এক আকাশ ভালোবাসি পর্ব ৪৩+৪৪

#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_৪৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

—-“হুম ছিলো। ভাবীর মুখে শুনেছিলাম মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পরে ও নাকি মেয়েটার সাথে হাসিবের সম্পর্ক ছিলো। হাসিবকে নিয়ে মেয়েটার সংসারে অশান্তি হতো। তারপর তো আর কিছু জানা হয় নি। এর আগেই সব এলোমেলো হয়ে গেলো।”

মুহিত কিছুটা সিরিয়াস হয়ে বলল,,,,,,

—–“ঐ মেয়েটার এড্রেস তুমি জানো?”

—–“না তা তো জানি না। যখন ভাবী আমাকে হাসিবের সম্পর্কে জানায় তখন ভাবীদের মাএ নতুন বিয়ে হয়েছে। অনেক অনেক বছর আগের কথা। তখন রূপ ও হয় নি। ভাবীর মুখে শুনেছিলাম মেয়েটা ঢাকার উওরাতেই থাকত। এখন হয়তো ঠিকানা পাল্টাতে পারে।”

মুহিত মলিন হেসে মায়া আহমেদের হাত ধরে শান্ত স্বরে বলল,,,,,,

—–“তুমি চিন্তা করো না আম্মু। যদি তুমি সত্যিই নির্দোষ হও তবে তুমি ন্যায় পাবেই। কয়েকটা দিন সময় দাও আমায়। আমি দেখছি সত্যিটা কিভাবে বের করা যায়।”

মায়া আহমেদ চোখের জল ছেড়ে মুহিতের দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,,,,,

——“আমাকে ক্ষমা করে দিও মুহিত। আমি অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে। রূপের সাথে ও কম অন্যায় করি নি। আর সুপ্রিয়ার কথা না হয় বাদ ই দিলাম। তোমরা আমাকে শেষ বারের মতো মাফ করে দাও। ভুল গুলো সংশোধন করার সুযোগ করে দাও। কথা দিচ্ছি আমি খুব ভালো হয়ে দেখাবো। ভালো বউ হবো, ভালো মা হবো, ভালো শ্বাশুড়ী হবো। আমাকে আর একটা বার সুযোগ করে দাও তোমরা প্লিজ।”

মুহিত মায়া আহমেদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,,,,,

—–“সুযোগ পাবে তুমি আম্মু। তোমার পরিবার এতোটা ও নির্দয় না। আমি কখনো তোমাকে সৎ মায়ের চোখে দেখি নি। মায়েদের কোনো ভেদাভেদ হয় না। মা মা ই হয়। আমি ও তোমাকে ভেদাভেদ করি নি। না কখনো করব।”

মুহিত কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,,,,

—–“আগে তোমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে। পুরো সত্যিটা সামনে আনতে হবে। আসল দোষীকে খুঁজে বের করতে হবে। যদি আমার সন্দেহ সঠিক হয় তবে তুমি খুব শীঘ্রই মুক্তি পেতে চলেছ।”

মায়া আহমেদ কৌতুহলী দৃষ্টিতে মুহিতের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“মুহিত তুমি কি হাসিবকে সন্দেহ করছ?”

মুহিত বেশ তাড়াহুড়ো করে বলল,,,,,,,

—–“পরে জানতে পারবে। এখন আমি আসি। অনেক কাজ বাকি আছে।”

মুহিত আর দাঁড়াল না। রূপকে নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলো। রূপ মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। মায়া আহমেদের সাথে দেখা করতে পারে নি বলে। মুহিত ড্রাইভ করছে আর খুব মনযোগ দিয়ে কিছু এক্টা ভাবছে। সামনের চুল গুলো টেনে মুহিত মনে মনে বিড়বিড় করে বলছে,,,,,

—–“মামুর অতীত সম্পর্কে জানতে হলে আমাকে প্রথমে মামুর এক্সের কাছে যেতে হবে না হয় আদনানের কাছে। কিন্তু কিভাবে ওদের কাছে পৌঁছাবো। আম্মু তো বলল মামুর এক্স ঢাকার উত্তরাতে থাকত। কিন্তু সে তো অনেক বছর আগের কথা। এখন নিশ্চয়ই জায়গা পাল্টিয়েছে। ইসসস মাথা কাজ করছে না। কি করলে সঠিক পথটা খুঁজে পাবো তাও বুঝতে পারছি না।”

কিছুক্ষন ভাবনা চিন্তার পর আচমকাই মুহিত রূপের দিকে তাকিয়ে বেশ সিরিয়াস হয়ে বলল,,,,,,

—–“রূপ…..তোমার কাছে আদনানের নাম্বার আছে?”

রূপ অন্যদিকে তাকিয়ে মুখটা ভাড় করে বলল,,,,,,

—–“থাকলে ও দিবো না। আমি তোমার সাথে রাগ করেছি।”

মুহিত এক হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে রূপকে এক্টা হেচকা টান দিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। রূপ বেকুব হয়ে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করেই মুহিত রূপের ডান গালে এক্টা বাইট বসিয়ে বাইটের জায়গাটায় এক্টা গভীর চুমো খেয়ে বলল,,,,,,,,

—–“তাড়াতাড়ি রাগ কমাও। নয়তো এবার আরো জোরে বাইট দিবো। প্রথমবার, তাই ব্যাথার পর আদর করে দিয়েছে। দ্বিতীয় বার এটা হবে না।”

রূপ বাইটের জায়গাটায় হাত দিয়ে মুখটা কালো করে মুহিতের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

—–“কন্ট্রাক্ট নম্বর চেইক করতে হবে। হয়তো সেইভ থাকতে পারে।”

—–“হুম তাড়াতাড়ি চেইক করো।”

রূপ পার্স থেকে ফোনটা বের করে খুব মনযোগ দিয়ে ফোনে আদনানের নাম্বার খুঁজছে। প্রায় অনেকক্ষন খোঁজাখু্ঁজির পর রূপ আদনানের নাম্বারটা কল লিস্টে খুঁজে পেলো। মুহিতের দিকে তাকিয়ে রূপ মলিন হেসে বলল,,,,,,,

—–“পেয়েছি। এই নাও নাম্বার।”

মুহিত গাড়িটা রাস্তার ফুটপাতে থামিয়ে রূপের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ওর নিজের ফোনে নাম্বারটা সেইভ করে নিলো। রূপ কিছুটা কৌতুহলী হয়ে মুহিতের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,,

——“আচ্ছা তুমি মিঃ আদনানের নাম্বার দিয়ে কি করবে?”

