এক কাপ ঠান্ডা কফি পর্ব -১১+১২

#এক_কাপ_ঠান্ডা_কফি
#পর্ব:- ১১

ওসির কথা শুনে পুতুল ঘাবড়ে গেলেও সাজু ভাই একটুও বিচলিত হলেন না। গতকাল রাতে যখন জানতে পেরেছেন ও বাসায় তার ছবি পাওয়া গেছে তখন থেকে এটা ধারণা ছিল। পুলিশের সঙ্গে সামান্য ঝামেলা হতে পারে এটা আগেই সে আন্দাজ করে রেখেছে।

এমন সময় সেখানে প্রবেশ করলো পুতুলের মামা, তার হাতে একটা কাপ। সেই কাপের মধ্যে রয়েছে কফি ” এক কাপ ঠান্ডা কফি। ”

★★ ★

আজকে সকালে নাস্তা করার জন্য সাব্বির যখন হোটেলে এসেছিল তখনই তাকে চিনতে পারে সেখানকার এক কাস্টমার। তিনি পত্রিকা পড়েন নিয়মিত, পত্রিকায় উত্তর বাড্ডা লাশ পাওয়ার ঘটনা ও সেখানে সাব্বিরের ও তার বাবার ছবি ছাপা হয়েছে।

লোকটা তখনই আশেপাশে দুজনের সাহায্য নিয়ে সাব্বিরকে ধরে ফেলে। সাব্বির কোনো পেশাদার খুনি নয়, সে কোনো উপায়ে পালিয়ে যেতে পারে নাই। স্থানীয় থানায় খবর দেবার পরে তারা এসে সাব্বিরকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাকে সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেই ওসি সাহেবের কাছে।

সকাল সাড়ে দশটার দিকে ওসি সাহেবের সামনে সাব্বিরকে হাজির করা হয়। ওসি সাহেব তাকে বেশ কিছু প্রশ্ন করে,

– তোমার নাম কি?

– সাব্বির।

– ওই মেয়েটাকে খুন করলে কেন?

– আমি খুন করিনি।

– এতকিছুর পরও অস্বীকার করো?

তারপর সাব্বির সেই রাতের ঘটনা সবকিছুই ওসি সাহেবকে বলে। সবটা শুনে ওসি সাহেব সাব্বিরের বেশিরভাগ কথা বিশ্বাস করে নাই। খুনিরা ধরা পড়ার পরে এমন অসংখ্য গল্প বলে আর সেসব গল্প শোনার অভ্যাস তার আছে।
ওসি সাহেব সাজুর সেই ছবিটি সাব্বিরের সামনে দিয়ে বললো,

– তুমি যাকে ফ্ল্যাটের মধ্যে দেখেছ এটাই কি সেই লোক?

সাব্বির ভালো করে তাকালো। সাজুকে তার চেনার কথা নয়, তাছাড়া সেই রাতে সাব্বির রাব্বি কে নিজের চোখে দেখেনি। তাই বললো,

– স্যার আমি এই ছবির মানুষটাকে চিনি না। আর সেই রাতে তো আমি ওই অজ্ঞাত লোকটার মুখ দেখতে পারিনি। শুধু কণ্ঠ শুনেছিলাম।

– তোমার বাবা এখন কোথায়?

– আমি জানি না। বাবা আমার উপর প্রচন্ড রেগে গেছে তাই তার সামনে দাঁড়ানোর সাহস নেই।

– লাশ গুম করতে পারো নাই তাই রেগে আছে?

– জ্বি।

– তুমি আমার সঙ্গে কত% সত্যি বলছো।

– যা বলেছি সবটাই সত্যি বলছি।

– কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না কারণ ছবির ছেলেটা একজন গোয়েন্দা।

– ওহ্।

– তুমি বরং সিদ্ধান্ত নাও, তোমরা কার হুকুমে লাশ গুম করো, তারপর সেদিন রাতে ওই মেয়ের সঙ্গে কি কি হয়েছে। কেন খুন করেছ আর কার কথাতে খুন করেছ সবকিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নাও। পরে যখন তোমার সঙ্গে দেখা করবো তখন আমার এই ভদ্র ব্যবহার পাওয়া যাবে না।

ওসি সাহেব উঠে গেলন। তারপরেই মাহিশার বাবা ও খালু আর দুলাভাই আসেন। তাদের নিয়ে তিনি চলে যান ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। সেখানে গিয়ে তিনি সাজুর বিষয় বেশ সন্দেহের আলামত লক্ষ্য করেন।

★★★

রাব্বির দিকে তাকিয়ে রামিশা বললো,

– আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন, এখন শেষ একটা কাজ করে দিবেন?

