#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_২২
#নিশাত_জাহান_নিশি
মেসেজটি পড়া শেষে অয়ন্তী বিপুল উৎসাহ নিয়ে ভিডিও ক্লিপটিতে ক্লিক করতেই আচমকা সশব্দে চিৎকার করে উঠল! মূলত ভিডিওটিতে রাফায়াত কাউকে জা’নো’য়ারদের মত একের পর এক ছু’রি’কা’ঘাত করছিল!
রাফায়াতের সমস্ত মুখমণ্ডল যদিও কালো মুখোশ দ্বারা আবৃত ছিল তবুও যেন মুখোশের আড়ালে থাকা রাফায়াতকে চিনতে বেশী সময় ব্যয় করতে হলোনা অয়ন্তীর! তাছাড়া একটু আগের আসা মেসেজটি পড়লেই পরিষ্কার বুঝা যায় ছেলেটি রাফায়াত-ই ছিল! সন্দেহ যখন বিশ্বাসে পরিণত হলো তখনি অয়ন্তীর হাত থেকে ফোনটি ছিটকে পড়ল। তবে ভিডিওটি এখনও চলমান। বেঁচে থাকার মিনুতিতে ছেলেটির বুক ফাঁটা আর্তনাদ যেন বিপুল আতঙ্ক নিয়ে অয়ন্তীর কর্ণকুহরে সশব্দে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে! ঘটনাচক্রে উপস্থিত না থেকেও ছেলেটির জন্য অয়ন্তীর মনে অস্বাভাবিক দয়ামায়াবোধ কাজ করতে লাগল। অথচ ঘটনাচক্রের মূল কা’ল’প্রি’ট হয়েও পি’শা’চ রাফায়াতের মন গলছিল না তখন একরত্তিও! সে তার হ’ত্যা’কাণ্ড চালিয়েই যাচ্ছিল।
সমগ্র শরীর অয়ন্তীর কালবৈশাখী ঝড়ের ন্যায় তালগোল পাকিয়ে কাঁপছিল। চক্ষুজোড়া নে’শাখো’রদের মত রক্তিম বর্ণ ধারণ করছিল! চোখের পাতা থেকে টলটলিয়ে পানি ঝড়ছিল। হৃৎস্পন্দন দ্রুত গতিতে টিউটিউ করছিল। হাঁপানি রোগীদের ন্যায় তার শ্বাস-প্রশ্বাস তড়িৎ বেগে ওঠা-নামা করছিল! মুখ থেকে প্রখর গোঙানির শব্দ নিঃসৃত হচ্ছিল। অয়ন্তীর এই ভয়াবহ ছটফটানির শব্দ পাওয়া মাত্রই যেন রাফায়াতের ম’রা ঘুম ভাঙল! অর্ধখোলা চোখে সে বিরক্তিভরা চাহনিতে অগ্রে চতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অমনি তার ঘোলাটে নেত্রকোটরে অয়ন্তীর বিভৎস মুখখানি স্পষ্ট হলো। সঙ্গে সঙ্গেই বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল রাফায়াতের। এই বিক্ষিপ্ত অবস্থায় অয়ন্তীকে দেখতে পাবে সে তা ঘুম ভাঙার আগে অবধিও ভাবতে পারেনি।
ধরফড়িয়ে শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠল রাফায়াত! এরমধ্যেই ভিডিওটিতে চলতে থাকা ছেলেটির বিকট চিৎকারের আওয়াজ রাফায়াতের কর্ণকুহরে বেজে উঠল। হকচকিয়ে ওঠে রাফায়াত অয়ন্তীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অস্থির দৃষ্টিতে মেঝে পড়ে থাকা ফোনটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। ক্ষণিকের মধ্যেই তার চক্ষু জোড়া চড়কগাছে পরিণত হলো! হুড়োহুড়ি করে সে ফোনটি হাতে তুলে নিলো। ভিডিওটিতে বার কয়েক বিশৃঙ্খল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চোখ তুলে সে এবার ভয়ে কাতরাতে থাকা অয়ন্তীর দিকে তাকালো। মুহূর্তের মধ্যেই সে ভিডিওটি বন্ধ করে দিলো। শুকনো ঢোঁক গিলে অয়ন্তীর দিকে তাকালো।
অয়ন্তীর বর্তমান অবস্থা বেগতিক খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। চোখ উল্টে সে পড়ে যাবে যাবে এমন উপক্রম হচ্ছিল। অমনি ঘোর উদ্বিগ্ন হয়ে রাফায়াত অয়ন্তীকে তার বাহুডোরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে বলল,,
“কী হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন তুমি? ভয় পেয়েছ?”
