এক মুঠো প্রেম পর্ব -১১

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১১

স্পৃহা থম মেরে বসে আছে অনেকক্ষণ যাবৎ। প্রান্তি বারবার জিজ্ঞেস করছে, স্পন্দন ফোনে কী বললো? কিন্তু স্পৃহা কোনো উত্তর দিচ্ছে না। এরই মধ্যে আহান আর নীড় ফিরে এলো। স্পৃহার মুখের অবস্থা দেখে ওরা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে যে, কিছু একটা হয়েছে। প্রান্তি চিন্তিত ও ভীত ভঙ্গিতে নখ কামড়াচ্ছে। নীড় সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,

-ইজ দেয়ার এনিথিং রোঙ্? পিহুর মুখের কন্ডিশন ভালো ঠেকছে না।

আহান বিরক্তি নিয়ে নীড়ের মাথায় একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো,

-শালার ইংরেজ কোথাকার! রাজাকারের বংশোদ্ভূতের মতো ইংরেজি না ছেড়ে মাথা খাটাইতে পারোস না? এই প্রান্তি কিছু করছে, আমি শিয়র!!!

বলেই প্রান্তির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

-শোন ছেড়ি, আমরা যাওয়ার পর থেইকা পিহুরে কী কী কইছোস, এইখানে কী কী হইছে ফটাফট এখন উগলে দিবি। একটা কমা-ও যেন এদিক সেদিক না হয়!

প্রান্তি রাগী গলায় আহানকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-আমি কী করেছি? আজব! কিছু হলেই সব দোষ আমার ঘাড়ে কেন দিস তুই?

-কারণ তুই-ই যত নষ্টের গোড়া! আস্ত একটা ঝামেলার গোডাউন। আর তুই-ই এখন কিছু একটা করছোস, সেটাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। সো, তাড়াতাড়ি কইয়া ফেল, কী হইছে?

প্রান্তি আমতা আমতা করে ওদের সবটা খুলে বলতেই আহান দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো,

-দেখলি? দেখলি তো! আমি কইলাম না? ঐ তোরে আমি মানা করছিলাম না? এসব কথা পিহুকে না কইতে। ক্যান বললি?

নীড় বিরক্ত হয়ে আহানের দিকে তাকিয়ে বললো,

-ভাই, যা বলার বলেছে ও। এখন সেটা নিয়ে ঘাটলে কোনো লাভ হবে? তার চেয়ে স্পন্দন ভাই কী বললেন সেটা জানা এখন বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।

আহান ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললো,

-দেখ, তোরা যেমনে ভাবোস, আমি তেমনে ভাবতে পারবো না। আহিরের বাচ্চা আছে কি নাই? বউয়ের কী হইছে? এসব জাইনা এখন লাভ কী? আর এই পিহুরে মন চায় একটা আছাড় মারি। এই তুই এখনো আহির ভাইরে নিয়ে পড়ে আছিস কেন, বলতো! তোর বিয়ে হইসে না? যেভাবেই হোক, হইসে তো? এখন আহিররে নিয়া মাথা ঘামাইয়া কী হইবো? যতই ঘাটোস না ক্যান, মামা! রেজাল্ট সেই একই হইবো। মিলাইয়া নিস!

সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে স্পৃহা এবার মুখ খুললো,

-আমি আসল সত্যিটা জানতে চাই, আহান! একচুয়েলি কী হয়েছে?

-আচ্ছা, মানলাম। তুই সত্যিটা জানতে চাস। যদি এমন হয় যে, আহির ভাই কোনো যৌক্তিক কারণেই বিয়েটা করসে, তখন কী করবি? আদ্র ভাইকে ছেড়ে দিবি?