– বলেন।

– আমাকে একটু মিরপুরে পৌঁছে দিতে পারবেন? সেখানে আমার বোনের বাসা।

– সাজু ভাইয়ের কাছে যাবেন না?

– না। তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছেটা মরে গেছে। আপনি যদি এই উপকারটা করেন আমি তাহলে নিশ্চিন্তে আপুর বাসায় যেতে পারবো।

– ঠিক আছে আপনি তৈরি হয়ে নেন আমি ফ্রেশ হয়ে আপনাকে ডাক দেবো।

রামিশার রুম থেকে বের হতেই রাব্বির মোবাইল বেজে উঠলো। স্ক্রিনে খুব পরিচিত একটা নাম্বার দেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাব্বি। তারপর অস্ফুটে মুখ থেকে বের হয়ে গেল ” দাদাজান “।

– হ্যালো রাব্বি?

– জ্বি দাদাজান।

– তোমাকে আমি বলেছিলাম না যেকোনো কাজ করার আগে বিশেষ করে খুনের আগে আমার সঙ্গে একটু কথা বলে নিবা।

– কিন্তু সবকিছু তো ঠিকই চলছে। আর আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি আপনি দেশে ছিলেন না।

– তাই বলে অপেক্ষা করা যেত না?

– মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে তার সঙ্গে আরেকটা পরিবার জড়িয়ে যেত। বিয়ের আগেই কাজটা করতে হতো তাই বেশি ঝামেলা করিনি।

– চরম ভুল করেছ। আর সাজু ছেলেটাকে এর মধ্যে ফাঁসাতে গেলে কেন? যাকে তাকে খুন করার জন্য কিন্তু আমি তোমাকে সুরক্ষিত রাখি না। তুমি বলেছিলে যে খারাপ কাজে জড়িত এমন কাউকে মারার কন্ট্রাক্ট পেলে তুমি করবে। কখনো ভালো কাউকে তুমি টাকার বিনিময়ে হলেও মারবে না।

– হ্যাঁ মনে আছে।

– তাহলে এখানে সাজুর দোষ কি? আর যে মেয়ে কে খুন করছো তার দোষ কি?

– ওই গোয়েন্দা সাজু ভাই একটা নিরপরাধ ব্যক্তি কে আসামি বানিয়ে দিয়েছে। কৌশলে এমন কাজ করেছে যে লোকটা আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে নাই। আর যে মেয়েকে খুন করেছি সে কয়েকটা ছেলের সঙ্গে বেঈমানী করেছে। আপনি তো জানেন দাদাজান, মেয়ে মানুষের বেঈমানী আমি সহ্য করতে পারি না।

– মেয়েটার সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানি না তবে সাজুর সম্পর্কে যেটা বলছো সেটা একদমই ভুল কথা। ওই ছেলে কোনো নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসাবে না, সে সখের জন্য গোয়েন্দার কাজ করে। পেশা হিসেবে নয়।

– রাব্বি চুপচাপ।

– তুমি কি জানো যে সাজু ছেলেটাকে গুলি করা হয়েছে? আর সে হাসপাতালে ভর্তি, এবং তাকে সেই অবস্থায় আবার ওসি সাহেব গেছে গ্রেফতার করার জন্য।

চমকে গেল রাব্বি। সাজু ভাইয়ের প্রতি হামলা হবে এটা তার আশঙ্কা ছিল কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি সেটা হবে তার ধারণা ছিল না।

– আপনি কীভাবে জানেন?

– আমি অনেক কিছুই জানি। যে লোকটার সঙ্গে তোমার চুক্তি হয়েছে আমি তার সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়েছি।

– কীভাবে?

– তুমি কার কার সঙ্গে কথা বলো সেই কল করার সব লিস্ট করা হয়। সেখান থেকেই আমি দুটো নাম্বার আলাদা করেছি, কারণ তুমি তো তোমার পারসোনাল নাম্বার দিয়ে খুব বেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলো না।

– এটা আপনার ঠিক হয়নি।

– অবশ্যই ঠিক আছে। তুমি না জেনে বিপদের মধ্যে জড়াবে এটা তো হবে না। সাভারের সন্ত্রাসী আলাউদ্দীনকে তো চেনো তুমি, তাই না?

