এক শহর ভালোবাসা পর্ব শেষ

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৪৫
#সুরাইয়া_নাজিফা

আমি কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বারবার রায়ান ভাইয়ার বলা কথা ভাবছি আর শান আসার জন্য অপেক্ষা করছি।গাড়ির ভিতরে একটা কথাও বলিনি উনার সাথে।যদিও উনি আসতে আসতে অনেক কথাই বলছিলেন কিন্তু আমি তেমন একটা কথা বলিনি। আমি চেষ্টা করছিলাম বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার কিন্তু আমি বিফল হয়েছি। এখন যদি আমি এটা মনে চেপে রাখি তাহলে আমি কখনোই ভালো থাকতে পারব না তাই শানের সাথে কথা বলে পরিষ্কার হওয়াটাই ভালো। কিন্তু শান এখনও আসছে না। তখন দেখেছিলাম সাম্য আর আরশ ভাইয়ারদের সাথে কথা বলতে হয়তো ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু।আমার শরীরে অস্বস্থি লাগছিলো।কেমন ঘুম ঘুম ভাব। তাই সুয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে গেলাম বুঝতে পারলাম না।

আমার ঘুম ভাঙ্গল কারো শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে। আমি আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। শান আমার পাশে বসে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো।শানকে দেখতে পেয়ে তখনকার কথা গুলো আমার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। শানকে দেখতে পেয়ে আমি দ্রুত উঠে বসলাম শোয়া থেকে।

আমাকে ধরফরিয়ে উঠতে দেখে শান ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“শরীর খারাপ লাগছে?”

আমি শানের দিকে তাকিয়ে “না সূচক ” মাথা নাড়ালাম।
“তাহলে উঠে গেলে যে? ”

আমি উৎকণ্ঠিত হয়ে বললাম,
“আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে। ”

শান কপাল কুচকে বললো,
“এমন কি কথা যেই কথা তোমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। ”

শান একটু কাছে এসে আমার কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
“কোনো স্পেশাল কথা বলতে চাও না কিছু করতে চাও। ”

আমি উনার থেকে একটু দূরে সরে বললাম,
“আমি এখন মোটেও এসবের মুডে নেই আমি একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই। ”

শান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“সিরিয়াস?”
“হুম। ”
“কি কথা?”

আমি কিছুক্ষন নিজের প্রশ্ন গুলো একবার ভেবে নিয়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
“ঐদিন তানিশার পার্টিতে আমার সাথে কি হয়েছিল?কেন সেদিন আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম? আপনি কখন এসেছিলেন? কেন আমার কিছু মনে নেই? ”

“আবার এসব প্রশ্ন?”

“জানতে চাই আমি।”

শান চুপ করে রইল আমি উনাকে চুপ থাকতে দেখে বললাম,
“প্লিজ চুপ করে থাকবেন না উত্তর দিন? ”

“তোমাকে আগেই বলা হয়েছে সবকিছু তারপরেও কেন সেটা বিশ্বাস করছো না । বারবার একই কথা বলো কেন?”

আমি কঠোর গলায় বললাম,
“কারণ সেটাতে কোনো সত্যি কথা ছিল না যে বিশ্বাস করব তাই সত্যি জানতে চাই আমি। ”

“তোমাকে সত্যিই বলেছি। ”
“আপনি মিথ্যেটাকে জোর দিয়ে সত্যি বললে সেটা তো আর সত্যি হয়ে যাবে না। ”

শান রক্তলাল চোখে আমার দিকে তাকালো।আমি বেশ বুঝতে পারছি শানের রাগ হচ্ছে। শান কখনো এটা পছন্দ করে না যে উনার দিকে কেউ আঙ্গুল উঠাক। কিন্তু এখন যদি আমি ভয় পেয়ে চুপ থাকি তাহলে আমি কখনোই সত্যি কথা গুলো জানতে পারব না। শান চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আবারও আমার দিকে তাকালো। চেষ্টা করছে নিজের রাগটা কন্ট্রোল করার।

“সুইটহার্ট কিসব কথা নিয়ে পড়ে আছো বলোতো ঘুমিয়ে পড় অনেক রাত হয়েছে এমনিতেও তুমি অসুস্থ। ” কথাটা বলেই উনি শুয়ে পড়লেন

“আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন। ”

কিন্তু শানের কোনো উত্তর পেলাম না। একটু বিরক্ত হলাম আমি। অদ্ভুত এভাবে চুপ করে থাকার মানে কি?আমি জিভ দিয়ে একটু নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম,

“আজ হাসপাতালে রায়ান ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছিল।”

আমার কথা শুনে শান শোয়া থেকে ধরফরিয়ে উঠে বসল আর অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে ভিত কন্ঠে বললো,
“রায়ান? ওর সাথে কি করে দেখা হলো? ও তো দেশে ছিলো না?কি বলেছে তোমায়? ”

আমি শানের কথা শুনে সরু চোখে শানের দিকে তাকালাম,
“শান আপনার কথা শুনেই মনে হচ্ছে আপনারা কিছুতো লুকাচ্ছেন। আপনি রায়ানের সম্পর্কে এতো জানেন কি করে? আমি যেতটুকু জানি ওর সাথে আপনার একবারই দেখা তাতে নিশ্চয় এতো জানা পরিচিত থাকার কথা না যে ও কখন কোথায় থাকে সেটাও জানবেন।”

শান রাগান্বিত স্বরে বললো,
“তোমাকে কি বলেছে ও প্রথমে সেটা বলো। ”

শানকে এভাবে রাগতে দেখে আমি একটু দম নিয়ে বললাম,
“ও কিছু বলেনি তবে আমি আপনার থেকে জানতে চাই। ”

শান একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। আজকে রায়ান যদি সোহাকে কিছু বলতো তাহলে হয়তো রায়ানকে আজকে পুঁতে ফেলতো শান। তাহলে তানিশা ঠিকই বলেছে রায়ান পরিবর্তন হয়ে গেছে আশা করি ওর থেকে সোহার আর কোনো বিপদ নেই।

শানকে একদৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে আকাশ -কুসুম ভাবনা ভাবতে দেখে আমি বললাম,
“কথা বলছেন না কেন?”

