এক শহর ভালোবাসা পর্ব ৪৩+৪৪

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৪৩
#সুরাইয়া_নাজিফা

শান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আর আমি শানের কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম। শান আমার মাথা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে যার ফলে আমার ঘুম চলে আসছিলো।

আমি উঠে বসলাম,
“ধ্যাত ভালো লাগছে না। ”
“কি হলো?”
“কেউ আমার মাথা হাত বুলিয়ে দিলে আমার ঘুম চলে আসে। ”
শান হাসল,
“নিজেই বললে হাত বুলিয়ে দিতে এখন নিজেই বলো ঘুম আসছে পড়া চোর একটা। ”
আমি কপাল কুচকে বললাম,
“মোটেও না। ”
“ওকে আজকের মতো ঘুমিয়ে পড়ো এমনিতেও অনেক রাত হয়ে গেছে। ”

শানের কথা শুনে আমি খুশি হয়ে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলাম। তারপর টেবিলের উপর বই রেখে আবার বিছানায় এসে বসলাম। পাশে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে তারপর শানকে বললাম,

“পানি খাবেন? ”
“দেও। ”

শানকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলাম। শানের খাওয়া হলে গ্লাসটা পাশে রেখে তারপর
সুয়ে পড়লাম। শান আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরলেন আমি শানের বুকে মাথা দিলাম। শান সবসময়ের মতো আমার কপালে একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। হঠাৎ আমার ছোট্ট মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরঘুর করতে লাগল।তাই আমি শানের বুক থেকে একটু মাথা তুলে শানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

“আচ্ছা আপনি যদি বিয়ের আগেই আমাকে ভালোবাসতেন তাহলে প্রথমবার প্রথম রাতে ঐরকম ব্যবহার করলেন কেন?”

আমার প্রশ্ন শুনে শান মাথায় হাত বুলানো বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“অনেকদিন থেকেই জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম কিন্তু এতো কিছুর মধ্যে কখনো জিজ্ঞেস করাই হয়নি তাই। ”
“ওহ। ”

শান চুপ হয়ে গেল
“কি ব্যাপার শুধু ওহ বলে চুপ হয়ে গেলেন যেটা জিজ্ঞেস করলাম বলুন? ”
“হলুদের রাত থেকেই আমি তোমার উপর প্রচন্ড রেগে ছিলাম তাই ফুলসজ্জার রাতে ঐ রকম ব্যবহার করেছিলাম। ”

শানের কথা শুনে আমি উঠে বসে বললাম,
“রেগে ছিলেন কেন?”

শানও উঠে বসে মুখ ফুলিয়ে বললো,
“কেন আবার তুমি কাজকর্মই এমন করো যে সেসব চোখের সামনে দেখলে মানুষ রাগতে বাধ্য হবে।”

আমি গালে হাত রেখে ভাবার অভিনয় করে বললাম,
“আমি আবার কি করেছিলাম? ”

“কেন মনে নেই হলুদের রাতে কোন ছেলের হাতে হাত রেখে বসে বসে গল্প করছিলে বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে। এখন কোনো মানুষ যদি তার ভালোবাসার মানুষকে এভাবে অন্য কারো হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহলে নিশ্চয়ই তার খুশি হওয়ার কথা নয়? ”

উনার কথা শুনে আমি আবার তিন -চার মাস পিছনে গিয়ে মনে করার চেষ্টা করলাম যে উনি কি বলছেন। কার সাথে ছিলাম তাও হলুদের রাতে?কিছুক্ষন ভাবনার পর হঠাৎ মনে পড়তেই আমার প্রচন্ড হাসি পেয়ে গেল আমি কিছুতেই নিজের হাসি আটকাতে না পেরে খিলখিলিয়ে হেসে দিলাম। আমাকে এভাবে হাসতে দেখে শান ভ্রু কুচকে বললো,

“রাত বারোটা বাজে পাগল হয়ে গেছ নাকি?”

আমি হাসতে হাসতে বললাম,
“না তবে আপনার কথা শুনে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো। ”

“কেন আমি পাগল হওয়ার মতো কি বললাম?”

“আচ্ছা আপনি কি সেই ছেলেটার মুখ দেখেছিলেন?”

“না। মুখ দেখলে ঐ ছেলের কপালে অনেক দুঃখ ছিল ভাগ্যিস দেখিনি পিছন ফিরে ছিল। ”

“বাই এনি চান্স তাহলে ঐ ছেলেটাকেই কি আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড ভেবেছিলেন?”

“এখন ওতো রাতে বিয়ের কনে অনুষ্ঠানের মাঝে না থেকে যদি বাড়ির বাহিরে কোনো ছেলের সাথে থাকে তাহলে তো মানুষ নিশ্চয় তাদের ভাইবোন ভাববে না। ”

“এই আমাদের সমাজের সবার না একই সমস্যা কোনো একটা ছেলে মেয়েকে একসাথে দেখলো কি দেখলো না এরমধ্যে মনগড়া একটা সম্পর্ক জুড়ে দিয়ে পুরো বাড়ি রটিয়ে বেড়ায়। আর বলে মেয়েটা খারাপ। অথচ একবারও এটা ভাবে না যে ছেলেমেয়ে গুলো সত্যিই ভাইবোন হতে পারে অথবা তাদের মধ্যে কোনো বন্ধুত্বপৃূর্ণ সম্পর্কও থাকতে পারে?যেগুলো আমাদের যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করে নিতে হয়। সবাই পারে না।”

শান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“মানে?”

আমি মুচকি হেসে বললাম,
“মানে আপনি যাকে দেখেছিলেন সেটা সৃজন ছিল।”

শান অবাক হয়ে বললো,
“হোয়াট?”