– হ্যাঁ।

– সাজুকে খুন করার বর্তমান দায়িত্ব এখন তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তোমাকেও।

– মানে?

– ওরা তোমাকেও সরিয়ে ফেলার প্ল্যান করেছে, কারণ তারা জানে তুমি আমার ডানহাত।

– আপনি কার কথা বলছেন?

– তুমি আগে আলাউদ্দীনকে থামাও, তাকে শেষ করো তারপর আসল লোকের ঠিকানা দিচ্ছি।

– ঠিক আছে হয়ে যাবে।

– আমি চাই সাজুকে মারার আগে তুমি কাজটা করে ফেলো। কারণ সাজু বেঁচে থাকলো তোমার খুব একটা সমস্যা হবে না।

– আমি চেষ্টা করবো।

– আরেকটা কথা।

– বলেন।

– যার সঙ্গে তোমার চুক্তি হয়েছে তার প্রধান লক্ষ্য ছিল সেই মেয়েটা। কিন্তু কেন তাকে মেরে ফেলা হয়েছে সেই তথ্য পুলিশ বের করুক। তবে তারা জানতো যে মেয়েটাকে মারার জন্য তোমাকে চুক্তি করা হলেও কিছুটা ঝামেলা হতে পারে। তাই ওই এলাকার একজনকে তারা টাকা দিয়ে কিনতে চায়। কিন্তু সেই লোকটা কাজটা করতে রাজি হয় ঠিকই তবে সেটা টাকার বিনিময়ে নয়।

– তাহলে?

– সাজুর জীবনের বিনিময়।

– বুঝতে পারলাম না।

– সেই লোকটা বলেছিল, ওই একই ব্যক্তিকে দিয়ে যদি সাজুকে খুন করাতে পারে তাহলে সে সকল ঝামেলা নিজে টেক্কা দেবে।

– এবার বুঝতে পারছি। তাই তারা আগে সাজুকে মারার কন্ট্রাক্ট করে আমার সঙ্গে। তার একদিন পরে বলে আরেকটা মেয়ে খুন করতে হবে।

– হ্যাঁ সেটাই। মেয়েটা তাদের টার্গেট হলেও সাজু হচ্ছে যিনি সবকিছু ধামাচাপা দেবেন সেই লোকটার টার্গেট।

– দাদাজান।

– হুম।

– আমি জানি আমার মতো অনেক রাব্বি আছে আপনার আয়ত্তে। তাই তাদের মাধ্যমে এসব বের করা আপনার কাছে কোনো ব্যাপার না। তবে সত্যি বলতে আজকে আপনি অনেক কিছু বের করে দিলেন যেটা খুব জরুরি ছিল।

– আমি স্বার্থ ছাড়া কিছু করি না রাব্বি। সামনে আবার নির্বাচন, তাই সেই পর্যন্ত তোমাকে নিজের কাছে সাবধানে রাখা আমার একান্ত জরুরি।

– আপনি একটা উপকার করবেন?

– কি?

– ওসি সাহেবকে কল দিয়ে বলবেন সাজু ভাইকে ছেড়ে দিতে। আমি জানি সাজু নিজেই এটা থেকে বের হতে পারবে, কিন্তু সময় লাগবে। আমি চাই না সে জেলে যাক বা তার সম্মানে আঘাত লাগুক।

– ওকে আমি দেখছি বিষয়টা। তুমি আজকে রাতের মধ্যে আলাউদ্দীনকে শেষ করার ব্যবস্থা করো।

নিজের পিস্তলটা সঙ্গে নিয়ে রামিশার কাছে চলে গেল রাব্বি। রামিশাকে মিরপুর পৌঁছে দিয়ে তাকে যেতে হবে সাভারে। আলাউদ্দীনের খোঁজ বের করতে হলে তাকে সেখানে যেতেই হবে।

★★★

কোনো ধরনের কথাবার্তা না বলে চুপচাপ ঠান্ডা কফি শেষ করলেন সাজু ভাই। তারপর ওসি সাহেবকে বললো,

– আমি জানি আমার ছবি উত্তর বাড্ডা ওই বাড়ির মধ্যে পাওয়া গেছে। আমার এক বন্ধু আরেকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আপনার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলো। তিনি হয়তো আপনাকে বলেছিল ওই ছেলেটা আমি।

– হ্যাঁ বলেছিল। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি সব তুমি প্ল্যান করে করেছো।