আমার কথা শুনে শানের ঘোর কাঁটে। শান আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে আমাকে টেনে ওনার বুকের মাঝে নিয়ে আসল তারপর জড়িয়ে ধরে বললো,

“বেখেয়ালি কিছু কথা না যদি সারাজীবন অজানাই থাকে তাহলেই ভালো। সবকথা জানতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। যদি কারো ভালোর জন্য কোনো কথা লুকানো হয় তাতে কোনো অপরাধ নেই। আমি চাই না তোমার মনে কোনো খারাপ প্রভাব পড়ুক বা তুমি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ো। শুধু তুমি এতটাই জেনে রাখো তুমি যখন যেই অবস্থাতেই থাকোনা কেন সব সময় সেইফ থাকবে এইখানে আমার বুকের মাঝে। কোনো বিপদ আসার আগে তাকে আমাকে পেড়িয়ে যেতে হবে। সব সময় তোমাকে যত্ন করে আগলে রাখব আমার বুকে। খুব ভালোবাসি তোমায় । ”

শান আমার মাথায় ঠোঁট ছোঁয়ালো শানের কথা শুনে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।আমি জানি উনি যা করবেন আমার ভালোর জন্যই করবেন হয়তো এই কথা না বলার মাঝেও আমার কিছু ভালোই হবে।

আমিও উনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“আমিও আপনাকে খুব খুব খুব বেশী ভালোবাসি।”


পরেরদিন সকাল বেলা আমরা দুজনেই উঠে গেলাম। আরো একটা ব্যস্ত সকালের শুরু। তবে প্রতিদিনের মতো আজও মনে একরাশ মুগ্ধতা আর ভালোবাসা ছেয়ে আছে শানের যেই ভালোবাসার মুগ্ধতা থেকে আমি কখনো বের হতে চাই না।

প্রতিদিনের মতো আমি আমার নিজস্ব কাজ গুলো সেড়ে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিলাম। কারণ এখন আর বাড়ির কাজ খুব একটা আমাকে কেউ করতেই দেয় না। সব আমার দুই আপু সামলে নেয় আর আমি সারাদিন বাচ্চাদের সাথে কাঁটাই। ওড়নাটা গায়ে সেট করে নিয়ে টেবিলের কাছে বই গুছানোর জন্য যেতেই শান প্রশ্ন করল,

“কোথায় যাচ্ছো তুমি? ”
“ভার্সিটিতে। ”
“কোনো প্রয়োজন নেই। ”
আমি গুছানো বন্ধ করে শানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“কেন?”
“কেন কি তুমি যে অসুস্থ সেটা কি ভুলে গেছো। ”
আমি উনার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
“আমাকে দেখে আপনার কোন দিক থেকে অসুস্থ মনে হয় কত সুন্দর চলে ফিরে বেড়াচ্ছি। ”
“অসুস্থ মানুষকে দেখে অসুস্থ মনে হতে হতেই হবে এমন কোনো কথা আছে কি?”
“সবসময় এমন উল্টা প্রশ্ন না করলে হয় না। ”
“তোমার এতো বেশী কথা না বলে যেটা বললাম সেটা শুনতে ইচ্ছা করে না। ”

আমি মুখ ফুলালাম। উনি হেসে দিলেন। আমার কোমড়ে হাত দিয়ে আমাকে উনার কাছে টেনে নিলেন আর ঠোঁটে আলতো করে একটা ভালোবাসার স্পর্শ একে দিয়ে বললো,
“বাসায় থাকো আর রেস্ট নেও।”

“রিপোর্ট কে আনবে? আমি ভেবেছিলাম আসার পথে নিয়ে আসবো।”

“তোমাকে ভাবতে হবে না আমি বুঝে নেবো তুমি শুধু আমার জানের দিকে খেয়াল রাখো। ”

আমি একটু হাসলাম তারপর উনাকে বিদায় দিয়ে আবারও রুমে এসে একটা ঘুম দিলাম। কিছুক্ষন পর ঘুম থেকে উঠে আরিশের কাছে গেলাম আর সারাদিন ওর সাথেই যেমন খেলাধুলা করে কাঁটাই তেমনই আজকের দিনটাও পার করলাম। বিকাল বেলা ভূমিকা আর স্মৃতি আপু এসে আমার রুমে ঢুকল,

স্মৃতি আপু বললো,
“আচার খাবি? ”
আচারের নাম শুনেই আমার মুখে পানি চলে আসলো,
“কিসের আচার? ”
ভূমিকা আপু বললো,
“আমের আমি আনিয়েছি। ”

আমি ছোঁ মেরে নিয়ে নিলাম আর কাউকে কিছু না বলেই খেতে আরম্ভ করলাম।আচার আনবে আর আমি খাবো না সেটা কি হয় নাকি। আর আজকাল তো একটু বেশীই খেতে মন চায় আচার। শুধু শানকে বলতে পারিনা। উনি এসব খাওয়া পছন্দ করে না। স্মৃতি আপু আর ভূমিকা আপু আমার মুখপানে তাকিয়ে খানিকটা হাসলো। তখনই রহিমা আন্টি হাতে করে খাবার নিয়ে ডুকল।

