এক মুঠো কাঁচের চুরি পর্ব – ২৩

#এক_মুঠো_কাঁচের_চুরি
#পর্ব_২৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

নিস্তব্ধ রাত,চারদিকে পিনপিনে নীরবতাময় পরিবেশ।তানহা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে কান্না করছে।সবে মাত্র দু-চোখের পাতা এক করেছিল।কিন্তু ইফাদ এসে,খাবার খেতে নিয়ে চলে গেল।চৈতালির কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে,কথাগুলো বুকে এসে আঘাত করছে।দিনের বেলায় নিজেকে শক্ত রাখতে পারলে-ও,রাতের বেলায় দু-চোখের পানি বাধ মানতে চায় না।বৃষ্টির মতো অঝোরে ঝরে পড়ে।ইফাদ এতক্ষণ সহ্য করতে-ও আর সহ্য করতে পারলো না।তানহাকে নিজের দিকে ঘোরালো।একহাতে গাল দিয়ে,তানহার দিকে তাকিয়ে বলল।

–কি হয়েছে কান্না করছো কেনো?তোমাকে কান্না করতে নিষেধ করি নাই।চোখের পানি সব ঝরে ঝরে পড়ছে।কার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছো তুমি?

তানহার থেকে কোনো উওর আসলো না।দৃষ্টি অন্যদিকে রেখেছে।দু-চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গুলো গড়িয়ে পড়ছে।ইফাদ এক দৃষ্টিতে তানহার দিকে তাকিয়ে আছে।কি অদ্ভুত সেই দৃষ্টি।ইফাদের দৃষ্টি তানহার ভেতরে ঝড় তুলে দিয়েছে।অন্য দিকে ঘুরতে চাইলে ইফাদ শক্ত করে তানহাকে ধরে রাখলো।তানহা একবার ইফাদের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে নিল।ইফাদ তানহার দু-চোখের পাতায় আলতো করে অধর ছুঁইয়ে দিলো।ইফাদের গরম নিঃশ্বাস তানহার মুখের ওপরে পড়তেই পরম আবেশে দু-চোখ বন্ধ করে নিল তানহা।তানহার অধরযুগল গুলো নিয়ে আয়ত্তে করে নিল ইফাদ।তানহার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো।ইফাদ তা’ অনুভব করতে পারলো।তানহার হাতে ভাজে নিজের হাত এক করে দিল।দু’জনের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসতে শুরু করলো।দু’জনের মাঝে নেই কিঞ্চিৎ পরিমান দুরত্ব।অবশেষে পূর্ণতার রেশ ঘিরে ধরলো ইফাদ আর তানহাকে।তাদের ভালোবাসা দেখে স্বয়ং চাঁদও লজ্জায়,মুখ লুকিয়ে ফেললো।অতঃপর একটি রাত সাক্ষী হলো তাদের মধুচন্দ্রিমার।

আবির ঘুমোচ্ছিল।হঠাৎ করে কল বেজে উঠলো।ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা হাতে নিল।অতিরিক্ত ঘুমের কারনে,ঠিকমতো তাকাতে-ও পারছে না।দু-চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে আছে।ফোনটা রিসিভ করলো।সাথে সাথে ভেসে এলো একটা মেয়ের রাগান্বিত কণ্ঠ।

–কু*ত্তা*র বা*চ্চা* তুই কোনোদিন ভালো হবি না।আমি ভেবে ছিলাম।তোর থেকে দূরে গেলে,তুই হয়তো শিক্ষা পেয়ে ঠিক হবি।আমি তো’ ভুলেই গিয়েছিলাম।তুই তো মহান পুরুষ।তোর মনে দয়া মায়া বেশি।তাই এক মনে,একটা নারী রাখতেই পারিস না।তোর মনে হাজারো নারীর ভীড়।একটা কথা কি জানিস।পঁচা জিনিসে মাছি ভনভন করে বেশি।তুই হচ্ছিস সেই পঁচা জিনিস।আমি বুঝি না।এত সুন্দর সুন্দর মেয়ে গুলো,বেছে বেছে পঁচা জিনিসে হাত দেয় কেনো?কালকের মধ্যে তুই যদি আমার সাথে দেখা না করিস।তোর অবস্থা আমি কি করবো।তুই নিজে-ও জানিস না।