– একজন ওসি হয়ে বাচ্চাদের মতো কথা বলেন বিষয়টা খুবই দুঃখজনক। মাহিশা যে রাতে খুন হয়েছে তখন আমি খুলনা ছিলাম, আর আমার ওই ছবির বিষয় নিয়ে আমিও কৌতূহলে আছি।

– আপনি বললেই তো বিশ্বাস করবো না আপনি সেদিন কোথায় ছিলেন বা কি করেছেন।

– আপনারা আমার মোবাইল নাম্বার চেক করুন। বিগত মাস খানিকের মধ্যে আমার মোবাইল ট্রাক্ট করুন।

– কি কি করবো সেটা তো আপনার কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে না। গোয়েন্দা হয়েছেন বলে সবসময় জ্ঞান দিবেন নাকি?

সাজু খেয়াল করলো ওসি সাহেব তাকে একবার আপনি আরেকবার তুমি করে সম্বোধন করছে। এরমানে লোকটা একটু নার্ভাস হয়ে গেছে, কিন্তু সাজু বরাবরের মতোই শান্ত হয়ে বসে আছে।

এমন সময় ওসি সাহেবের ফোনে কল এলো। তিনি বিরক্তি নিয়ে কলটা রিসিভ করলেন। অপর প্রান্ত থেকে কিছু একটা শুনে নড়েচড়ে বসেছেন।
কল করেছে একটু আগে রাব্বির সঙ্গে যে লোকটা কথা বলছিল সেই লোক।

– জ্বি স্যার।

– সাজু সাহেব কি আপনার সামনে?

– হ্যাঁ স্যার।

– তাকে গ্রেফতার করবেন না, উনি এই মামলায় ঘটনাচক্রে জড়িয়ে যাচ্ছেন। আমি তার হয়ে কথা দিচ্ছি আপনি আসল খুনিকে ঠিকই পাবেন। আর সেজন্য আপনার দরকার কিছু শক্ত প্রমাণ, আর সেটা আপনাকে এই সাজু সাহেব বের করে দেবে।

– কিন্তু স্যার।

– সে পালাবে না ওসি সাহেব। আপনি একটু সময় দেন সে সবটা বের করতে পারবে, তাকে জেলের মধ্যে আটকে রাখলে সেটা সম্ভব না।

– ঠিক আছে স্যার।

– এখন সাজু সাহেবের হাতে মোবাইলটা দিয়ে আপনারা রুম থেকে বের হয়ে যান। আমি একটু তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

সাজুর হাতে মোবাইল দিয়ে সবাই রুম থেকে বের গেল। সাজু প্রথমে সালাম দিল,

– আসসালামু আলাইকুম।

– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, ভালো আছেন সাজু সাহেব?

– জ্বি। আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।

– আমি আমার পরিচয় ওসি সাহেবের কাছে প্রকাশ করেছি। আপনার সঙ্গে প্রকাশ না করলে চলবে, তবে আমি সরকারি দলের কেউ।

– এতবড় কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।

– আপনার উপর এই হামলা কে করেছে এবং কে আপনাকে খুন করতে চায় আমি জানি। একটা রাজনৈতিক চক্র মোংলার ওই মেয়েকে খুন করে এবং সেখানে নিরাপত্তার আশায় আরেকটা লোকের কথায় আপনাকেও খুন করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।

– আমি বুঝতে পারছি।

– কে আপনাকে খুন করাতে চায় সেটা আপনি নিজেই বের করতে পারবেন আশা করি। তারপর ওই মেয়ের খুনের অপরাধীকেও আপনি বের করবেন আশা রাখি।

– আমি আমার শত্রুকে বুঝতে পারছি।

– কে বলেন তো?

– মোংলা থানার দারোগা সাহেব। ওই দারোগা সাহেবের নির্দেশে আমার উপর হামলা হচ্ছে। তিনিই আমাকে খুন করাতে চায় সেটা আমি কিছুক্ষণ আগে নিশ্চিত হয়েছি।
#এক_কাপ_ঠান্ডা_কফি
#পর্ব:- ১২