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো আহানের দিকে। পরমুহূর্তেই হেসে দিয়ে বললো,

-তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, আহান? আমার যেমন বিয়ে হয়েছে, আহিরেরও হয়েছে। ওনার স্ত্রী আছে। নিজে একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সংসার ভাঙবো আমি? আর আহির বিয়ে না করলেও ওনার কাছে কখনো যেতাম না। কারণ তাহলে আদ্রকে ঠকানো হবে। আদ্রের সাথেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি আমি।

আহান স্পৃহার কথাগুলো শুনে বেশ সন্তুষ্ট হলো। ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললো

-এই না হইলো আমার বইন! দেখলি, কী সুন্দর কইরা ভাবতে পারে ও? কিন্তু আহিরের ব্যাপারে জেনে তো এখন আর কোনো লাভ নাই। ওর টপিক বাদ দে।

-সত্যিটা জানতে হবে, আহান। নিজেকে আর ধোঁয়াশার মাঝে রাখতে চাই না আমি। অন্তত মানসিক পরিতৃপ্তির জন্য সত্যিটা জানা প্রয়োজন আমার।

আহান ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,

-ওকে। তাহলে এখন কী করবি?

স্পৃহা ভাবলেশহীন ভাবে বললো,

-এয়ারপোর্ট যাবো। আহির কানাডা চলে যাচ্ছে। বিকেল চারটায় নাকি ফ্লাইট। হাতে অনেক টাইম আছে। পৌঁছানো যাবে আশা করি।

এয়ারপোর্টে পৌঁছে স্পন্দনের কথা অনুযায়ী সেকেন্ড টার্মিনালে যেতেই স্পন্দনকে দেখতে পেল স্পৃহা। স্পন্দনকে একা দেখতে পেয়ে স্পৃহা বেশ অবাক হলো।

-ভাইয়া!

স্পন্দন চমকে উঠে পাশে তাকাতেই স্পৃহাকে দেখতে পেল। ও আগেই বুঝতে পেরেছিল যে, স্পৃহা আসবে। তাই তেমন অবাক হয়নি। তবুও চোখে মুখে কৃত্রিম বিস্ময় ফুটিয়ে বললো,

-তুই? এখানে কেন এসেছিস?

স্পৃহা উত্তর না দিয়ে ব্যস্ত স্বরে বললো,

-আহির ভাই কোথায়, ভাইয়া? এখনো তো অনেক সময় বাকি! উনি কি ইমিগ্রেশন পেরিয়ে গেছে?

স্পন্দন মাথা নাড়িয়ে বললো,

-হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগেই তো গেল! তুই দেখা করবি জানলে ওয়েট করত হয়তো!

স্পৃহার মুখটা কালো হয়ে গেল। ভেবেছিল আহিরের সাথে বাচ্চাটা সরাসরি দেখলে ওকে জিজ্ঞেস করা যাবে আর আহির মিথ্যেও বলতে পারতো না। কিন্তু আহির তো চলেই গেল!

স্পন্দন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পৃহার দিকে। আহির যে স্পৃহাকে ভালোবাসত, সেটা ও জানে। কিন্তু স্পৃহা আহিরকে ভালোবাসে কি না সেটা ও জানে না। মনে মনে সন্দেহ জাগছে তার। আবার স্পন্দনের এতোকিছু জানার ব্যাপারে স্পৃহা অজ্ঞাত।

-ভাইয়া, তোমার কাছে একটা জিনিস জানতে চাইবো। সত্যি করে বলবে?

স্পন্দন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বললো,

-আমার জানা থাকলে বলবো।

-আহির ভাইয়ের নাকি একটা ছেলে আছে? এটা কি সত্যি?

স্পন্দন ভাবলেশহীন ভাবে বললো,

-হ্যাঁ, আছে তো!

স্পৃহা অবাক হয়ে বললো,

-মানে? এটা কীভাবে সম্ভব? উনি তো কয়েক …

-ছেলেটা ওর নিজের না। দত্তক নিয়েছে ওরা।

স্পৃহা হতভম্ব হয়ে তাকালো। অবাক হয়ে বললো,

-দত্তক কেন নিয়েছে? বিয়ে যখন হয়েছে, বাচ্চাও হতো একসময়। এতো তাড়াতাড়ি …

-ছেলেটা আহিরের নিকটাত্মীয়ের কেউ একজন। বাবা-মা কেউই এখন জীবিত নেই, তাই নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। বুঝলি?

