#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১০
আদ্র একপা একপা করে এগোচ্ছে আর স্পৃহা সমানতালে পিছু হটছে। স্পৃহার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। ভয়ংকর বিপদ যেন সাইরেন বাজিয়ে নিজের আগমন জানান দিচ্ছে। আদ্রের রক্তিম চোখজোড়ায় ফুটে ওঠা হিংস্রতা দেখে স্পৃহার পিলে চমকে উঠলো। কম্পিত কণ্ঠে বললো,
-আদ্র, আপনি এগোবেন না। আমার কথা শুনুন। এমন এগ্রেসিভ হবেন না, প্লিজ।
আদ্র ভাঙা ভাঙা গলায় কাঠিন্য বজায় রেখেই বললো,
-ক্ কেন? কেন এগোবো না? আহির তোমার কাছে এলে তো নিষেধ করতে না! আমি এলেই সমস্যা?
আদ্রের কথা শুনে স্পৃহা অবাক চোখে তাকালো। ওর নাকে একটা বিদঘুটে গন্ধ ঠেকছে। নাক-মুখ কুঁচকে ফেললো স্পৃহা। আদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,
-ডোন্ট বি প্যানিকড্। ইউ আর মাই ওয়াইফ। আই লাভ ইউ আ লট, সুইটহার্ট!! আই ওয়ানা স্পেন্ড এভ্রি মোমেন্ট অফ মাই লাইফ উইথ ইউ। এন্ড নাও, আই ওয়ান্ট ইউ।
আদ্রের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই স্পৃহার পা পেছনে ঠেকে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো মা-রা-ত্ম-ক বিপদসংকেত হিসেবে বেডের সাথেই ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ও। ভীত দৃষ্টিতে আদ্রের দিকে তাকালো স্পৃহা।
সকালের নরম রোদ জানালা ভেদ করে চোখে এসে পড়তেই নাক-মুখ কুঁচকে ধীরগতিতে চোখ খুলে তাকালো আদ্র। মাথাটা প্রচন্ড ভার লাগছে। কপাল চেপে ধরে উঠে বসলো সে। ঝাপসা দৃষ্টি ক্রমশ স্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছতর হতেই আশেপাশে চোখ বুলালো। ঘরের এক কোণায় চোখ যেতেই দৃষ্টি থেমে গেল তার। পুরু ভ্রূদ্বয় কুঞ্চিত হয়ে গেল মুহুর্তেই।
বেড থেকে অদূরে ঘরের এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে আছে স্পৃহা। হাটুর ভাজে মুখ পুরে স্থির হয়ে আছে সে। শাড়ির আঁচল মেঝে গড়িয়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। স্পৃহার চুল ও পোশাকের এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে আদ্র অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। স্পৃহার এমন অবস্থা কীভাবে হলো? প্রশ্নটা বারবার মাথায় ঘুরছে। কাল রাতে কী কিছু হয়েছিল? মনের কোণে উঁকি দেওয়া প্রশ্নটির প্রেক্ষিতে কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। আদ্রের এখন কিচ্ছু মনে পড়ছে না।
ধীর পায়ে স্পৃহার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর সামনে বসলো আদ্র। অতি নিকটে কারো অবস্থান টের পেয়ে মুখ তুলে ভীত দৃষ্টিতে তাকালো স্পৃহা। ফুলে যাওয়া অশ্রু পূর্ণ চোখ দুটো দেখে আদ্রের বিস্ময়ের মাত্রা আরো একধাপ বৃদ্ধি পেল। কিন্তু আদ্রকে দেখা মাত্রই স্পৃহার চোখে মুখে ফুটে ওঠা ভয়টা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে রাগ ও ঘৃণার একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হলো।
আদ্র হাত বাড়িয়ে স্পৃহার মুখ স্পর্শ করতে গেলেই স্পৃহা ঝামটা মেরে ওর হাত সরিয়ে দিল। রাগী গলায় বললো,
-ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ মি! ছোঁবেন না আপনি আমায়। একদম ছোঁবেন না!!
শেষোক্ত কথাটা অনেকটা কান্নামিশ্রিত গলায় বললো স্পৃহা। আদ্র বিস্ময়বিমূঢ় কন্ঠে বললো,
-তুমি এমন রিয়েক্ট করছো কেন, স্পৃহা? আর এমনভাবে বসেই বা আছো কেন? কিছু কি হয়েছে?