স্মৃতি আপু বললো,
“খেয়ে নে। ”

আমি আচার খেতে খেতে বললাম,
“না খাবো না। ”

“না খেলে আমি ভাইয়াকে বলব তুই দুপুরেও ঠিকঠাক খাস নি তবে বুঝবি ভাইয়া কিন্তু আমাকে বলে গেছে।”

আমি আচার খাওয়া বাদ দিয়ে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বললাম,
“উফ সবসময় একজন না একজনকে আমার পিছনে লাগিয়েই রাখতে হবে উনার। ”

আমি হাতে খাবারের প্লেটটা তুলে খেতে আরম্ভ করলাম।

ভূমিকা আপু বললো,
“তোমার শরীর কি ঠিক আছে এখন?
“হুম। ”
“রিপোর্ট কি আজকে দিবে। ”

খেতে খেতে আমার হাত আটকে গেল। রিপোর্ট? শিট আমি তো ভুলেই গেছি প্রায় রিপোর্টের কথা। আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“হুম। ”

এভাবে গল্প করতে করতে খাওয়া শেষ করলাম যদিও খাবার পুরাটা শেষ করিনি। যেটুকু পেরেছি খেয়েছি।যদি গল্পে মসগুল না থাকতাম তাহলে ততটুকুও হয়তো পেটে যেত না।


সন্ধ্যায় গিয়ে বাগানের ওই বেঞ্চটাতে বসলাম।ঘরের মধ্যে কেমন ভ্যাপসা গন্ধ এসে বারবার নাকে ঠেঁকছিল তাই এখানে এসে বসলাম এখন একটু ভালো লাগছে। চারদিকে লাইট জ্বলছে তাই চারপাশটা খুব ভালো দেখা যাচ্ছে। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম শান আসার টাইম হয়েছে।হয়তো আসতে আরেকটু সময় লাগবে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল রিপোর্ট নিয়ে। রিপোর্টের কথা ভাবতেই মনের মধ্যে সুপ্ত থাকা ভয়টা আবারও জেগে উঠল আচ্ছা রিপোর্ট ভালো আসবে তো। যদি ভুলভাল কিছু হয় তখন। বুকের মধ্যে ডিপডিপ করতে লাগল। তারপরও নিজেকে একটু শান্ত করে বেঞ্চেই বসে রইলাম।

কিছুটা সময় যাওয়ার পর একটু দূর থেকে দেখলাম শান আসছে। শানকে আসতে দেখে আমি উঠে দাঁড়ালাম। শান এক পা দু পা ফেলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। শানকে দেখে বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠলো। মুখটা কালো করে রেখেছে। একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। আমার মাথায় খারাপ চিন্তা গুলো বাসা বাঁধতে লাগলো। আমি নিজেকে শান্ত করে শানের উদ্দেশ্যে বললাম,

“গেছিলেন ডাক্তারের কাছে? ”

শান মুখে কিছু না বলে মাথাটা একবার উপর নিচ করে নাড়ালো।আমি আবারও বললাম,
“রিপোর্ট কি হলো? ”

শান কোনো কথা না বলে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ রিপোর্টের কথা জানতে চাইতে শানের ব্যবহারে একটু অবাকই হলাম। শান চোখ বন্ধ করে শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে আছে আর উনার নিঃশ্বাস খুব দ্রুত গতিতে পড়ছে। হৃদপিন্ডের সংকোচন প্রসারণের শব্দটাও যেন আনি শুনতে পাচ্ছি এতটা শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে আমায়। আমি এক হাত শানের পিঠে রেখে বললাম,
“শান? ”

কোনো রেসপন্স করল না আমি আবারও বললাম,
“রিপোর্টের কি হলো বললেন না কিন্তু। ডাক্তার কি কিছু খারা….।”

পুরো কথা বলার আগেই শান আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বলে উঠলো,
“আমাদের মাঝে একটা ছোট্ট প্রাণ আসতে চলেছে সোহা। আমার অংশ ধীরে ধীরে তোমার মাঝে বেড়ে উঠছে। ইউ আর প্রেগন্যান্ট মাই লাভ। ”

শানের কথাটা শুনে একমিনিটের জন্য হয়তো আমার হৃদপিন্ডের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কানের মধ্যে শানের বলা শেষের কথাটা প্রতিধ্বনিত হতে থাকল “ইউ আর প্রেগন্যান্ট মাই লাভ। ”

শান আমাকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের পেটে হাত রাখলাম। কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি ধীর কন্ঠে বললাম,
“রিপোর্ট? ”

শান রিপোর্টটা আমার হাতে তুলে দিলো। আমার হাত কাঁপছিল। কাঁপা হাতে রিপোর্টটা আস্তে আস্তে খুললাম। পুরো রিপোর্টের এত লেখার মধ্যে আমার চোখে যেন শুধু “পজেটিভ “লেখার মধ্যে আটকে রইল। আমি ধাপ করে বেঞ্চের উপর বসে পড়লাম। শান এসে হাটু গেড়ে আমার সামনে বসল। আমার হাত ধরে বললো,

“সুইটহার্ট ?”
“শান এটা কি সত্যি?”
“হুম। ”
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ”
শান হাসল,
“তোমার কথা কি বলবো জানো ডাক্তার যখন আমাকে এই কথাটা বলেছিল আমারও একই অবস্থা হয়েছিল। আমিও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমি বাবা হবো আর এই ছোট্ট মেয়েটা মা। আমাদের অংশ আর কিছুদিন পর আমার সামনে থাকবে। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে পুরো বাড়ি দৌঁড়ে বেড়াবে। তার সব আবদার আমাকে ঘিরে হবে যেগুলো সব আমি পূরণ করব। তার হাসির কলকল ধ্বনিতে বাড়ির আনাচে-কানাচে খুশিরা খেলা করবে।আমার মনে হচ্ছে সব আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আমার এত খুশি হচ্ছে মনে হয় তোমাকে কোলে তুলে পুরো পৃথিবী বলে বেড়াই আমি বাবা হতে চলেছি। ”

