এক মুঠো প্রেম পর্ব -১২

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১২

আদ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পৃহার দিকে। তার চোখে মুখে ফুটে ওঠা আগ্রহ ও কৌতুকের দেখে স্পৃহা হালকা হাসলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-আপনি ড্রিংক করেন, এটা আমায় আগে জানালেই পারতেন!

আদ্র গাল ফুলিয়ে বললো,

-তুমি যেমন ভাবছো, তেমনটা নয়। আমি অ্যাডিক্টেড না। মাঝে মাঝে মাইল্ড লেভেল পর্যন্ত-ই খাই। কিন্তু সেদিন একটু একসেস হয়ে গেছে, তাই আউট অফ সেন্স হয়ে গিয়েছিলাম।

-এজন্যই আপনার মনের কথাগুলো জানতে পেরেছিলাম, আদ্র।

স্পৃহার মুখে শ্লেষের হাসি। আদ্র ভ্রু কুঁচকালো। মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন-ই জাগছে ওর। কিন্তু স্পৃহা ঘুরিয়ে পেচিয়ে যা বলছে, তাতে কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না সে। তাই কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো,

-তুমি সরাসরি বলবে সেদিন ঠিক কী হয়েছিল?

স্পৃহা একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

-সেদিন কিছুই হয়নি, আদ্র। আপনি সেন্সে ছিলেন না, তাই আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু সাথে সাথেই আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো এর আগে এতো ড্রিংক করেননি! তাই …

এতক্ষণে আদ্র একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। তা দেখে স্পৃহা শুকনো হেসে আদ্রের সামনে থেকে সরে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতেই মনের মধ্যে নানা ভাবনা চিন্তা এসে জড়ো হলো। আহির দেশ ছেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ওর জীবন থেকে চিরতরে চলে গেল। হয়তো ভিন্ন পরিবেশে গিয়ে নিজের জীবনটাকে নতুনভাবে ও সুন্দররূপে গুছিয়ে নিতে চায় সে। ভাবতে ভাবতেই স্পৃহা বললো

-আহির আজ কানাডা চলে গেছে, আদ্র!

আদ্র অবাক হয়ে বললো,

-আচ্ছা?? হঠাৎ কেন চলে গেল?

-জানি না। জানতে চাই-ও না!

স্পৃহা চোখ ঘুরিয়ে আদ্রের দিকে তাকালো। ওর চোখ পানিতে টইটম্বুর হয়ে আছে যেন পলক ফেলতেই গড়িয়ে পড়বে পানি। আদ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। স্পৃহা ধরা গলায় বললো,

-সেদিন আমার কাছে আপনি একটা বেবি চেয়েছিলেন, আদ্র!

আদ্র গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেললো। এইসময় এমন কথার মানে খুঁজে পাচ্ছে না ও৷ হাত দিয়ে কপাল ঘষে বললো,

-তুমি সময় চেয়েছিলে তখন। আমিও ভেবে দেখেছি, তোমার পড়াশোনা বাকি। এখনই ইচ্ছেটা তোমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না।

-পড়াশোনা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না, আদ্র।

আদ্র বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে গেছে এমন কথা শুনে। নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই বললো,

-আর ইউ ওকে? মাথা ঠিক আছে তোমার?

বলেই এগিয়ে এসে স্পৃহার কপালে, গালে চিন্তিত ভঙ্গিতে হাত দিতে লাগলো। স্পৃহা বিরক্ত হয়ে ওর হাত সরিয়ে দিলো। সাথে সাথেই চোখের পানিতে গাল ভিজে উঠলো তার। কাতর স্বরে বললো,

-আমার জীবনে একটু শান্তি চাই, আদ্র। শুধু একটু শান্তি-ই লাগবে আমার। ছোট বেলা থেকে সবার অবহেলা, অনাদরে বড় হয়েছি আমি। একটুও ভালোবাসেনি কেউ আমায়! বাবা, মায়ের দুই চোখের বিষ ছিলাম আমি। শুধু মাত্র ভাইয়ার কারণে আজ আমি বেচে আছি। আমি না খেয়ে থাকলে, ভাইয়া ছাড়া কেউ খোঁজও নিত না। অসুস্থ হলে কেউ একবার জানতেও চাইত না, সুস্থ হয়েছি কিনা। এজন্যই আমার জীবনে আমি শুধু একটু শান্তি চাই। একটু ভালোবাসা চাই, যেটাকে আঁকড়ে ধরে সারাজীবন বাঁচতে পারবো আমি।

আদ্রের বুকও ভার হয়ে গেছে স্পৃহার এমন কান্নামিশ্রিত আকুতি শুনে। স্পৃহার চোখের পানি গুলো নিজ হাতে মুছে দিলো ও। দুই হাতে জড়িয়ে বুকে আগলে নিলো স্পৃহাকে। মাথায় ওষ্ঠ স্পর্শ করে সুর টেনে টেনে বললো,

-আপনার সকল ইচ্ছে নিজ দরবারে মঞ্জুর করতে পেরে আনন্দিত হলাম, মহারাণী। কিন্তু এতো দেরি করে আমার রাজ্য পদধূলি দেওয়ার জন্য আপনাকে শ খানেক চুমু দন্ডে দন্ডিত করা হলো। আমি নিজ দায়িত্বে গুণে গুণে তা আদায় করে নেব।

স্পৃহা আদ্রের এমন টেনে টেনে বলা কথা শুনে কান্নার মাঝেই হেসে দিলো।
___________________________

প্রণব নিজের কাপড়চোপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্যাকিং করছে। প্রান্তি দরজার আড়ালে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রণব আপাতত নিজের কাজে ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রান্তির দিকে তাকাচ্ছে না ও। বোনকে ছেড়ে এমনিতেই যেতে ইচ্ছে করছে না। তারওপর প্রান্তি এখন বায়না ধরলে মনটাই খারাপ হয়ে যাবে ওর।

-ভাইয়া, তুই সত্যিই যাচ্ছিস?