কথা বলতে যদিও বেশ কষ্ট হচ্ছিল অয়ন্তীর তবুও সে কাঁপা কাঁপা গলায় রাফায়াতকে ধিক্কার জানিয়ে বলল,,
“আপনি খু’নি! আপনার ছোঁয়ায় পাপ আছে!”
সঙ্গে সঙ্গেই অয়ন্তীকে ছেড়ে দিলো রাফায়াত! ব্যথা লেগেছে তার বুকে। ভেতরটায় নিদারুন জ্বলন হচ্ছে। খু”‘নি শব্দটি শুনতে শুনতে যদিও সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তবে অয়ন্তীর মুখে এই খু’নি শব্দটি শুনে তার নিজের প্রতি কেমন যেন ধিক্কার জন্মাতে লাগল! নিজেকে এবার সত্যিই তার পাপী মনে হতে লাগল। তার ছোঁয়ায় পাপ আছে তা যেন এখন বিশ্বাসে পরিণত হলো। এই পাপী শরীর নিয়ে সে নিষ্পাপ অয়ন্তীকে ছুঁতে চায়না আর! অয়ন্তীর শরীরে তার পাপের দাগ লাগাতে চায়না। অয়ন্তী তো হলো প্রখর শুভ্রতায় মোড়ানো পবিত্র এক দেহ। যার মধ্যে সরষে পরিমাণও অপবিত্রতার ছিঁটেফোঁটা নেই!
শরীরের ব্যালেন্স সামলে রেখে অয়ন্তী মেঝে থেকে ওঠে বিছানার উপর বসল। মাথা নিচু করে গলায় হাত সে কোঁকাতে লাগল। শুকনো গলায় বলল,,
“পাপাপানি।”
রাফায়াত ধড়ফড়িয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চিন্তিত হয়ে টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা এনে অয়ন্তীর ফুঁপাতে থাকা চিবুকের সামনে ধরল। অয়ন্তীর চোখে চোখ মিলাতেও তার কুণ্ঠাবোধ হচ্ছিল। অয়ন্তীর কাছাকাছি থাকতেও কেমন যেন অস্থিরতা কাজ করছিল। ঠোঁট নেড়ে কথা বলতেও ঘৃণাবোধ কাজ করছিল! মোট কথা, তার এখন ইচ্ছা করছিল নিজেকে নিজে শেষ করে দিতে! এই পাপী জীবন নিয়ে তার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। যেখানে সত্য-মিথ্যার বাছবিচার না করে-ই তার ভালোবাসার মানুষটাই তাকে ধিক্কার জানাচ্ছে সেখানে এই অপ্রিয় জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে আর কোনো লাভ আছে বলে মনে হচ্ছেনা তার!