গতকাল রাতে মংলা থেকে ফেরার পথে সাজুর উপর যখন হামলা হয়েছে তখন থেকেই সাজু বেশ চিন্তা করতে লাগলো। আব্দুল কাদেরের কথা অনুযায়ী মংলায় তখন তাদের দলীয় আর কেউ ছিল না। কিন্তু সাজু সেই সময় মংলা ত্যাগ করে আসার পরে বেশ কয়েকবার পিছনে একটা বাইক দেখতে পেয়েছে। সাজু মনে মনে ভাবলো যে তার বাগেরহাট যাবার কথা দারোগা ছাড়া আর কেউ জানে না। তখন ছোট্ট একটা সন্দেহ মনের মধ্যে উঁকি মারে।

দ্বিতীয় সন্দেহ আসে সাজুর এই খুলনা থেকে ঢাকা যাবার কথা দারোগা সাহেবের কাছে সে কল দিয়ে বলেছে। এমনকি কোন গাড়িতে করে যাচ্ছে সেটাও জিজ্ঞেস করেছিল ভদ্রলোক। মিথ্যা বলা সাজুর স্বভাব নয়, আর যদি না বলে তবে দারোগা হয়তো বুঝতে পারবে সাজু সন্দেহ করে। তাই সাজু বলে দেয় তার বাসের নাম, আর ঠিক সেই তথ্য ধরেই দারোগা হয়তো খুনির সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছে।

তৃতীয় সন্দেহ আসে সন্দেহের মাধ্যমে। রামিশার বাগেরহাট যাবার কথা গতকাল রাতে সাজুর ফোনে মেসেজ এসেছিল তখনই সাজু দারোগার কাছে বলেছিল। সে বলেছিল, ” চট্টগ্রাম থেকে আমার এক বন্ধু আসবে তাকে নিরাপদে রাখার জন্য মংলাতে ভালো কোনো হোটেল আছে? ”

দারোগা সেটা কারো কাছে বলেছে কিনা সেটা সাজু জানে না। রাব্বির কাছে তার চুক্তিকারী মেসেজ দিয়ে জানিয়েছে সেটা সাজুর জানার কথা নয়। কিন্তু সাজু যখন আন্দাজ করতে পারে যে রামিশার উপর বিপদ হতে পারে। তারপর রামু আর কল রিসিভ করে নাই। তখন থেকেই সাজুর সন্দেহ আরো বাড়তে থাকে।

এরপরই সাজু ভাই ওই দারোগা সাহেবের আত্মীয় স্বজনের খোঁজ নেবার জন্য একজনের সঙ্গে কথা বলে। সেই লোক মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে যতটুকু তথ্য বের করতে পেরেছে তারমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল।

সাজু ভাই অসুস্থ হয়ে লন্ডনে যাবার আগে নয়নের মায়ের সেই নয় বছর আগের খুন হবার রহস্য বের করেছিল। সেই মামলায় আসামি ছিল মিনহাজ নামে নয়নের মামাতো ভাই। আর এই দারোগা হচ্ছে সেই মিনহাজের মামা, সম্ভবত নিজের ভাগ্নে দোষী হবার জন্য সাজুকে দায়ী করেছে।

[ নয়নের মায়ের মৃত্যুর রহস্যের গল্প সাজু ভাই সিরিজের গল্প “সরি আব্বাজান-২” এর মধ্যে জানানো হয়েছে। যারা ওই রহস্যটা জানেন না তারা পড়ে নিতে পারেন। ]

|
|

ওসি সাহেবের নাম্বারে কল করা সেই ক্ষমতাসীন লোকটা সাজুর কথা শুনে খানিকটা চুপ থেকে আবার বললেন,

– আপনার সন্দেহ পুরোপুরি সত্যি। যারা ওই মেয়ে খুন করেছে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দারোগা আপনাকে শেষ করতে চাইছে।

– সাজু বললো, কিন্তু আপনি এতকিছু জানলেন কীভাবে? আর এসবের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি সেটা বুঝতে পারছি না।

– আলাউদ্দীন নামের এক সন্ত্রাসী দিয়ে আপনার উপর আক্রমণ করা হয়েছে। আপনি আজকের রাতটা একটু সাবধানে থাকবেন, তাছাড়া আহত শরীর নিয়ে রাতে বের হবার দরকার নেই।

– কিন্তু আমাকে বের হতে হবে।

– কেন?

– চট্টগ্রাম থেকে আমার এক বন্ধু আসার কথা ঢাকায়, সে কুমিল্লা আসার পরে তার উপর হয়তো কোনো আক্রমণ হয়েছে। আমি সেই থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি কিন্তু আমি ব্যর্থ।

রামিশা যে রাব্বির কাছে রয়েছে সে কথা লোকটা জানে না। যদি জানতো তাহলে হয়তো কিছু একটা বলতে পারতো৷
সাজু অনেক কথাই এই অপরিচিত লোকটার সঙ্গে বলতে চাচ্ছে না। কিন্তু যতটুকু বলছে সেটা ওই ওসি সাহেব তাকে স্যার বলেছিল সেজন্যই বলা।

– সাজু সাহেব?