মুহিত বেশ ব্যস্ত স্বরে বলল,,,,,,,

—–“দরকার আছে।”

—–“কি দরকার? আমাকে ও বলো। আমি ও শুনতে চাই।”

মুহিত এবার রূপের দিকে তাকিয়ে বেশ সিরিয়াস হয়ে বলল,,,,,,,,,

——“তোমাকে এখন আদনানের সাথে কথা বলতে হবে!”

রূপ কপাল কুচকে বলল,,,,,,

—–“মানে কেনো?”

মুহিত রূপের কাছাকাছি এসে রূপের ঠোঁটে আলতো করে এক্টা চুমো খেয়ে বলল,,,,,,

—–“আদনানকে ফোন করে জিগ্যেস করবে আদনান এখন কোথায় আছে। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে হবে। সে যেনো তোমার কথায় ইমপ্রেস হয়ে এক্সেক্ট ঠিকানা টা বলে দেয়।”

—–“কিন্তু কেনো মুহিত? মিঃ আদনানের ঠিকানা দিয়ে কি হবে?”

—–“উফফফ বড্ড কথা বলছ তুমি। দরকার আছে বিধায় তো বললাম।”

মুহিত এবার রূপের ফোনটা হাতে নিয়ে আদনানের নাম্বারে ডায়াল করে ফোনটা রূপের কানে ধরিয়ে দিয়ে বলল,,,,,,,

—–“নাও শুরু করো। যে করেই হোক আদনান এখন কোথায় আছে খোঁজ নাও। আমি পরে তোমাকে সব বলছি।”

এর মাঝেই ঐ পাশ থেকে আদনান কলটা পিক করে নিলো। মুহূর্তেই রূপ ঠোঁটে মলিন হাসি ফুটিয়ে আদনানকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“হ্যালো মিঃ আদনান।”

ঐদিকে আদনান রূপের কল পেয়ে আনন্দে আত্নহারা হয়ে পুরো রুম জুড়ে পায়চারী করছে আর মিটিমিটি হেসে বলছে,,,,,,,,

—–“হায় রূপ। কেমন আছো?”

—–“এইতো ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

——“এতক্ষন খুব আপসেট ছিলাম। কিন্তু তোমার কলটা পেয়ে খুব ভালো লাগছে।”

রূপ লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বলল,,,,,,

—–“ফোনে আপনার ভয়েস টা শুনতে আরো দারুন লাগে।”

—–“এই প্রথম কেউ আমার ভয়েসের এতোটা প্রশংসা করল। থ্যাংকস রূপ।”

—–“থ্যাংকস দিতে হবে না জনাব। শুধু আপনার বাড়ির এড্রেসটা বলুন। আমি আপনার সাথে এক্টু দেখা করতে চাই। পার্সোনাল ভাবে।”

আদনান খুশিতে দাঁত বের হেসে বলল,,,,,,

—–“সত্যিই তুমি আমার সাথে দেখা করতে চাও?”

—–“জ্বি সত্যি।”

—–“ওকে ঠিকানা আমি টেক্সট করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আম্মু ও বাড়িতে নেই। ভালোই হবে আমরা অনেকটা সময় একা কাটাতে পারব।”

রূপ হাসি চেঁপে বলল,,,,,

—–“হুম আমি ও তাই ভাবছি। একজনকে প্রতিদিন দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে গেছি। মাঝে মাঝে এক্টু আধটু টেস্ট বদলানো দরকার।”

মুহিত চোখ লাল করে রূপের দিকে তাকিয়ে আছে। রূপ কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে কিছুটা সিরিয়াস হয়ে মিনমিন করে আদনানকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“শুনুন খুব সাবধান। মুহিত যেনো কিছু জানতে না পারে। আমি ওর অগোচড়ে আপনাকে কল করেছি। আজ হুট করেই আপনার কথা খুব মনে পড়ছিলো। তাই আপনাকে কল না করে থাকতে পারলাম না। দয়া করে মামুকে ও কিছু বলবেন না। মামু আবার দরদ দেখিয়ে মুহিতকে বলে দিতে পারে। আপনি তাড়াতাড়ি ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিন। আমি আসছি।”

—–“আমি কাউকে কিছু বলব না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। আর এক্টু সেজে গুজে এসো কেমন?”

—–“তা আর বলতে। অবশ্যই সেজেগুজে আসব। আচ্ছা রাখছি। মুহিত যেকোনো সময় ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারে।”

রূপ তাড়াতাড়ি কলটা কাট করে কয়েকটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে মুহিতের দিকে তাকালো। মুহিত রূপের গালে আরেকটা কামড় বসিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,,,,,

—–‘কি বললে তুমি? মাঝে মাঝে টেস্ট বদলানো দরকার?”