রাফায়াতের দিকে না তাকিয়েই অয়ন্তী পানির গ্লাসটা হাতে তুলে নিলো। ঢকঢক করে গ্লাস ভর্তি পানি সে শেষ করে নিলো। মুহূর্তেই বিছানার উপর গ্লাসটি রেখে সে অঝোরে কেঁদে দিলো। মাথা নুইয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,,
“আমাকে মুক্তি দিন প্লিজ। আপনার এই পাপী জগৎে আমি আর থাকতে চাইনা। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। প্রতিটা মুহূর্তে মনে হয় ম’রে যাচ্ছিনা কেন আমি? এই দুর্দিন গুলো দেখার জন্যই কী আমি বেঁচে আছি? এই ভয়ঙ্কর জীবনটা তো আমি আশা করিনি। কত সুন্দর, গোছানো, পরিপাটি ছিল আমার জীবনটা। আপনি হঠাৎ এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিলেন। কী সুখ পাচ্ছেন আপনি এতে হ্যাঁ? রুহের হায় ছাড়া তো আর কিছু-ই না।”
নাক টেনে চোখের জল নিবারণ করল রাফায়াত! ভেতরটা যদিও তার দ্বগ্ধ হতে হতে কয়লায় পরিণত হচ্ছিল তবুও সে কণ্ঠে তুমুল স্পৃহা নিয়ে বলল,,
“খুব শীঘ্রই তুমি মুক্তি পাবে অয়ন্তী। আমার পাপী জীবনে তোমাকে আর থাকতে হবেনা। আবারও তোমার লাইফটা আগের মত হয়ে উঠবে খুবই সুন্দর, গোছানো আর পরিপাটি।”
বুকে দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে রাফায়াত পিছু ঘুরে দাঁড়াতেই হঠাৎ তার ফোনটিতে পুনরায় কল এলো। চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে রাফায়াত মেঝে থেকে ফোনটি কানে তুলে নিলো। গলায় উচ্ছৃঙ্খলতা এনে উত্তেজিত হয়ে বলল,,
“এসব কী চঞ্চল? ভিডিওটা কে পাঠিয়েছে?”
চঞ্চল উগ্র মেজাজে সামনের পেছনের চুলগুলো টেনে ধরল। তটস্থ গলায় বললল,,
“শা’লা। তুই আগে ফ্লাট থেকে বের হ। পারলে অয়ন্তীকে নিয়ে পালা! অনিক আমাকে ব্ল্যা’ক’মে’ই’ল করছে! আই ডোন্ট নো ভিডিওটা কে করেছে আর অনিকের কাছেই বা ভিডিওটা গেল কীভাবে। আমার মনে হচ্ছে অনিক আমাদের ট্রেস করছে। তাই আমি নাম্বার চেঞ্জ করে তোকে অন্য নাম্বার থেকে কল করেছি। আমার এই সিমটার ব্যাপারে কিন্তু অনিক কিছু জানেনা। তাই সে আমাকে এখন ট্রেস করতে পারবেনা। তবে তোর জন্য হয়ত খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে রাফায়াত! অয়ন্তীর খোঁজ না পেলে অনিক ভিডিওটা নেতার হোয়াট’স অ্যাপে সেন্ড করবে বলে আমাকে হুমকি দিয়েছে! নেতার ছেলেকে তুই নির্মমভাবে আ’হ’ত করেছিস রাফায়াত বুঝতে পারছিস তো কী হতে পারে?”
“রাফায়াত এসব সস্তা ব্ল্যা’ক’মে’ইলের পরোয়া করেনা চঞ্চল! অনিক আমার একটা পশমও ছিঁড়তে পারবেনা! গুটির চাল কীভাবে ঘুরাতে হয় আমিও জানি। কাঁটা দিয়ে কাঁটা কীভাবে তুলতে হয় তা আমারও জানা। এবার দেখবি রাফায়াতের খেলা। এই ভিডিওটিই যখন অনিকের কাছে থাকবেনা তখন অনিক আমাকে ব্ল্যা’ক’মে’ইল করবে কীভাবে হ্যাঁ?”
“ওহ্ রিয়েলি? তো তুই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় থাকা অনিকের ফোন ঘেঁটে ভিডিওটা ডিলিট করবি বুঝি?”
