এক আকাশ ভালোবাসি পর্ব ৪২+৪৩

#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_৪২
#নিশাত_জাহান_নিশি

রূপ চুপ করে মুহিতের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আচমকাই মাথা ঘুড়ে ধপাস করে ফ্লোরে ছিটকে পড়ল। কিছু পড়ার আওয়াজে ডক্টররা পিছু ফিরে তাকালো। রূপকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে ডক্টররা দৌঁড়ে এসে রূপকে ধরল।

রূপ ফ্লোরে পড়েই জোরে জোরে গোঙ্গাচ্ছে। শ্বাস চূড়ান্ত পর্যায়ে বেড়ে গেছে। কিছুক্ষন শ্বাস টেনে সে আচমকাই চোখ জোড়া বুজে নিলো। ডক্টররা রূপকে পাশের কেবিনে শিফট করে দিলো। এই মুহূর্তে রূপের সেন্স ফেরানোটা খুব দরকার। এরপর ইনহেলার প্রেস করে ওর শ্বাস টান কমাতে হবে। মৃন্ময় দৌঁড়ে গিয়ে হসপিটালের ফার্মেসীতে গিয়ে ইনহেলার নিয়ে এলো। বেশ কিছুক্ষন পর রূপের জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই ডক্টররা রূপকে ইনহেলার প্রেস করতে বলল। রূপ বার বার মারুকে ইশারা দিয়ে বলছে মুহিতের সেন্স ফিরেছে কিনা। মারু রূপকে মিথ্যা শান্তনা দিয়ে বার বার মাথা নাড়িয়ে বলছে, হুম জ্ঞান ফিরেছে। রূপ আশ্বস্ত হয়ে ডক্টরের কথা মতো ইনহেলার প্রেস করে নিলো।

দুবার ইনহেলার প্রেস করার পর রূপের শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রনে এলো। রূপ এখন কিছুটা স্বাভাবিক। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে রূপ হন্ন হয়ে বসা থেকে উঠতে নিলেই মিঃ হাসিব রূপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,,,

——“পাগলামী করো না রূপ। তোমাকে এমন পাগলামী করতে দেখলে মুহিত কষ্ট পাবে। শান্ত হয়ে বসো। মুহিত ভালো আছে, সুস্থ আছে। কিছুক্ষন পরেই মুহিতের জ্ঞান ফিরবে। অন্তত কিছুটা সময়ের জন্যে হলে ও মুহিতকে অবজারভশানে থাকতে দাও। তুমি ও কিছু খেয়ে নাও। এক্টু ঘুমিয়ে নাও। শরীরের দিকে একবার দেখেছ? কি অবস্থা হয়েছে?”

রূপ মাথাটা নিচু করে চোখের জল ছেড়ে বেডের চাঁদর খামচে ধরল। মারু রূপের পাশে বসে রূপের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,,,,,,

—–“কাঁদিস না রূপ। মুহিত ভালো আছে। তুই খামোখা পাগলামী করছিস। খেয়ে দেয়ে এক্টু ঘুমিয়ে নে। ঘুম থেকে উঠেই দেখবি মুহিত তোর পাশে বসে আছে।”

রূপ ছলছল চোখে মারুর দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“সত্যি বলছিস তো? ঘুম থেকে উঠেই আমি মুহিতকে দেখব?”

—–“হ্যাঁ বাবা। সত্যি বলছি। আগে তো ঘুমা!”

রূপ পা উঠিয়ে আবারো আগের মতো বেডের উপর শুয়ে পড়ল। মৃন্ময় এতক্ষনে রূপের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। মারু রূপের পাশে বসে রূপের মুখে পাউরুটি, কলা পুড়ে দিচ্ছে। রূপ ও লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে নিচ্ছে। পর পর অনেক গুলো পাউরুটির পিস খাওয়ার পর রূপ আর খেতে পারছে না। মারু ও আর জোর করল না। রূপের মাথায় হাত বুলিয়ে মারু রূপকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রায় দশ মিনিট পর রূপের চোখ লেগে এলো। আস্তে ধীরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো রূপ।

সানোয়ার আহমেদের সেন্স ফিরেছে মাএ। উনার দু পাশেই তিনজন পুলিশ অফিসার বসে আছে। সানোয়ার আহমেদ চোখ খুলেই কপাল কুঁচকে মিনমিন করে বলল,,,,,,

—–“স্যার আমার ছেলে কেমন আছে? বেঁচে ফিরেছে তো আমার ছেলে?”

প্রধান পুলিশ অফিসার সানোয়ার আহমেদের হাত ধরে বলল,,,,,,,

—–“মুহিত ভালো আছে স্যার। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। শেষ পর্যন্ত মুহিত টিকে থাকতে পেরেছে। সবটাই আল্লাহ্ র দয়ায়।”

সানোয়ার আহমেদ মলিন হেসে বলল,,,,,,

—–“নিশ্চিন্ত হলাম। এবার আমি মরলে ও আমার আপসোস থাকবে না।”

—–“আপনারা দুজনই আমাদের খুব উপকার করলেন স্যার। আপনাদের জন্যই আমরা ঐ জঘন্য র‍্যাকেট টাকে ধরতে পেরেছি। আপনাদের মতো সাহসী সোর্সদের পাশে পাওয়া সত্যিই খুব ভাগ্যের ব্যাপার। আমরা নিতান্ত ভাগ্যবান বলেই আপনাদের পেলাম।”

—–“এটা তো আমাদের ডিউটি ছিলো। যদি ও আমার ছেলে এই নিয়ে তিন তিনবার আপনাদের সাথে কাজ করেছে। আশা করি আপনারা বুঝে গেছেন আমার ছেলে আমার চেয়ে ও তিনগুন সাহসী।”

—–“তা আর বলতে? আমাদের সবটাই বুঝা হয়ে গেছে। আশা করছি নেক্সট টাইম ও আমরা আপনাদের পাশে পাবো!”

