকে শুনেছিস?”

রূপ ঢুকড়ে কাঁদছে আর চিল্লিয়ে বলছে,,,,,,

—–“আমাকে একজন কল করে বলেছে। আঙ্কেল এবং মুহিত দুজনই আহত। প্লিজ কথা না বাড়িয়ে আমাকে মুহিতের কাছে নিয়ে চলো। হাতে বেশি সময় নেই। আমি আমার মুহিতকে জীবিত অবস্থায় দেখতে চাই। যেকোনো মূল্যেই হোক, আমার মুহিতকে চাই ই চাই।”

মৃন্ময় আর কথা না বাড়িয়ে দৌঁড়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল। মিঃ হাসিব পেরেশান হয়ে মৃন্ময়ের পাশের সিটে বসে পড়ল। রূপ বড় বড় শ্বাস ফেলে গাড়ির ব্যাক সিটে বসে পড়ল। রূপের পাশে মারু বসেছে। মারু রূপকে বুকের সাথে চেঁপে ধরে রেখেছে। রূপের শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে যায় যায় অবস্থা। মুহিতকে দেখার উওেজনায় সে কাতর হয়ে আছে।

মৃন্ময় হাই স্পীডে গাড়ি নিয়ে ছুটল ঢাকা হাইওয়ে রোডে। রূপদের ফ্ল্যাটটা হাইওয়ে থেকে প্রায় আধ ঘন্টার রাস্তা। মৃন্ময় পারছে না গাড়িটা হাওয়ায় ভাসিয়ে নিতে। রূপ কেঁদে কেটে মারুর বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। মারু কিছুতেই রূপকে সামলাতে পারছে না। মুহিতের ঠোঁটের সেই পাগল করা মৃদ্যু হাসিটা রূপকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। রূপ আদৌ মুহিতের সেই হাসি মুখটা দেখতে পারবে কিনা সে নিয়ে দুটানায় আছে। রূপের কানে শুধু এক্টা কথাই বাজছে,,,,,,,

—–“ভালোবাসি রূপ। খুব খুব খুব ভালোবাসি। আমি তোমাকে এক আকাশ সমান ভালোবাসি। তুমি পৃথিবীর যতো দূর ছুটে যাবে ততদূর পর্যন্ত আমার ভালোবাসার ছায়ায় তোমাকে থাকতে হবে। তুমি চাইলে ও আমার ভালোবাসা অস্বীকার করতে পারবে না। কারন তোমার মাথার উপর থাকা বিশাল আকাশটাকে তুমি চাইলে ও সরাতে পারবে না।”

রূপ এসব ভাবছে আর ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে। মারু রূপের মাথায় হাত বুলিয়ে রূপকে শান্ত হতে বলছে। উওজনা, কৌতুহল, ভয়, বিড়ম্বনা এসব নিয়ে কেটে গেলো প্রায় আধ ঘন্টা। আধ ঘন্টা পর গাড়ি এসে পৌঁছে গেলো ঢাকা হাইওয়ে রোডের বিপরীত পাশে। মৃন্ময় আর মিঃ হাসিব গাড়ি থেকে নেমে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে রাস্তার এই পাশ ওপাশ ঘুড়ে মুহিত আর সানোয়ার আহমেদকে খুঁজছে। সোডিয়ামের ঝাপসা আলোতে আশ পাশটা ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে না। দুজনই ফ্ল্যাশ লাইট নিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে হাঁটছে আর মুহিত মুহিত বলে চেচাচ্ছে।

রূপ খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। শ্বাস বেড়ে যাওয়ার কারনে এমনটা হচ্ছে। মারু রূপকে গাড়ি থেকে নামতে বারন করছে। কিন্তু রূপ মারুর কথা শুনছে না। গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে সে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। সোডিয়ামের আলোতে যতদূর যাওয়া সম্ভব রূপ ঠিক ততো দূর পর্যন্ত ছুটছে। আচমকাই রূপের চোখ গেলো রাস্তার ডান পাশে। মানুষের অবয়বের মতো কিছু এক্টা নড়ছে। মনে হচ্ছে কোনো মানুষ খুব যুদ্ধ করে শ্বাস প্রশ্বাস ফেলছে। রূপের বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল। চোখে, মুখে আতঙ্ক নিয়ে রূপ ছুটে গেলো রাস্তার ডান পাশে।