মেয়েটির কণ্ঠে শুনে,ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো আবির।দু-চোখ কচলে ভালো করে,নাম্বারটা দেখে নিলো।নাম্বারটা দেখে মুখের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

–তুমি এতদিন কোথায় ছিলে,তুমি জানো তোমাকে পাগলের মতো কোথায় কোথায় খুঁজেছি।তুমি একবার আমার কাছে ফিরে এসো।আমি একদম তোমার মনের মতো হয়ে চলবো।

–তোর ছলনায় আমি এবার ভুলবো না।আল্লাহর কাছে কি যে,পাপ করে ছিলাম।তোর মতো মানুষের সাথে আমার দেখা হয়েছিল।

–তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো কেনো?তুমি আমাকে আগে কতটা সন্মান করতে,আর আজকে তুই তাগারি করে কথা বলছো।

–তুই সন্মান করার মতো কোন কাজটা করেছিস।আমাকে দেখা।তোর সাথে ফালতু কথা বলার আমার সময় নেই।কালকে পার্কে চলে আসবি।আগে যেখানে আমরা দেখা করতাম।

–তুমি যা বলবে,যখন বলবে আমি তোমার সামনে গিয়ে হাজির হব।তুমি শুধু ফিরে এসো।কখন যেতে হবে আমাকে বলো।আমি এক ঘন্টা আগে গিয়ে বসে থাকবো।

ওপাশ থেকে কোনো উওর আসলো না।কলটা কেটে দিয়েছে।আবির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।এটা নতুন কিছু না।আবিরের অভ্যাস আছে।এসব দেখার।ভেতরটা খুশিতে ভরে উঠেছে।মানসিক অশান্তিটা কেটে গিয়ে,ভেতরটা শান্তিময় হয়ে উঠেছে।রাতের প্রহরটা যেনো কাটছেই না।আবিরের এখনই ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।বিছানায় শুইয়ে শুইয়ে ছটফট করছে।

ঘড়ির কাটায় চারটা বেজে পার হয়ে গিয়েছে।বিছানায় বসে থরথর করে কাঁপছে তানহা।একটু পর পর হাঁচি দিয়ে উঠছে।মাত্রই ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করার ফলে,এই করুন দশা তানহার।ইফাদ তানহার দিকে তাকিয়ে হাসছে।তানহা বিরবির করে কি জানি বলছে।ইফাদেকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল।

–ওভাবে থাকিয়ে থেকে কি দেখছেন।

–তোমাকে,,

–আগে কখনো দেখেন নাই।

–অসম্ভব সুন্দর তুমি।

–আল্লাহ তায়ালা তাহলে আপনাকে সুবুদ্ধি দিয়েছে।এতদিনে বউয়ের ওপরে নজর পড়েছে।

–অনেক আগেই পড়েছে।

–সব মিথ্যা কথা।

–সব সত্যি কথা।ভয়ে কিছু বলতে পারি নাই।

–আপনি ভয় পান হাসালেন।ভদ্রলোকের মতো গোসল দিয়ে আসুন।আপনি এখন বেশ সুস্থ আছেন।আজ থেকে আমার সাথে নামাজ পড়বেন।

ইফাদ দ্রুত কম্বলের মধ্যে ঢুকে গেল।তানহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইফাদের দিকে।

–আপনি আবার শুইয়ে পড়ছেন কেনো?নামাজ কি আপনার শশুর পড়বে।

–আমার শশুর নাই।থাকলে হয়তো পড়তেন।আল্লাহ তোমাকে ধৈর্যও দিয়েছে।আরো দিক।আমি অসুস্থ কাল থেকে নামাজ পড়বো।