সানোয়ার আহমেদ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,,,,,

——“আমরা চেষ্টা করব।”

পুলিশ অফিসার বুঝতে পেরেছে সানোয়ার আহমেদ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তাই উনি সানোয়ার আহমেদকে আশ্বাস দিয়ে বলল,,,,,,

—–“আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। যারা আপনাদের আজ এই হাল করেছে তাদের ও রিমান্ডে নিয়ে ঠিক এতোটাই বর্বর ভাবে ক্যালাবো। কড়ায় গন্ডায় সব শোধ করে নিবো।”

—–“আমি ও তাই চাই। আমার ছেলেকে ওরা যেভাবে নরপশুর মতো মেরেছে আপনারা ও তাদের ঠিক এই হাল করবেন। এটাই আপনাদের কাছে আমার চাওয়া।”

—–“এই বিষয়ে আপনি শত ভাগ নিশ্চিন্তে থাকুন। এর চেয়ে ও জঘন্য অবস্থা করব আমরা এদের। শুধু থানায় যাওয়ার অপেক্ষা।”

পুলিশ অফিসার কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,,,

—–“কাল এসে মুহিতকে দেখে যাবো। আজ তাহলে আমরা আসি। মুহিত ও রেস্ট নিক। সাথে আপনি ও।”

সানোয়ার আহমেদ মৃদ্যু হেসে মাথা নাড়াল। পুলিশ অফিসাররা এক এক করে কেবিন থেকে বের হয়ে হসপিটালের বাইরে চলে গেলো। মৃন্ময় নিঃশব্দে হেঁটে সানোয়ার আহমেদের পাশে বসল। সানোয়ার আহমেদ মলিন হেসে মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময় চোখের জল ছেড়ে সানোয়ার আহমেদের হাত জোড়ায় অসংখ্য চুমো খেয়ে বলল,,,,,,

—–“যাওয়ার আগে আমাকে অন্তত একবার জানাতে পারতে আব্বু। কি দরকার ছিলো এতোটা রিস্ক নিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে এতো বড় বিপদের সম্মুখীন হওয়া?”

সানোয়ার আহমেদ মৃন্ময়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,,,,,,,

—–“এটা নতুন কিছু না মৃন্ময়। এর আগে ও আমি অনেকবার এসব মিশনে গিয়েছি। আমার সাথে মুহিত ও যেতো। তবে এবার এতো জঘন্যভাবে ফেঁসে যেতে হবে বুঝতে পারি নি।”

—–“তার মানে এটা তোমার আরেকটা পেশা? যার কথা আমরা কেউ জানি না?”

—–“সুপ্রিয়ার মৃত্যুর পর পরই আমি এই পেশাটাতে জড়াই। অফিসের পাশাপাশি এসবে নিজেকে ব্যস্ত রাখতাম। পুরোটাই সুপ্রিয়াকে ভুলে থাকার চেষ্টা। আমার একজন দুঃ সম্পর্কের আত্নীয় ছিলো উনিই আমাকে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজে লাগায়। একদিন মুহিতের চোখে ধরা পড়ে যাই। এরপর মুহিত ও খুব রিকুয়েস্ট করে আমার সাথে এই কাজে জড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে দু বাপ ছেলে মিলে ছোট বড় বিভিন্ন মিশনে যেতাম। আর এই মিশনটাতে এসেই দুজনে নির্মম ভাবে আহত হলাম।”

—–“আব্বু আমি ও তোমাদের সাথে জয়েন করতে চাই।”

—–“না মৃন্ময়। এই পেশাটায় আমি তোমাদের আর জড়াব না। মুহিতকে তো কখনোই না। আজ যা অবস্থা হলো তার পর তো আর ভুলে ও না। আমি নিজের লাইফ রিস্কে ফেলতে পারি। তবে আমার সন্তানদের না।”

মৃন্ময় এক্টু ঝুঁকে সানোয়ার আহমেদের বুকে মাথা রেখে বলল,,,,,,

—–“এখন কেমন লাগছে আব্বু? কাটা জায়গা গুলো ব্যাথা করছে না তো?”

—–“না বেটা আমি ঠিক আছি।”

সানোয়ার আহমেদ আবারো এক্টা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,,,,,,

—–“আমার মুহিত কেমন আছে?”

—–“মুহিতকে ছয় ঘন্টা অবজারভশানে থাকতে হবে। এরপর বুঝা যাবে মুহিত কেমন আছে।”

—–“ওরা আমার ছেলেটাকে একের পর এক ব্লেড দিয়ে আঘাত করেছে। সবটা আমার চোখের সামনে। আমার ছেলেটা এরপরে ও হাল ছাড়ে নি। ক্ষত বিক্ষত শরীর নিয়ে লড়াই করে গেছে। আমার ছেলেটা আসলেই খুব সাহসী আর ধৈর্য্যশীল। নিদারুন ব্যাথা ও হজম করে নিতে পারে। আমি গর্বিত এমন সন্তানের বাবা হয়ে। সুপ্রিয়া ও হয়তো ঐ পাড় থেকে ওর ছেলের জন্য প্রাউড ফিল করছে। তবে কষ্ট ও পাচ্ছে। ভাবছে কেমন বাবা আমি! চোখের সামনে ছেলের উপর করা অমানবিক নির্যাতন সহ্য করেছি। জানো মৃন্ময় আমি চেয়ে ও কিছু করতে পারি নি। কারণ ওরা অনেক আগেই আমাকে আহত করে দিয়েছে। আমি চেয়ে ও কিছু করতে পারছিলাম না।”

সানোয়ার আহমেদের চোখ থেকে গড়গড়িয়ে পানি পড়ছে। মৃন্ময় কান্না থামিয়ে শান্ত স্বরে বলল,,,,,,,

——“আব্বু শান্ত হও। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর কান্না কাটি করো না। ঘুমানোর চেষ্টা করো। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”

সানোয়ার আহমেদ চোখ জোড়া বুজে নিলো। মৃন্ময় সানোয়ার আহমেদের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে সানোয়ার আহমেদ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। এক্টা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মৃন্ময় সানোয়ার আহমেদের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল,,,,,,,

—–“আব্বুকে এখন আম্মুর ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না। নয়তো অনেক টেনশান করবে। এমনিতেই আব্বু অসুস্থ। তার উপর এক্সট্রা টেনশান। না থাক আব্বু সুস্থ হলেই আম্মুর ব্যাপারে বলব। মুহিত ও যখন ফিরেছে তখন মামু আর মামানীর খুনের কেইসটা ভালোভাবে ইনভেসটিকেশান করে আসল সত্যিটা সামনে আনতে হবে। কেনো জানি না মন বলছে আম্মু নির্দোষ। আমার আম্মু কিছু করে নি।”