ক্রুর হাসল রাফায়াত! নাক ঘঁষে বেশ ভাব নিয়ে বলল,,
“প্রিয়া আছে না? এবার আমি তাকে ব্যবহার করব। এতদিন আমি ব্যবহার হয়ে এসেছি। এবার আমার পালা!”
ফট করেই কলটি কেটে দিলো রাফায়াত। রাগে গজগজ করে ফোনটি প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। টেবিলের উপরে থাকা বড়ো তালাটি নিয়ে সে ভেতর থেকে দরজায় তালা মেরে দিলো!অয়ন্তী যেন এখন কোনোভাবেই এই ফ্লাট থেকে পালাতে না পারে তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। এদিক-ওদিক না তাকিয়ে রাফায়াত সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে অয়ন্তী রাফায়াতের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। যদিও সে চেষ্টা করেছিল ফোনের ফুসুর ফুসুর শুনার জন্য! তবে ঘৃণা থেকে তার ইচ্ছে হচ্ছিলনা রাফায়াতের দিকে মনোনিবেশ করার! এমন ঘৃণিত একটা লোকের সাথে থাকাও অয়ন্তীর জন্মের পাপ বলে মনে হচ্ছে! এই পাপবোধ সে কীভাবে মোচন করবে সেই চিন্তায় উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। এমনিতেও রাফায়াতের চালাকি দেখে অয়ন্তী হয়রান না হয়ে পারছেনা। কী সুন্দর ভেতর থেকে দরজায় তালা মেরে দিলো! ব’দ লোকটা কীভাবে বুঝে গেল? যে সে এখন ফ্লাট থেকে পালানোর চিন্তা করেছিল?
চোখে-মুখে পানি ছিঁটাতেই হঠাৎ রাফায়াতের কপালের কাঁটা অংশটিতে জ্বালা করে উঠল! মরিচ লেগেছে এমন মনে হলো! আয়নায় তাকিয়ে দেখল আঘাতটা বেশ ঘোরতোরভাবেই লেগেছে। ক্ষতটাও বেশ গাঢ়। সেদিকে তেমন পাত্তা দিলোনা রাফায়াত। শুকনো র’ক্তগুলো কপাল থেকে মুছে মুখটা ভালো করে ধুঁয়ে নিলো। অতঃপর দীর্ঘ একটা শাওয়ার নিয়ে পুরোনো প্যান্টটা পড়েই ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। অয়ন্তী এতক্ষণে চেষ্টা করছিল তালাটা ভাঙার! সামান্য পাথর দিয়ে কী সম্ভব এত ভারী তালাটা ভাঙার? হাত দ্বারা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে রাফায়াত ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখল অয়ন্তীর এমন অবুঝের মত কারসাজি! ফিক করে হেসে দিতে বাধ্য হলো রাফায়াত। হাসির শব্দ পেয়ে অয়ন্তী পিছু ঘুরে দাঁড়াতেই থতমত খেয়ে গেল! ব্যালকনি থেকে আনা পাথরের টুকরোটিকে সে হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। রাফায়াতের দিকে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নাক-মুখ খিঁচে প্রচণ্ড রাগ দেখাতে লাগল। চুল ঝাড়তে ঝাড়তে রাফায়াত অয়ন্তীর দিকে অগ্রসর হলো। হেয়ালি গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“মুক্তি পেতে চাও আমার হাত থেকে তাইতো?”
একরোঁখা গলায় অয়ন্তী বলল,,
“হ্যাঁ চাই। আপনার মত খু’নির সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
“ভাবিয়া করিও কাজ। করিয়া ভাবিও না। এই প্রবাদ বাক্যটিতে বিশ্বাস করো তো?”
“হ্যাঁ, করি। তো???”