স্পৃহা কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইলো। তার মানে আহিরের বিয়েটা ও স্বেচ্ছায়-ই করেছে। এখানে কোনো রহস্য নেই। শুধু শুধু আকাশপাতাল ভাবছিল স্পৃহা। নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে বললো,

-আচ্ছা, তাহলে আমি যাই। বাইরে প্রান্তি-ওরা ওয়েট করছে আমার জন্য।

স্পৃহা চলে যেতেই স্পন্দন ফোন বের করে আহিরকে কল দিলো।

-তুই যেভাবে বলতে বলেছিস, সেভাবেই পিহুকে সবটা বলে দিয়েছি।

আহির মলিন হেসে বললো,

-ওয়েল ডান! গুড জব।

-তোর জন্য আজ নিজের বোনকে এতোগুলা মিথ্যে বলতে হলো।

-নিজের বোনের সুখের জন্য একটু মিথ্যেও বলতে পারবি না? কেমন ভাই তুই?

স্পন্দন মুখ বাকিয়ে বললো,

-হ্যাঁ, সেই! কিন্তু সত্যি কখনো চাপা থাকে না, আহির। একদিন পিহু সবটা জানবেই।

আহির আপনমনেই হেসে বললো,

-এমন যেন না হয় যে, আমার নিজেরই ওকে সব সত্যি খুলে বলতে হয়! যাই হোক, প্লেন একটু পরেই টেইক অফ করবে। এখন রাখি। ভালো থাকিস।

স্পন্দন হতাশ গলায় বললো,

-পৌঁছে ফোন দিস। রাখছি।
__________________________

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে অনেকক্ষণ আগেই। চিন্তিত ভঙ্গিতে বাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদ্র। স্পৃহার ক্লাস তো দুপুরেই শেষ হওয়ার কথা! সারাদিন পেরিয়ে গেল, এখনো বাড়ি ফিরে নি বলে চিন্তা হচ্ছে ওর। একবার ভার্সিটিতেও ঢু মেরে এসেছে সে। কিন্তু স্পৃহা সেখানে নেই। এখন হাত দিয়ে কপাল চেপে নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদ্র।

এমনসময় স্পৃহা আদ্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অবাক হয়ে বললো,

-আপনি এই সন্ধ্যে বেলায় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

আদ্র চমকে উঠে সামনে তাকালো। স্পৃহা তার চোখের সামনে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্র কিছুক্ষণ শকড কেন তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ স্পৃহার আগমন চমকে দিয়েছে তাকে। ধীরে ধীরে প্রকৃতির হতেই আদ্রের চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। রাগী গলায় বললো,

-সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি? দেরি হলে একটা ফোন করে জানিয়ে দিতে পারতে আমায়! জানো, আমি কত টেনশনে ছিলাম এতক্ষণ?

-এতো চিন্তার কিছু নেই। বেঁচে আছি আমি। এতো সহজে মরবো বলে মনে হয় না।

আদ্র আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-স্পৃহা!! কী বলছো তুমি এসব?

স্পৃহা মলিন হেসে বললো,

-চলুন, ভেতরে যাই।

আদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অনেকদিন পর স্পৃহা ওর সাথে সরাসরি একটু কথা বললো। ভাবতেই বেশ ভালো লাগছে ওর। কিন্তু সেদিন রাতে কী এমন হয়েছিল যে, স্পৃহা ওর থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল এতোদিন? কোনো ভুল করে বসেনি তো সেদিন! আদ্রকে জানতে হবে।

স্পৃহা ফ্রেশ হয়ে আসতেই আদ্র ওর মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। স্পৃহা হতভম্ব হয়ে বললো,

-কী হলো? এভাবে সামনে এসে দাঁড়ালেন যে!

আদ্র গম্ভীর কন্ঠে বললো,

-সেদিন রাতে কী হয়েছিল, স্পৃহা? যার জন্য তুমি এতোদিন আমায় এভয়েড করে চললে!

স্পৃহা এমন প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তেমন কোনো হেলদোল না দেখিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

-কিছুই হয়নি।

# চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here