মৃন্ময় কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,,,,

—–“এখনই পুলিশকে কল করে আব্বু আর মুহিতকে খুঁজে পাওয়ার খবরটা জানাতে হবে। নয়তো ওরা এখনো আমার আম্মু আর চাচ্চুকে দোষী মনে করবে।”

কথাগুলো মনে মনে আওড়িয়ে মৃন্ময় বসা থেকে উঠে রূপের কেবিনে উঁকি দিলো। মারু রূপের পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে। মিঃ হাসিব কেবিনের সামনের চেয়ার গুলোতে মাথা এলিয়ে ঘুমুচ্ছে। মৃন্ময় ও উনার পাশে বসে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিলো। এর মাঝে মৃন্ময়ের ও চোখ লেগে এলো।

পরের দিন। সকাল নয়টা। রূপের মাএ ঘুম ভাঙ্গল। ঘুম ভাঙ্গতেই সে পিটপিট চোখে অস্পষ্ট স্বরে মুহিত মুহিত করছে। এর মাঝেই রূপ বুঝতে পারল কেউ ওর মাথায় হাত বুলাচ্ছে। চির কাঙ্ক্ষিত মানুষটার উপস্থিতি টের পাচ্ছে সে। ঝট করে রূপ চোখ জোড়া পুরো খুলে সামনের দিকে তাকালো। মুহিত বসে আছে রূপের পাশে। মুখে মলিন হাসি। পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ করা। উপর দিয়ে এক্টা শার্ট হ্যাংগারের মতো ঝুলানো। শার্টের সব গুলো বোতম খোলা। সাদা ব্যান্ডেজটার কিছু কিছু জায়গা রক্তে লাল হয়ে আছে। এখনো এক্টু এক্টু রক্তক্ষরণ হচ্ছে। নিচে এক্টা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট। পায়ের কিছু কিছু জায়গায় ব্যান্ডেজ লাগানো।

রূপ এক দৃষ্টিতে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি স্থির হলে ও চোখ থেকে টলটলিয়ে পানি পড়ছে। মুহিত কাঁপা কাঁপা হাতে রূপের চোখের কোণের পানি গুলো মুছে দিলো। চোখ, মুখ খিঁচে মুহিত রূপের দিকে এক্টু ঝুঁকে রূপকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। কাটা জায়গা গুলোর তীব্র ব্যাথা উপেক্ষা করে ও মুহিত রূপকে ঝাপটে ধরল। এক্টু নড়াচড়া করলেই কাটা জায়গা গুলো ব্যাথায় ফুলে, ফেঁপে উঠে। সেই জায়গায় তো মুহিত রূপকে ঝাপটে ধরে রেখেছে। ব্যাথা তিনগুন বেশি পাওয়ার কথা। তবু ও মুহিত দাঁতে দাঁত চেঁপে রূপকে বুকের সাথে মিশিয়ে মিনমিন করে বলল,,,,,,

——“কেঁদো না রূপ। বলেছিলাম না আল্লাহ্ কখনো আমাদের প্রতি নির্দয় হবে না। পেলে তো আমায় খুঁজে? দেখো আমি কতো সুস্থ আছি। নিশ্চিন্তে শ্বাস নিচ্ছি। হার্টবিট ও দ্রুত গতিতে চলছে। কথা বলতে পারছি, হাঁটতে, চলতে পারছি, হাসতে পারছি। কাঁদতে পারছি। আমার রূপকে ও বুকে নিতে পারছি।”

মুহিত কিছুটা থেমে আবারো বলল,,,,,,,

—–“আমি ভালো আছি রূপ। প্লিজ তুমি আর কেঁদো না। নয়তো আমি ও ভেঙ্গে পড়ব। আমার এই মুহূর্তে সাপোর্ট দরকার। সেই সাপোর্ট টা আমি তোমার থেকেই আশা করছি।”

রূপ কান্না চেঁপে মুহিতকে বুকের উপর থেকে সরানের চেষ্টা করছে আর অভিমানী স্বরে বলছে,,,,,,,,

—–“ছাড়ো আমায়। একদম টাচ করবে না। না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি? আমি তোমাকে কতো খুঁজেছি জানো? দু দুটো দিন আমি তোমাকে ছাড়া থেকেছি। কষ্ট হয় নি আমার?”

মুহিত রূপের গালে টাইট এক্টা চুমো খেয়ে বলল,,,,,

—–“রূপ আমার কিন্তু ব্যাথা লাগছে। প্লিজ ছোটাছুটি করো না। শান্ত হও। কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমাকে না বলে কোথাও যাবো না।”

রূপ এবার ছোটাছুটি বন্ধ করে চোখে জল নিয়ে মুহিতের পুরো শরীরে চুমো খেয়ে মুহিতকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,,,,,,,,

—–“আর ব্যাথা দিবো না।”

রূপ কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,,

—–“আচ্ছা….. কিভাবে পারো এতো গুরুতর আঘাত শরীরে বহন করতে? কষ্ট হয় না? যন্ত্রনা হয় না?”

—–“ছেলেদের বিষ খেয়ে ও বিষ হজম করার ক্ষমতা রাখতে হয়। তবেই সে প্রকৃত পুরুষ। ছেলেদের এক্টুতেই কষ্ট পেতে হয় না। তাদের দাঁতে দাঁত চেঁপে সব কষ্ট, ব্যাথা সহ্য করে নিতে হয়।”

রূপ আবারো মুহিতের দু চোখে চুমো খেয়ে বলল,,,,,,

——“হুম এবার তোমার কেবিনে চলো। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে আমার কেবিনে এলে কেনো?”