“জ্বী। সৃজনকে আমি একটা মোটা দড়ি আনতে বলেছিলাম যেটা দিয়ে আমার রুম থেকে ফেললে নিচ পর্যন্ত নাগাল পাওয়া যায়। আমি জানতাম আপু বাবাকে বলতে পারবে না আর আরশ ভাইয়াকেও আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয় তাই পালিয়ে যাওয়াই শ্রেয় তাই প্লান’ বি ‘ছিল এটা আমার।আর সৃজন সেদিন হলুূদের অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে দড়িটা যোগার করে সেটা দেওয়ার জন্যই বাড়ির বাহিরে অপেক্ষা করছিলো ওত রাতে। কারণ সবার সামনে তো সেটা দেওয়া সম্ভব নয়। ”

আমার কথা শুনে এবার শানও ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। শান হেসে নিজের একহাত কপালে ঠেঁকিয়ে বললো,

“সিরিয়াসলি আর আমি সেদিন তোমাদের দুজনকে দেখে এসে এত পরিমাণ রেগে ছিলাম যে সেদিন রাতে বাবা একটা কাজ করতে পাঠিয়েছিলেন সেটা পর্যন্ত কমপ্লিট করিনি। বাসায় এসে সবার সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করেছিলাম সাথে নিজের রুমে সব ভেঙে চুরে চুরমার অবস্থা করেছি।এতটাই রেগে ছিলাম তোমার উপর। কেন তুমি আমার ভালোবাসাটা বুঝতে পারলেনা? আমার শুধু মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলছি সেদিন যদি আরশ না পালাতো তাহলে হয়তো আমি বিয়ের আসরেই সবার সামনে বলে বসতাম আমি তোমাকেই বিয়ে করতে চাই। বিয়ের পর ভেবেছিলাম তোমাকে অন্যকারো সাথে জড়ানোর শাস্তি দেবো বাট আফসোস তোমার ঐ মুখটা যতবার দেখেছি ততবারই দূর্বল হয়ে পড়েছি। আমার মনে হয়নি কখনো যে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারো আমাকে ছাড়া।কারণ তোমার জন্ম শুধু আমার জন্য। যার কারণে ঐ প্রথম দিনের পর আর সম্ভব হয়নি খারাপ ব্যবহার করার। ”

আমি “দ” স্টাইলে বসে দুইহাত হাটুতে রেখে চোখ ছোট ছোট করে শানকে প্রশ্ন করলাম,
“বাই দ্যা ওয়ে মনে করেন সেদিন আপনার ভুল ছিল বাট যদি এমন কখনো হয় আমি আপনার সাথে থাকতে চাই না বা অন্যকারো প্রেমে পড়ি তখন? ”

কথাটা বলতেই এতক্ষনে শানের হাসিখুশি মুখটা এক মুহূর্তে আধারে ঢেকে গেল। উনি রেগে আমার হাত ধরে টেনে আমাকে বিছানায় শুয়ে হাত দুটো বিছানায় চেপে ধরলেন। নিমিষেই আমার হাসিটা মিলিয়ে গেল।

“এত শখ কেনো এখনো অন্য ছেলের। তোমাকে বলেছিলাম না একদিন এমন কথা না বলতে। তুমি চাইলেও আমার সাথে থাকবে আর না চাইলেও। তারপরেও অন্য ছেলের কথা মাথায় আসে কি করে। আজ তোমার এমন হাল করব যে দ্বিতীয়বার আমি ছাড়া অন্যকোনো ছেলের কথা মাথায়ও আসবে না। ”

হঠাৎ উনাকে এতো রাগতে দেখে আমি ভিত কন্ঠে বললাম,
“স্যরি আমি তো মজা করছিলা…..।”

উনি আমার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দিলেন আর আমার গলায় নিজের মুখ ডুবিয়ে দিলেন।


৪ বছর পর,

“আরিশ বাবা দাঁড়া উফ এভাবে দৌঁড়াতে পারবো না আমি। ”
“ধলো পারলে আমালে ধলো। ”

এভাবে আধো আধো কন্ঠে বলে চলেছে আর দৌঁড়ে চলেছে আরিশ। আর আমিও আরিশের পিছনে ছুটে চলেছি ওকে ধরার উদ্দেশ্যে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হঠাৎ পা পিছলে পড়তে নেবে তখনই আমি গিয়ে ওকে ধরে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আরিশও ভয় পেয়ে গেছে ও আমার গলা জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষন পর আমি ওকে আমার চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে রেগে বললাম,

“এখনি কি হতো পড়ে দাঁত মুখ ভেঙে যেত তারপর নিজেও বকা শুনতি আমাকেও শুনাতি বললাম দাঁড়া এভাবে কেউ দৌঁড়ায়? ”

আরিশ ঠোঁট ফুলিয়ে মন খারাপ করে বললো,
“থলি(স্যরি)। ”

ওর এই আধো আধো বুলিতে স্যরি শুনে আর মুখ দেখে চোখের পলকেই আমার রাগ গলে জল হয়ে গেল আর আমি হেসে দিলাম।

আরিশ মাথা তু্লে বললো,
“তুমি লাত (রাগ) তরোনিতো(করোনিতো?”
আমি ওকে কোলে তুলে বললাম,
“এমন একটা গোলুমোলু মিষ্টির দোকানের সাথে কেউ রাগ করে থাকতে পারে তবে যদি সে আমাকে একটা ভালোবাসার পরশ দেয় তাহলে আমার রাগটা পুরোপুরি ভেঙে যাবে। ”

কথাটা বলতেই আরিশ আমার গালে নিজের ঠোঁট ছুয়ে দিলো তারপর নিজেও আমাকে তার গালের দিকে ইশারা করতেই আমিও ওর গালে একটা আদর দিলাম।

তখনই স্মৃতি আপু পিছনে এসে বললো,
“কি এতো ফিসফিস হচ্ছে দুই চাঁচি আর ভাতিজা মিলে হুম। ”