শানের এত খুশি দেখে আমার চোখে পানি চলে এলো। মানুষটা কতটা খুশি হয়েছে। শানের খুশি দেখে আমারও এতো খুশি লাগছে যেটা বলে বুঝানো যাবে না। আমার শরীরে একটা ছোট্ট প্রাণ বেড়ে উঠছে যে কিছু মাস পর আমার সামনে থাকবে তাকে আমি ছুঁতে পারব ভাবতেই খুশিতে দম আঁটকে আসছে।

শান কিছুক্ষন চুপ করে থেকে তারপর আবার বললো,
“কিন্তু তোমার স্ট্যাডি?এভাবে মাঝপথে বেবী? আই থিংক তুমি হয়তো এখন চাওনি আই আ’ম সো স্য…..।”

শান পুরো কথা বলার আগেই আমি আমার হাত দিয়ে উনার মুখ চেঁপে ধরলাম আর এসে উনার সামনেই হাটু গেড়ে বসে বললাম,
“প্লিজ এই কথা বলবেন না। আপনি জানেন আমি কতটা খুশি হয়েছি। এই বেবীটা খুব প্রয়োজন ছিল শান। আর বাকি রইল আমার মাস্টার্স সেটা তো যেকোনো সময়েই শেষ করা যাবে এই বছর নাহলে পরের বছর। এই চিন্তা করে কেউ কখনো নিজের জীবনের এতো সুন্দর অনুভুতি গুলো নষ্ট করে নাকি। এখন আমি যদি কিছু চাই তাহলে এই সময়ের এই অনুভুতি গুলো অনুভব করতে। ”

শানের কপালে কপাল ঠেঁকিয়ে আমরা দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম জীবনে যেই ছোট্ট অভাবটুকু ছিল সেটাও আজ পূর্ন হয়ে জীবনটাই রংধনুর সাত রঙ দিয়ে সেজে গেল।
.
.#এক_শহর_ভালোবাসা
#সুরাইয়া_নাজিফা
#শেষ_পর্ব

“এই অবস্থায় তুমি এতো উপরে উঠেছো কেন স্টুপিড? ”

হঠাৎ এতো জোরে কারো চিৎকারের আওয়াজ শুনে আমি পিছু ফিরে তাকালাম শান দাঁড়িয়ে। কিন্তু নড়াচড়া না করে আমি একবার উনার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজ করতে লাগলাম আর পেরেক গেঁথে বললাম,

“এই ছবিটা লাগাবো তাই উঠেছি। ”
“এখান থেকে পড়লে কি হবে হ্যাভ ইউ এ্যানি আইডিয়া? ” শান রাগান্বিত কন্ঠে বললো।
“কিছু হবে না ছবিটা লাগানো হলেই নেমে যাবো। ”
“এখনি নামো তুমি। ”
“প্লিজ আপনি দুই মিনিট একটু চুপ করে দাঁড়ান আমার কাজটা হয়ে যাবে। ”
শান চিৎকার করে বললো,
“সোহা। ”

আমি উনার কথা পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলাম। ছবিটা লাগিয়ে একটা বিশ্বজয়ী হাসি দিলাম। এতক্ষনের কষ্টটা সফল হলো। তারপর পিছনে ফিরে দেখলাম শান লাল লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। এতক্ষন ভয় না পেলেও এখন ভয় লাগতে লাগল। আমি ভিত চোখে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম। তারপর ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে নামতে যাবো হঠাৎ আমার শাড়ীর সাথে পা ভেজে পা টা পিছলে যেতেই আমি ভয় পেয়ে নিজের চোখ বন্ধ করে নিলাম। আমার বুকের ভিতর ডিপডিপ শব্দটা দ্বিগুন হলো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের পেঁটে হাত দিলাম। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো যাক আমার বেবী ঠিক আছে। আমি আস্তে আস্তে চোখ খুলে সামনে তাকালাম। শানের চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছে। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম আমি শানের কোলে তাই ব্যাথা পাই নি আজ যদি শান না থাকত তাহলে কি হতো আমার?

শান আমাকে কোলে নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসিয়ে দিলো আমি মাথানিচু করে রইলাম। শান গম্ভীর কন্ঠে বললো,

“এখন কি হতে পারত জানো তুমি?এতো লাফালাফি করো করো কেন সবসময়?”
“স্যরি।”
শান রেগে বললো,
“কিসের স্যরি আজকে একটা অঘটন ঘটলে এই স্যরি নিয়ে আমি কি করতাম।কি প্রয়োজন ছিল ওখানে তোমার? ”
আমি মাথানিচু করে আমতা আমতা করে বললাম,
“আপনার ছবিটা লাগাতে গেছিলাম। পুরো ঘরেরই লাগিয়েছি শুধু ওখানেই বাকি ছিল তাই লাগিয়ে দিলাম। ”

শান একবার পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো। এতক্ষনে খেয়াল করল পুরো রুম জুড়ে শানের ছবি লাগানো। সোহাকে চেয়ারের উপরে দেখেই মাথাটা এতো গরম হয়ে গেছিলো যে সেটা খেয়ালই হয়নি। শান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“এসব কি করেছো?”