প্রণব ঠোঁট গোল করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-এই নিয়ে সাতবার একই প্রশ্ন করলি তুই!

প্রান্তি ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,

-তাও তো তোর উত্তর সেই সেইম-ই রইলো। যা! কথাই বলবো না তোর সাথে!

প্রণব নিঃশব্দে হেসে বললো,

-আচ্ছা? বলিস না তাহলে।

প্রান্তি কাঁদো কাঁদো ফেস করে এগিয়ে এসে বললো,

-ভাইয়া, তুই যাস না, প্লিজ। তোকে ছাড়া আমি থাকবো কীভাবে বল? বাবা তো আমার খবরও রাখে না! তুই না থাকলে আমি একদম একা হয়ে যাবো!!

বলতে বলতেই ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে দিলো প্রান্তি। প্রণব হাত থেকে কাপড় ফেলে প্রান্তির দিকে ঘুরলো। ওর চোখ মুছে দিতে দিতে বললো,

-আরে এমনভাবে কাঁদছিস যেন আমি আজীবনের জন্য তোকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। মাত্র ছয়মাস-ই তো!দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আর তোর সাথে তো আমার রোজ কথা হবে, তাই না?

-কথা বললে কী হবে? আমি তো তোমাকে সরাসরি দেখতে পারবো না! ছুঁতেও পারবো না। তোমায় জড়িয়ে ধরতে পারবো না।

বলেই প্রণবকে জড়িয়ে ধরে কান্নার গতি বাড়িয়ে দিলো। প্রণবেরও খারাপ লাগছে। ছয় মাস কীভাবে প্রান্তিকে ছেড়ে থাকবে ও। কষ্ট হলেও যেতে হবে ওকে। তাই প্রান্তির মাথায় হাত রেখে বললো,

-প্রান্তি, একটা সত্যি কথা জানিস?

-কী কথা?

-কাঁদলে না তোকে একদম পেত্নীর মতো লাগে! আর এখন তো পুরোই শাঁকচুন্নির মতো লাগছে!

প্রান্তি ভ্রু কুঁচকে মুখ তুলে প্রণবের দিকে তাকালো। কটমট করতে করতে বললো,

-তুই আমায় পেত্নী বললি? তোর সাথে কথাই বলবো না আমি!

প্রণব কিটকিটিয়ে হেসে বললো,

-হ্যাঁ, সেই! এটুকুই তো পারো তুমি! পরে আমাকে ছাড়াই তোমার উদ্ধার হয় না।

প্রান্তি গাল ফুলিয়ে পাশ ফিরে তাকালো। হাতে হাত ভাজ করে বললো,

-মায়ের সাথে কথা বলেছিস?

-হ্যাঁ, বলেছি। জানিয়েও দিয়েছি ছয় মাসের জন্য ইন্ডিয়া যাচ্ছি।

-তোকে অনেক মিস করবো, ভাইয়া।

-আমিও মিস করবো। নিজের খেয়াল রাখিস।

বলেই প্রান্তির কপালে একটা চুমু দিয়ে ব্যাগপত্র ও গিটার নিয়ে চলে গেল প্রণব। প্রান্তি শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
________________________

কেটে গেছে দুই মাসেরও বেশি সময়। গ্রীষ্মকালীন প্রকৃতির রুক্ষতা বর্ষণের হঠাৎ আগমনে অনেকটাই কমে গিয়েছে। অফিসে নিজের কেবিনে বসে জানালার আড়ালে থাকা আকাশটাকে মন ভরে দেখছে আদ্র। নীলাম্বরের অস্তিত্ব জুড়ে বিরাজ করা কালচে সত্তাগুলো ইতস্তত বিচরণ করছে। মাঝে মাঝে গর্জেও উঠছে। হঠাৎ করেই কোনো একসময় কান্নায় ভেঙে পড়বে সে। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সকল জঞ্জাল।

এমন বৃষ্টির মৌসুমে কাজে একটুও মন বসছে না আদ্রের। বিরক্তি নিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিতেই পিয়ন এসে ডোরে নক করলো।

-স্যার, মে আই কাম ইন।

আদ্রের বিরক্তি আরো এক ধাপ বৃদ্ধি পেল। ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে বললো,

-ইয়েস, কাম ইন।

পিয়ন তার পান খাওয়া লালচে দাঁত গুলো বের করে একটা হাসি দিলো। আদ্র গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো,

-কিছু বলার আছে।

পিয়ন মুখে হাসি বজায় রেখেই একটা খাম টেবিলের ওপর রাখলো। আদ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,

-এটা কী?

-জানি না তো, স্যার! এক ম্যাডাম এসেছিলেন। আমায় ডেকে বললেন, এই খামটা আপনার কাছে পৌঁছে দিতে। আমার পকেটে কিছু বখশিশও দিলেন। সাথে সাথে চলেও গেলেন।

আদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। খামটা হাতে নিয়ে বললো,

-আচ্ছা, আপনি যান।

পিয়ন চলে গেল। আদ্র খাম খুলতেই কিছু কাগজ বেরিয়ে এলো। সেগুলো দেখেই সে একদম স্তব্ধ হয়ে গেল। বারবার লেখা গুলোর ওপর চোখ বুলালো ও। এটা সত্যি তো? নাকি ও স্বপ্ন দেখছে! বিশ্বাসই হচ্ছে না যেন!! চিন্তাভাবনা সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। অনুভূতি গুলোও কেমন যেন অচেনা লাগছে আদ্রের। অদ্ভুত ভাবেই চোখের কোল ছাপিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো তার।

# চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here