–আজকাল বলে কোনো কথা নেই।নামাজ না পড়লে আপনার সাথে সংসার করবো না।উঠুন বলছি।

–শীতের মধ্যে গোসল করলে আমি মরেই যাব।

–খালি বাজে কথা।উঠুন বলছি।আমি কি মরে গিয়েছি।

ইফাদ কম্বলের মধ্যে থেকে দু-চোখ বের করে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।যার অর্থ আজকে নামাজ না পড়লে হয় না।কিন্তু তানহা নামাজের বিষয়ে খুব কঠিন।সে,তার স্বামীর সাথে জান্নাতে যেতে চায়।তার স্বামীকে তো আল্লাহর ইবাদত করতেই হবে।যিনি আমাদের রিজিক দান করেন।আমাদের মনের সকল আশা পূর্ণ করে দেন।বিপদে সব সময় সরন করিয়ে দেন।কেউ পাশে না থাকলে উনি সব সময় আমাদের পাশে আছেন।আমরা এত অন্যায় করি।পাপা করি।তবুও উনি আমাদের ক্ষমা করে,আমাদের দোয়া কবুল করে নেন।আমরা তাকে খুশি করার জন্য তার ডাকে সাড়া দিতে পারবো না।তানহা রেগে বলল।

–থাকবো না আমি আপনার সাথে,যে মানুষ নামাজ পড়ে না।তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।বলেই বিছানা থেকে নেমে,ড্রেসিং টেবিলের কাছে থেকে ছোট ব্যাগটা হাতে নিল।থাকেন আপনি আপনার বাসায় চলে গেলাম।আর আসবো না।

তানহার কথা শুনে,ইফাদ দ্রুত উঠে এসে তানহার হাত ধরে বলল।

–যাচ্ছি যাচ্ছি।এত ভয় দেখানোর কি আছে।ভালো ভাবে বললেই তো’ শুনি।

তানহা চোখ গরম করে তাকালো।

–আপনি যাবেন।ইফাদ অসহায় মুখ করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।তানহা মুচকি হেসে বিছানা উঠে বসলো।বিছানায় বসে একা একা হেসে উঠেছে।লজ্জা লতা গাছের মতো মিইয়ে যাচ্ছে।দু-হাতে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ বসে থাকলো।তারপরে ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলো।মনটা কাল থেকে ফোন ফোন করছিল।রাগ করে ফোনটাকে ছুরে ফেলে দিয়েছি।নিজে পড়ে গেলে-ও এতটা কষ্ট হয়।ফোন পড়ে গেলে যতটা কষ্ট হয়।মুয়াজ্জিনের মধুর কণ্ঠে আজানের সুর কানে আসতেই তানহা উঠে দাঁড়াল।

ইফাদ চুলগুলো মুছতে মুছতে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো।থরথর করে কাঁপছে পুরো শরীর।

–এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছো।আমার জামাকাপড় এগিয়ে দাও।চুলগুলো মুছিয়ে দাও।স্বামীর সেবা করতে শিখো বউজান।তানহা হেসে ইফাদের জামাকাপড় এগিয়ে দিয়ে,ইফাদের হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে চুলগুলো মুছে দিতে লাগলো।

–জামাই যদি আমার মন মতো হয়ে চলে,জামাইকে একদম মাথায় করে রাখবো।কখনো কষ্ট পেতে দিব না।এবার অজু করে ঝটপট মসজিদে যান।

–না,আজকে যেতে পারবো না।পায়ে অনেকটায় ব্যথা আছে।আজকে বাসায় পড়ি।কাল থেকে মসজিদে যাব।

–আপনার মতো চোর আমি দু’টো দেখি নাই।

–তুমি আমাকে চোর বললে,কি চুরি করেছি আমি।

–আপনি একজন নামাজ চোর।নামাজ পড়তে চান না।এতদিন অসুস্থ ছিলেন,তাই কিছু বলি নাই।এখন আপনি বেশ খানিকটা সুস্থ।প্রতিদিন নামাজ পড়বেন।মানুষের ইচ্ছা শক্তিটাই বড়।অসুস্থ অবস্থায় আপনি শুয়ে থেকে নামাজ পড়তে পারবেন।চেয়ারে বসে নামাজ পড়তে পারবেন।আপনার কোনো সমস্যা থাকলে,বিপদ ঘটলে আপনি যে,ভাবে নামাজ পড়বেন।আল্লাহ তায়ালা ঠিক কবুল করে নিবেন।সুস্থ অবস্থায় এসব করার চিন্তা ভাবনা করবেন না।এসব উপায় গুলো যারা অসুস্থ,যাদের অনেক বড় বড় সমস্যা আছে তাদের জন্য।একটা কথাও বলবেন না।অজু করে নামাজ পড়বো দু’জন।