রূপ গালে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে কিছু বলতে যাবে এর আগেই ফোনে ম্যাসেজের টুং টাং শব্দ হলো। মুহিত এক ঝটকায় রূপের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে ম্যাসেজটা দেখে বাঁকা হেসে বলল,,,,,,

—–‘তাহলে আম্মু ঠিকই বলেছে। ঐ মহিলা এখনো ঢাকার উত্তরাতেই থাকে।”

ফোনটা রূপের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুহিত গাড়ি নিয়ে ছুটল আদনানের দেওয়া এড্রেসে। রূপ কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু মুহিতের কথা মতো কাজ করে যাচ্ছে। মুহিতকে যে কিছু জিগ্যেস করবে তার ও সাহস যোগাতে পারছে না রূপ। কারন মুহিত ক্ষনে ক্ষনেই রূপের গালে বাইট বসিয়ে দিচ্ছে। তাই সে বাইটের ভয়ে চুপ করে আছে।

প্রায় আধ ঘন্টা পর। গাড়ি এসে পৌঁছে গেলো আদনানের এড্রেস অনুযায়ী। মুহিত রূপকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলো। বাড়ির সদর দরজায় কলিং বেল চাঁপার দু মিনিট পর আদনান এসে দরজা খুলে দিলো। হাসি মুখে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে আদনান। সেকেন্ডের মধ্যেই আদনানের হাসি মুখটা উবে গেলো। রূপের পাশাপাশি মুহিতকে দেখে আদনানের চোখ খসে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

আদনান তাড়াহুড়ো করে দরজাটা লাগাতে নিলেই মুহিত দরজায় এক ধাক্কা দিয়ে আদনানকে নিয়েই রুমের ভিতর ঢুকে পড়ল। চোখ মুখ লাল করে মুহিত আদনানের কলার চেঁপে ধরেছে। রূপ বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। আদনান মুহিতের দিকে তাকিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলছে,,,,,,

—–“এসব কি হচ্ছে মুহিত? তুমি আমার কলার ধরলে কেনো?”

মুহিত দাঁত কিড়মিড় করে বলল,,,,,,

—–“তোর মা কোথায়। আগে সেটা বল।”

—–“আম্মু বাড়িতে নেই। তাছাড়া তুমি আমার আম্মুকে দিয়ে কি করবে? কলার ছাড়ো আমার। আমি কিন্তু হাসিব আঙ্কেলকে সব বলে দিবো।”

—–“আঙ্কেল কেনো? আব্বু বল। মিঃ হাসিব তো তোর আব্বু লাগে।”

মুহূর্তেই আদনানের চোখে, মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। রূপ তেড়ে এসে মুহিতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,,,,

—–“এসব কি হচ্ছে মুহিত? মামু উনার আব্বু হবে কি করে? মামু তো বিয়ে ই করে নি। তুমি বেশিই বাড়াবাড়ি করছ।”

মুহিত রূপের কথায় পাত্তা না দিয়ে আদনানকে এক্টা চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে আদনানের নাক বরাবর জোরে এক্টা ঘুষি মেরে বলল,,,,,,,

—–“বল তোদের পুরনো কাহিনী। মামু তোর মাকে কবে বিয়ে করেছে তাড়াতাড়ি বল। আর তুই ই বা কার সন্তান? মামুর নাকি অন্য কারোর?”

আদনান নাকে হাত দিয়ে ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠছে আর মৃদ্যু চিৎকার দিয়ে বলছে,,,,,,,

—–“তুমি কাজটা একদম ঠিক করলে না মুহিত। আমার গাঁয়ে হাত দিয়ে তুমি খুব বড় ভুল করলে।”

মুহিত এবার আদনানের পেট বরাবর আরো জোরে এক্টা ঘুষি মেরে বলল,,,,,,,,

—–“কথা না পেঁচিয়ে সোজা পয়েন্টে আয়। তোর আসল পরিচয় বল। ঠিক, ভুল পরে জাজ করিস।”

এর মাঝেই একজন ভদ্র মহিলা সদর দরজা দিয়ে দৌঁড়ে এসে পেছন থেকে মুহিতের কলার চেঁপে ধরে বলল,,,,,,

—–“এই কে তুমি? আমার বাড়িতে কি করছ?”

মুহিত পিছু ফিরে মহিলাটার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,,,,,,

—–“আপনিই কি তাহলে আদনানের মা?”

আদনান পেটে হাত দিয়ে মৃদ্যু চিৎকার করে বলল,,,,,,

—–“আম্মু দেখো। ছেলেটা আমার কি অবস্থা করেছে। এক্ষনি ছেলেটাকে বাড়ি থেকে বের করো।”

আদনানের দিকে তাকিয়ে আদনানের আম্মু চোখের জল ছেড়ে দিলো। মুহিত রাগটাকে কন্ট্রোল করে আদনানের আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

—–“আন্টি…… আমি আপনার ছেলের মতো। আমি আপনার থেকে কিছু জানতে চাই। প্লিজ আপনি আমাকে হতাশ করবেন না। এই মুহূর্তে আমার সত্যিটা জানা খুব দরকার।”

আদনানের আম্মু চোখের জল মুছে বলল,,,,,,

—–“কি সত্যি জানতে চাও বলো?”

—–“আপনি কি মিঃ হাসিবের ওয়াইফ?”

আদনানের আম্মু মাথা নিচু করে জবাব দিলো,,,,,

—–“হুম আমিই উনার ওয়াইফ।”

রূপ মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সে আদনানের আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছে। আদনান চোখ লাল করে ওর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“আম্মু জাস্ট শাট আপ। এসব কি আবল তাবল বকছ তুমি? ওদের মিথ্যে কেনো বলছ?”

আদনানের আম্মু চোখ তুলে আদনানের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“সত্যি কখনো চাঁপা থাকে না আদনান। আজ আমাকে সত্যিটা স্বীকার করতেই হবে।”

আদনানের আম্মু চোখের জল মুছে মুহিতের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“হাসিবের সাথে আমার বিয়ের পঁচিশ বছর চলছে। পঁচিশ বছর আগে আমার প্রথম সংসারটা ভেঙ্গে যায়। এর জন্য দায়ী হাসিব। বিয়ে ভাঙ্গার পর পরই হাসিব আমাকে জোর করে ওর বড় বোনের অগোচড়ে আমাকে বিয়ে করে নেয়। আমাদের বিয়ের আড়াই বছর পর ওর বড় বোন মারা যায়। শুনেছি সিলিন্ডার ব্লাস্টে। তখন আদনান দেড় বছরের। আপুর মৃত্যুর দু বছর পর হাসিব দেশের বাইরে চলে যায়। দু বছরে এক বার করে সে দেশে ফিরত। এক মাস থেকে আবার চলে যেতো। তবে এইবার দেশে ফিরে সে এই বাড়িতে আসে নি। তোমাদের বাড়িতে থেকে যায়। এর এক্সেক্ট কারণ আমি জানি না।”

মুহিত কিছুটা সিরিয়াস হয়ে বলল,,,,,,

—–“আপনি কি সত্যিই এর কারণ জানেন না? নাকি কিছু গোপন করছেন?”