আপুর কথা শুনে আমি পিছনে ফিরে তাকালাম আর দুজনের মুখেই একটা হাসি ফুটে উঠল। হ্যাঁ আরিশ স্মৃতি আপু আর আরশ ভাইয়ার ছেলে। ভাইয়ার নামের সাথে মিল রেখে আরিশের নামকরণ করা হয়েছে । আরিশের বয়স এখন আড়াই বছর । দেখতে একদম নিজের বাবা মায়ের কার্বন কপি মাশাআল্লাহ । এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে যেন সারাদিন হা করে তাকিয়েই থাকতে মন চায়।

দেখতে দেখতে চারবছর কেঁটে গেছে। সময় কতো দ্রুত চলে যায়। এই চার বছরে সবার জীবনেই নতুনত্বের ছোঁয়া এসেছে।আপুর কোল জুড়ে আরিশ এলো। একমাস হলো আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স কম্প্লিট করেছি। অনার্স কম্প্লিট হওয়ার পর কথা মতো আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা শিফট করি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে এডমিশন নেই। এখন সবাই আমরা একই সাথে একই বাড়িতে থাকি। সারাদিন আমরা তিন ঝাঁ মিলে হাসি মজা মাস্তিতেই দিনটা কেঁটে যায়। ইদানীং মায়ের শরীরটা ভালো নেই তাই তিনি আমাদের আড্ডায় অংশ নিতে পারে না তবে মা থাকলে তিনিই পুরো আড্ডা জমিয়ে দেয়। তারউপর এখন তো আরিশের সাথেই খুনশুটিতে সময় চলে যায়।

ঐশী আর তিমির ভাইয়া তিনবছর আগেই অষ্ট্রেলিয়ায় শিফট হয়ে গেছে। ওদের বিজন্যাসও ওখানেই শিফট করে নিয়েছে। ঐশীর এখানে থাকলে পুরনো স্মৃতি গুলো মনে পড়ে কষ্ট হয় তাই চলে গেছে শানের চোখের আড়ালে। ওদেরও একটা মেয়ে হয়েছে তৃমিশা। মেয়ে নিয়ে বেশ ভালোই আছে।

শান, আরশ ভাইয়া, সাম্য ভাইয়া সবাই আগের থেকে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাবা বিজন্যাস থেকে পুরোপুরি ছুটি নিয়ে নিয়েছে যার কারণে সব দায়িত্ব এসে পড়েছে ওদের উপর। হয়তো আগের মতো এতো সময় দিতে পারে না তবে আমাদের ভালোবাসা একবিন্দুও কমেনি।সাথে শানের কেয়ার তো যেন বেড়েই চলেছে। অফিসে থাকলেও যখনই সময় পায় ফোন দিয়ে আমার খবর নেয় পারলে তো প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় কল দেয়।এজন্য ফোন সবসময়ই নিজের কাছেই রাখতে হয়। শান আগেও যেমন ছিল এখনও তেমনই আছে একটুকুও চেন্জ হয়নি। শুনেছি সময়ের সাথে নাকি ভালোবাসাও কমতে থাকে কিন্তু আমার মনে হয় এখন আগের থেকে আরো বেশীই ভালোবাসে শান আমায় এতটা চোখে হারায়।

আমাদের পুষ্পও অনেক বড় হয়ে গেছে এখন নয় বছরের হয়ে গেছে সে আর আগের থেকে অনেক পাঁকা বুড়িও। রোজ রোজ নতুন কাহিনী করে স্কুল থেকে ফিরে আর খুব উৎসাহ নিয়ে এসে সেসব আমাকে শুনায় আর না শুনতে চাইলেও জোর করে শুনাবেই সে। এভাবেই সবার জীবন একদম খুশিতে পরিপূর্ণ হয়ে বিন্দাস চলছে।

আমি আপুর কাছে গিয়ে বললাম,
“রান্না শেষ? ”
“হুম অলমোস্ট শেষ বাকিটা রহিমা আন্টি দেখে নিবে। তা কি ফিসফিস চলছিল দুজনে মিলে বললি না কিন্তু।”
আমি আর আরিশ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ইনোসেন্ট ভঙ্গিতে বললাম,
“কি হবে কিছু না। তাই তো আরিশ সোনা। ”

আরিশ আমার কথায় সায় দিয়ে দুই তিনবার জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালো। আপু গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“মিথ্যে বলে লাভ নেই আমি কিন্তু সব দেখেছি? ”

আমি আর আরিশ একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে মাথানিচু করে নিলাম। আপু আরিশকে আমার কাছে থেকে নিয়ে বললো,
“কতবার বারণ করেছি না এসব দুষ্টমি না করতে কথা শোনো না কেন তুমি?এখন যদি পরে হাত পা ভাঙে তারপর আর কেউ মেয়ে দেবে?”

আরিশ মুখ উঁচু করে আধো আধো কন্ঠে বললো,
“দিবে। মেত(মেঝ) মণির মেয়েতে(মেয়েকে)দিবে আমি ওতেই(ওকেই)বিয়ে তলব(করব)। ”

আপু দুই গালে হাত দিয়ে মুখটা ইংরেজি “ও” বর্ণের মতো করে বললো,
“সর্বনাশ যার আসার এখনও খবর নাই তাকে বিয়ে করার জন্য আগে থেকেই লাইন দিয়ে ফেলেছিস তুই। ”

আরিশ কি বুঝল জানি না ও শুধু হাসল ওর হাসি দেখে আমরা দুজনেই হেসে দিলাম। তারপর আমরা দুজনেই আরিশকে নিয়ে কিছুক্ষন মজা করলাম।

তখনই আপু বললো,
“ভূমিকা আপু এখনও আসেনি পুষ্পকে নিয়ে?”
“না। ”
“এতো লেইট যে আজ?”