– বলেন।

– আমি আগামীকাল দিনের মধ্যে আপনার জন্য একটা লাইসেন্স করা পিস্তলের ব্যবস্থা করে দেবো। আর যেকোন একটা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আপনাকে যোগ দিতে হবে। কারণ আপনি এখন যে মামলার মধ্যে আছেন সেটা খুব বিপদের একটা কাজ।

– একদিনের মধ্যে কি সেটা সম্ভব?

– সেই দায়িত্ব আমার, আমি আগামীকাল সকালে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবো। আপনি আজ রাতটা সাবধানে থাকবেন।

– একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।

– বলেন সাজু সাহেব।

– আপনি বলেছিলেন আলাউদ্দীন নামের একজন আমার উপর হামলা করেছে। কিন্তু ঘটনা সেরকম নয়, আমার ধারণা আমাকে গুলি করেছে রাব্বি নামে এক সন্ত্রাসী।

মোবাইলের অপর প্রান্তে নীরবতা। সে হয়তো ধারণা করেনি সাজু সরাসরি রাব্বিকে সন্দেহ করবে। কিন্তু আব্দুল কাদের যে সবটা স্বীকার করেছে তাতে সন্দেহ করাই স্বাভাবিক। সেজন্য সেও চায় আব্দুল কাদের মারা যাক, কিন্তু লোকটা যখন জানতে পেরেছে আব্দুল কাদেরকে মারার কথা নিয়ে রাব্বির সঙ্গে মতবিরোধ আছে। তাই নিজে থেকে রাব্বিকে কিছু বলে নাই।

– রাব্বি বা যে কেউ হোক সেটা আপনি ঠিকই বের করবেন। আপনাকে সবদিক থেকে সহোযোগিতা করবো আমি, আপনি চিন্তা করবেন না।

– এতে আপনার লাভ?

– লাভের হিসাব সবসময় চলে না সাজু সাহেব। আমি আগামীকাল আপনাকে কল দেবো তবে সেটা আপনার ব্যক্তিগত নাম্বারে।

কলটা কেটে গেল। সাজু কাউকে না ডেকে চুপ করে বেডে বসে আছে। দারোগা সাহেবের বিষয়টা তাকে বেশ ভাবাচ্ছে, তার সামান্য সন্দেহ ছিল। মিনহাজের মামা তাই নিজের ভাগ্নের জন্য হয়তো প্রতিশোধ নিতে পারে।
কিন্তু এই আগন্তুক লোকটা কে হতে পারে সেটা তার মনের মধ্যে জট পাকিয়ে দিচ্ছে।

ওসি সাহেবের সঙ্গেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল সাজু ভাই। পুতুল তার মামার সঙ্গে বাসায় চলে গেছে, কালকে তার পরীক্ষা আছে। সাজুর মোবাইল সাজুর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো,

– আমার সঙ্গে গেলেই পারতেন। শুধু শুধু নিজের বিপদ কেন ডেকে আনছেন?

– আমি জানি না রামিশা এখন কেমন আছে, তাই তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

– একটা কথা বলি?

– হ্যাঁ।

– রামিশা কল দিয়েছিল, তখন আপনার কাছে ডাক্তার ছিল। আমি রামিশা আপুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম।

– কি বলেছে? আর আপনি এতক্ষণ সেটা বলেন নাই কেন?
সাজু বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে গেল।

– সরি সাজু ভাই। আমি ভুলে গেছিলাম, আর এরপরই পুলিশ এসে গেছে।

– ঠিক আছে আমি দেখছি, তোমার সঙ্গে পরে দেখা হবে।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিল সাজু ভাই। ওসি সাহেব বলেছিল তাদের সঙ্গে কুড়িল বা বাড্ডা পর্যন্ত যাবার জন্য। সাজু তাদের সঙ্গে না গিয়ে আলাদা হয়ে গেল এবং আগামীকাল সকাল বেলা তাদের থানায় যাবে সেই আশ্বাস দিল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং মাহিশার লাশ যেখানে পাওয়া গেছে সেটা ভালো করে দেখা দরকার।