ইফাদ আর তানহা দু’জন অজু করে এসে পাশাপাশি জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল।নিজেকে আজ ভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছে তানহার।কোনো এক রাতে স্বপ্ন দেখেছিল।স্বামীর সাথে পাশাপাশি বসে নামাজ পড়বে।আল্লাহ তায়ালা তানহার মনের ইচ্ছা পূর্ণ করে দিল।তানহা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করল।

দু’জন নামাজ শেষ করে,একে ওপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল।কি সুন্দর সেই হাসি।দু’টি মানুষের হাসির মধ্যে আল্লাহ তায়ালার রহমত ঝরে পড়েছে।

–আপনি ঘুমিয়ে নিন।আমি রান্নার জোগার করে আসি।সকালে একবারে এত কাজ করা জুলুম হয়ে যায়।

–কোথাও যেতে হবে না।তুমিও আমার সাথে ঘুমাবে।

–মাথাটা এত ব্যথা করছে।আজকে মনে হয় কোরআন শরীফ-ও পড়তে পারবো না।

–সারারাত ঘুম হয় নাই।তাই এমন হচ্ছে,একটু ঘুমিয়ে নাও।মাথাটা হালকা লাগবে।

–তাই হয়তো।তানহা জায়নামাজ গুছিয়ে তুলে,বিছানায় গিয়ে শুইয়ে পড়ল।বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সাড়া রাজ্যের ঘুম এসে তানহার চোখে ধরা দিল।ইফাদ আস্তে করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।অনেকক্ষণ পরে রুমে আসলো।তানহা ঘুৃমে বিভোর।তানহার মাথাটা তুলে নিজের বুকে ওপরে রাখলো ইফাদ।তানহার কপালে অধর ছুঁইয়ে তানহাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল।

ঘড়ির কাটায় আটটা বাজে তানহা চোখে মেলে নিজেকে ইফাদের বুকে আবিষ্কার করে।ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই চোখ কপালে উঠে যায়,দ্রুত উঠে রান্না ঘরে গেল।রোকেয়া বেগম চৈতালি দু’জনের রুমের দরজা বন্ধ।তারমানে কেউ উঠে নাই।তানহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্না ঘরে আসলো।রান্না ঘরে এসে অবাক হয়ে গেল।তানহার অর্ধেক কাজই করা আছে।এখন শুধু রান্না করে নামানো।তানহা ভাবতে শুরু করলো কে,করেছে তার কাজগুলো।তার শাশুড়ী।তার শাশুড়ী করলে কখনো অর্ধেক কাজ করে না।এত ভেবে কাজ নেই।রান্নায় মন দিল তানহা।

দশটার দিকে ঘুৃম ভাঙে চৈতালির।ফোন হাতে নিয়ে আবিরকে ফোন দিল।আবির চৈতালির ফোন কেটে দিল।চৈতালি আবার ফোন দিলো।আবির বিরক্ত হয়ে ফোন তুলল।

–তুমি আর আমাকে ফোন দিবে না।তোমার ভাবি আমাকে যা ইচ্ছে খুশি বলেছে।তুমি যদি সবকিছু ছেড়ে আমার কাছে চলে আসতে পারো।তাহলে আমার কাছে আসবে।না হলে আসতে পারবে না।

–কোথায় আসতে হবে বলুন।

–যেখানে আমরা দেখা করি।এগারোটায় দেখা করবে আমার সাথে।বলেই আবির কল কেটে দিল।আবির বিষয়টা সিরিয়াসলি নিল না।আবির জানে চৈতালি কখনো তার পরিবারকে কষ্ট দিয়ে,আবিরের কাছে আসবে না।কিন্তু আবিরের ভাবনাটা আদৌও কি সঠিক।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here