——“আমার পাগলী বৌ টাকে দেখতে। আমি জানতাম ঘুম থেকে উঠে আমাকে না দেখলে তুমি আবার পাগলামী জুড়ে দিবে তাই চলে এলাম।”

—–“ইসসসস কি যে করো না। চলো চলো কেবিনে চলো। তোমার এখন রেস্ট দরকার।”

রূপ মুহিতকে বুক থেকে উঠিয়ে বেড ছেড়ে নেমে মুহিতের ডান হাতে আলতো করে ধরে মুহিতকে নিয়ে মুহিতের কেবিনে চলে গেলো। বেডে মুহিতকে শুইয়ে দিয়ে রূপ মুহিতের পাশে বসে মুহিতের মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর বলছে,,,,,,

—–“বলো নি কিন্তু কোথায় গিয়েছিলে!”

মুহিত রূপের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“ড্রাগস সাপ্লাইকারীদের ধরতে।”

রূপ নাক, মুখ কুঁচকে বলল,,,,,

—–“মানে?”

—–“মানে, আমি আর আব্বু পুলিশের সিক্রেট সোর্স। মাঝে মাঝেই আমাদের বিভিন্ন মিশনে যেতে হয়। যেমন দুই দিন আগে গিয়েছিলাম ড্রাগস সাপ্লাইকারীদের ধরতে। আর ঐখানে গিয়েই……

মুহিত কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,,,

—–“আমি ভেবে নিয়েছি রূপ। আর অসবে জড়াবো না। অন্তত তোমার কথা ভেবে তো কখনোই না। আমার কিছু হয়ে গেলে তোমাকে দেখে রাখার মতো কেউ থাকবে না। তুমি সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবে। আমি তোমার প্রতি এতোটা ও স্বার্থপর হতে পারব না।”

রূপ চোখের জল ছেড়ে নাক টেনে বলল,,,,,,

—–“সত্যি বলছ তো?”

মুহিত হাতটা উঁচু করে রূপের চোখের জল গুলো মুছে দিয়ে মলিন হেসে বলল,,,,,,

—–“হুম সত্যি বলছি।”

রূপ মুচকি হেসে মুহিতের কপালে চুমো খেয়ে বলল,,,,,,

—–“চার দিন থাকতে হবে হসপিটালে। এরপর তোমাকে আর আঙ্গেলকে নিয়ে বাড়ি ফিরব।”

—–“হুম। আব্বুকে এক্টু আগে দেখে এলাম। ঘুমুচ্ছে আব্বু।”

রূপ কিছুক্ষন চুপ থেকে মুহিতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

—–“জানো মুহিত। আমি এক্টা অন্যায় করে ফেলেছি।”

মুহিত কপাল কুঁচকে বলল,,,,,

—–“কি? ”

—–“আমি ভেবেছি ফুফুমনি আর রেজাউল আঙ্কেল হয়তো তোমাকে আর আঙ্কেলকে কিডন্যাপ করেছে। তাই আমি উনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছি। উনারা এখন থানায়।”

—–“অভিযোগটা তুলে নাও রূপ। খামোখা ওদের পেরেশান করলে।”

—–“হুম। তবে এক্টা অভিযোগ আমি তুলতে পারব না।”

—–“মামু, মামানীর খুনের অভিযোগ?”

—–“হুম।”

—–“আচ্ছা আগে সুস্থ হয়ে উঠি। দেখি কি করা যায়। আগে তুমি থানায় গিয়ে অভিযোগটা তুলে এসো। মৃন্ময় ভাইকে সাথে নিয়ে যাও। মামু সহ মৃন্ময় ভাই আর মারু ভাবী আব্বুর কেবিনে আছে।”

—–“মামুকে তোমার কেবিনে রেখে যাচ্ছি। মারু না হয় আঙ্কেলের কেবিনে থাকবে।”

—–“হুম তাই করো।”

রূপ মুহিতের দিকে তাকিয়ে মৃদ্যু হেসে রুম থেকে বের হয়ে মৃন্ময়কে সাথে নিয়ে থানায় চলে গেলো। মায়া আহমেদ আর রেজাউল আহমেদের বিরুদ্ধে কিডন্যাপিং এর অভিযোগ তুলা হলো। রেজাউল আহমেদ ছাড়া পেয়ে বাড়ি চলে গেলো। মায়া আহমেদ এখনো জেলে আছে। উনার বিরুদ্ধে কিছুই প্রমানিত হচ্ছে না। মায়া আহমেদের অবস্থা খুব করুন। শুকিয়ে পাতলা হয়ে গেছে। মুখের দিকে তাকানো যায় না। মায়া আহমেদের অবস্থা দেখে রূপ আর মৃন্ময় না কেঁদে পারল না। রূপের ও কোথাও না কোথাও মনে হচ্ছে মায়া আহমেদ নির্দোষ। দোষী হলে হয়তো এই তিন দিনে সত্যিটা স্বীকার করে দিতো। রূপ আপাতত মুহিতের সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা করছে। এরপর না হয় সত্যিটা উদঘাটিত হবে। মৃন্ময় ও ওর আব্বু আর মুহিতের সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা করছে।

এভাবে কেটে গেলো প্রায় পাঁচদিন। মুহিত আর সানোয়ার আহমেদকে রিলিজ করে বাড়ি নিয়ে আসা হলো। রূপদের ফ্ল্যাটেই মুহিত আর সানোয়ার আহমেদকে আনা হলো। মারু আর মৃন্ময় ও রূপদের ফ্ল্যাটে চলে এসেছে। দুই রোগীকে একসাথে সেবা করবে বলে।

মারু সকাল থেকেই কেমন যেনো করছে। বমি বমি ভাব, মাথা ঘুড়ানো প্লাস খাবারের ঘ্রাণ ও শুকতে পারছে না। মৃন্ময় ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে প্র্যাগনেন্সি কিট নিয়ে এলো। কিট পজেটিভ এসেছে। দুঃখের মাঝে ও সুখের হাসি সবার মুখে। সবাই খুশি মারুর প্র্যাগনেন্সিতে। মৃন্ময় তো বিশাল খুশি। খুশিতে সে পাগলামী শুরু করেছে। তবে কোথাও না কোথাও মৃন্ময়ের খারাপ লাগা কাজ করছে। মায়া আহমেদের কথা বার বার মনে পড়ছে।