—–“আমি সত্যিই কিছু জানি না। হাসিব আমাকে কখনো কিছু বলে নি। আমি ও কিছু জানার আগ্রহ প্রকাশ করি নি। প্লিজ মুহিত এবার তুমি আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও।”

আদনানের আম্মুকে ক্রস করে মুহিত আদনানের দিকে এগিয়ে এসে আদনানের থুতনীটা উপরে তুলে চোয়াল শক্ত করে বলল,,,,,,

—–“এইবার তুই বল। তোর আব্বু সম্পর্কে যা যা জানিস।”

—–“আমি কিচ্ছু জানি না। জানলে ও তোকে বলব কেনো?”

—–“বলবি। কারণ তুই বলতে বাধ্য। না হয় এখনি পুলিশ ডেকে তোকে চার দেয়াল বন্দি করে আসব। রিমান্ডে নিয়ে যখন পুরো শরীরে গরম পানি ঢেলে দিবে তখন বুঝবি রিমান্ডের মজা।”

আদনান শুকনো ঢোক গিলে মুহিতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

—–“কিকিকি জানতে চাও তুমি?”

মুহিত বাঁকা হেসে বলল,,,,,,

—–“এইতো লাইনে এসেছিস। এবার বল, সকালে তোর হাতে ঐটা কিসের ফাইল ছিলো?”

——“রূপদের সম্পওির ফাইল।”

রূপ চোখে জল নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে আদনানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,,

—–“সম্পওির ফাইল তো পুলিশের হেফাজতে ছিলো। আপনার হাতে এলো কি করে?”

—–“পুলিশের কন্সটেবলকে মোটা অঙ্কের টাকা খাইয়ে ফাইলটা হাতে নিয়েছি। আব্বু শিখিয়ে দিয়েছে। তাই আমি ও করেছি।”

রূপের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। চোখ থেকে টলটলিয়ে পানি পড়ছে। শেষ পর্যন্ত ওর নিজের মামু ওকে ঠকালো। যেখানে মামুকে সে নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করত। সেই মামু কিনা তাকে এতো নিঁখুতভাবে ঠকালো! মুহিত রূপের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে রূপকে বুকের মাঝে চেঁপে ধরে আদনান আর আদানানের আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“আপনারা কেউ মুখ খুলবেন না। মামু যেনো বুঝতে না পারে আমি এখানে এসেছি। কিছুটা সময়ের জন্য মামুর সাথে যোগাযোগ বন্ধ রাখবেন। আমার কথা না শুনলে ক্ষতিটা কিন্তু আপনাদের ই হবে। একজনের সাথে তিনজন জেল খাটবেন।”

কথা গুলো বলেই মুহিত রূপকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পকেট থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে থানায় কল করে বলে দিলো মুহিতদের ফ্ল্যাটে চলে আসতে। মিঃ হাসিবকে হাতে নাতে ধরতে। পুলিশ মুহিতের কথা মতো মুহিতদের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মুহিত ও গাড়িতে উঠে খুব স্পীডে গাড়ি ছেড়ে দিলো। রূপ গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ জোড়া বুজে কেবল চোখের জল ছেড়ে যাচ্ছে। মুহিত গাড়িতে বসেই মৃন্ময় আর সানোয়ার আহমেদকে কল করে বলে দিলো ফ্ল্যাটে আসতে। ওরা ও ছুটছে মুহিতদের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে।

প্রায় আধ ঘন্টা পর। মুহিত গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলো ফ্ল্যাটে। পুলিশ এখনো আসে নি। মৃন্ময় আর সানোয়ার আহমেদের গাড়ি ও দেখা যাচ্ছে না। মুহিত রূপকে নিয়ে দৌঁড়ে ফ্ল্যাটের ভিতর ঢুকে গেলো। মিঃ হাসিব রুমে বসে ল্যাপটপে কিছু করছে।
#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_৪৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

প্রায় আধ ঘন্টা পর। মুহিত গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলো ফ্ল্যাটে। পুলিশ এখনো আসে নি। মৃন্ময় আর সানোয়ার আহমেদের গাড়ি ও দেখা যাচ্ছে না। মুহিত রূপকে নিয়ে দৌঁড়ে ফ্ল্যাটের ভিতর ঢুকে গেলো। মিঃ হাসিব রুমে বসে ল্যাপটপে কিছু করছে।

রূপ মুহিতের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মিঃ হাসিবের রুমে ঢুকে গেলো। মিঃ হাসিবের মনযোগ এখনো ল্যাপটপের দিকে। তাই উনি রুমে এখনো দ্বিতীয় কোনে ব্যক্তির অস্তিত্ব টের পায় নি। রূপ চোখে জল নিয়ে মিঃ হাসিবের সামনে থেকে ল্যাপটপটা সরিয়ে কান্নাসিক্ত কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,,

—–“আমার আম্মু, আব্বু তোমার কি ক্ষতি করেছিলো মামু? কেনো তুমি আমার আম্মু, আব্বুকে মেরেছ?”

মিঃ হাসিব থতমত খেয়ে বসা থেকে উঠে আমতা আমতা করে বলল,,,,,,,

—–“এসব তুমি কি বলছ রূপ? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?”

—–“আমার মাথা খারাপ হয় নি। মাথা খারাপ হয়েছে তোমার! সম্পওির লোভে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই তুমি আমার আম্মু, আব্বুকে মেরে দিয়েছ!”