স্পৃহা তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টিতে তাকালো। বললো,
-এমনভাবে বলছেন যেন আপনি কিছুই জানেন না? নাটক করছেন আমার সাথে?
-আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না, স্পৃহা! আমার কিছু মনে পড়ছে না।
স্পৃহা এবার অদ্ভুতভাবে হাসলো। আদ্র অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পৃহার মুখের হাসির দিকে। সেই হাসিতে ফুটে উঠেছে শ্লেষ, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য, ঘৃণা আর নিজের জীবনের প্রতি হাজারো অভিযোগ ও অনুযোগ
__________________________
আহির চিন্তিত মুখে বসে আছে। মনে মনে চাইছে, একটু আশার আলো যেন অবশিষ্ট থাকে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের উপস্থিতি স্পষ্ট। মুখোমুখি বসে থাকা ব্যক্তিটা বেশ মনযোগ সহকারে কাগজপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। অনেকক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পর ব্যক্তিটা মুখ তুলে আহিরের দিকে তাকালো। মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বললো,
-ইউ হ্যাড বেটার গো টু এব্রোড, মিস্টার আহির। দেয়ার ইজ নো আদার আল্টারনেটিভ ফর ইউ।
আহির যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললো,
-দেশের বাইরে আমি যাচ্ছি-ই। কিন্তু আমায় এটা বলুন যে, কোনো ইম্প্রুভমেন্টের চান্স আছে?
ব্যক্তিটি হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
-আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী হয়তো নয়! ম্যাক্সিমাম ১% পসিবিলিটি আছে।
আহির হাতের মুঠোয় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে থম মেরে বসে রইলো অনেকক্ষণ। এটা তো জানাই ছিল তার! কিন্তু সরাসরি নিশ্চিত হওয়ার পর মানতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। মানবমন এতো অদ্ভুত কেন? তার থেকেও বড় কথা, নিয়তি এতো নিষ্ঠুর কেন?
_______________________
ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামতেই স্পৃহা কোনো বাক্যব্যয় না করেই গাড়ি থেকে নেমে গেল। আদ্র বললো,
-স্পৃহা, লিসেন টু মি। আমি…
কথা শেষ হওয়ার আগেই স্পৃহা ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-ক্লাস শেষে গাড়ি পাঠানোর কোনো দরকার নেই।
বলেই গটগট করে চলে গেল। কয়েকদিন ধরে স্পৃহার আচরণগুলো বেশ কষ্ট দিচ্ছে আদ্রকে। কোনো কিছু স্পষ্টভাবে বলছেও না, স্বাভাবিকও হচ্ছে না। প্রতিটা মুহুর্ত এভোয়েড করে চলে ওকে। সরাসরি কথা বলা সেদিনই বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি আদ্রের দিকে চোখ তুলে একবার তাকায়ও না। বিষয়টা প্রচন্ড পীড়া দিচ্ছে আদ্রকে। বিতৃষ্ণায় দাঁতে দাঁত চেপে স্টিয়ারিং-এ একটা ঘুষি দিল আদ্র।
-তোর ইদানীং কী হয়েছে? বল তো! সবসময় অমন মুখ কালো করে থাকিস কেন? কিছু কি হয়েছে?
প্রান্তির প্রশ্ন শুনে নীড় আর আহান প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো স্পৃহার দিকে। বিষয়টা ওরা-ও খেয়াল করেছে, তবে তেমন সিরিয়াস ভাবে নেয়নি। কিন্তু প্রান্তির প্রশ্ন শুনে ওদের মনেও কৌতূহল জাগছে। স্পৃহা ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
-কী হবে? কিছুই হয়নি!
আহান সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,
-ঐ আহিরকে নিয়া এখনো ভাবছিস নাকি তুই? ওয় কোনো ঝামেলা করে নাই তো? দেখ, বইন! কিছু হইলে আমারে তাড়াতাড়ি বল। আমি তো ওকে…
-অহেতুক হাইপার হচ্ছিস, আহান। আমার কিছু হয়নি, বললাম তো?