আমি শানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম,
“মা বলেছে এই সময়ে চোখের সামনে যা দেখে বেবী দেখতেও তেমনই হয় তাই অনেক গুলো বেবীর ছবি দিয়ে গেছিল পরে এসে লাগিয়ে দেবে। কিন্তু আমি তো চাই আমাদের বেবী আপনার মতো হোক তাই আমি আমার পছন্দের ছবি লাগিয়েছি।যাতে ঘরের যেদিকেই তাকাই শুধু আপনাকেই দেখতে পাই আর একা একা বসে বোর হচ্ছিলাম তাই ভাবলাম নিজেই লাগিয়ে নেই। ”

শানের মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠল আমার কথা শুনে। তবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার পাশে বসল । তারপর দুই হাতে আমার মুখটা ধরে বললো,
“যাইহোক সুইটহার্ট এই সময়টা তোমার একটু সেইফলি থাকা উচিত। আমি চাই না তোমার একটু গাফিলতির জন্য তোমার কোনো ক্ষতি হোক। আমি তোমাকে হারাতে চাইনা জান। এখন তুমি আর বেবী ছাড়া আমার জীবনে আর কিছুই নেই তাই একটু লাফালাফিটা কম করো খুব ভয় হয় আমার তোমাকে নিয়ে প্লিজ অন্তত বেবীর জন্য।

আমি হেসে শানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম,
“একদম চিন্তা করবেন না আমার বা বেবীর কিছুই হবে না আমি সবসময় আপনার সাথেই থাকবো বুঝেছেন বাই এনি চান্স যদি কখনো মরেও যাই তাও পিছু ছাড়ব না খুশি এবার। ”

শান আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,
“সোহা এসব কি ফালতু কথা বলছো তুমি। কিছু হবে না তোমার। এইসব কথা আরেকবার বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। ”

আমি হেসে বললাম,
“ওকে কিছু হবে না আমি সারাজীবন আপনার সাথেই থাকব। আমি তো কথার কথা বলেছিলাম এতো হাইপার হচ্ছেন কেন? যাইহোক ওইদিকের কাজ হয়ে গেছে?”

“হুম বাকিটা বাড়ির সবাই সামলে নেবে এখন কথা না বলে একটু রেস্ট নেও।”

আমি শুয়ে পড়লাম শান আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ইশারায় বললো চোখ বন্ধ করতে। আমি চোখ বন্ধ করে একটু হাসলাম। আসলে বাড়ির সবাই আমার প্রেগন্যান্সির খবর শুনে এতটা খুশি হয়েছে যে আমার আর বেবীর সুস্থতার জন্য আজকে বাড়িতে অনেক গরীব দুঃখিকে খাওয়ানো হয়। আমার আম্মু তো আমার জন্য এতো এতো আচার নিজের হাতে বানিয়ে নিয়ে এসেছে।যেন বাহিরের কিছু না খাই। আব্বু এখনই বাবুর জন্য খেলনা কিনে নিয়ে এসেছে। আম্মু আমার কপালে চুমু দিয়ে বললো,
“আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না আমার সেই ছোট মেয়েটা এখন নিজে কারো মা হবে। ”

আমি প্রতিউত্তরে শুধু হাসলাম আর প্রচন্ড লজ্জা লাগছিল কেন জানি এই অবস্থায় বাবা মায়ের সামনে বসতেই পারছিলাম না । শ্বাশুড়ী মা তো বলেই দিয়েছেন উনার নাতি বা নাতনী যেই আসুক না কেন উনার হাতের তৈরী কাঁতা ছাড়া কিছু ব্যবহার করবে না। তাই এখন থেকেই উনি বাবুর জন্য কাঁতা সেলাই করা শুরু করেছেন।

ভূমিকা আপু বলেই ফেলেছেন,
“অবশেষে আমাদের অপেক্ষার অবশান শেষ হলো এখন আমাদের শানের ঘরেও ছোট্ট অতিথি আসতে চলেছে।”

এই একটা সংবাদে বাড়িতে যেন খুশির জোয়ার বইয়ে এনেছিল। আরশ ভাইয়া ছোট চাচ্চু হওয়ার খুশিতে এখনই বাবুর নাম সিলেক্ট করার কাজে লেগে পড়ল। সবার খুশি দেখে আমারও খুব ভালো লাগছিলো।আগে তো সবাই এমনিতেও চোখে চোখে রাখত আর এখন তো চোখের আড়ালই করে না। এক পা নিচে নামাতে দেয় না। মুখ ফুটে কিছু চাইতে না চাইতেই সেটা হাতের সামনেই পেয়ে যাই। শান তো আমাকে পুরো নিয়মকানুনের মাঝেই বেঁধে দিয়েছে দিনের চব্বিশ ঘন্টায় কি কি করব, কি খাবো, কি পরবো, কতটা ঘুমাবো এভরিথিং আর এসব উনি নিজেই পাশে থেকে অনুসরণ করায় হয় ভালোবেসে নাহলে ধমক দিয়ে আর আমাকে সেইসব কিছু মুখ বুঝে পালন করতে হয়। কিছুই বলতে পারিনা ওনার ভয়ে। এইভাবেই সবার ভালোবাসার ছায়ায় আমার জীবনের আরো ছয় মাস চলে গেল।


এই মাসেই আমার আট মাস হলো শরীরের ভিতরে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। অনেক ভারী হয়ে গেছি। এখন আর চাইলেও আগের মতো লাফালাফি করতে পারিনা এখন হাঁটাচলাতেই প্রচুর কষ্ট হয়। পেঁটের আকারও বেড়ে গেছে অনেকটা।আস্তে আস্তে আমার ভিতরে আমার আর শানের প্রাণপাখি বেড়ে উঠছে। প্রতিটা মিনিট প্রতিটা সেকেন্ড তার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি আমি। শানও এই অনুভুতি অনুভব করতে কখনো ছাড়ে না।সারাদিন বাবুকে নিয়ে চিন্তা। বাবু আসলে কি করবে, কিভাবে মানুষ করবে সারাদিন শুধু এই গল্প।উনার এসব পাগলামি দেখে সারাদিন শুধু নিজের মনেই হাসতে থাকি আর উনার কথায় তাল মিলাতে থাকি।