কথাটা বলতে না বলতেই পুষ্প দৌঁড়ে এসে আরিশকে জড়িয়ে ধরল পুষ্পকে দেখে আরিশও অনেক খুশি হয়ে গেল। হয়তো দুজনেই কাজিন তবে পুষ্প আরিশকে এতটা ভালোবাসে যে মনেই হয় না এরা কাজিন। পুষ্প বাসায় থাকলে আরিশের আর কাউকে প্রয়োজন হয়না সারাদিন পুষ্পর সাথে খেলাধুলা, খুনসুটিতেই কেঁটে যায়। ভূমিকা আপু এসে সোফায় বসল।

“বাবা এই মেয়ে ছোট বেলা থেকই আমাকে একের পর এক পেইন দিচ্ছে কখনো শান্তিতে থাকতেই পারেনা এতটা বড় হয়েছে তারপরও ওর জন্য কমপ্লেইন শুনতে শুনতে শেষ আমি। ”

আমি বললাম,
“কেন কি করল আবার পুষ্প?”

“কি করেনি তাই বলো ওদের স্কুলের একটা ফুলের বাগান আছে সেখানে লেখা ছিল ফুল ছিড়লে পাঁচশত টাকা জরিমানা। এরপরেও সেই মেয়ে ওখান থেকে ফুল ছিঁড়ে নিয়েছে। আর ওকে যখন ডাকা হলো কি বললো শুনবে ‘ওখানে কোথাও তো লিখা ছিল না ফুল ছিঁড়া মানা শুধু বলেছে জরিমানা। তো আমার বাবার অনেক টাকা আছে সেখানে পাঁচশত কেন একহাজার দিতেও আপত্তি নেই তাই আমার যেই ফুল ভালো লাগবে আমি সেটাই ছিঁড়ব’ এজন্যই স্কুলে আমাকে ডেকে পাঠিয়ে ছিল। ”

ভূমিকা আপু কথা শুনে আমি আর স্মৃতি আপু হেসে দিলাম।স্মৃতি আপু বললো,
” ঠিকই তো আছে ওখানে লিখতে হতো তো ফুল ছিঁড়া মানা ওরই বা কি দোষ। ”

“না স্মৃতি তুমি আর ওকে তাল দিও না এমনিতেই পুরো বিগড়ে গেছে মেয়ে আরও লাই দিলে মাথা উঠে যাবে। ”

ওদের কথা শুনে আমি পুষ্পকে কাছে ডেকে বললাম,
“সোনা তোমাকে বলেছিলাম না স্কুলে গিয়ে দুষ্টমি না করতে তারপরেও করেছো কেন?”

“দুষ্টমি করিনি শুধু ফুল নিয়েছি। ”

“উহুম সেটাও অন্যায়। দেখো তোমার যেই প্রিয় টেডিটা আছে ওটাকে তো তুমি অনেক ভালোবাসো কাউকে ধরতে দেও না এখন কেউ যদি সেটা ক্ষমতার জোরে তোমার অনুমতি ছাড়া ধরে তাহলে তোমার কেমন লাগবে?”

পুষ্প মন খারাপ করে বললো,
“অনেক খারাপ লাগবে।”

আমি মুচকি হেসে বললাম,
“তেমনি ওদেরও খারাপ লেগেছে যখন তারা বারণ করার পরেও তাদের অনুমতি ছাড়া ফুলটা ছিঁড়েছো। দেখো সোনা টাকাটা বড় না বড় হচ্ছে মানুষের সেই জিনিসটার প্রতি ভালোবাসা, টান, অনুভুতি সেখানে আঘাত করা কি অন্যায় নয়? ”

পুষ্প হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। আমি আবারও বললাম,
“এইবার দেখো তোমার ওই টেডিটার যদি একটা চোখ, বা নাক তুলে নেওয়া হয় তাহলে কি ওই টেডিটার আর সৌন্দর্য থাকে? ”

“না। ”

“তেমনি ফুল গাছে থাকলেই দেখতে সবথেকে বেশী সুন্দর লাগে ছিঁড়ে ফেললে তারসহ পুরো গাছটারই সৌন্দর্য নষ্ট হয়।তাকে আর কোথাও মানায় না। বুঝলে তাই এরপর থেকে আর এমনটা করবে না কেমন?”

“ওকে মিষ্টি। ”

“গুড গার্ল এবার গিয়ে ফ্রেস হয়ে নেও যাও। ”

পুষ্প চলে গেল সাথে করে আরিশকেও নিয়ে গেল। স্মৃতি আপু বললো,
“তোর মতো পুষ্পকে আর কেউ বুঝাতে পারে না।এতো সুন্দর করে বুঝাস যে বুঝতে বাধ্য ”

ভূমিকা আপু মন খারাপ করে বসে আছে আমি উনাকে শান্তনা দিয়ে বললাম,
“ব্যাপার না আস্তে আস্তে বয়সের সাথে ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না। ”

ভূমিকা আপু গম্ভীর কন্ঠেই বললো,
“আর ঠিক হবে এই মেয়ে বড় হলে একদম স্বৈরাচারী হবে দেখো সবাই। ”

আপু ভূমিকা আপুর মন ভালো করতে হঠাৎ বলে উঠলো জানো তো আরিশ কি বলেছে একটু আগে। তারপর আপু সব কিছু খুলে বললো। ভূমিকা আপু কথাটা শুনে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে হাসার উপক্রম।

তারপর আমাকে বললো,
“দেখেছো তোমার মেয়ে এখনও পৃথিবীতে আসেইনি তার আগেই বর রেডি এবার তো মেয়েকে পৃথিবীতে আনা প্রয়োজন কোনো প্লান করেছো? ”