“পরে যদি কখনো মনে হয় আমাকে ছেড়ে তুমি ভুল করেছ তবে কিন্তু তখন হাজার কান্নাকাটি করেও আমাকে ফিরে পাবে না।”
“হাসালেন মিস্টার রাফায়াত! আপনাকে ছেড়ে গেলে আমাকে কান্নাকাটি কেন করতে হবে হ্যাঁ? কে হন আপনি আমার? আমার জীবনে খুবই তুচ্ছ একজন মানুষ আপনি। যার কোনো মূল্য-ই নেই আমার কাছে। বরং আপনার থেকে ছাড়া পেলে আমি এই দোয়া করব যে, আর কখনও যেন আপনার মুখোমুখি না হতে হয় আমাকে! স্বস্তির শ্বাস ফেলে নামাজের মোনাজাতে বলব,,
“হ্যাঁ আল্লাহ্। জীবনের জন্য জাস্ট বেঁচে গেলাম আমি!”
মিচকে হাসল রাফায়াত! ঘাড়টা বাঁ দিকে খানিক কাত করে শরীরের আড়মোড়া ভাঙল। স্পষ্ট স্বরে বলল,,
“ওকে! তবে তাই কথা রইল। তুমি খুব শীঘ্রই মুক্তি পেতে যাচ্ছ আমার হাত থেকে!”
বুকে যদিও ঝড় বইছিল রাফায়াতের তবে এই মুহূর্তে সেই ঝড় থামিয়ে দিলো রাফায়াত! ভেজা শরীরেই গাঁয়ে তার শার্টটি জড়িয়ে নিলো। পায়ে জুতো পড়ে দরোজার তালাটা খুলল৷ পিছু ঘুরে ভাবশূন্য গলায় অয়ন্তীকে বলল,,
“আমি নাশতা নিয়ে আসছি।”
উত্তরের অপেক্ষা না করেই রাফায়াত দরোজার বাইরে চলে গেল। বাইরে থেকে আবারও দরোজায় তালা মেরে দিলো! বদ্ধ রুমের ভেতরে অয়ন্তী হাঁসফাঁস করতে লাগল। চোখের জল ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। নিজের ভাগ্যের প্রতি নিজেরই ঘৃণা ধরছে তার। ঘণ্টা খানিকের মধ্যে রাফায়াত আবারও ফ্লাটে ব্যাক করল। হাতভর্তি রকমারী নাশতা তার। মনে হচ্ছে যেন দুই-তিনদিনের নাশতা সে একদিনে নিয়ে এসেছে! রুমে রাফায়াতের অস্তিত্ব পেয়ে অয়ন্তী হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসল। রাফায়াত এতক্ষণে নাশতাগুলো বিছানার উপর সাজিয়ে রাখল। কান্নারত অয়ন্তীর দিকে আড়চোখে তাকালো সে। কোমল কণ্ঠে বলল,,
“খেয়ে নাও। আর এখানে দুটো কাপ নুডলস আছে দুপুরে খেয়ে নিও। আমার ফিরতে ফিরতে রাত হবে হয়ত। রাতের খাবার আমি রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়ে আসব। আর কিছু মনে না করলে তোমার বডির মাপটা দেওয়া যাবে?”
চোখের জল মুছে নাক টানল অয়ন্তী। নির্ভেজাল চাহনিতে রাফায়াতের দিকে তাকালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কেন? বডির মাপ কেন?”
“এক জামা পড়ে আর কতদিন থাকবে?”
“কেন? একটু আগে না বললেন খুব শীঘ্রই আমাকে মুক্তি দিবেন।”
“ঠিক আছে। বাট স্পেসেফিক সময়টা তো বলিনি। সেই সময়টা বেড়ে মাসখানিকও লাগতে পারে! আ’ম নট শিওর।”
ঝড়ের বেগে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো অয়ন্তী। রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছিল। মাথার মগজ যেন গরম ফেনের ন্যায় উতলে পড়ছিল! বিক্ষুদ্ধ হয়ে অয়ন্তী দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
“হোয়াট দ্যা ফা*! এত বারোভা’তা’র কেন আপনি? বারো বার বারো রকমের কথা বলেন!”