আগের থেকে দেখতে মোটা হয়ে গেছি।এখন শরীর সবসময় খারাপ লাগে।খাওয়া দাওয়া তেমন একটা করতে পারিনা। খাবার সামনে আসলেই যেন ভিতর থেকে সব ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। সময়ে অসময়ে ঘুম আসে আবার অনেকগুলো রাত তো না ঘুমিয়েই কেঁটে যায়। আর ঐ রাত গুলোতে শানও আমার সাথে জেগে থাকে। আমার সাথে বসে বসে গল্প করে যতক্ষন আমি না ঘুমাই। উনাকে কারণ জিজ্ঞেস করলেই উনি সবসময় বলে,

“দেখো সুইটহার্ট যেই কষ্ট গুলো তুমি অনুভব করছো সেটা তো আমি পারবো না কিন্তু সেই কষ্ট গুলো যেটুকু লাঘব করা যায় বা ভাগ করা যায় সেটুকু আমি করতে চাই।কারণ ও শুধু তোমার একার না আমারও। আর এই সুখের অনুভুতি গুলো অনুভব করা থেকে আমি বঞ্চিত হতে চাই না। ”

আমি শুধু উনার দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবি আমাদের সন্তান একজন উপযুক্ত দায়িত্ববান বাবা পেতে চলেছে যে সবসময় ওকে আগলে রাখবে সব বিপদ থেকে।

দুপুরে গোসল করে আসার পর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা মুছছিলাম তখনই শান এসে বললো,
“মাথা মুছতে মুছতে তো পুরো শরীর ভিজিয়ে ফেলছো এখনও পর্যন্ত মাথা মুছাটা শিখলে না এমন করলে তো ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার সহ বাবুর এখন তো একটু কেয়ারফুল হও। ”

আমি মুখ ফুলালাম,
“প্রতিদিনই কেন আপনাকে এসব কথা বলতে হবে আমি জানি মাত্রই মুছতে শুরু করেছি তার মধ্যেই আপনি চিল্লাচিল্লি শুরু করছেন। ”

“প্রতিদিন বলেও তো তোমাকে ঠিক করতে পারছি না জানি না একসাথে দুটো বাচ্চাকে আমি কি করে সামলাবো। ”

আমি একটু হাসলাম। এইসব কথা এই চারমাসে শুনতে শুনতে এখন আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। উনার এতোটা ভালোবাসা রোজ পাচ্ছি সেটাই আমার কাছে অনেক।আমি উনার গলা জড়িয়ে উনার নাকের সাথে আমার নাক স্লাইড করে বললাম,
“ভালোবাসা দিয়ে। ”

শান হাসল। উনার রাগটা যত দ্রুত আসে তেমনিই দ্রুতই চলে যায় আমার ভালোবাসাময় পাগলামিতে। শান আমার চুল গুলো মুছে দিয়ে আমার জন্য খাবার নিতে গেল। এই খাবার নিয়েই রোজ শানের সাথে আমার একটা ঠান্ডা যুদ্ধ চলে যায় যেখানে অলওয়েজ শানেরই জয় হয়। শান আমার মুখোমুখি বসে আমার সামনে খাবার ধরল,

“হা করে। ”
আমি একটু নাক উঠিয়ে বললাম,
“পরে খেলে হয় না। ”
শান চোখ দেখিয়ে বললো
” একদম না এখনই খেতে হবে। ”

আমি হা করতেই শান যত্ন সহকারে আমার মুখে খাবার তুলে দিতে লাগল।আমি শানের দিকে তাকিয়ে আমাদের বিয়ের প্রথম দিকের কথা গুলো ভাবতে লাগলাম কি ছিলাম আর এখন কি হয়ে গেছি। মনে পড়তেই হাসি পেল শান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হাসছো কেন?”
আমি নিজের হাসি থামিয়ে চোখের ইশারায় বললাম “কিছু না। ”

শান আবারও খাবার মুখের কাছে আনতেই আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম,
“খাবো না। ”
“খেয়ে নেও নাহলে শরীর খারাপ লাগবে। ”
“বমি আসছে। ”
“আচ্ছা একটু পরে খেও। ”

আমি হতাশ হলাম উফ তারপরেও খাইয়েই ছাড়বে। হঠাৎ আমার মাথা একটা প্লান আসলো এই থেকে বাঁচার। আমি “ওয়াক ওয়াক” করতে লাগলাম। শান অস্থির হয়ে বললো,
“কি হয়েছে? ”
আমি নাক উঠিয়ে বললাম,
“প্রচুর বমি আসছে খাবো না আমি। ”
“সত্যিই। ”

আমি ইনোসেন্ট মুখ করে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালাম শান বললো,
“ওকে তুমি রেস্ট নেও আমি এসব রেখে আসছি। ”

শান চলে গেল আমি বিশ্বজয়ী একটা হাসি দিলাম। যাক আজকে বেঁচে গেলাম।

আমি বিছানায় পিছনে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে বসলাম। হঠাৎ আমার মন চাইল আইসক্রিম খেতে যদিও জানি শান খেতে দিবে না তারপরেও।আমি পেঁটে হাত রেখে বললাম,
“উফ সোনা কেন যে এসব খাবার খেতে ইচ্ছা হয় তুই তো চিনিস না তোর বাবাকে এইসময়ে তো এসব একদমই খেতে দেবে না। ”