ডান পাশে ছুটে যেতেই রূপের চোখ পড়ল সানোয়ার আহমেদের নড়তে চড়তে থাকা রক্তাক্ত দেহটার দিকে। উনার পুরো শরীরটা রক্তে লাল হয়ে আছে। খুব কষ্টে উনি শ্বাস নিচ্ছে। সানোয়ার আহমেদের পাশেই মরা লাশের মতো পড়ে আছে মুহিত। মুহিত এক্টু ও নড়ছে না। আদৌ সে শ্বাস নিচ্ছে কিনা তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। সানোয়ার আহমেদ নড়ে চড়ে মুহিতের দিকে এগুতে চেষ্টা করছে আর অস্পষ্টভাবে কিছু বলছে। চোখের সামনে এসব দেখে রূপের মাথা ঘুড়ছে। হাত, পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে সে। শ্বাস দ্বিগুন বেড়ে দম আটকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

রূপকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মারু দৌঁড়ে এসে দাঁড়ালো রূপের পাশে। রূপ কাঁপা কাঁপা হাতে মারুকে ইশারা করে মাটিতে পড়ে থাকা সানোয়ার আহমেদকে দেখালো। মারু রূপের ইশারাকে ফলো করে সামনের দিকে তাকালো। সাথে সাথেই মারু জোরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,,,,,,,

—–“মৃন্ময়য়য়য়য়য় এখানে এসো। মুহিত আর আব্বু এখানে।”

মারুর কন্ঠস্বর শুনে মৃন্ময় আর মিঃ হাসিব দৌঁড়ে এলো রূপদের কাছে। এক ছুটে মৃন্ময় সানোয়ার আহমেদের পাশে বসে চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,,

——“আব্বু্বুবুবুবু…… কি হয়েছে তোমার? প্লিজ চোখ খুলো।”

সানোয়ার আহমেদ আধ খোলা চোখে মৃন্ময়ের হাত চেঁপে ধরে অস্পষ্ট স্বরে বলল,,,,,,

——“মুমুমুমুহিতকে বাঁচাও। ওওওকে তাড়াতাড়ি হসপিটাল নিয়ে যাও।”

মৃন্ময় চোখে এক রাশ জল নিয়ে মুহিতের দিকে তাকালো। মিঃ হাসিব মুহিতের পাশে বসে মুহিতকে এক নাগাড়ে ঝাকাচ্ছে আর মুহিতকে চিৎকার করে ডাকছে। এক পর্যায়ে মিঃ হাসিব আর মৃন্ময় হাল ছেড়ে দিলো। ওরা ভেবে নিয়েছে মুহিত আর নেই। তবে সানোয়ার আহমেদ এখনো নিশ্বাস নিচ্ছে। উনাকে বাঁচানো সম্ভব হলে ও মুহিতকে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হবে না।

রূপ নীরবতা ভেঙ্গে দৌঁড়ে গেলো মুহিতের কাছে। মুহিতের রক্তাক্ত বডিটা হাঁটুর উপর রেখে রূপ মুহিতের রক্ত মাখা মুখটা আলতো করে ছুঁয়ে মুহিতের চোখে, মুখে অসংখ্য চুমো খেয়ে চেঁচিয়ে বলছে,,,,,,,,

—–“এই মুহিত। কি হয়েছে তোমার? তুমি এভাবে শুয়ে আছে কেনো? কেনো এভাবে নিথর হয়ে পড়ে আছো? চোখ খুলো মুহিত, প্রাণ ভরে শ্বাস নাও। দেখো তোমার রূপ তোমার পাশেই আছে।”