বেকুব বনে গেল রাফায়াত! অয়ন্তীর মুখ থেকে এহেন উচ্ছৃঙ্খল ভাষা শুনে মুখে হাত চলে গেল তার। চক্ষুজোড়া বিস্ময় নিয়ে সে দুষ্টু গলায় বলল,,
“কী ভাষা রে মা’য়’রি! মেয়েদের মুখের ভাষাও এতটা বিচ্ছিরি হয়?”
“এই খু’নির বাচ্চা শুন? খারাপ মানুষদের সাথে খারাপ ভাষাই আসে। ভালো ভাষা আসেনা।”
“যাক! মিষ্টি মেয়েদের মুখে মাঝে মাঝে খারাপ ভাষা শুনতেও মিষ্টি লাগে। ইশশ! কী ভয়ঙ্কর সুন্দর ভাষা। হোয়াট দ্যা ফা*!”
চটে গেল অয়ন্তী। উড়নচণ্ডী ভাব নিয়ে বাঁকা হাসতে থাকা রাফায়াতকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে রুম থেকে বের করে দিলো। ভেতর থেকে দরোজার খিলটা আটকে দিলো। চোঁয়াল উঁচিয়ে দরজায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রাফায়াতকে শাসিয়ে বলল,,
“তুই আর আসবিনা এই ফ্লাটে। লু’চ্চা, লা’ফা’ঙ্গার, খু’নি ছেলে কোথাকার। তোর প্রতি আমার শুধু ঘৃণা আসে বুঝেছিস? মায়া টায়া আসেনা। তোর সাথে এক রুমে থাকতেও আমার ঘিন ঘিন লাগে। হাজার ধাক্কালেও আর দরোজা খুলব না আমি। এই বদ্ধ ঘরে-ই পঁচে গলে ম’র’ব। পারলে আমার ম’রা’র খবরটা আমার মা-বাবাকে জানিয়ে দিস। তারাও জানুক তাদের লাইফ সিকিউর করতে গিয়ে তাদের মেয়ে একটা খু’নির হাতে মরেছে!”
___________________________________
প্রিয়ার পছন্দের হাওয়াই মিঠাই হাতে নিয়ে প্রিয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে রাফায়াত। ঠোঁটে তার মিথ্যে হাসি! কাউকে বোকা বানানোর হাসি। উল্টোদিকে প্রিয়ার ঠোঁটের কোণে লুটিয়ে পড়ছে যেন প্রশস্ত এক হাসি! সবকিছু ভুলে রাফায়াত তাকে এত জলদি আপন করে নিবে তা দুঃস্বপ্নেও যেন ভাবতে পারেনি প্রিয়া! লোভনীয় হাওয়াই মিঠাইসহ রাফায়াততে দেখামাত্রই প্রিয়ার জিভ লকলক করে উঠল! আর এক মুহূর্ত ব্যয় না করে সে ছোঁ মেরে যেইনা রাফায়াতের মুখের সামনে থেকে হাওয়াই মিঠাইটি কেড়ে নিতে যাবে অমনি রাফায়াত মিঠাইটি তার পেছনে লুকিয়ে নিলো! লোভাতুর প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে সে স্মিত হাসল। নরম স্বরে বলল,,
“উঁহু। আগে আমার কাজটা করো। এরপর তোমার পছন্দের এই হাওয়াই মিঠাইটা পাবে তুমি!”
মন খারাপ হয়ে গেল প্রিয়ার! বিষণ্ণ গলায় বলল,,
“ওকে। তুমি যা বলবে তাই হবে।”
সাইড ব্যাগ থেকে প্রিয়া তার সেলফোনটি বের করল। মুচকি হেসে রাফায়াতের দিকে তাকিয়ে অনিকের নাম্বারে ডায়াল করল! তড়িঘড়ি করে রাফায়াত প্রিয়ার পাশে এসে বসল। ইশারায় প্রিয়াকে বলব সে যা যা শিখিয়ে দিয়েছে প্রিয়াও যেন তাই তাই অনিককে বলে! মাথা নাড়িয়ে প্রিয়া হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। প্রথম রিংটি বেজে উঠতেই অনিক ঐ পাশ থেকে তড়িঘড়ি করে কলটি তুলে নিলো। ঝেড়ে কাশল প্রিয়া। উত্তেজিত গলায় বলল,,
“অনিক শুনছ?”