মুহিত আর সানোয়ার আহমেদ এখন মোটামুটি সুস্থ। ক্ষত জায়গা গুলো শুকাতে শুরু করেছে দুজনেরই। তবে মুহিতের পুরোপুরি সুস্থ হতে অনেকটা সময় লাগবে। রূপ সেবা, যত্নের কোনো রকম ত্রুটি রাখছে না। দিন রাত এক করে মুহিত আর সানোয়ার আহমেদের সেবা করে যাচ্ছে। রূপের সেবায় ওরা এক্টু এক্টু করে সুস্থ হয়ে উঠছে।
#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_৪৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

মুহিত আর সানোয়ার আহমেদ এখন মোটামুটি সুস্থ। ক্ষত জায়গা গুলো শুকাতে শুরু করেছে দুজনেরই। তবে মুহিতের পুরোপুরি সুস্থ হতে অনেকটা সময় লাগবে। রূপ সেবা, যত্নের কোনো রকম ত্রুটি রাখছে না। দিন রাত এক করে মুহিত আর সানোয়ার আহমেদের সেবা করে যাচ্ছে। রূপের সেবায় ওরা এক্টু এক্টু করে সুস্থ হয়ে উঠছে।

হসপিটাল থেকে ফেরার দুই দিন পর। সানোয়ার আহমেদ এখন পুরোপুরি সুস্থ। মৃন্ময় আর মারুকে নিয়ে উনি বাড়ি ফিরে গেছে। মুহিত এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয় নি। ক্ষত স্থান গুলো শুকাতে বেশ কয়েকিদন সময় লাগবে। এর মাঝেই সানোয়ার আহমেদ একদিন থানায় গিয়ে মায়া আহমেদকে দেখে এসেছে। মায়া আহমেদের রোগা চেহারাটা দেখে উনার এই প্রথম খুব মায়া হয়েছে। মায়া আহমেদের মাঝে উনি মায়া খুঁজে পেয়েছে। যা উনি আগে ও অনেকবার খোঁজার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু পায় নি। সবসময় পৈশাচিক রূপটাই দেখতে হয়েছ। অবশ্য এখন মায়া খুঁজে ও লাভ নেই। হয়তো, এখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।

ঘড়িতে রাত বারোটা। মুহিত বিছানা ছেড়ে উঠে ডেস্কের উপর থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিলো। গ্লাসে এক ফোঁটা পানি ও নেই। খুব জল তেষ্টা পেয়েছে ওর। রূপ পাশেই নাক টেনে ঘুমুচ্ছে। মুহিত রূপকে না জাগিয়ে ড্রইং রুমে গেলো জল খেতে। ড্রইং রুমটা ড্রিম লাইটের ঝাপসা আলোতে আধো অন্ধকার হয়ে আছে। মুহিত পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে যেই না চুমুক দিতে যাবে অমনি নিচ তলা থেকে কারো হাঁটা চলার আওয়াজ শোনা গেলো। মনে হচ্ছে কেউ দ্রুত পায়ে হেঁটে মুহিতদের সদর দরজা থেকে নিচ তলায় সিঁড়ি বেয়ে নামছে। রাতের নিস্তব্ধতার জন্য হালকা পিন পড়ার আওয়াজ ও ক্লিয়ারলি শোনা যায়। সে জায়গায় কারোর হাঁটার আওয়াজ তো পৃথিবী ধসের মতো মনে হয়।

মুহিতের ব্যাপারটা ঠিক সুবিধার লাগছে না। পানি খাওয়া ছেড়ে মুহিত ধীর পায়ে হেঁটে সদর দরজা খুলে পা টিপে টিপে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে নিচ তলার দিকে ছুটল। নিচ তলায় নামার সাথে সাথেই মুহিতের চোখ গেলো বাড়ির গার্ডেনের দিকে। কোনো এক্টা আগন্তুকের ছায়া দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে মনে হচ্ছে এটা কোনো পুরুষের ছায়া। কালো হুডি পড়ে আছে। পেছন থেকে ডাকাত বা ছিনতাইকারীর মতো মনে হচ্ছে। মুহিত আর দাঁড়িয়ে না থেকে অসুস্থ শরীর নিয়ে এক ছুটে ঐ আগন্তুকটাকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরে এলোপাথারী কিল, ঘুষি মারছে আর জোরে জোরে চেঁচিয়ে বলছে,,,,,,

—–“মামু, আমজাদ আঙ্কেল কে কোথায় আছেন। প্লিজ তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসুন। আমাদের বাড়িতে ডাকাত ঢুকেছে।”

কালো হুডি পড়া লোকটা ব্যাথায় কাতড়াচ্ছে আর চেঁচিয়ে বলছে,,,,,,,

—–“প্লিজ মুহিত ছাড়ো। আমি কোনো চোর, ডাকাত নই। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি হাসিব আঙ্কেলের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

এর মাঝেই মিঃ হাসিব দৌঁড়ে এসে আগন্তুকটাকে মুহিতের থেকে ছাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মুহিতকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

——“এএএ তুমি কি করছ মুহিত? সে কোনো চোর, ডাকাত না। সে হলো আদনান। যার সাথে আমি রূপের বিয়ে ঠিক করেছিলাম!”

মুহিত বেশ অবাক হয়ে বলল,,,,,,,

—–“আদনান? এতো রাতে সে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে?”

মিঃ হাসিব হকচকিয়ে বলল,,,,,,

—–“হুম ঐ আর কি। সারা দিন সময় হয়ে উঠে না তো। বিজনেসের কাজে আদনান পুরো দিন ব্যস্ত থাকে তাই রাতে এসেছে আমার সাথে দেখা করতে। কথা বলেই চলে যাবে। তুমি যাও মুহিত। রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ো। ঐ দিকে রূপ আবার একা।”

মিঃ হাসিব আর আদনানের দিকে কিছুক্ষন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মুহিত পেছনে মোড় নিয়ে ফ্ল্যাটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মিঃ হাসিব আর আদনান এক্টা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে ওরা দুজনই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মুহিত কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। বার বার পিছু ফিরে তাকাচ্ছে। কোথাও এক্টা ডাউট হচ্ছে ওর। মনের ভেতর হাজারো সন্দেহ আর কৌতুহল দানা বাঁধছে। এ সব কিছু উপেক্ষা করে মুহিত ফ্ল্যাটে ঢুকে বেড রুমে চলে গেলো। সদর দরজাটা ভেতর থেকে লাগায় নি মুহিত। মিঃ হাসিব ফ্ল্যাটে ঢুকবে বলে।