মুহিত নড়ছে না। ড্যাড বডির মতো পড়ে আছে। মুহিতের পুরো শরীরে ছুড়ির আঘাত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্লেডের দাগ ও দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ পোস্টার ভেবে মুহিতের গাঁয়ে রং তুলি দিয়ে আঁকি বুঁকি করেছে। নিজের ইচ্ছে মতো মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের প্রতিভাকে পোস্টারে তুলে ধরেছে। মোট কথা মুহিতের পুরো শরীরটা ব্লেড দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে। শার্ট, প্যান্ট ভেদ করে ব্লেডের দাগ গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। প্রতিটা দাগের ক্ষত খুব গভীর। চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। কোনো নর পশু ছাড়া সুস্থ একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব না এতোটা নির্মম হওয়া।

রূপ আর বসে না থেকে মুহিতের বুকে কান পেতে হার্টবিট চেইক করছে। কিছুক্ষন শান্ত হয়ে থেকে রূপ আচমকা চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,

—–“মামুমুমু আমার মুহিত বেঁচে আছে। ওর হার্টবিটের আওয়াজ আমি শুনেছি। প্লিজ আমার মুহিতকে হসপিটাল নিয়ে চলো।”

মৃন্ময় আর মিঃ হাসিব তড়িঘড়ি করে মুহিতকে কোলে তুলে গাড়িতে উঠিয়ে নিলো। রূপ গাড়ির ব্যাক সিটে বসে মুহিতের মাথাটা রূপের হাঁটুর উপর রাখল। মৃন্ময় আর মিঃ হাসিব আবারো দৌঁড়ে গিয়ে সানেয়ার আহমেদকে কোলে তুলে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসিয়ে দিলো। ড্রাইভিং সিটে বসে মৃন্ময় মারুকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,,,

—–“মারু আমি সুমন ভাইকে কল করে দিয়েছি। উনি হয়তো গাড়ি নিয়ে আসছে ও। উনি এলেই তুমি আর মামু সামনের হসপিটালে চলে এসো।”

মারু চোখের জল ছেড়ে বলল,,,,,,,,

—–“যাও তাড়াতাড়ি। আব্বু আর মুহিতকে বাঁচাও। মামু আর আমি এক্টু পরেই আসছি। তুমি চিন্তা করো না।”

মৃন্ময় এবার হাই স্পিডে গাড়ি ছেড়ে দিলো। রূপ মুহিতকে বুকের মাঝে চেঁপে ধরে চোখের জল ছেড়েই যাচ্ছে। সে পারছে না মুহিতকে বুকের মাঝে পুড়ে নিতে। রূপের শাড়িটা ও এতক্ষনে রক্তে লাল হয়ে গেছে। পুরো মুখে রক্তের ছাপ পড়ে গেছে। রূপ মুহিতের ক্ষত দাগ গুলোতে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে আর এক্টু পর পর চোখ বন্ধ করে শিউরে উঠছে। এই মুহূর্তে রূপকে মনে হচ্ছে রূপ মুহিতের প্রতিটা আঘাতকে নিজস্ব ভাবে ফিল করছে। নিজের শরীরে ধারন করছে। মিঃ সানোয়ারের অবস্থা ও তেমন ভালো না। উনার শরীরে প্রায় অনেক গুলিই ছুড়ির আঘাত। উনি ব্যাথায় গোঙ্গাচ্ছে আর অস্পষ্টভাবে বলছে,,,,,,,

—–“আমার ছেলেকে বাঁচাও। ওরা আমার ছেলেকে খুব জঘন্য ভাবে মেরেছে। আমার জন্যই আমার ছেলের আজ এই অবস্থা। মুহিতকে বাঁচাতে না পারলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না। প্লিজ আমার ছেলেকে বাঁচাও।”

উনি এসব বলছে আর কিছুক্ষন পর পর ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠছে। রূপ মুহিতের বুকে মাথা রেখে নানা ধরনের কথা বলে যাচ্ছে। মুহিতের হার্টবিট টা এক্টু এক্টু করে নড়ছে। তবে সে নিথর হয়ে পড়ে আছে। রূপ মুহিতের হার্টবিটের আওয়াজ শুনছে আর গলা জড়ানো কন্ঠে বলছে,,,,,,,,