আমি একটু লজ্জা পেয়ে হেসে বললাম,
“এখনো আমার স্ট্যাডি কমপ্লিট হয়নি তাই কোনো প্লান করিনি। ”

ভূমিকা আপু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আর কবে প্লান করবে কে জানে বিয়ের চারবছর হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতিকে দেখে কিছু শেখো তোমাদের কত পরে বিয়ে করেও ওর বাচ্চার বয়স আড়াই বছর আর তোমরা কি করছো লজ্জা থাকা উচিত। ”

ভূমিকা আপুর কথা শুনে আমি লজ্জা পেলাম।আপু তো এমন ভাবে আমাকে বলছে যেন সব দোষ আমার একার এখন নিজের মুখে বাচ্চার কথা শানকেই বা কিভবে বলব যদি সে কিছু না বলে? তখনই পুষ্প উপর থেকে চিল্লিয়ে বললো,

“মিষ্টি তোমার ফোন বাজছে হয়তো শান ফোন করেছে।”

আমি কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়ালাম উপরে যাওয়ার জন্য । হঠাৎ উঠে দাঁড়াতেই আমার মাথাটা কেমন ঘুড়ে উঠলো। আমি মাথায় হাত দিয়ে পরে যেতে নিতেই আপুরা ধরে ফেললো।

স্মৃতি আপু বললো,
“কি রে কি হয়েছে তোর? ”
ভূমিকা আপু বললো,
“ঠিক আছো? ”
আমি একটু বসে দুইমিনিট চোখ বন্ধ করে রইলাম তারপর দুজনকে শান্ত করার জন্য বললাম,
“ঠিক আছি সম্ভবত এতক্ষন বসে ছিলাম তাই এমন হয়েছে তোমরা বসো আমি আসছি। ”

কথাটা বলেই আমি আস্তে আস্তে উপরের দিকে পা বাড়ালাম। এখন এদের কি করে বলবো ইদানীং এমন মাঝে মাঝেই হচ্ছে বললে শুধু শুধু টেনশন করবে।


রাত আটটা বাজে শান ফিরে আসে।কয়েকদিন ধরে উনার আসতে এমনই লেইট হয়।হয়তো কাজের চাপ বেশী। প্রতিদিনের মতো শান আসার পরই আমি উনার কোট, টাই সব খুলে দিলাম।

শান আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কেমন কাঁটলো আজ সারাদিন? ”

“এইতো প্রতিদনের মতো কেঁটে যাচ্ছে। আপনার কাজকর্ম কেমন চলছে? ”

“ভালোই একটা প্রজেক্ট নিয়ে কিছুদিন এতো বিজি আছি যে তোমাকে ঠিক মতো সময়ই দিতে পারছি না। তুমি রাগ করছো না তো?”

আমি হেসে বললাম,
“একদমই না। কেন রাগ করব এতো কাজের মাঝেও আপনি আপনার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন। আমার এতো যত্ন করছেন তারপরও কেন রাগ করব? ”

শান আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো,
“আমাকে বুঝার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা আমার মিষ্টি বউটা। ”
“আচ্ছা আপনি গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসুন আমি কফি নিয়ে আসছি। ”

তারপর আমি গিয়ে উনার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আসলাম। শান ফ্রেস হয়ে সোফায় এসে বসল আমি উনার দিকে কফি বাড়িয়ে দিতেই শান কফিটা হাতে নিয়ে আমাকে টেনে উনার সামনে বসিয়ে দিলো।

আমার একগালে হাত দিয়ে বললো,
“কি হয়েছে তোমার কিছুদিন ধরে তোমাকে একটু উইক দেখাচ্ছে? শরীর খারাপ নাকি?”

কি বলবো বুঝতেছি না। কিছুদিন ধরেই এমন দূর্বল দূর্বল লাগছে। মাথা ঘুরানো, ঘাড় ব্যাথা, মাঝে মাঝে তো খেতেও পারিনা তেমন একটা। কিন্তু এখন এটা বললেই শুরু হয়ে যাবে শানের বকা ঝকা তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।

আমি একটু হেসে বললাম,
“কিছু হয়নি ঠিক আছি। ”

“শিউর?কিছু লুকাচ্ছো না তো? ”

আমি একটু ভিত কন্ঠে বললাম,
“না।”
.#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৪৪
#সুরাইয়া_নাজিফা

সকালে ঘুমিয়ে ছিলাম হঠাৎ শরীরে প্রচন্ড অস্বস্তি হতেই উঠে বসলাম। কেমন গা গোলাতে লাগলো তাই ধাক্কা দিয়ে শানের হাত সরিয়ে দিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলাম। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে এমন হওয়ায় শান দ্রুত উঠে পড়ে আর দৌঁড়ে আমার পিছনে ওয়াশরুমে আসে। কল ছেড়ে কুলি করে মুখটা ধুয়ে নিলাম।আমি পাশ থেকে টাওয়ালটা নিতে পা বাড়াতে যাবো তখনই মাথাটা আবার ঘুরে উঠতেই শান পিছন থেকে আমাকে ধরে ফেললো। আমি শানের বুকে মাথা রাখলাম কিছুক্ষন।

“কি হয়েছে তোমার? ”

শানের এমন গম্ভীর কন্ঠো শুনে আমি আস্তে আস্তে নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম আর নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম,

“কই কিছু না। ”
“আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো কালকে তুমি আমার সাথে মিথ্যা বলেছো তোমার শরীরটা ভালো নেই তাই না। ”

শান অস্থির হয়ে আমার কপালে, গলায় হাত দিয়ে দেখল,
“কই জ্বর তো নেই তবে?”