সাজু ভাই রামিশার নাম্বারে পরপর তিনবার কল দিল কিন্তু রিসিভ করেনি সে। চতুর্থ কল দিতে গিয়ে নাম্বার ওয়েটিং পেল।
” কারো সঙ্গে কথা বলছে নিশ্চয়ই। ” মনে মনে বললো সাজু ভাই।

সাজুর মোবাইল থেকে রামিশার নাম্বার নিয়ে রেখেছিল পুতুল। খুব কৌশলে মোবাইলের ফিঙ্গার লক সাজুর আঙ্গুলের ছাপ দিয়েই খুলে ফেলে। সাজু তখন অচেতন ছিল। তারপর রামিশার নাম্বার নিজের মোবাইলে সেভ করে রাখো।
সাজুর কাছ থেকে বেরিয়ে রামিশার নাম্বারে কল দেয় পুতুল।
পরপর তিনবার কল দেবার জন্য রামিশা ধারণা করেছিল এটাও সাজু ভাই দিয়েছে। কিন্তু নতুন অপরিচিত নাম্বার দেখে একটু ভাবতে লাগলো। সাজু ভাই কি অন্য নাম্বার দিয়ে কল দিচ্ছে?
এমনটা চিন্তা করে সে কলটা রিসিভ করে চুপ করে থাকে। তারপর মেয়ে কণ্ঠ শুনতে পেয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,

– কে আপনি?

– আমার নাম পুতুল, সাজু ভাইয়ের মোবাইল দিয়ে আপনার সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম।

– ওহ্।
সামান্য ভাবলো রামিশা। সাজু ভাই তাহলে এখনো মেয়েটার সঙ্গে আছে নিশ্চয়ই। কল রিসিভ হচ্ছে না তাই একে দিয়ে ওকালতি করাচ্ছে।

– আপু..?

– বলেন।

– আমি তখন মিথ্যা বলেছিলাম। আসলে সাজু ভাইয়ের সঙ্গে আমার মাত্রই গতকাল পরিচয় হয়েছে। যদিও অনেক আগেই তাকে চিনতাম কিন্তু দেখা হয়েছে গতকাল।

– আশ্চর্য। গতকাল দেখা হয়েছে আর তাতেই আপনি নিজেকে তার স্ত্রী বলে পরিচয় দিচ্ছেন।
অবশ্য সত্যি সত্যি যদি গতকালই বিয়ে হয়ে থাকে সেটা ভিন্ন কথা। তো আমাকে কল দিয়েছেন কেন?

– সরি বলতে।

– কেন?

– সাজু ভাই অসুস্থ শরীর নিয়ে এখন আপনাকে খুঁজতে বের হয়েছে। আমি জানি সে খুঁজে বের করতে পারবে।

– অসুস্থ মানে? কি হয়েছে তার?

– পাটুরিয়া ফেরির মধ্যে তাকে কারা যেন গুলি করেছিল। কাঁধে লেগেছে গুলি।

– বলেন কি?
রামিশার কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ।

– তারপর আমিই তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি ঢাকায় আর তখন থেকে মোবাইল আমার কাছে ছিল। আপনার সঙ্গে এভাবে কথা বলার জন্য আমি লজ্জিত।

– সাজু ভাই এখন কোথায়?

– উত্তরা থেকে সে একা বের হয়ে গেছে। তার উপর আবারও কেউ আক্রমণ করতে পারে কিন্তু সে আপনাকে খুঁজতে চলে গেছে।

– ঠিক আছে আপনি কলটা কাটেন আমি এখনই সাজু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছি।

– একটা কথা ছিল।

– তাড়াতাড়ি বলেন।

– আমি যে তখন আপনাকে ওসব বলেছিলাম সেটা তাকে বলবেন না। সাজু ভাই তাহলে হয়তো আমার সঙ্গে আর কথা বলবে না।

– ঠিক আছে বলবো না। আপনি ওকে আহত অবস্থায় ঢাকায় নিয়ে এসেছেন সেজন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। মেলা মেলা ধন্যবাদ।

কল কেটে দিয়েছে রামিশা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাস্তায় দিকে তাকিয়ে রইল পুতুল। রামিশা তাকে বলে গেল মেলা মেলা ধন্যবাদ, এটা নিশ্চয়ই সাজু ভাইয়ের বলা কথা। কারণ একমাত্র সাজু ভাই শুধু ধন্যবাদ না দিয়ে মেলা মেলা ধন্যবাদ বলে।