স্পৃহার কথার পৃষ্ঠে বলার মতো কিছু পেল না ওরা। আহান আর নীড় হতাশ হয়ে চা খেতে চলে গেল। স্পৃহা গেল না। প্রান্তি ইচ্ছে করেই স্পৃহার সাথে রয়ে গেল।
ওরা চলে যেতেই প্রান্তি উচ্ছ্বল গলায় বললো,
-আহির ভাইয়ের কোনো খবর জানিস তুই?
স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-তোর মনে হয় যে, আমার আহিরের সাথে এখনো যোগাযোগ আছে?
-আরে, আমি সেটা কখন বললাম? আহির ভাই তো স্পন্দন ভাইয়ার ফ্রেন্ড! ওনার কাছ থেকে কিছু শুনিসনি?
স্পৃহা তেমন কোনো হেলদোল না দেখিয়ে বললো
-ওনার সম্পর্কে কিছু জানার ইচ্ছে আমার নেই। তাই জিজ্ঞেস করিনি।
প্রান্তির মুখটা চুপসে গেল। মুখ ছোট করে বললো,
-আমি বেশ কয়েকদিন আগে আহির ভাইকে দেখেছি। তারপর থেকেই আমার কেন যেন মনে হয়, আহির ভাইয়ের বিয়ের ব্যাপারে এমন কোনো রহস্য হয়তো আছে যেটা আমাদের অজানা।
স্পৃহা অবাক চোখে তাকালো। বললো,
-মানে? কোথায় দেখেছিস তুই আহিরকে যে তোর এমন মনে হয়?
-পার্কে দেখেছিলাম। আহির ভাইয়ের বউ-ও ছিল। আর…
বলেই প্রান্তি দ্বিধাভরা চোখে স্পৃহার দিকে তাকালো। স্পৃহা সন্দেহ নিয়ে বললো,
-আর?
-আর ওনাদের সাথে একটা চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলেও ছিল।
স্পৃহা হতভম্ব হয়ে বললো,
-মানে?
-মানেটা তো আমিও জানি না! প্রথমে ভেবেছিলাম ওটা ওনাদের ছেলে নয় হয়তো। পরে দেখলাম, আহির ভাইকে পাপা আর আনিলাকে পাপা বলে ডাকছে। তখন থেকেই আমি এটার সমীকরণ মেলাতে পারছি না।
স্পৃহা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। কম্পিত কণ্ঠে বললো,
-ওটা আহির ছিল? নিশ্চিত তুই?
প্রান্তি বিরক্তি নিয়ে বললো,
-আরে হ্যাঁ! তোকে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আহানের ঝাড়ি খেয়ে আর বলতে পারিনি, বলার সুযোগও পাইনি।
স্পৃহা চোখে বিস্ময় নিয়ে থম মেরে বসে রইলো অনেকক্ষণ। হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে ভাবতে লাগলো ও। আহিরের বিয়ে তো কয়েকমাস আগেই হলো! তাহলে চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা কীভাবে সম্ভব? আহির কি অনেক আগেই বিয়ে করেছে? কিন্তু এটা তো হতেই পারে না! ওদের বিয়ের সময় স্পন্দন উপস্থিত ছিল। স্পষ্ট ভাবেই বোঝা যাচ্ছে, বাচ্চাটা আহিরের নয়। তাহলে কীভাবে কী হয়েছে?
প্রশ্ন গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা হাতে নিয়ে স্পন্দনকে ফোন দিলো স্পৃহা। স্পন্দন ফোন রিসিভ করতেই স্পৃহা হুট করে বললো,
-ভাইয়া! ভাইয়া তুই আহির ভাইয়ার ব্যাপারে কিছু জানিস?
আহিরের ব্যাপারে স্পন্দন বেশ অবাক হলো। হতবাক হয়ে বললো,
-হঠাৎ আহিরের ব্যাপারে জানতে চাইছিস কেন?
স্পৃহা দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-তুমি বলবে?
স্পন্দন হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে যে উত্তরটা দিলো, সেটা স্পৃহার একদম প্রত্যাশিত ছিল না। মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়লো ওর। নিজেকে অকূল পাথারের শিকার বলে মনে হচ্ছে এখন।
# চলবে…
✘কপি করা নিষেধ✘