——“তুমি চিন্তা করো না মুহিত। আল্লাহ্ তোমাকে ঠিক বাঁচিয়ে দিবে। তুমি ই তো ঐদিন বলেছিলে আল্লাহ্ কখনো আমাদের প্রতি নির্দয় হবে না। তুমি দেখে নিও আল্লাহ্ ঠিক আমাদের কথা রাখবে। তোমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবে। নয়তো আমাকে ও তোমার সাথে নিয়ে যাবে। তুমি ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর আপন কেউ নেই মুহিত। মা-বাবার মৃত্যুর পরে তো তুমিই আমাকে বুকে আগলে রেখেছ। সেই ছোটবেলা থেকে। জীবনের বাকিটা সময় ও তুমি ঠিক এভাবেই আমাকে বুকে আগলে রাখবে। তোমার ছায়ায় আমাকে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা থেকে বাঁচিয়ে রাখবে। আমি জানি আমার মুহিত কখনো আমাকে একা রেখে কোথাও যাবে না। এভাবেই আমার বুকে মিশে থাকবে। আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না মুহিত। কোথাও না।”

রূপ এসব বলে নিজেই নিজেকে শান্তনা দিচ্ছে। আর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুহিতের কাটা জায়গা গুলো চেঁপে ধরছে। রক্ত যেনো কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। তাজা তাজা রক্ত গুলো শরীর থেকে গড়গড়িয়ে পড়ছে। রূপ এসব দেখে আরো বেশি নার্ভাস হয়ে পড়ছে।

মৃন্ময় এতোটাই স্পীডে গাড়ি ছেড়েছে যে প্রায় পনেরো মিনিটের মধ্যে গাড়ি এসে পৌঁছে গেলো হসপিটালের সামনে। মৃন্ময় গাড়ি থেকে নেমে হসপিটালের ভিতর ঢুকে ওয়ার্ড বয়দের ডেকে দুটো স্ট্রেচার এনে সানেয়ার আহমেদ আর মুহিতকে স্ট্রেচারে করে হসপিটালের ভিতর ঢুকিয়ে নিলো। রূপ মুহিতের স্ট্রেচারের পিছু দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অপারেশন থিয়েটারের সামনে চলে এলো। মৃন্ময় ডক্টর ডেকে মুহিত আর সানোয়ার আহমেদকে চেক আপ করিয়ে দ্রুত অপারেশনের অনুমতি দিয়ে দিলো। দুজন ডক্টর সানোয়ার আহমেদকে নিয়ে ও.টি তে ঢুকে গেলো। আরো দুজন ডক্টর মুহিতকে ও.টি তে ঢুকাচ্ছে আর মৃন্ময়কে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,,,,,,

——“উনার অবস্থা খুবই বর্বর। শেষ অব্দি আমরা উনাকে টিকিয়ে রাখতে পারব কি না জানি না। তবে আমরা চেষ্টা করব। বাকিটা উপর ওয়ালার ইচ্ছা। আপনারা পুলিশ ডায়েরি করে আসুন। দুজনের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দুজনই কোনো ক্রাইমের স্বীকার হয়েছে।”