মিঃ হাসিব পর পর শুকনো ঢোক গিলছে আর অস্থির দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। বুকের উপর দুহাত গুজে মুহিত এসে দাঁড়িয়ে আছে রূপের পাশে। মুহিত এক ভ্রু উঁচু করে মিঃ হাসিবের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,,

—–“সত্যিটা স্বীকার করুন মামু। এখনো সময় আছে। পরে কিন্তু পস্তাতে হবে। যতো তাড়াতাড়ি সত্যিটা স্বীকার করবেন। ততো আপনার সাজা কম হবে।”

মিঃ হাসিব কাঠ কাঠ গলায় মুহিতের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

—-“কি কি সত্যি স্বীকার করব? কি করেছি আমি?? আমার জানা মতে তো, আমি কিছু করি নি।”

মুহিত কিছু বলার আগেই রূপ বলে উঠল,,,,,,

—–“আর ড্রামা করতে হবে না মামু। আদনান আমাদের সত্যিটা বলে দিয়েছে। তুমি বিবাহিত। তোর বউ আছে, ছেলে ও আছে। আর আদনান ই হলো তোমার একমাএ ছেলে।”

রূপ হেচকি তুলে কেঁদে আবার বলল,,,,,,,,

—–“আমরা এ ও জানি। তুমি ই আমার আম্মু, আব্বুকে খুন করেছ। শুধুমাএ সম্পওির লোভে। শুনো মামু….. আমাদের থেকে আর কিচ্ছু লুকিয়ে লাভ নেই। আমরা সব জেনে গেছি।”

সঙ্গে সঙ্গেই মিঃ হাসিবের কাশি উঠে গেলো। উনি একনাগাড়ে কাশছে আর হাফাচ্ছে। মুহিত বেশ বুঝতে পেরেছে মিঃ হাসিব নাটক করছে। ডেস্কের উপর থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে মুহিত মিঃ হাসিবের দিকে এগিয়ে এসে বাঁকা হেসে বলল,,,,,,,

—–“নিন পানিটা খান। এরপর শান্ত হয়ে সত্যিটা বলুন। নয়তো পুলিশের উত্তম মধ্যম খেয়ে সত্যিটা স্বীকার করতে হবে।”

মিঃ হাসিব আরো ঘাবড়ে গেলো। ভয়ে উনার চোখে পানি টলমল করছে। রূপের এক্টু ও মায়া হচ্ছে না মিঃ হাসিবের জন্য। উল্টো রাগ হচ্ছে। মুহিতের হাত থেকে গ্লাসটা ছিনিয়ে নিয়ে রূপ তেড়ে এসে মিঃ হাসিবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,

—–“তাড়াতাড়ি পানিটা গিলো। এরপর সত্যিটা বলো।”

মিঃ হাসিব রূপের রক্তিম চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে রূপের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে রূপের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

—–“রূপ সত্যি বলছি আমি কিছু করি নি। তোর ফুফু আম্মু স্বয়ং নিজেই ঐ খুনের সাথে জড়িত। আমি কিছু করি নি। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।”

—–“তুমি যদি নির্দোষ ই হও তবে কেনো কন্সটেবলকে দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা খাইয়ে আমার বাড়ির দলিল হাতিয়ে নিলে?”

মিঃ হাসিব কাঠ কাঠ গলায় কিছু বলতে নিলেই মুহিত মৃদ্যু চিৎকার দিয়ে বলল,,,,,,

—–“প্লিজ মামু ভনিতা করো না। তাড়াতাড়ি মুখ খুলো। এতে তোমারই ভালো হবে। পুলিশ এলে কিন্তু এর চেয়ে করুন অবস্থা হবে তোমার।”

মিঃ হাসিবকে ঝাঁকিয়ে রূপ মৃদ্যু চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,,,,,,

—–“সম্পূর্ণ প্রমাণ তোমার বিরুদ্ধে মামু। তুমি ফেঁসে গেছো। পুরোপুরি ফেঁসে গেছো। এতো বছর পর আসল সত্যিটা আমার সামনে এলো। জীবনের সবচে তিক্ত সত্যিটা আমাকে ফেইস করতে হচ্ছে। ভালোয় ভালোয় মুখ খুলে দাও মামু। নয়তো তুমি এবার রূপের হিংস্র রূপটা দেখবে। সহ্য করতে পারবে না কিন্তু। তখন মনে হবে মৃত্যুই শ্রেয়।”

মিঃ হাসিব এবার মাথাটা নিচু করে বলতে লাগল,,,,,

—–“হ্যাঁ আমিই মেরেছি আপু আর দুলাভাইকে। তখন আমার টাকার খুব দরকার ছিলো। অনেক অনেক টাকার দরকার ছিলো। কিন্তু দুলাভাই নারাজ ছিলো। উনার এতো এতো সম্পওি থাকা সত্ত্বে ও উনি কিপটেমি করত। তখন আদনানের মায়ের সাথে আমার বিয়ের দুই বছর চলছিলো। আপু আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানত না। আমার ও কাউকে জানানোর ইচ্ছে ছিলো না। এতে হীতে বিপরীত হতো। আপু আর দুলাভাই আমাদের বিয়েটা মেনে নিতো না। আমাদের আলাদা করে দিতো। তাই আমি ভয়ে কাউকে কিছু শোনাই নি। ব্লাস্টের আগের দিন রাতে আমি আপুর সাথে দেখা করতে ঐ বাড়িতে যাই। নতুন বিজনেসের জন্য আমার অনেক গুলো টাকার দরকার ছিলো। আপুর কাছে টাকা চাইতে গেলেই আপু না করে দেয়। শুধুমাএ দুলা ভাইয়ের ভয়ে। টাকা চাইলেই উনি আমাকে নানা ভাবে ইনসাল্ট করত। মুখে উপর না করে দিতো। তাই ঐ দিন জেদের বসে আপুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সিলিন্ডারের পাইপটা ফুটো করে দিয়ে আসি। পুরো বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করি। পরের দিন সকালে আমার মনটা খুব অস্থির অস্থির করছিলো। অনুশোচনা তাড়া করছিলো। কারণ তখন আমার রাগটা কমে গিয়েছিলো। বুঝতে পারলাম আমি ভুল করেছি। তখনই তাড়াহুড়ো করে আপুর নম্বরে কল করি। আপু যেনো গ্যাস অন না করে। কিন্তু আপু কলটা রিসিভ করছিলো না। তাই আমি দৌঁড়ে চলে গেলাম আপুদের বাড়িতে। গিয়ে দেখি অলরেডি সবটা শেষ হয়ে আছে। রূপকে এক্টা ভদ্র মহিলা কোলে নিয়ে রেখেছে। আপু আর দুলাভাইয়ের সাথে পুরো বাড়িটা জ্বলে পুড়ে গেছে। রূপ পাশের বাড়িতে ছিলো বলে বেঁচে গেছে। রূপকে কোলে নিয়ে আমি চোখের জল ছাড়ছিলাম। অনুশোচনা, অনুতাপে দ্বগ্ধ হচ্ছিলাম।”