অতি মনোযোগের সহিত অয়ন্তীর রুমের দলিলপত্র ঘাঁটছিল অনিক! এরমধ্যেই হঠাৎ প্রিয়ার কল এলো। তাই অনিচ্ছাকৃত সত্ত্বেও অনিক কলটি তুলতে বাধ্য হলো। রগচটা ভাব নিয়ে সে প্রতিউত্তরে বলল,,
“কী হইছে তোমার হ্যাঁ? এই অসময়ে হঠাৎ কল করলা কেন?”
“আমি কী আর সাধে এই সময়ে তোমাকে কল করেছি বলো? জরুরী দরকার আছে বিধায় কল করেছি।”
“কী দরকার বলো?”
“রাফায়াতের বিষয়ে সিক্রেট কিছু বলার ছিল তোমাকে!”
মুহূর্তেই তৎপর হয়ে উঠল অনিক! হাতে থাকা দলিলপত্রগুলো সে আলমারির তাকে তাকে গুছিয়ে রাখল। ভ্রুযুগল ঈষৎ উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী সিক্রেট?”
“ফোনে বুঝিয়ে বলা যাবেনা অনিক। যা বলার সরাসরি বলতে হবে!”
“নাটক করিস না তো। যা বলার ফোনেই বল।”
“আমি নাটক করছিনা অনিক। যা বলছি সব সত্যি বলছি। প্লিজ তুমি একবারের জন্য আমার সাথে দেখা করতে চট্টগ্রাম আসো। এতে যেমন তোমারও লাভ হবে তেমনি আমারও। বলা যায়না এই সুযোগে হয়ত তুমি তোমার অয়ন্তীকে খুঁজে পেলেও পেতে পারো।”
“এই? তুই আমার সাথে কোনো খেলা খেলছিস না তো? তোর পাশে কী রাফায়াত আছে?”
“আরেহ্ আজব তো! কীসব আজেবাজে কথা বলছ তুমি বলো তো? আমি নিজেও তো রাফায়াতকে সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছিনা। পাগল পাগল লাগছে আমার। আর তাছাড়া আমাকে যদি তোমার এতটাই সন্দেহ হয় তো আসার দরকার নেই তোমার! রাখছি আমি বাই।”
“আরেহ্ শুনো শুনো। এত হাইপার হচ্ছে কেন? তুমি কিন্তু নিজেও জানো অয়ন্তীকে আমার কতটা প্রয়োজন। কাল সকালের মধ্যেই আমি চট্টগ্রাম আসছি। তবে একটা শর্ত আছে, আমার আসার ব্যাপারটা যেন কাক পক্ষিটিও জানতে না পারে!”
“জানবে না কেউ। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। তাহলে কাল সকালেই আমাদের দেখা হচ্ছে ওকে? এখন রাখছি তবে, বাই।”
ফট করে কলটি কেটে দিলো প্রিয়া। মৃদু হেসে ভ্রু নাচিয়ে রাফায়াতের দিকে তাকালো! কদাচিৎ হাসল রাফায়াত। প্রিয়াকে মিছেমিছি ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে ধরল! দাঁতে দাঁত চেপেও কোমল কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল,,
“আমরা খুব শীঘ্রই বিয়ে করছি প্রিয়া! তুমি শুধু অনিককে একবার চট্টগ্রাম নিয়ে এসো। তার ফোন থেকে ভিডিওটা ডিলিট করো। অনিককে ফাঁসিয়ে আমরা অতি শীঘ্রই আমাদের সুখের সংসার বাঁধব প্রিয়া!”
#চলবে…?