ডক্টর আর দাঁড়ালো না। হাতে করে তিন ব্যাগ রক্ত নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে ও.টি তে চলে গেলো। রূপ ফ্লোরে দেয়ালের সাথে ঠ্যাস দিয়ে বসে আছে। চোখের পাতা ও ফেলছে না সে। চোখ দিয়ে শুধু টলটলিয়ে পানি পড়ছে। মানব মুর্তি হয়ে গেছে সে। হাত, পা ও নাড়াচাড়া করছে না। কেবল কান্নার গোঙ্গানী শোনা যাচ্ছে। শাড়িটা ও গাঁ থেকে খুলে খুলে পড়ছে। চোখ, মুখের অবস্থা খুব নাজেহাল। দিন, দুনিয়া ভুলে সে নিজের মধ্যেই ডুবে আছে। নিজের সাথে বুঝা পড়া করছে সে। মুহিতের সাথে মনে মনে নানা ধরনের বুঝা পড়ায় লিপ্ত আছে। তার প্রতিটা ধ্যান জুড়ে শুধু মুহিতের বিচরন চলছে। চিৎকার করে কাঁদতে পারছে না সে। চিৎকার করে কান্নার মাঝে এক্টা মজা আছে। ভেতরের সব জমানো কষ্ট উগড়ে ফেলা যায়। তবে নীরব কান্নার যন্ত্রনা বেশি। এই কান্নায় ভিতরটা ছিন্ন ভিন্ন হলে ও মুখ খুলে প্রকাশ করা যায় না। কষ্টটা বুকের ভিতর ই দলা পেকে রয়ে যায়।

এর মাঝেই মারু আর মিঃ হাসিব হসপিটালে ছুটে এলো। মৃন্ময় রূপের পাশে দাঁড়িয়ে মাথা টা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এক্টু আগেই সে পুলিশকে ফোন করে হসপিটালে চলে আসতে বলেছে। মারু ছুটে এসে রূপের পাশে বসল। রূপের মাথায় হাত বুলিয়ে মারু কিছু বলতে নিলেই রূপ এক ঝটকায় মারুর হাতটা সরিয়ে মিনমিন করে বলল,,,,,,,

——“আমাকে একদম শান্তনা দিতে আসবি না। আমার মুহিতের কিছু হয় নি। ভালো আছে সে। আমি এই মাএ মুহিতের সাথে কথা বলেছি। মুহিত বলেছে সে ভালো আছে। শুধু হালকা এক্টু ব্যাথা পেয়েছে। ডক্টর এক্টু চেক আপ করে দিলেই সেরে যাবে। আমার মুহিত খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। আমাকে বলে গেছে একদম কান্না না করতে। না হয় আমার শ্বাস বেড়ে যাবে। তখন মুহিত আমাকে খুব বকবে। তুই শান্তনা দিতে আসলেই আমার কান্না চলে আসবে। আমি চাই না আমার কান্নার কারনে মুহিত কষ্ট পাক। তোরা আমার সামনে থেকে চলে যা। আমি এখানে একা একাই বসে থাকব। ডক্টরের চেক আপ শেষ হলে মুহিত এসে আমার পাশে বসবে।”

রূপ আচমকা চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,,,,,,,

—–“জায়গাটা খালি কর জলদি।”

মারু থতমত খেয়ে তাড়াহুড়ো করে মারুর পাশ থেকে উঠে মৃন্ময়ের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। মৃন্ময় মারুর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,,,,,,,

——“মন খারাপ করো না। রূপ এখন নিজের মধ্যে নেই। মুহিত ছাড়া রূপকে এই মুহূর্তে কেউ শান্ত করতে পারবে না। ওকে নিজের মতো করে একা ছেড়ে দাও। আর আল্লাহ্ কে ডাকো। আল্লাহ্ যেনো আমার বাবা আর ভাই উভয়কেই সুস্থ করে দেয়।”

মারু চোখের পানি ছেড়ে মৃন্ময়ের কাঁধে মাথা রেখে চোখ দুটো বুজে নিলো। মৃন্ময় এক হাত দিয়ে মারুতে টাইট করে ধরে রেখেছে। মিঃ হাসিব রূপের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রূপকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই উনার। তাছাড়া রূপকে এখন শান্তনা দেওয়ার অবস্থা ও নেই। কারন রূপ এখন সুপার ভাইলেন্ট হয়ে আছে। রূপকে ঘাটানো ঠিক হবে না। ঐদিকে রূপ মনে মনে নানা ধরনের প্রলাপ বকছে। কি সব হাবি জাবি বলছে। কখনো হাসছে তো কখনো কাঁদছে। পাশ ফিরে কারো সাথে কথা বলছে। মানসিক প্রেশারে তার মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে গেছে।