মিঃ হাসিব কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,,,

—–” বাড়ির দলিলটা আগে থেকেই মায়া আহমেদের কাছে ছিলো। তাই দলিলটা ঠিক ছিলো। এতো কিছুর পরে ও আমার লোভ যেনো সরছিলো না। এতো টাকার সম্পওি দেখে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। আমি ভেবেছিলাম রূপের আঠারো বছর পাড় হলেই আমি রূপকে আদনানের সাথে বিয়ে দিয়ে পুরো সম্পওি নিজেদের দখলে নিয়ে আসব। কিন্তু তা আর হলো না। এর আগেই তোমাদের দুজনের বিয়ে হয়ে গেলো। আমি জানতাম মায়া আহমেদ এতো কোটি টাকার সম্পওির লোভ ছাড়তে পারবে না। নিশ্চয়ই এক্টা সময় পর উনার মধ্যে ও লোভ ঢুকে যাবে। হলো ও ঠিক তাই। উনি ঠিক রূপকে জোর করে সম্পওি হাতিয়ে নিলো। তখন থেকেই আমার পরিকল্পনা ছিলো দেশে ফেরার। রূপের কানে মায়া আহমেদের নামে বিষ ঢুকিয়ে সম্পওির দলিলটা নিজের কাছে আনার। খানিক সফল ও হয়েছি। তবে সবশেষে ধরা পড়ে গেলাম। শেষ রক্ষা আর হলো না।”

রূপ ধপ করে বেডের উপর বসে গেলো। চোখ থেকে গড়গড়িয়ে পানি পড়ছে। মুহিতের চোখে ও পানি টলমল করছে। মৃন্ময় আর সানোয়ার আহমেদ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এতোক্ষন সব শুনছিলো। ওরা ও কিছুটা সময়ের জন্য থমকে গেলো। মিঃ হাসিব এখনো মাথাটা নিচু করে রেখেছে। পুলিশ অফিসাররা ফ্ল্যাটে ঢুকে শো শো বেগে রূপদের ডাইনিং রুমে চলে এলো। নীরবতা ভেঙ্গে মিঃ হাসিব রূপের দিকে তাকিয়ে অনুতপ্ত কন্ঠে বলল,,,,,,

—–“আমি আমার দোষ স্বীকার করছি রূপ। আইন আমাকে যা শাস্তি দিবে আমি তাই মেনে নিবো। পাপ করার পর আমি বুঝতে পেরেছি আমি পাপ করেছি। এর আগে যদি বুঝতাম তাহলে হয়তো নিজের আপন বোনকে জানে মারার এতো বড় ঘাটিয়া প্ল্যানিং করতাম না। তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি রূপ। বলব না আমাকে ক্ষমা করে দাও। কারন ঐ মুখটা আমি আর রাখি নি। আমার পাপের ফল আমি ভোগ করতে চাই।”

পুলিশ রুমে ঢুকার সাথে সাথেই মিঃ হাসিব নিজ থেকে পুলিশের কাছে নিজের সমস্ত দোষ স্বীকার করে নিলো। মিঃ হাসিবকে এরেস্ট করে পুলিশরা থানার দিকে রওনা হয়ে গেলো। মায়া আহমেদের বিরুদ্ধে কেইস তুলার জন্য রূপকে ও পুলিশের সাথে যেতে হবে। রূপের সাথে মুহিত, মৃন্ময় আর সানোয়ার আহমেদ ও ছুটল থানায়। রূপ এক প্রকার থ হয়ে আছে। কান্না থামিয়ে শান্ত হয়ে আছে। মুহিত রূপকে এই মুহূর্তে শান্তনা দিতে চাইছে না। কেঁদে কেটে কষ্টটা হালকা করুক। এরপর রূপকে ভালোবেসে সবটা বুঝাতে হবে।

থানায় পৌঁছে রূপ মায়া আহমেদের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ তুলে নিলো। আদনান আর মিসেস আয়রা মিঃ হাসিবকে লকাপে দেখে কান্না জুড়ে দিলো। মুহিত ঐ লোভী কন্সটেবলের বিরুদ্ধে পুলিশ অফিসারের কাছে অভিযোগ তুলল। প্রমান পাওয়ার সাথে সাথে ঐ কন্সটেবলকে চাকরী থেকে ডিসমিস করা হলো। বাড়ির দলিল এখন মুহিতের হাতে। মিঃ হাসিব অনুতপ্ত ভরা চোখ নিয়ে রূপের দিকে তাকিয়ে আছে। রূপ এক্টা সেকেন্ডের জন্যে ও মিঃ হাসিবের দিকে তাকাতে চাইছে না। আদনান আর মিসেস আয়রা রূপের থেকে ক্ষমা চেয়ে নিলো। সাথে মুহিতের থেকে ও। মিঃ হাসিব মুহিতের দিকে তাকিয়ে কান্নাসিক্ত কন্ঠে বলল,,,,,,