আমার মনটা খারাপ হলো তারপরও ভাবলাম একবার বলেই দেখি। শান নিচ থেকে আসতেই আমি চোখ ছোট ছোট করে শানের কাছে আবদার করে বললাম,
“শুনুন না আমার না আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছে প্লিজ এনে দিন না। ”

আমার কথা শুনেই শান রেগে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভালো জিনিস খেতে চাও না। দেখলেই বমি আসে।আর যেসব জিনিস খেলে শরীর খারাপ করে সেসবই খাওয়ার জন্য হা করে থাকো। ”

আমি আহত কন্ঠে বললাম,
“প্লিজ কিছু হবে না খাবো আমি। ”
“একদম না চুপচাপ গুমিয়ে যাও বিকালে হাঁটতে যাবে। ”

আমার এতো রাগ হলো আমি শোয়ার জন্য বালিশ ঠিক করতে করতে শানকে শুনিয়ে বেবীকে বললাম,
“দেখেছিস তো তোর বাবা আমাকে একদমই তোর পছন্দের জিনিস গুলো খেতে দেয় না সবসময় এমন করবে।আমি তো কিছু বলতে পারছি না কবে যে তুই আসবি আর তোর বাবাকে ইচ্ছা মতো বকে দিবি সেই অপেক্ষাতেই আছি। ”

শান আমার পাশে বসে বললো,
“আমার প্রিন্সেস কখনোই তোমার কথা শুনবে না কারণ ও জানে ওর মা কতটা কেয়ারলেস ওর বাবা যা করছে সেটা ওদের ভালোর জন্যই। ”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
“মেয়েই হবে কে বলেছে আপনাকে?”
“আমি জানি। ”
“ছেলে হবে। ”
“মেয়ে। ”
“আমি বলছি ছেলে। ”
“ওকে বেবীকেই জিজ্ঞেস করে নেও। ”
“ও কি করে বলবে?”
“বলবে জিজ্ঞেস করো। ”

আমি পেঁটে হাত রেখে বললাম,
“সোনা বল তো তুই আমার প্রিন্স। ”

শান ভ্রু উচিয়ে বললো,
“কি বেবী কিছু বললো না তো। ”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
“ধ্যাত ও কি করে বলবে পাগল নাকি। ”
শান হেসে বললো,
“ওয়েট এবার আমাকে দেখো।”

শান পেঁটের কাছে এসে হাত বুলিয়ে বললো,
“প্রিন্সেস তোমার মাকে বলে দেও তো যে তুমি আমাদের প্রিন্সেস। ”

আমি হা করে ওনার কাজ গুলো দেখছিলাম কি করছেন উনি পাগল হলেন নাকি?কিন্তু আশ্চর্যের হলেও সত্যিই কথাটা বলতেই বেবী জোরে পেঁটে কিক করলো। আমি লাফিয়ে উঠে পেঁটে হাত রাখলাম। শান আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে দিল।
“দেখলে এবার। ”

আমি রেগে বললাম,
“ধ্যাত পিচ্চি বের হওয়ার আগেই বাবার দলে চলে গেছিস। যা থাক তোর বাবার সাথে। কথাই বলবো না আর তোর আর তোর বাবার সাথে। ”

কথাটা বলেই আমি চাঁদর মুড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষন পর শান আমার মাথার কাছে এসে বললো,
“সোহা উঠো। ”

আমি শুনেও না শুনার মতো থাকলাম। শান আবারও বললো,
“উঠো না সুইটহার্ট। ”

আমি তখনও উঠলাম না। সোহা উঠছে না দেখে শান ইচ্ছা করেই বললো,
“ওকে উঠো না তবে আইসক্রিমটা আমি একাই খাই। ”

আইসক্রিমের কথা শুনতেই আমি দ্রুত উঠে গেলাম আর উঠেই দেখলাম শানের হাতে আইসক্রিম বক্স। আমার চোখ চকচক করে উঠলো। আমি শানের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে এক চামচ মুখে দিতেই শান বললো,
“বেশী না অনলি চার চামচ। ”
“মাত্র।”
“হুম। ”

যদিও মন খারাপ হলো তারপরও একদম না খাওয়ার চেয়ে এই চার চামচই বা কম কিসে। এভাবেই শান শত নিয়মকানুনের মাঝেও একটু একটু করে আমার সব ইচ্ছা – আবদার গুলো পূরণ করে।


রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। শান যেন ঘুমায় তাই একটু শুয়ে ছিলাম উনার পাশে। আমার জন্য আজকাল উনিও ঘুৃমাতে পারেনা। কিন্তু শুতেই শরীরে অস্বস্থি অনুভব হচ্ছিল তাই উঠে বসলাম।বেবীও হয়েছে একটা পাজি দিনের বেলা ঘুমাবে আর রাতের বেলায় আমাকে একটু শান্তিতে থাকতেই দিবে না।

আমি বিছানা থেকে নেমে রুমের ভিতরেই হাঁটতে লাগলাম। বাহিরে খুব সুন্দর চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে মন চাইছো এই টাইমটায় যদি বের হতে পারতাম। হঠাৎ রুমের নেভানো আলোটা জ্বলতেই আমি একটু পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম শান বসে আছে। আমি এগিয়ে এসে বিছানার একপাশে বসলাম,

“কি ব্যাপার উঠে গেলেন কেন?”
“তোমার শরীর কি বেশীই খারাপ লাগছে। ”
“না।”
“তাহলে উঠে গেলে যে? ”
“আপনি তো জানেনই রাতের বেলা আমার খুব হয় না এই কয়দিন তাই সমস্যা নেই আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। ”
শান আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে একটা চুমু দিলেন,
“তোমার খুব কষ্ট হয় না সুইটহার্ট। এতটা কষ্ট হবে জানলে আমি কখনো বেবীই নিতাম না। ”
উনার কথা শুনে আমি হাসলাম,
“কি বাচ্চাদের মতো কথা বলছেন বলুন তো এই কষ্টের মধ্যেও কত সুখ আছে জানেন আপনার কোনো অধিকার নেই আমাকে এই সুখ থেকে বঞ্চিত করার। ”

শান একদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন আর আমিও উনাকেই দেখতে লাগলাম। হঠাৎ আমি বলে উঠলাম,

“আচ্ছা শান বেবী আসার পর আপনার আমার প্রতি ভালেবাসা কমে যাবে না তো?”