প্রায় আধ ঘন্টা পর। কয়েকজন পুলিশ অফিসার হম্বিতম্বি হয়ে হসপিটালে ছুটে এলো। পুলিশদের দেখেই মৃন্ময় আর মিঃ হাসিব দ্রুত পায়ে হেঁটে উনাদের কাছে এগিয়ে গেলো। একজন মাঝ বয়সী পুলিশ অফিসার মাথা থেকে ক্যাপটা খুলে মৃন্ময়কে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“মিঃ সানোয়ার আর মুহিত কোন কেবিনে আছে?”

মৃন্ময় অবাক হয়ে বলল,,,,,,,

—–“আপনারা উনাদের নাম জানেন কিভাবে? আমি তো আপনাদের জাস্ট ফোন করে বলেছিলাম হসপিটাল আসতে। দুজন লোকের সাথে খারাপ কিছু হয়েছে। ব্যাস এটুকুই।”

পুলিশ অফিসার বেশ সিরিয়াস হয়ে মৃন্ময়ের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,,,,,,,,

—–“উনারা দুজনই পুলিশের সোর্স। দুই দিন আগেই আমরা এক্টা মিশনে গিয়েছিলাম। ড্রাগস পাচারকারীদের ধরতে। কিন্তু ঐখানে গিয়ে আমরা নিজেরাই ফেসে যাই। মুহিত আর মিঃ সানোয়ারের যৌথ প্রচেষ্টায় দু দিন পর আমরা আসামীদের নিয়ে ঐ খান থেকে বেঁচে ফিরি। তবে মুহিত আর মিঃ সানোয়ারকে কিছু বাছাই করা ড্রাগস সাপ্লাই কারীরা নির্মম ভাবে মার ধর করেছে। মিঃ সানোয়ারকে বাঁচাতে গিয়ে মুহিতের অবস্থা আরো করুন পর্যায়ে ঠেকেছে। হয়তো উনাদের ক্ষত বিক্ষত শরীর দেখেই আপনারা বুঝতে পেরেছেন। আমরা চেয়েছিলাম মুহিত আর মিঃ সানোয়ারকে হসপিটালে নিয়ে আসতে। কিন্তু মুহিত বলল আগে আসামীদের আইনের হেফাজতে রেখে আসতে। তা ও আমি আমার আরেকজন সোর্স দিয়ে মুহিতের ওয়াইফকে খবরটা জানিয়ে দিয়েছি। আমি জানতাম পরিবারের লোকরাই মুহিত আর সানোয়ার আহমেদকে উদ্ধার করতে পারবে। আপনি কল করার পর বুঝতে আর দেরি হলো না উনারা দুজনই হলেন সানোয়ার আহমেদ আর মুহিত।”

মৃন্ময় মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মিঃ হাসিব অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে পুলিশের দিকে তাকিয়ে আছে। মারু পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রূপ এখনো নিজের সাথে কথা বলছে। কি সব বলছে সে নিজে ও জানে না। মৃন্ময় মিঃ হাসিবের পাশে দাঁড়িয়ে অনুশোচনা নিয়ে বলল,,,,,,,,,

—–“তাহলে আমার আম্মু আর চাচ্চুর বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ ভুল ছিলো? ওরা অকারনে দুইদিন থানায় ছিলো?

মিঃ হাসিব গলা ঝাঁকিয়ে বলল,,,,,,,

——“সমস্ত অভিযোগ ভুল হলে ও এক্টা অভিযোগ কিন্তু ঠিক। তোমার আম্মুই আমার বোন এবং বোন জামাইকে খুন করেছে।”

মৃন্ময় মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ অফিসার গুলো ও.টি র সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উনাদের চোখে, মুখে অস্থিরতার ছাপ। মারু রূপের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তবে কিছু বলছে না। রূপ হাত, পা ছুড়ছে, হাসছে, কাঁদছে, নিজের মতো করে যা ইচ্ছে তা করছে।