—–“মুহিত….. আমার ছেলে আর ওয়াইফকে তোমরা দেখে শুনে রেখো। আমার পাপের ফল ওরা ও ভোগ করছে। আমি পাপি হলে ও ওরা কিন্তু সম্পূর্ণ নির্দোষ। আপু আর দুলাভাইয়ের খুনের ব্যাপারে ওরা কিছু জানে না। আমার অবর্তমানে ওদের সব দায়িত্ব তোমার। আর পারলে রূপকে বলো আমাকে ক্ষমা করে দিতে। জীবনের বাকিটা সময় না হয় আমি হাজুতবাস করে কাটিয়ে দিবো। অন্তত মৃত্যু পরে হলে ও যেনো রূপ আমাকে ক্ষমা করে।”

রূপ আর এক সেকেন্ড ও থানায় দাঁড়াল না। কাঁদতে কাঁদতে থানার বাইরে চলে গেলো। রূপের সাথে মায়া আহমেদ ও থানা থেকে বের হয়ে গেলো। রূপ গাড়িতে বসে অঝড়ে কাঁদছে। মায়া আহমেদ ব্যাক সিটের দরজা খুলে রূপের পাশে বসে রূপের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,,,,,

—–“কাঁদিস না রূপ। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যা। আমি আছি তোর পাশে। মা হয়ে থাকব তোর পাশে। মুহিতের মা হলে তো আমি ও তোর মা।”

মায়া আহমেদ কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,,

—–” দেখ, তোর সাথে আমার দুইটা সম্পর্ক। প্রথমত তুই আমার ভাইয়ের মেয়ে, দ্বিতীয়ত তুই আমার ছেলের বৌ। আমি তোকে খুব আগলে রাখব রূপ। আমি আমার সমস্ত ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি এতো বছর মুহিত আর তোর সাথে চরম অন্যায় করেছি। এতোটা বছরের পাপ আমি এক সপ্তাহ চার দেয়ালে বন্দি থেকে ভোগ করেছি সমস্ত ভুল গুলো বুঝতে পেরেছি। এই শাস্তিটা আমার দরকার ছিলো। উপর ওয়ালা হয়তো বুঝে শুনেই ভুলবশত আমাকে এতো বড় শাস্তি দিয়েছে। হাজার হাজার শুকরিয়া উপর ওয়ালার কাছে।”

রূপ আচমকাই কাঁদতে কাঁদতে মায়া আহমেদকে জড়িয়ে ধরে বলল,,,,,,,

—–“ফুফুমনি……. আমাকে আর কষ্ট দিও না প্লিজ। আমি তোমার মেয়ে হয়ে থাকতে চাই। যেমনটা দোলা আপু থাকে। আমি একজন মা চাই। যে আমাকে খুব বুঝবে, ভালোবাসবে, আগলে রাখবে। তুমি কি আমার সেই মা হবে ফুফুমনি? আপন লোকদের থেকে ঠকতে ঠকতে আজ আমি নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। এতো পেইন আমি নিতে পারছি না। ছোট বেলা থেকেই নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছি। মা, বাবার আদর পাই নি। ইচ্ছে হয়, মায়ের আদর পেতে, বাবার ছাঁয়া পেতে। কিন্তু হয়ে উঠে না। কেউ আমাকে আপন করে নেয় না। সবাই স্বার্থের জন্য কাছে এসে আবার দূরে ঠেলে দেয়। এই ছোট্ট জীবনটায় আমি প্রতি পদে পদে ঠকেছি। ঠকতে ঠকতে মুখ থুবড়ে মাটিতে মিশে গেছি। বিশ্বাস করো আমি আর পারছি না। ক্লান্ত হয়ে উঠেছি আমি। প্রতিটা নিশ্বাসের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। এতো হেলা ফেলার জীবন আর ভালো লাগছে না।”

মায়া আহমেদ চোখের জল ছেড়ে রূপকে বুকের সাথে মিশিয়ে বলল,,,,,,

—–“তোকে আর ঠকতে হবে না রূপ। আমি তোর আপন মা হয়ে দেখাবো। মায়ের মতো আদর করব, ভালোবাসব, আগলে রাখব। আর সারফারাজ তোকে বাবার ছায়া দিবে। তুই এবার সম্পূর্ণ এক্টা পরিবার পাবি। বাড়ির সবাই তোকে মাথায় তুলে রাখবে। সাথে আমার ছেলে মুহিতকে ও। তোদের আর আলাদা ফ্ল্যাটে থাকতে হবে না রূপ। নিজের বাড়িতে থাকবি। মুহিতকে ও আর অন্যের আন্ডারে কাজ করতে হবে না। ওর বড় ভাইয়ের সাথে নিজেদের অফিসের কাজে জয়েন করবে। আমি আর কারো মধ্যে বৈষম্য রাখব না। সবাই আমার কাছে এক। আমি খুব ভালো হয়ে দেখাবো। যতোটা ভালো হলে পরিবারের সবাই আমাকে ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা করবে, সম্মান করবে।”

মায়া আহমেদের বুক থেকে মাথা তুলে রূপ ছলছল দৃষ্টিতে মায়া আহেমেদের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃদু হেসে মায়া আহমেদ রূপের চোখের জল মুছে দিয়ে রূপের নাক টেনে বলল,,,,,,

—–“কি বিশ্বাস করছিস না তাই তো? আমি কিন্তু সত্যি বলছি। বাড়ি ফিরে চল তাহলেই টের পাবি। তখন বুঝবি মায়া আহমেদ যা বলে সত্যি বলে। আজ থেকে পুরো পরিবারকে আগলে রাখব আমি। খুব ভালো বৌ, মা, আর শ্বাশুড়ী মা হয়ে দেখাবো।”

রূপ এক গাল হেসে আবার মায়া আহমেদকে জড়িয়ে ধরল। মায়া আহমেদ ও রূপের কপালে চুমো খেয়ে রূপকে জড়িয়ে ধরল।