আমি কোনো কথা না বলে চুপ হয়ে আছি। কি যে আছে আমার কপালে। দেখে তো মনে হচ্ছে প্রচুর রেগে আছে। আমাকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে শান প্রচন্ড পরিমানে রেগে গিয়ে ধমক দিয়ে বললো,

“কি হলো চুপ করে আছো কেন আন্সার মি। ”

শানের ধমক শুনে একটু কেঁপে উঠলাম আমি শান আমার ডান বাহু শক্ত করে ধরে বললো,
“এই ঠিক করে বলোতো খাওয়া দাওয়া করছো তুমি এই কয়দিন যাবৎ ঠিক মতো। ”

সর্বনাশ করেছে। এই কয়দিন ধরে তো সত্যি সত্যিই আমি ঠিকঠাক মতো খাওয়া দাওয়া করিনা। আমারই বা কি দোষ খেতে পারলে তো খাবো।শান আনাকে চুপ থাকতে দেখে নিজের কোমড়ে একহাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“এখনও বাচ্চাদের মতোই সবসময় তোমার পিছনে যতক্ষন খাবার নিয়ে দৌঁড়ানো যায় ততক্ষন ঠিকঠাক থাকো এই কয়দিন কাজে ব্যস্ত বলে তোমার খাওয়ার দিকে নজর দিতে পারিনি এজন্য না খেয়ে শরীরের এই অবস্থা করেছো তাই না। ”

আমি আমতা আমতা করে বললাম,
“উফ সকাল সকাল এতো চিৎকার চেঁচামেচি করছেন কেন আপনি?বাড়িসহ মাথায় তুলে ফেলবেন নাকি?কিছু হয়নি আমার। ”

শান অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“গলা তুলে আর একটা বললে ঠাঁটিয়ে এক চড় মারব। আমি দেখতে পাচ্ছি ঠিক আছো কি নাই তোমাকে বলার প্রয়োজন নেই। কালকে রাতেও মিথ্যা বলেছো তুমি। ”

শানকে এতো রাগতে দেখে আমার কান্না পাচ্ছিল। আমি গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরলাম।

শান রেগে বললো,
“ছাড়ো আমাকে। ”

আমি ঝাপটে ধরেই বললাম,
“না। ”

শান কিছু না বলে চুপ করে রইল কিন্তু আমাকে ধরল না। আমি উনার গালে আমার ঠোঁট ছোঁয়ালাম। মন খারাপ করে ধরা গলায় বললাম,
“স্যরি তো আমি আপনাকে টেনশন দিতে চাইনি এতো কাজের প্রেশারে থাকেন এই কয়দিন।”

এবার শানও আমাকে জড়িয়ে ধরল। জড়িয়ে রেখেই বললো,
“তোমার থেকে বেশী আমার লাইফে আর কোনো কিছুই ইমপর্টেন্ট নয়। তুমি টেনশন দিতে না চাইলেও আমি সারাদিন তোমার টেনশনেই থাকি সেটা কি তুমি জানো। তুমি খাচ্ছো কিনা, নিজের খেয়াল রাখছো কিনা সেটা ভেবেই অস্তির হয়ে থাকি। কারণ আমি জানি তুমি বেখেয়ালি। শুধু শুধু এই নামে ডাকি না আমি তোমায়।”

কিছুক্ষন আমি শানের বুকেই মাথা দিয়ে রইলাম। শান আমাকে কোলে তুলে নিল। এখন আর কিছু বললাম না কারণ এখন কিছু বললেই বকা খাবো। শান আমাকে কোলে তুলে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসপ আমাকে বেডে বসিয়ে দিলো।

“এখন ঠিক লাগছে শরীর? ”

আমি ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“হুম। ”

“ওকে রেডি হয়ে নেও?”

আমি চমকে উঠে বললাম,
“রেডি হবো কেন?”

“ডাক্তারের কাছে যাবো।”

“ডাক্তারের কাছে কেন?কার কি হয়েছে?এই আপনি ঠিক আছেন তো?”

শান আমার দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললো,
“জাস্ট শাট ইউর মাউথ সোহা আমার কি হবে তোমাকে দেখাবো। ”

আমি ইনোসেন্ট ভাবে তাকিয়ে বললাম,
“দেখুন আমার কিছু হয়নি যাবোনা আমি। ”
শান কাবার্ড থেকে নিজের প্যান্ট শার্ট বের করতে করতে বললো,
“তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি যা বললাম করো দ্রুত রেডি হও। ”

কথাটা বলেই উনি ওয়াশরুমে চলে গেল। ধ্যাত যে জন্য বলতে চাইনি সেটাই হলো এখন পুরোপুরি রোগী বানিয়ে ছাড়বে।


সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে ছিল সাথে আমরা এসে যোগ দিলাম। আমাকে সকাল সকাল এমন বাহিরে যাওয়ার জন্য রেডি দেখে মা বললো,
“কিরে কোথায়ও যাচ্ছিস নাকি সোহা?”

আমি কিছু বলার আগে শান বললো,
“হুম ডাক্তারের কাছে।”

বাবা ব্যস্ত হয়ে বললো,
“কেন কার কি হয়েছে?”

শান চেয়ার টেনে বসে বললো,
“সোহা অসুস্থ। ”

স্মৃতি আপু অবাক হয়ে বললো,
“হঠাৎ অসুস্থ মানে? কালকে পর্যন্ত তো সুস্থই ছিল। ”

আপু আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
“কি হয়েছে বাবু তোর।”

শান স্মৃতি আপুকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
“তোমার বোনকে তো তুমি চেনো স্মৃতি মরে গেলেও কাউকে মুখ ফুঁটে কিছুই বলবে না। ”
আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম,
“কিছুই না উনি একটু বেশী বেশী করছে। শরীরটা একটু দূর্বল লাগে কিছুদিন ধরে এজন্যই এখন ধরে বেঁধে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। ”