বেড রুমে ঢুকে মুহিত দরজায় খিল লাগিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। ব্যালকনির গ্রীল দিয়ে মিঃ হাসিব এবং আদনানকে দেখা যাচ্ছে। মিঃ হাসিব আঙ্গুল নাড়িয়ে খুব রাগী লুক নিয়ে আদনানের সাথে কথা বলছে। আদনান মাথাটা নিচু করে রেখেছে। বুঝাই যাচ্ছে সে কোনো কারণে অনুতপ্ত। মিঃ হাসিব কিছুক্ষন রাগা রাগি করে কিছুটা শান্ত হয়ে আদনানের মাথায় হাত বুলিয়ে আদনানকে ইশারা করে বলল বাড়ি থেকে বের হতে। আদনান ও শো শো বেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। মিঃ হাসিব কিছুক্ষন আদনানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটা ধরল।

মুহিত ব্যালকনি থেকে সরে রুমে ঢুকে পড়ল। মিঃ হাসিবের ব্যবহার মুহিতের মনে হাজারো সন্দেহের ঝড় তুলছে। তার উপর আদনানের এমন রাত, বিরাতে হুট করেই আগমন। সব মিলিয়ে মুহিত চিন্তায় পড়ে গেছে। মুহিত ধীর পায়ে হেঁটে বেডের উপর বসে পড়ল। ডান পাশে ফিরে মুহিত রূপের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে নিষ্পাপ লাগছে রূপকে সাথে স্নিগ্ধ আর শুভ্র। রূপের মায়াবী মুখটার দিকে তাকাতেই মুহিতের সব চিন্তা উড়ে গেলো। মুখে তৃপ্তির হাসি ফুঁটে উঠল।

মলিন হেসে মুহিত এক্টু ঝুঁকে রূপের কপালে আলতো করে চুমো খেলো। এরপর পালাক্রমে গালে, নাকে, থুতনীতে, ঠোঁটে। ঠোঁটে চুমো খাওয়ার সাথে সাথেই রূপ খানিক কেঁপে উঠল। পিটপিট করে রূপ চোখ খুলল। মুহিত এখনো রূপের দিকে ঝুঁকে আছে। রূপ বাঁকা হেসে আচমকাই মুহিতের ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরল। মুহিত ও মুচকি হেসে রূপকে আদর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এক পর্যায়ে দুজনেরই চোখ লেগে এলো। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।

পরের দিন,,,,,,,,

সকাল আটটা। রূপ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে কিচেনে চলে গেলো নাশতা বানাতে। মুহিত এখনো ঘুমুচ্ছে। মিঃ হাসিব ঘুম থেকে উঠে খুব তাড়াহুড়ো করছে। মনে হচ্ছে কোনো ইম্পরটেন্ট কাজ আছে। রূপ উনার জন্যই তাড়াহুড়ো করে নাশতা বানাচ্ছে। মুহিত আচমকাই ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠল। গাঁ থেকে কম্বলটা সরিয়ে মুহিত রুম থেকে বের হয়ে মিঃ হাসিবের রুমে চলে গেলো। মিঃ হাসিব ওয়াশরুমে শাওয়ার নিচ্ছে। মুহিত উনার রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। বেডের কাছে যাওয়ার সাথে সাথেই মিঃ হাসিবের ফোনটা ভাইব্রেশান মোডে বেজে উঠল। মুহিত ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখল নাম্বারটা আদনানের নাম দিয়ে সেইভ করা। মুহিত আস্তে করে ফোনটা হাতে নিয়ে কলটা পিক করার সাথে সাথেই ঐ পাশ থেকে আদনান বেশ চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,

—–“আব্বু তুমি কোথায়? এই ঠান্ডার মধ্যে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।”

মুহিত হ্যাং মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আদনানের মুখে আব্বু ডাকটা শুনে সে বিচলিত হয়ে পড়েছে। কুটুস করে ফোনটা কেটে দিয়ে মুহিত ওয়াশরুমের দরজার দিকে একবার তাকিয়ে ফোনটা আবারো আগের জায়গায় রেখে রুম থেকে সোজা বের হয়ে গেলো। কিচেন রুমের দিকে উঁকি দিয়ে মুহিত দেখল রূপ খুব মনযোগ দিয়ে নাশতা বানাচ্ছে। কিচেন রুমে পা বাড়াতে গিয়ে ও মুহিত থেমে গেলো। পিছু ফিরে বেড রুমে চলে গেলো। আয়নার সামনে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে মুহিত ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।

মিঃ হাসিব ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে হন্ত দন্ত হয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। কিচেন রুমে ঢুকে উনি রূপকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“রূপ আমি এক্টু আসছি।”

রূপ পরোটা সেকছে আর চেঁচিয়ে বলছে,,,,,,

—–“মামু দাঁড়াও। নাস্তা করে যাও। আমার হয়ে গেছে।”

মিঃ হাসিব বেশ ব্যস্ত স্বরে বলল,,,,,,,,

—–“সময় নেই রূপ। খুব তাড়া আছে। আধ ঘন্টার মাঝেই ফিরে আসব। এরপর না হয় খাবো।”

মিঃ হাসিব আর দাঁড়ালো না। কিচেন থেকে বের হয়ে সদর দরজা খুলে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে খুব দ্রুতগতিতে হেঁটে রাস্তায় চলে গেলো।

মুহিত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মুখটা কোনো রকমে টাওয়াল দিয়ে মুছে মিঃ হাসিবের রুমে উঁকি দিয়ে দেখল উনি নেই। মুহিত দ্রুত পায়ে হেঁটে ফ্ল্যাট থেকে বের হচ্ছে আর কিচেনে থাকা রূপকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বলছে,,,,,,,,

—–“রূপ আমি এক্টু আসছি। কিছুক্ষন পরেই ফিরছি। তুমি নাশতা রেডি করে ডাইনিং টেবিলে রাখো।”

রূপ মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বলল,,,,,,,

—–“এই তোমরা মামু, ভাগিনা কি আমার সাথে মজা করছ? দুজনের মুখে একই কথা।”

চুলার আঁচ টা কমিয়ে রূপ কিচেন থেকে বের হয়ে তেড়ে এসে মুহিতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,,

——“কোথায় যাচ্ছ তুমি হ্যাঁ? এই অসুস্থ শরীর নিয়ে?”