শান আমার গলা জড়িয়ে বললো,
“না বরং ভালেবাসাটা আরো বাড়বে সুইটহার্ট। তুমি আমাকে এত বড় একটা গিফট দেবে বাবা হওয়ার সুখ দেবে তাহলে সেই তোমার প্রতিই আমার ভালোবাসা কি করে কমবে?”

আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শান আবারও বললো,
“চলো আমার সাথে?”

আমি অবাক হয়ে বললাম,
“এতো রাতে কোথায় যাবো।”

শান নাক টেঁনে বললো,
“চলোই না দেখতে পাবে। ”

আমি আর কথা না বলে শানের সাথে চলে গেলাম। শান আর আমি আস্তে আস্তে বাড়ির সদর দরজা ঠেঁলে বেরিয়ে এলাম। কোনো গাড়ি ছাড়াই বেরিয়ে গেলাম গেইট থেকে। আমি শানের কর্মকান্ড দেখে একটু অবাক হলাম এতো রাতে বাহিরে নিয়ে এলো আমায়। আশেপাশে কোনো মানুষ নেই একদম জনমানবশূন্য ।পুরো শহর জুড়েই যেন আমরা। মাথার উপর থালার মতো চাঁদটা পুরো আকাশ জুড়ে আলো ছড়াচ্ছে। আর রাস্তায় সোডিয়াম লাইটের আলোয় দুইপাশের পথটাই আলোকিত হয়ে আছে। হালকা বাতাসে আমার চুল গুলো উড়ছে।কিছুটা গিয়ে আমি শানকে প্রশ্ন করলাম,
“এতো রাতে রাস্তায় কেন?”

শান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভয় লাগছে?ভয় পেও না আমি আছি তো।”
“ভয় লাগছে না ভাবছি এই সময় এখানে নিয়ে এলেন?”
“কেন তোমার ইচ্ছা ছিল তো আমার কাঁধে মাথা রেখে এমন একটা জনমানবশূন্য রাস্তায় হাঁটার। কথা দিয়েছিলাম তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করব তাহলে এটা ভুলে যাই কি করে।

শানের কথা শুনেই আমার প্রায় পাঁচ বছর আগের সেই রাতের কথা মনে পড়ল যেদিন আমরা প্রথম একে অপরকে নিজেদের ভালোবাসার কথা বলেছিলাম।

“যখন শহরটা ঢেকে যাবে ভালোবাসায়
তোমায় প্রতিটা ছোঁয়ায় খুঁজে পাবো তোমায়
কোনো এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় নতুন করে আবারও প্রেমে পড়ব তোমার
ফাঁকা রাস্তায় সোডিয়াম আলোর হালকা আলোতে খালি পায়ে তোমার কাঁধে মাথা রেখে হারিয়ে যাবো তোমার সাথে
তখন শুধু তুমি তোমার ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে আমার অধর ছুয়ে দিয়ে মিষ্টি করে বলো “ভালোবাসি”
তোমার শত ব্যাস্ততায় আমাদের ভালেবাসা যেন কখনো না হারায়
তুমি সবটা সময় শুধু দিবে আমায়
পুরো শহর জুড়ে ছেঁয়ে যাবে জনমানবশূন্যতায়
থাকবে না কেউ পিছু ডাকার, থাকবে না কেউ দূরে রাখার, থাকবে না কেউ আমাদের মাঝে আসার
রয়ে যাবো শুধু তুমি আর আমি
সেই শহরে লেনাদেনা হবে তোমার আর আমার
এক শহর ভালোবাসার।”

কথা গুলো মনে মনে আরো একবার আওড়ে নিতেই মুখে হাসি ফুঁটে উঠল। এতো বছরেও শান নিজের কথার এতটুকু খেলাপ করেনি। সবসময় অক্ষরে অক্ষরে আমাকে দেওয়া প্রতিটা কথা ভালোবাসা দিয়ে পূরণ করেছে। আমি নিজের পায়ের জুতোটা খুলে হাতে নিয়ে নিলাম শান বললো,
“আরে করছো কি জুতো খুলেছো কেন?”
“খালি পায়ে আপনার সাথে হাঁটবো বলে। আমি সেদিন বলার সময় এটাও তো বলেছিলাম।”
“ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার।”
“কিছু হবে না একদিনই তো। ”

শান আর কিছু বললো না উল্টো নিজেও নিজের পায়ের জুতোটা খুলে হাতে নিয়ে নিলো। আমি উনার দিকে তাকাতেই উনি আমার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে একটু হাসল। আমি উনার কাঁধে মাথা রাখলাম উনি আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরলেন।আমরা দুজনেই হাঁটতে লাগলাম অজানা গন্তব্যে। কোথায় যাচ্ছি জানা নেই শুধু হারিয়ে যেতে চাই আজ একে অপরের সাথে কোনো এক ভালোবাসার শহরে আর বলতে চাই এক শহর ভালোবাসা দিতে চাই তোমায়।
.
.
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here