আমার কথাটা শুনে শান রক্তচোখে আমার দিকে তাকালো শানের তাকানো দেখে আমি নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ হয়ে খাওয়া শুরু করলাম।কিছুটা খেতেই আর খেতে ইচ্ছা করছিলো না তাই প্লেটটা ঠেলে উঠে দাঁড়ালাম।

“কি হলো কই যাও খাওয়া ফেলে?”
“খাবো না আর।”
শান চোখ দেখিয়ে বললো,
“একটু খাবারও প্লেটে দেখতে চাই না শেষ করো পুরোটা। ”
“প্লিজ না খেতে পারছি না। ”
“কোনো কথা শুনতে চাইছি না খাও। ”

আর কি করার খেতে বসে গেলাম আবারও শানকে মনে মনে বকা দিতে দিতে। কিন্তু দুই একবার মুখে দিতেই ভিতর থেকে সব ঠেলে আসতে চাইছে এমন অবস্থা।

শান গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“দেখেছো না খেয়ে কি করেছো শরীরের।”

ভূমিকা আপু আমার সামনাসামনি বসে গালে হাত দিয়ে গোলগোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শানের উপর তো আর রাগ দেখাতে পারছি না তাই ভূমিকা আপুর তাকানো দেখে আমি একটু তেঁতে বললাম,
“কি হয়েছে ওভাবে কি তাকিয়ে আছো কেন?মজা নিচ্ছো?”

আমার কথা শুনে ভূমিকা আপু একটু হেসে বললো,
“না ভাবছি হঠাৎ তোমার এমন কি হয়ে গেল যে খেতেই পারছো না আমার তো অন্যকিছু মনে হচ্ছে।”

শান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আর ভাবা ভাবির কাজ নেই। সোহা উঠো লেইট হচ্ছে। ”

আমি উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে বলে শানের পিছু চললাম। কিছুটা গিয়ে শান আবার দাঁড়িয়ে পড়ল আর আরশ ভাইয়াকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
“আমার অফিসে যেতে লেইট হবে সব সামলে নিস ভাইয়ার সাথে। ”
“ওকে টেনশন নিস না। ”

তারপর আমি আর শান দুজনেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম।


ডাক্তারের কাছে আসার পর বেশ কিছুক্ষন সময় নিয়ে আমার চেকাপ করল। শান আমার সাথেই ছিল। যদিও আমাকে চেক করার সময় শানকে বলেছিল বাহিরে যেতে কিন্তু সে তো নাছড় বান্দা যাবে না মানে যাবেই না। উনার মুখটা কেমন কালো হয়ে আছে হয়তো একটু বেশীই চিন্তা করছে শান আমাকে নিয়ে এখন আমার নিজেরও খারাপ লাগছে এজন্যই বলতে চাইনি। চেকাপ করার পর ডাক্তার বললো উঠে আসতে। আমি উঠে গেলাম। তারপর আমরা দুজনেই ডাক্তারের সামনে দুটো চেয়ার টেনে বসে গেলাম।

ডাক্তার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বিয়ে হয়েছে কত বছর?”
শান বললো,
“চার বছর চারমাস। ”
ডাক্তার একটু হেসে বললেন,
“অনেক ভালোবাসেন নিজের ওয়াইফকে তাই না?”

ডাক্তারের কথা শুনে আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। শান কোনো দ্বিধা ছাড়াই বললো,
“নিজের থেকেও বেশী। ”
আমি শানের দিকে তাকালাম। ডাক্তার আবার বললো,
“হুম আপনাকে দেখেই বুঝা যায়। তো বেবী আছে আপনাদের।”
“না।”
“কেন প্লান করেননি? ”
“আসলে ওর এখনও স্ট্যাডি চলছে তাই। ”

ডাক্তারের এসব কথার আগা মাথা কিছুই মাথায় ডুকতেছে না। এসব প্রশ্ন কেন করছে উনি? শুধু নিরব দর্শক হয়ে দেখে যাচ্ছি সব। ডাক্তার শানের কথার প্রতি উত্তরে বললো,
“ওহ।আচ্ছা এখানে কিছু টেস্ট দিয়েছি এগুলো করিয়ে কালকে দেখা করবেন। ”

“কি হয়েছে সোহার? ”

ডাক্তার হেসে বললো,
“অনেক বড় অসুখ হয়েছে তবে সেটা কালকে রিপোর্ট দেখে শিউর ভাবে বলতে পারবো। তবে আপাদত ওনার খাওয়া দাওয়ার দিকে একটু বিশেষ নজর দিবেন। অনেক দূর্বল উনার শরীর। ”

ব্যাস এটাই বাকি ছিল বলার। শান আমার দিকে তাকাতেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম তারপর ডাক্তারের কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম। সেখান থেকে একেবারে টেস্ট করিয়ে নিলাম। টেস্টের রেজাল্ট কালকে দিবে। আমরা দুজনেই হাসপাতালের বাহিরে এসে দাঁড়ালাম।

শান বললো,
“তুমি একটু দাঁড়াও আমি গাড়িটা পার্কিং থেকে নিয়ে আসছি। ”
“আচ্ছা। ”

শান চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ বলে উঠল,
“সোহা।”

হাসপাতালের মধ্যে নিজের নাম কোনো পরিচিত মানুষের কন্ঠে শুনতে পেয়ে অনেকটাই অবাক হলাম আমি। পিছনে ঘুরতেই যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তাকে দেখে মোটেও বিশ্বাস হচ্ছে না।আবারও পুরোনো ভয়টা জেগে উঠল। আমার অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল,
“রায়ান ভাইয়া। ”

রায়ান একটু হেসে বললো,
“যাক তাও ভালো আমাকে এখনও মনে রেখেছো আমি তো ভেবেছি ঐদিনের পর আর মনেও রাখবে না। ”

উনার কথা শুনে আমার একটু খটকা লাগল তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
“আপনাকে মনে না রাখার মতো কোনো ভুল তো আপনি করেননি তাহলে কেন ভুলে যাবো। ”