মুহিত দ্রুত পায়ে হেঁটে সদর দরজা থেকে বের হচ্ছে আর রূপকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,,,,,,

—–“সামনেই যাচ্ছি। এক্টু হেঁটে আসি। সারাক্ষন রুমে বসে থাকতে বোর লাগে। তুমি নাশতা তৈরী করতে করতেই আমি ফিরে আসব।”

মুহিত আর কথা বাড়াল না। ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে এক প্রকার দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রাস্তায় চলে এলো। রাস্তার বাম সাইডের একেবারে শেষ প্রান্তে মিঃ হাসিবকে দেখা যাচ্ছে। পায়ে হেঁটে উনাকে ফলো করা যাবে না। স্পিডে দৌঁড়াতে হবে। মুহিত ব্যাথা যুক্ত শরীর নিয়ে খুব স্পীডে দৌঁড়াতে লাগল। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এক পর্যায়ে মুহিত মিঃ হাসিবের কাছাকাছি চলে গেলো। আচমকাই মিঃ হাসিব এক্টা গলির ভিতর ঢুকে গেলো। মুহিত ও খুব সাবধানে পা ফেলে ঐ গলির রাস্তায় মোড় নিলো।

গলির এক্টা চিপা রাস্তায় আদনান দাঁড়িয়ে আছে। হাতে এক্টা ফাইল। মিঃ হাসিব এক ছুটে আদনানের কাছে চলে গেলো। মুহিত এক্টা বড় বট গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে সে সব দেখছে কিন্তু কিছু শুনছে না। মিঃ হাসিব আর আদনান খুব হেসে হেসে কথা বলছে। দেখে মনে হচ্ছে আজ ওদের ঈদ। আদনান হেসে হেসে মিঃ হাসিবের হাতে ফাইলটা ধরিয়ে দিলো। মিঃ হাসিব ফাইলটা নিয়ে খুশিতে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ফাইলটা কিছুক্ষন ঘাটাঘাটির পর মিঃ হাসিব ফের ফাইলটা আদনানের হাতে ধরিয়ে দিলো। কিছুক্ষন কথা বার্তার পর মিঃ হাসিব বিদায় নিয়ে আবারো বাড়ির রাস্তায় মোড় নিলো। আদনান ও উল্টো দিকে হাঁটা ধরল।

মিঃ হাসিব মেইন রাস্তায় উঠার সাথে সাথেই মুহিত উনার পিছু পিছু হাঁটা ধরল। বাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার পর পরই মুহিত রাস্তার অপজিট পাশে গিয়ে এক্টা নুডলসের প্যাকেট কিনে আবারো রাস্তার ঐ পাশে চলে এলো। মিঃ হাসিব বাড়ির মেইন গেইটে পা রাখতে গেলেই মুহিত পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,,,

——“আরে মামু। কোথায় গিয়েছিলেন?”

মিঃ হাসিব পিছু ফিরে থতমত খেয়ে বলল,,,,,,,,

—–“ঐঐঐ তো এক্টু হাঁটতে বের হয়েছিলাম।”

মুহিত নুডলসের প্যাকেট টা নাড়াচ্ছে আর বলছে,,,,,,

—–“ওহ্ আচ্ছা।”

মিঃ হাসিব চোখে সন্দেহ নিয়ে মুহিতের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

—–“তুতুতুমি কোথায় গিয়েছিলে?”

—–“এই তো নুডলস কিনতে। অনেক দিন হলো নুডলস খাওয়া হয় না।”

মিঃ হাসিব এক্টা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল,,,,,,

—–“ওহ্ হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। চলো এবার ফ্ল্যাটে যাই।”

মুহিত সামনের দিকে এগুচ্ছে আর বলছে,,,,,,

—–“হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন।”

দুজনই দ্রুত পায়ে হেঁটে ফ্ল্যাটে চলে এলো। সদর দরজায় টোকা দেওয়ার সাথে সাথেই রূপ দরজাটা খুলে দিলো। টেবিলে মাএ খাবার সাজিয়েছে রূপ। দুজনকে এক সাথে দেখে রূপ হালকা হেসে বলল,,,,,,

—–“যাক বাবা দুজনই একসাথে এলে।”

মুহিত আর মিঃ হাসিব মৃদ্যু হাসল। মুহিত নুডলসের প্যাকেট টা রূপের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,,,,,,,

—–“এই নাও নুডলস। বিকেলে রান্না করবে। অনেকদিন খাওয়া হয় না।”

রূপ নুডলসটা নিয়ে কিচেন রুমে যাচ্ছে আর বলছে,,,,,,,

—–“তুমি চাইলে এখনই রাঁধতে পারি।”

—–“না না এখন থাক। আগে তো নাশতা করে নেই।”

মুহিত মিঃ হাসিবকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে গেলো। রূপ হাতে করে গরম গরম চা নিয়ে মুহিত আর মিঃ হাসিবের সামনে রাখল। মিঃ হাসিব চা এ চুমুক দিচ্ছে আর কিছু এক্টা ভাবছে। মুহিত পরটা সহ ওমলেট মুখে দিচ্ছে আর মিঃ হাসিবকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,,,,,

—–“মামু। তুমি কি বিয়ে করবে না?”

মিঃ হাসিব আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই রূপ বলে উঠল,,,,,,

—–“করবে না কেনো? অবশ্যই করবে। আমরা আজ থেকেই মেয়ে দেখব।”

মুহিত দুষ্টুমি করে বলল,,,,,,

——“মেয়ে না। মহিলা দেখতে হবে। মামুর বয়স দেখেছ? সঠিক বয়সে বিয়ে করলে মামুর হয়তো তোমার মতো এক্টা ছেলে বা মেয়ে থাকত।”

রূপ চোখ লাল করে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে। মুহিত রূপের রাগী চাহনীকে অগ্রাহ্য করে মিঃ হাসিবের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“মামু এতো বছর আপনার বিয়ে না করার কারণ কি?”