প্রায় এক ঘন্টা পর। সানোয়ার আহমেদের অপারেশন শেষ হলো। উনাকে কেবিনে শিফট করে দেওয়া হলো। হুশ ফিরে নি এখনো উনার। পুলিশ অফিসাররা উনাকে ঘিরে রেখেছে। মুহিতের অপারেশন এখনো চলছে। মৃন্ময়, মিঃ হাসিব অপারেশন থিয়েটারের সামনে ঘুরাঘুরি করছে। রূপ এবার বসা থেকে উঠে ধীর পায়ে হেঁটে ও.টি র সামনে গেলো। জানালার কাঁচ দিয়ে রূপ ও.টি র ভিতরটা পর্যবেক্ষন করছে। তবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রূপ জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে মৃন্ময়কে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,,

—–“মৃন্ময় ভাই। মুহিত এখনো রুম থেকে বের হচ্ছে না কেনো?”

মৃন্ময় গলা জড়ানো কন্ঠে বলল,,,,,,,

—–“এইতো আর কিছুক্ষন পর বের হবে। তুই অপেক্ষা কর।”

—–“আর কতো অপেক্ষা করব? ধ্যাত আমি আর পারছি না।”

এর মাঝেই ওটির দরজা খুলে ডক্টর বেরিয়ে এলো। ডক্টর কিছু বলার আগেই রূপ এক দৌঁড়ে ওটির ভিতর ঢুকে গেলো। ডক্টর রাগ দেখিয়ে রূপকে কিছু বলতে নিলেই মৃন্ময় বেশ কাতর স্বরে বলল,,,,,,

—–“স্যার প্লিজ রূপকে বাঁধা দেবেন না। সে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। রোগীর কাছে কিছুটা সময় থাকতে দিন। আশা করছি ওর জন্য রোগীর কোনো রকম ক্ষতি হবে না।”

ডক্টর আর কিছু বলল না। মৃন্ময়ের কথা মেনে নিলো। রূপ ওটিতে ঢুকেই দেখল, মুহিতের শরীরটা সাদা কাপড় দিয়ে জড়ানো। আচমকাই রূপ থমকে গেলো। অজানা ভয়ে তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। ওটির ভিতর থাকা ডক্টররা রূপের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,,,,,,,

—–“ম্যাম আপনি চিন্তা করবেন না। উনি সুস্থই আছে। উনার পড়নের শার্ট,প্যান্ট সব খুলে রাখা হয়েছে। পুরো শরীরে সেলাই করতে হয়েছে তো তাই। লজ্জা নিবারনের জন্যই চাঁদর দিয়ে উনাকে ঢেকে রাখা হয়েছে।”

রূপ স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে দৌঁড়ে গেলো মুহিতের কাছে। মুখ থেকে চাঁদরটা সরিয়ে রূপ এক দৃষ্টিতে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখটা নেতিয়ে ছোট হয়ে গেছে। মুখ বাদে পুরোটা শরীরে মুহিতের কাটা ছেড়ার দাগ। এক হাতে ব্লাডের নল আর অন্য হাতে স্যালাইনের নল। মুখে অক্সিজেন লাগানো। মুহিতের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।

রূপ চুপ করে মুহিতের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আচমকাই মাথা ঘুড়ে ধপাস করে ফ্লোরে ছিটকে পড়ল। কিছু পড়ার আওয়াজে ডক্টররা পিছু ফিরে তাকালো। রূপকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে ডক্টররা দৌঁড়ে এসে রূপকে ধরল।

#চলবে,,,,,,,,,,,,

(গতকাল হাজার চেয়ে ও এক্টা এক্সট্রা পার্ট দিতে পারলাম না। কারন আমার হাতে খুব ব্যাথা। গত কয়েকদিন যাবত হাত নিয়ে সাফার করছি। ঠিক মতো পাঠকদের মন রাখতে পারছি না। তার জন্য আমি সত্যিই খুব অনুতপ্ত।)
#চলবে,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here