ঐদিকে,,,,,,

মুহিত নিরুপায় হয়ে আদনান আর মিসেস আয়রার দায়িত্ব নিলো। মিঃ হাসিব খুব জোর করছিলো। মুহিতের ও কেমন মায়া লেগে গেছে। তাই সে না করতে পারল না। সানোয়ার আহমেদ ও মুহিতকে এই বিষয়ে সাপোর্ট দিয়েছে। তাই মুহিত বিশেষ করে রাজী হয়েছে। মিঃ হাসিবকে জেলে রেখে সবাই থানা থেকে বের হয়ে এলো। আদনান আর মিসেস আয়রা নিজেদের বাড়িতে ফিরে গেলো। আগামী কাল মিঃ হাসিবকে কোটে তোলা হবে। এরপর উনার সাজা শুরু হবে। মিঃ হাসিব স্ট্রেটলি বলে দিয়েছে উনার পক্ষে যেনো কোনো লয়ার হায়ার করা না হয়। উনি উনার পাপের সাজা ভোগ করতে চায়। আদনান আর মিসেস আয়রা বাধ্য হয়ে মিঃ হাসিবের কথা মেনে নিলো।

মায়া আহমেদ এখনো রূপকে বুকের সাথে চেঁপে ধরে রেখেছে। মুহিত, মৃন্ময় আর সানোয়ার আহমেদ ব্যাক সিটের জানালা দিয়ে রূপ আর মায়া আহমেদকে দেখছে। ওরা তিনজনই মুখে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে রূপ আর মায়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা তিনজন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না চোখের সামনে যা দেখছে। সানোয়ার আহমেদ গলাটা ঝাঁকিয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠল,,,,,,

—–“এ বাবা এসব কি দেখছি? চোখ দুটো গেলো নাকি আমার?”

মুহিত আর মৃন্ময় ও চোখ ঘঁষে সানোয়ার আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,

—–“আমরা ও তাই ভাবছি। তিনজনের কি একসাথেই চোখের ব্যামো হলো!”

রূপ আর মায়া আহমেদ মুচকি মুচকি হাসছে। রূপ হাসি থামিয়ে মুহিতের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“ঢং না করে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসো। বাড়ি যেতে হবে! বাপ, ছেলেরা মিলে ঢং শুরু করেছে।”

মুহিত ভ্রু কুঁচকে বলল,,,,,,

—–“বাড়ি যাবো মানে? ফ্ল্যাটে যাবে না?”

রূপ কিছু বলার আগেই মায়া আহমেদ বলে উঠল,,,,,

—–“না যাবে না। তুমি ও যাবে না। আজ থেকে আমরা সবাই একই বাড়িতে থাকব। রূপের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে। সো আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়ো।”

মৃন্ময় আর সানোয়ার আহমেদ ক্লোজ আপ হাসি দিয়ে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে। মুহিত খুশিতে হাসতে হাসতে মৃন্ময় আর সানোয়ার আহমেদকে জড়িয়ে ধরল। খুশিতে মুহিতের চোখের কোনে পানি জমে এলো। শুধু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা। রূপ মায়া আহমেদের বুকে মাথা রেখে এক দৃষ্টিতে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে। মুহিতের হাসি মুখটা মুগ্ধ নয়নে দেখছে সে। মায়া আহমেদ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে চোখে অসংখ্য জল নিয়ে তিন বাপ, ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। জীবনের আসল খুশিটা উনি দু চোখ ভরে দেখছে। মৃন্ময় এক প্রকার লাফাচ্ছে আর হেসে হেসে বলছে,,,,,,,

——“ইয়েস, আজ থেকে আমরা সবাই এক সাথে থাকব। মারু শুনলে খুব খুশি হবে।”

মুহিত এবার হাসি থামিয়ে মায়া আহমেদ আর রূপের দিকে তাকিয়ে আছে। সানোয়ার আহমেদ মুহিতকে ছেড়ে মুহিতের হাত ধরে জানালার ভিতর মুখ ঢুকিয়ে আচমকাই মায়া আহমেদের কপালে চুমো খেয়ে বলল,,,,,,,

—–“আজ আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারব… হ্যাঁ আমি মায়ার মধ্যেই আমার সুপ্রিয়াকে খুঁজে পেয়েছি। আজ থেকে আমার পরিবারটা সম্পূর্ণ হবে। ঐ বাড়িতে আমার আর দম বন্ধ হয়ে আসবে না। বরং কোনো বাঁধা ছাড়াই আমি শ্বাস নিতে পারব।”

মায়া আহমেদ প্রেম নজরে তাকিয়ে আছে সানোয়ার আহমেদের দিকে। রূপ বাঁকা হেসে মায়া আহমেদের চোখ দুটো হাত দিয়ে চেঁপে ধরে বলল,,,,,

—–“এভাবে আমার আব্বুর দিকে তাকাবে না। নয়তো প্রেমে পড়ে যাবে। এই বুড়ো বয়সে প্রেমে পড়া বারণ। বাড়িতে গিয়ে যতো ইচ্ছে প্রেম করো। ছেলে মেয়েদের সামনে এসব এলাউড না।”

সানোয়ার আহমেদ চরম লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে পাশের গাড়িতে উঠে পড়ল। উনি একা ড্রাইভ করে বাড়ি যাবে। মুহিত আর মৃন্ময় রূপদের সাথে একই গাড়ি করে বাড়ি ফিরবে। মায়া আহমেদ মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসছে। মুহিত আর মৃন্ময় হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠে বসল। মুহিত পিছনের দিকে একবার তাকিয়ে খুব স্পিডে গাড়ি ছেড়ে দিলো। পেছন থেকে সানোয়ার আহমেদ ও গাড়ি ছেড়ে দিলো।

রূপ মায়া আহমেদের হাত ধরে এক দৃষ্টিতে মায়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের নিচের কালো দাগ গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুখটা ও কেমন শুকিয়ে গেছে। চোখের কোণে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জল গুলো মুছে দিয়ে রূপ মায়া আহমেদকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে নিলো। খুব আপন লাগছে মায়া আহমেদকে। ঠিক নিজের আপন মা এর মতো।

#চলবে,,,,,,,,,,,,
#চলবে,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here