মিঃ হাসিব কাঠ কাঠ গলায় বলল,,,,,,,

——“ক্লাস টেন থেকে আমি একজনকে ভালোবাসতাম। সে তখন ক্লাস এইটে পড়ত। টোয়েলভ ক্লাসে উঠার পর ওর বিয়ে হয়ে যায়। এরপর থেকে আমার ও বিয়ে করার ইচ্ছেটা মরে যায়।”

—–“এই সামান্য কারণে আপনি বিয়ে করেন নি?”

—–“এটা সামান্য না অনেক। আমি তাকে আজ ও ভুলতে পারি নি। হয়তো কখনো পারব ও না। সে যদি আজ ও আমার কাছে ফিরে আসে আমি তাকে গ্রহন করে নেবো।”

কথা গুলো বলেই মিঃ হাসিব নাশতার টেবিল ছেড়ে উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। মুহিত গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো। মুহিতের মন বলছে, কোথাও এক্টা রহস্য লুকিয়ে আছে। মিঃ হাসিবের ব্যাপারে অনেক কিছু জানার আছে। মিঃ হাসিব নিশ্চয়ই কিছু আড়াল করছে। আদনানের আচমকা আব্বু ডাকটা মুহিতের মনে সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছে। মিঃ হাসিবের ব্যাপারে জানতে হলে মায়া আহমেদের শরনাপন্ন হতে হবে। মায়া আহমেদ ছাড়া সেকেন্ড কোনো ব্যক্তি নেই যে রূপের রিলেটিভ সম্পর্কে জানবে।

রূপ আচমকা মুহিতকে ঝাঁকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,,,,,,

—–“দিলে তো আমার মামুটাকে রাগিয়ে? কি দরকার ছিলো মামুকে খোঁচা দিয়ে কথা বলার?”

রূপ বিরক্তি নিয়ে আবার বলল,,,,,

—-“ধ্যাত মামু না খেয়েই চলে গেলো।”

মুহিত চা এর কাপে চুমুক দিচ্ছে আর মনে মনে বিড়বিড় করে বলছে,,,,,,,

—–“এখনই আমার থানায় যেতে হবে। আম্মুর সাথে পার্সোনালী কথা বলতে হবে। মামুকে নিয়ে করা আমার সন্দেহ যদি ঠিক হয়, তবে রূপকে একা এই বাড়িতে রেখে যাওয়া সেইফ হবে না। যেকোনো মুহূর্তে অঘটন ঘটতে পারে।”

মুহিত চেয়ার ছেড়ে উঠে বেড রুমের দিকে যাচ্ছে আর রূপকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,,,,

—–“রূপ রেডি হও। থানায় যাবো।”

রূপ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,,,,,

—–“ফুফুমনির সাথে দেখা করবে?”

—–“হুম এক্টু দেখে আসি। একবার ও আম্মুকে দেখতে যাওয়া হয়নি।”

মুহিত কিছু এক্টা ভেবে মিঃ হাসিবের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,,

—–“জানো রূপ….. আমি ও চাই মিসেস মায়া আহমেদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক। খুনের সাজা হোক। উনিই তোমার বাবা, মাকে খুন করেছে।”

মুহিতের কথা বলা শেষ হতে না হতেই মিঃ হাসিব রুম থেকে বের হয়ে মুহিতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,,,

——“হ্যাঁ বাবা। তুমি একদম ঠিক বলেছ। মায়া আহমেদ ই আমার বোন আর দুলাভাইয়ের খুনি। সম্পওির লোভে উনি এসব করেছে। প্রথম থেকেই উনাকে আমার সন্দেহ। আমি ও চাই উনার শাস্তি হোক।”

মুহিত বাঁকা হেসে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,,,,,

——“মামু আপনি নিজেই এসে আমার পাতা জালে পা দিলেন। আমার মনের সন্দেহটা আরো দ্বিগুন বাড়িয়ে দিলেন।”

মুহিত আর কথা না বাড়িয়ে রুমে ঢুকে রেডি হতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রূপ ডাইনিং টেবিলটা গুছিয়ে রুমে গিয়ে শাড়ী পাল্টে নিলো। প্রায় পনেরো মিনিটের মধ্যে দুজন রেডি হয়ে থানার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো।

প্রায় বিশ মিনিট পর গাড়ি এসে পৌঁছে গেলো থানায়। মুহিত আর রূপ গাড়ি থেকে নেমে থানার ভিতর ঢুকে গেলো। পুলিশ অফিসার থেকে পারমিশান নিয়ে মুহিত মায়া আহমেদের সাথে কথা বলতে চলে গেলো। রূপ পুলিশ অফিসারের সামনে বসে আছে। দুজন একসাথে আসামীর সাথে দেখা করার নিয়ম নেই।

মায়া আহমেদের নেতিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে মুহিতের চোখে পানি চলে এলো। মায়া আহমেদের হাত জোড়া ধরে মুহিত শান্ত কন্ঠে বলল,,,,,,,,

—–“আম্মু…… কেমন আছো?”

মায়া আহমেদ চোখের জল ছেড়ে মিনমিনিয়ে বলল,,,,,,,

—–“এইতো আছি।”

কিছুটা থেমে মায়া আহমেদ আবারো বলল,,,,,

—–“বিশ্বাস করো মুহিত। আমি কিছু করি নি। রূপ অযথা আমাকে সন্দেহ করছে।”

মুহিত মায়া আহমেদের হাতে চুমো খেয়ে বলল,,,,,

—–“আমার কয়েকটা প্রশ্নের উওর দিতে পারবে আম্মু?”

—-“বলো মুহিত। আমি চেষ্টা করব।”

—–“রূপের মামু সম্পর্কে আমার কিছু জানার আছে।”

—–“হুম বলো কি জানতে চাও। তবে আমি উনার ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না।”

—–“মামুর কি সত্যিই কোথাও সম্পর্ক ছিলো?”

—–“হুম ছিলো। ভাবীর মুখে শুনেছিলাম মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পরে ও নাকি মেয়েটার সাথে হাসিবের সম্পর্ক ছিলো। হাসিবকে নিয়ে মেয়েটার সংসারে অশান্তি হতো। তারপর তো আর কিছু জানা হয় নি। এর আগেই সব এলোমেলো হয়ে গেলো।”

#চলবে,,,,,,,,,
#চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here