রায়ানের চোখে মুখে অপরাধের ছাপ একদম স্পষ্ট হয়ে আছে। রায়ান মাথা নিচু করেই বললো,
“সত্যিই সোহা তোমার মন অনেক বড় যে এত সহজে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো। সত্যি বলতে ঐদিনের পর আমি নিজেও ভালো নেই। এই একটা অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আমি তোমার ভালোবাসায় না ভালোবাসা না ভালোবাসা হলে হয়তো তোমার ক্ষতি করার চিন্তা করতাম না। আসলে আমি তোমার সৌন্দর্যে এতটাই অন্ধ হয়ে গেছিলাম যে ঠিক ভুলের পার্থক্যই করতে পারিনি। তোমাকে নিজের করার জন্য কতটা নিচে নেমে গেছিলাম ভাবলেই নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হয়। ভাগ্যিস ঠিক সময় মতো সেদিন যদি শান না আসতো তাহলে তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হওয়ার কারণটা আমিই হতাম। পরবর্তীতে আমি অনুভব করেছি আমি কি পাপ করতে যাচ্ছিলাম তোমার আর শানের সম্পর্কটা নষ্ট করতে চাইছিলাম তেমার জীবন নষ্ট করতে চেয়েছিলাম যাইহোক শেষ মূহূর্তে আমি বেঁচে গেছি এই পাপ করা থেকে। তবে আমি সত্যি ক্ষমাপ্রার্থী। তুমি ক্ষমা না করলে আমি কখনোই শান্তিতে থাকতে পারবো না। প্লিজ সোহা ক্ষমা করে দেও আমাকে। ”

আমি উনার কথার অর্থ বুঝলাম না উনি কিসের জন্য অনুতপ্ত আর কেনই বা এতটা দোষি মনে করছে। উনি তো আমার সাথে তেমন কিছু করেনি শুধু একটু বিরক্ত অনুভব করতাম উনার এই গায়ে পড়া স্বভাবে বাট উনি যেভাবে বলছে তাতে তো মনে হচ্ছে উনি অনেক বড় কিছু করেছে। আমি একটহ ইতস্তত করে বললাম,

“ভাইয়া আপনি কি বলছেন আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কাইন্ডলি বিষয়টা একটু খুলে বলবেন কি? ”

সোহার কথা শুনে রায়ান বেশ অবাক হলো নিজের বিষ্ময় নিয়ে বলে উঠল,
“কেন তানিশার পার্টির কথা মনে নেই তোমার? ”
“তো কি হয়েছে তাতে?”

সোহার এমন পাল্টা প্রশ্ন শুনে রায়ানের আর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে সোহা সেদিনের ঘটা কোনো ঘটনাই জানে না হয়তো কেউ বলেনি? যাক ভালোই হয়েছে।রায়ান ভাবলো তাহলে সেই রাতের কথা নাহয় সোহার না জানাই থাক।

রায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথা ঘুরিয়ে বললো,
“না তেমন কিছুই হয়নি। আচ্ছা এসব কথা বাদ দেও তোমার খবর কি? তুমি হাসপাতালে কেন? অসুস্থ নাকি?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“একটু অসুস্থ? ”

“কি বলো কি হয়েছে?”

“জানি না কালকে রিপোর্ট দিলে বুঝতে পারব। তা আপনি বাংলাদেশে কবে এলেন আমি যতটা শুনে ছিলাম আপনি তো চলে গেছিলেন না দেশ থেকে? ”

রায়ান একটু হেসে বললো,
“হুম চলে গেছিলাম নিজের করা কিছু ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে তবে এই একবছর হলো দেশে ফিরেছি। চলে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু কাল রাতেই আমার ওয়াইফের লিভার পেইন ওঠে যার কারণে ওকে এখানে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। ”

“ওহ কি হয়েছে উনার? প্রেগন্যান্ট ছিলো কি?”

“হুম ছেলে হয়েছে। ”

রায়ান ভাইয়ার কথা শুনে আমি অনেক খুশি হলাম। যাক অবশেষে উনিও নিজের জীবনে ভালো আছে খুশি আছে।

আমি হেসে বললাম,
“কনগ্রাচুলেশন। ”

“ধন্যবাদ।এসো না ভিতরে এসে আমার বেবী আর ওয়াইফকে দেখে যাও। ”
আমি একটু মন খারাপ করে বললাম,
“আসলে ভাইয়া আমি শানের সাথে এসেছি আর শান গাড়িটা আনতে গেছে পার্কিং থেজে এসে যদি আমাকে না দেখতে পায় অনেক রাগ করবে বুঝতেই তো পারছেন। ”

“ওহ আচ্ছা তাহলে কোনো একসময় এসে দেখে যেও আর আমার ছেলের জন্য দোয়া করো। ”

“অবশ্যই।”

রায়ান ভাইয়া এমন কিছু টুকটাক কথা বলে চলে গেলেন।আমি উনাকে হাসিমুখে বিদায় দিলাম। যাক মানুষটা আগের থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু উনার কিছুক্ষন আগে বলা কথা গুলো আমার কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছি না। উনি কেন এমন ভাবে কথা গুলো বললো।আর তানিশার পার্টির কথাই বললো যেই রাডের কোনো কথা আমার মনে নেই। তাহলে কি ঐ রাতে এমন কিছু হয়েছিল যেই কথা আমাকে শান বলেনি। শান তো কখনো আমার থেকে কিছু লুকায়নি। তাহলে ঐদিনের কথা লুকিয়েছে কেন?কেন বলেনি আমায়? উনি এটা মোটেও ঠিক করেনি।
.
.
চলবে

বিঃদ্রঃ দিনদিন অলস হয়ে যাচ্ছি রিচেক দেওয়া হয়নি ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here