সাজুর মোবাইল বেজে উঠলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে রামিশার নাম্বার দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলো সাজু ভাই। রামিশা বললো,

” সাজু ভাই আপনি কোথায়? ”

★★★

একটু আগে মিরপুর ১০ নাম্বারে রামিশাকে বাইকে করে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে রাব্বি। তাকে এখন দ্রুত কিছু কাজ করতে হবে, গাবতলি থেকে ভালো একটা পিস্তল নেবে। তারপর সাভারে গিয়ে আলাউদ্দীনের সাঙ্গপাঙ্গ ধরে তাদের থেকে বের করতে হবে আলাউদ্দীনের অবস্থান।
কিন্তু রাব্বি জানে না যে সাজু ভাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আছে আলাউদ্দীন নামের সেই সন্ত্রাসী। সাজুকে সমান তালে এখনো অনুসরণ করে যাচ্ছে ওই খুনি আলাউদ্দীন।

রাত আটটা।
মাহিশার লাশ কিছুক্ষণ আগে নিয়ে আসা হয়েছে বাড়িতে। একটু পরেই দাফন করা হবে। যেহেতু মৃত্যুর কয়েকদিন পার হয়ে গেছে তাই লাশ আর বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। আগেই কবর খুড়ে রাখা হয়েছে, মসজিদের ইমাম সাহেব এলেই জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।

মংলা থানার দারোগা সাহেবও উপস্থিত হয়েছেন। মাহিশার বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেছেন। সাজুর নামে মামলার কথা শুনে ভদ্রলোক একটু চমকে যাবার অভিনয় করলেন। একটু পরে তার মোবাইলে একটা কল এলেই তিনি মোবাইল নিয়ে খানিকটা দুরে চলে যায়।

– দারোগা বললো, হ্যা বলেন।

– আমাদের দ্বিতীয় ভাড়াটে খুনি এখন সাজুর প্রায় কাছাকাছি বসে আছে। তারা নাকি এখন একটা রেস্টুরেন্টে আছে।

– সেখানে গুলি করা কি ঠিক হবে?

– ঠিক বেঠিক আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। সাজুর সঙ্গে একটা মেয়ে আছে, সেই মেয়েটা সহ যদি খুন করা হয় তাহলে কি সমস্যা হবে?

– কোন মেয়ে? বিকেলে যে মেয়েটা ছিল?

– না এটা অন্য কেউ। একটু আগেই নাকি তাদের দেখা হয়েছে, আর তারপর তারা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসেছে।

– ঝামেলা না হলে কাজটা করে ফেলুক।

– সাজু আপনার পরিকল্পনা জেনে গেছে।

– মানে?

– সাজু বুঝতে পেরেছে তাকে আপনি খুন করতে চান, আপনি নাকি আপনার ভাগ্নের জন্য এমন করছেন।

– দারোগা বললো, ওহ্ শিট, এক্ষুনি ওদেরকে মেরে ফেলতে বলুন। সাজু যদি বেঁচে থাকে তাহলে আমি শেষ হয়ে যাবো। আর আমি শেষ মানে আপনিও শেষ, বুঝতে পারছেন। সামনে কিন্তু আপনার নির্বাচন, আর এবার কিন্তু আপনাকে জিততেই হবে। আর এই সাজুকে বাঁচিয়ে রাখলো আপনি আমি দুজনেই খুব বিপদে পড়বো।

– ঠিক আছে, বিকেলে বেঁচে গেলেও এবার আর বাঁচতে পারবে না। খুব কাছ থেকে গুলি করার কথা বলে দিচ্ছি। রেস্টুরেন্টের পাশেই কাপড়ের কাপড়ের মার্কেট, আমার লোক খুন করে ওখান অনায়সে পালিয়ে যাবে।

[ মতামত জানাতে ভুলবেন না। আজকে গল্পটা লেখার মানসিকতা ছিল না, কিন্তু গতকাল সবার বেশ ভালো মন্তব্য পেয়েছি। তাই ভাবলাম কেন আর শুধু শুধু হতাশ করবো আপনাদের? তাই আশা করি আজও নিজেদের মতামত প্রকাশ করবেন। ]

চলবে…

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম।
[ মন্তব্য করার জন্য কি প্রতিদিন অনুরোধ করতে হবে? 😌 ]

চলবে…

লেখাঃ- মোঃ সাইফুল ইসলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here